Tag Archives: ডুবজলে যেটুকু প্রশ্বাস

উৎসর্গ : বাবা শ্রীরঞ্জিত রায়চৌধুরীর স্মৃতির প্রতি শ্রদ্ধায়

Leave a comment

Filed under উপন্যাস

এক

লাশগুলোকে নামানো হচ্ছিল হোসপাইপ কেটে থামানো পাটনামুখো দরোজা-জানলাহীন, টয়লেটের পাল্লাহীন গয়া প্যাসেঞ্জারের অন্ধকার লাগেজ ভ্যান থেকে, একের পর এক আদুল-গা তামাটে পুরুষের পেশিদার শরীর, মহিলাদের ঘোমটামোড়া দেহ, ঠাণ্ডা কাঠ, পূণ্যলাভের জন্য পুড়তে যাবে গঙ্গায়, আর এই লেভেল ক্রসিং থেকে একটু দূরত্বে, রাস্তার ধারে ফোলডিং চেয়ার-টেবিল সাজিয়ে, ল্যাম্পপোস্টের তলায় বসে স্বাভাবিক মৃত্যুর প্রমাণপত্র দিয়ে চলেছে পাটনা মিউনিসিপাল কর্পোরেশানের পাকাচুল কদমছাঁট চশমাচোখ ডাক্তার সুনীলরঞ্জন নাহাবিশ্বাস ওরফে বিসওয়াসজি, শ্মশানঘাট কাছেই বলে, প্রতিদিন সন্ধ্যার টিমটিমে বিজলি আর কেরোসিন লন্ঠনের আলোয় ফুলকো মেলার জমজমাট ভিড়, আগেভাগে তৈরি তাদের বাঁশের মাচান, ফুল, শাদা আর গোলাপি থানকাপড়, ঠ্যালা, রিকশা, ট্যাকসি, ধুপ, সিঁদুর, খুচরো টাকা পয়সা, খই-বাতাসা, কাতাদড়ি, নাইলন দড়ি, মাটির কলসি । ফিক্সড প্রাইস । কাউকে দরদস্তুর করতে হয় না । বিহারি সংস্কৃতির মড়া পোড়ার যাকিছু ।

পাটনা-গয়া লাইনে দাঙ্গা বা জাতপাত-মারকাট হলে, যখন লাশের সংখ্যা বেড়ে যায়, লেভেল ক্রসিং পেরোতে ঘণ্টাখানেক লেগে যায় । ট্রেনটার কোনো বরাদ্দ সময় নেই থামার । যতক্ষণ লাশ ততক্ষণ আশ । লেভেল ক্রসিং ছেড়ে প্রচুর সময় লেগে যায় ট্রেনটার, স্টিম এনজিনের ভোপ্পোর ভোঁ কয়লাচুরো উড়িয়ে, কিংবা ডিজেল এনজিনের গরম হলকার ধোঁয়া ভাসিয়ে । বর্ষাকালে জলে ডোবা রাস্তা, গ্রীষ্মে জ্যাম, শীতে শবযাত্রীর শিকারে সস্তার রাঁঢ় ।

মোটর সাইকেলে বসে যখন বিরক্তি উথলে উঠছিল, ট্রেনটার যাবার অপেক্ষায়, পাশেই এক যুবক হাতি, পেছনের বাঁ পা জিরেন দিচ্ছিল শ্রীকৃষ্ণের কায়দায়, নীহারিকার বর্ণালী থেকে তখন সবে হেমন্ত নামছে স্হানীয় পৃথিবীতে, অদৃশ্য কানামাছি-ওড়ানো শুঁড়ের ধাক্কায়, যেন বিদ্যুৎ দিয়ে গড়ে নরম মাংস, ঘুরে যায় মুণ্ডু, চকিতে হাজার সর্ষেফুল ফুটে উঠে মিলিয়ে যায়, তারপর গলায় চোঙবাঁধা অবস্হায় নিজেকে খুঁজে পায় সুশান্ত, হাসপাতালে, সরকারি রাজেন্দ্র ব্লকের শতচ্ছিন্ন গয়ের রক্ত পুঁজ মাখা বিছানায়, মাছির দল তার ঠোঁটে বসে ঘুমজাগানিয়া চালিশা শোনাচ্ছিল । হাসপাতাল, তায় সরকারি, পটল অবধারিত জেনে, একহাতে নলসুদ্দু স্যালাইনের বোতল ঝুলিয়ে বাড়ি কেটে পড়েছিল ও, সুশান্ত, রিকশায় চেপে । বাড়িতে ধুদ্ধুমার । অনেককাল লেগে গিয়েছিল সারতে । থানায় গিয়ে মোটর সাইকেলটা নিয়ে এসেছিলেন সুশান্তর বড়োজ্যাঠা, হাতে-টানা ঠ্যালায় চাপিয়ে ।

বিছানায় শুয়ে, গলায় চোঙবাঁধা, কড়িকাঠের দিকে তাকিয়ে, কাকার কাছ থেকে জানতে পেরেছিল সুশান্ত, ওই পালোয়ান হাতিটায় চেপে ইন্দিরা গান্ধি গিয়েছিলেন আক্রান্ত গ্রামের মানুষদের সান্ত্বনা দিতে । এগারোজন তফশিলি মানুষের সাফায়া করে দিয়েছিল পিছড়াবর্গের কুরমি জাতের মহাবীর আর পরশুরাম মাহাতো, যাদের পরে ফাঁসি হয়েছিল । সীতারাম মাহাতো, সিরি মাহাতো, রামকিশুন মাহাতো, রাজেন্দর মোচি, নেপালি, সিমন, বলদেও আর কেশব মাহাতোর কুড়ি বছরের জেল । কিন্তু কালীচরণ, দাসো পাসোয়ান, রামচন্দর মোচি, মহাবীর মাঝি, শ্রবণ পাসওয়ান, রাজো পাসওয়ানদের  প্রতি একজন মৃত প্রধানমন্ত্রীর বিশ্বাসভঙ্গের আক্রোশ হাতিটা চাপিয়ে দিলে ওর, সুশান্তর, ঘাড়ে !

মুচি মাল্লা শুঁড়িদের হাতে যে-সব দেড়-দু একর জমির কাগজ ধরিয়ে দেয়া হয়েছিল, তার মালিক ওই কুরমিরা জেল থেকে তেল, কাপড়, চিনি, টাকা ফি মাসে পাঠাচ্ছে নিজের নিজের বাড়ি ; জমি কেনাকাটা চলছে, অথচ মুসহর দুসাধ চামার আর তেলিরা সুযোগ পেলেই গ্রাম ছেড়ে পাটনা, জ্ঞাতি খুঁজেপেতে কলকাতা । গ্রামে একটা পুলিশ ফাঁড়ি বসিয়ে কর্তাবাবারা নিশ্চিন্ত ।

বেলছির পর যখন পারসবিঘায় গোলমাল হল, লাগেজ ভ্যান থেকে লাশ নামাতে সময় লেগেছিল বেশ, মনে আছে সুশান্তর । রামাশিষ, হরিভগত, শ্যামনারায়ণ প্রসাদ, রামস্বরূপ, সিয়ারাম, কিসমিসিয়া দেবী, হরমণিকুয়ারি, গুলাবিয়া দেবী, পতিয়া দেবী, আর শ্যামপেয়ারিদের জলজ্যান্ত পুড়িয়ে মেরেছিল নিরঞ্জন শর্মার ছোটো ভাই মদন শর্মা । তারপর থেকে ভূমিহার আর নিচুজাতের খুনোখুনি । খুনোখুনিতে ঝামরে নষ্ট হয়ে গেছে সবুজ গ্রামের পর সবুজ গ্রাম । এই সব গ্রামে রোদ্দুরেরও শীত করে । কনসারা, দরমিয়া, নোনহি-নগওঁয়া, মলবরিয়া, দনওয়র-বিহটা, মিনবরসিমা, বারা– উড়ন্ত ধুলোয় মানুষহীন প্রান্তর, সাপের পালিয়ে যাওয়ার চেয়ে সন্দেহময় শুকনো পাতায় পদক্ষেপ । লেঠেল-ঘেরা পাকা ধানের খেত । পাড়ভাঙা যেমন নদীর মুদ্রাদোষ, তেমন সুশান্তর এই লাশ-নামানো-মেলা দেখা, মাঝে-মধ্যে সান্ধ্যকালীন নেশা ।

সুশান্তর চেহারা অবাঙালি । পাঁচফুটের ফর্সা গালফোলা ঘাড়েগর্দান কোঁকড়াচুল চনমনে । গলায় চোঙ বেঁধে হালকা কাজের বিভাগে কিছুকাল কাটাবার পর পৌঁছেছিল অতনুদের ত্যাঁদড়া-কর্মী বিভাগে । ঘোষ বলে অফিসে জাতপাতের বিভাজনে ও দুধিয়া ঘোষ, মানে গয়লা, যাদব, বিহারি যাদব কর্মীরা নিজেরাই ওকে কৃষ্ণায়ত যাদব বানিয়ে দিয়েছে, কংসায়ত যাদবে ফ্যালেনি । অথচ মুঙ্গেরের পিপারিয়ে গ্রামে, যেখানে ওদের প্রচুর জমিজমা, ঘোষ হবার দরুণ সেখানে যাওয়া, ফসল তোলানো, এতোয়ারি হাটের খাজনা তোলা সব বন্ধ । বাবার ঠাকুর্দা, মানে ঠাকুর্দার বাবা, হাইকোর্টে, তখন কলকাতা হাইকোর্টে মামলা লড়তে যেতে হতো, ভূমিহার রাজনাথ সিংকে ফৌজদারি মামলায় জিতিয়ে দেয়ায়, মুঙ্গেরের রোমহর্ষক দিয়ারায় দুশো একর জমি, আর সাত একর আনাজ-বাগান, আর এতোয়ারি হাট ওর ঠাকুর্দার নামে করে দিয়েছিল । সুশান্ত যায়নি কখনও পিপারিয়ে । ছোটোবেলায় চাল মুসুর অড়র ভুট্টা সর্ষে পটল কচি তরমুজ আম আর হাটের টাকা আসত । তারপর ওখানে  কৈলু যাদব, কজ্জল ধানুকদের অপহরণের দল এমন জ্বালাতন আরম্ভ করলে যে সেসব জমিজমা এখন কাদের হাতে তা শুধু কানাঘুষায়, কোনো যাদব ছিটকে পাটনায় এলে, তার মুখে ভাসাভাসা জানা যায় । বাংগালি-তাংগালি বলে, সুশান্তরা আর সেখানে পাত্তা পায় না । লোকমুখে প্রচারও করে দেয়া হয়েছে যে কোনো বাংগালি ঘোষবাবু এলে তার মাথা ধড় থেকে আলাদা করে দেয়া হবে।

দিয়ারা, দ্বীপের মতন গঙ্গার চর, জেগে ওঠে, থাকে বছরের পর বছর, বেগুসরায় মুঙ্গের থেকে নদীর কিনারে-কিনারে ভাগলপুর কাটিহার ওব্দি । এক জায়গায় ডুবে আরেক জায়গায় কুমিরের পিঠের মতন ভেসে ওঠে অনেক সময়ে, খেলা করা অজস্র মানুষের সুখশান্তি নিয়ে, তাদের দুর্ধর্ষ ক্রুর মমতাহীন আতঙ্কিত করে রাখে আজীবন, ভালা বরছি গঁড়াসা ভোজালি পাইপগান কট্টা তমঞ্চা দিয়ে । ঢেউরা দিনেরাতে হাসি বিলোয় ।

মেদিনি পুলিশফাঁড়ির সুরজগড়হার কাছে হুসেনা গ্রামের পালোয়ান, কোমরে ঘুনসি, গলায় তাবিজ, থলথলে বুক আর উরধ, কদমছাঁট অধিক যাদব, দুধ বিক্রির ফাঁকে, কিষান-কামিলের নূনতম মজুরির মজুরি আন্দোলন পিষে ফেলার লেঠেল হিসেবে জোতদারেরদের স্যাঙাত থাকতে-থাকতে নিজেরাই আরম্ভ করে দিলে জোরজবরদস্তি জমিজমার দখল নেয়া, কানপুর থেকে চটের থলেতে আসত পিস্তল কারতুজ হাতবোমা দোনল্লা একনল্লা, খড়ের গাদায় লুকোনো, পালতোলা নৌকোয় । সামহো-সোনবরসা কুরহা দিয়ারায় গোটাকতক চাষি ট্যাঁফোঁ করলে, তাদের ডান হাত কেটে গঙ্গায় । নিজেদের হুসেনা গ্রামে পুলিশের ওপর কয়েক ঝাঁক গুলি চালিয়ে ভাগাল । তারা আর ওমুখো হয়নি । মেদিনি ফাঁড়ির পুলিশ ইন্সপেক্টর যতীন্দ্রনাথ সিং ছ’জন কন্সটেবলের শং্গে যখন ওদের কাছে আত্মসমর্পণ করলে, অধিক যাদব গঁড়াসা দিয়ে চারজনের ভুঁড়ি ফাঁসায় । লাশ নদীতে আর বন্দুকগুলো নিজেদের কব্জায় । পেট চিরে মারাকে শিল্পের পর্যায়ে তুলেছিল । পেট চিরে পূণ্যসলিলা গঙ্গায় ফেলেছিল আরও অনেককে, টুকরো-টুকরো, যেমন পাঁঠার দোকানের মাংস, বেশিরভাগ সীমান্ত চাষি, যেমন অঙ্গদ যাদব, এতোয়ারি মাহাতো, ডুকো মাহাতো, দেবেন মাহাতো, সুধীর মাহাতো । অধিক যাদব মরলে, ওর রাজ্যপাট যায় কৈলু যাদবের হাতে, সে পিপারিয়ে গ্রামের অমৃত যাদবের ছেলে । সুশান্তদের গরদানিবাগের বাড়িতে অমৃত যাদব একবার এসেছিল, চার বছরের খালি-গা ধুলোমাখা কৈলুকে নিয়ে ।

লখন তাঁতিকে, পুলিশের মুখবির, মানে চর সন্দেহে, কেন তাড়িয়ে-তাড়িয়ে গ্রামবাসীদের চোখের সামনে থেঁতো করে মেরেছিল কৈলু, অফিসের একজন পিওনের কাছে, যে অবসর পাবের পর প্রভিডেন্ট ফাণ্ডের কিছু টাকায় কিনে, কোনও এক কমবয়সী তরুণীকে বিয়ে করেছিল, তার কাছ থেকে জানতে পেরেছিল সুশান্ত । পরে, মুখ্যমন্ত্রীর মধ্যস্হতায়, কৈলু যাদব আর ওর প্রতিবেশী দুলারচন্দ্র যাদবের সন্ধি হলে, অপহরণের ব্যবসা আরমভ করে কৈলু । দিয়ারা থেকে দূরে-দূরে ছড়িয়ে পড়ে ব্যবসার আওতা, পাটনা রাঁচি মজফফরপুর লখনউ কানপুর এমনকি দিল্লির রাস্তা থেকেও তুলে আনতে পেরেছিল রওনক আগরওয়ালকে । কৈলুকে সাফায়া করার জন্যে সরকার ‘অপারেশান কোবরা’ চালু করলে, সেই যে ও গা ঢাকা দিয়েছে, খুঁজে পাওয়া যায়নি আজ পর্যন্ত ।

কৈলুর জায়গা দখল করেছে কজ্জল ধানুক, আর ধানুকদের নরকে যাওয়া উচিত হবে না ভেবে সুশান্তর বাবা কাকা জ্যাঠারা আর নিজেদের জমিজমা খেতখামার চাষবাস হাটের আয় ইত্যাদির কথা ভুলে গিয়ে ও-মুখো হননি । পিপারিয়াতে ওরা বাংগালি যাদব । বারোটা যাদব বাচ্চাকে একদিন দুপুরে বরছি-ভালা দিয়ে ছিন্নভিন্ন করেছে কজ্জল ধানুক, শুনেছেন ওনারা লোকমুখে । ধানুক বিন্দ আর ভূমিহার এখন একদিকে, যাদবরা অন্যদিকে । লছমিপুর-তৌফির দিয়ারায়, বদলা নেবার জন্যে, গঙ্গার ওপর থেকে ভেসে গিয়ে শীতের কুয়াশা যখন ঘিরে ধরেছে কুঁড়েঘরগুলোকে, যাদবরা দল বেঁধে হামলা করে বিন্দ বাচ্চা বউ বুড়োদের আস্ত রাখা অনুচিত ভেবেছিল ; বিন্দ জোয়ানরা বেঁচে গিয়েছিল কেউ কেউ, অন্ধকারে পিটটান দিয়ে ।

 

ঘন সবুজ কচি আমের থুতনিতে হাত দিয়ে আদর করছিল একটা প্রৌঢ় আমপাতা । গাছের প্রায়ান্ধকার গোড়ায়, আধভিজে উইপোকার মেটেরঙা দেউড়ি । মিহিন আবেগপ্রবণ বিকেল-বাতাস বেড়াতে বেরিয়েছে গোধুলী-বাতাসের সঙ্গে হাত ধরাধরি করে । আকাশে দীঘল ফোলাফোলা মেঘ । অনেক দূরে, ওই দিকে, একাধটা ঠুনকো বিদ্যুতের অদৃশ্য আওয়াজ । এখন রূপসী মর্জির বিকেল । অল্পবয়সী খেটে-খাওয়া কয়েকটা কাক চলে গেল দক্ষিণ থেকে উত্তরে । একটু আগে সামনের ছাতিম গাছে যে-চড়াই পাখিগুলো স্হূল রঙ্গরসিকতায় মশগুল রেখেছিল নিজেদের, তারাও এখন ডানা গুটিয়া ঠোঁট গুঁজে চুপচাপ । রাস্তার ওপারে ধনী আর উদার কাঁঠালগাছ । রোদ্দুর বোধহয় গাছের ছায়া মাড়ায় না এ অঞ্চলে । চারিদিকের এমন অতীন্দ্রিয় জগতের আভাস পেয়ে ছোটোখাটো গোলগাল নুড়ির দল উদাসীন শুয়ে আছে কালভার্টের তলাকার ছিপছিপে নালার কিনার বরাবর ।

কালভার্টের ওপর বসে, ধূসরিত কাহিল পা ঝুলিয়ে, আনমনে এইসব দেখছিল অতনু । যে লজঝড়ে বাসটা পাটনা থেকে ভোর পাঁচটায় ছেড়েছিল, তা থেকে এই অজ দিগন্তে নেমে পড়েছে ও । সৌন্দর্য সৃষ্টির আকুতিতে মগ্ন  আসন্ন বিকেল-গোধূলির স্নেহময় আকাশ, বাসের জানালায় থতমত বাতাস, বাধ্য করেছিল ওকে এইখানে নেমে পড়তে । সেই তখনই জড়সড়ভাব এসে গিয়েছিল স্হানীয় রোদ্দুরের । একটু পরেই কেয়ারি-করা অন্ধকার গজিয়ে উঠবে ওর চারপাশে, তখন পথ, চলার পথ, দেখা যাবে না বলে হাঁটতে আরম্ভ করবে ও, অতনু । জঙ্গলের কালচে সবুজ মহাফেজখানা পেরিয়ে, গ্রামটা ওইদিকেই ।

ময়লা বলতে যা বোঝায়, অতনুর গায়ের রঙ তার থেকে এক পোঁচ ফর্সা । দু-চোখ প্রায় সব সময় বরফের বুদবুদ, ভেতরে ভেতরে উসখুসে নদীর মুখচোরা স্রোত । গত অঘ্রাণে তেইশে পড়েছে । নোংরা জামা-কাপড় । টো-টো বেড়ানো চটজলদি পিচপথের ধূসর গন্ধমাখা কোলহাপুরি । হাতঘড়ি পরার অভ্যাস, চুড়ি-চুড়ি মনে হয় বলে, আর সময়ের বাদবিচার না-থাকায়, নেই ওর । এই বয়সেই চুলের কিছুটা চিলতে, ডান ঘেঁষে, পেকে গেছে, দুশ্চিন্তায় নয়, চিন্তাহীনতায় । কখনও যেচে আলাপ করে না, কারোর সঙ্গে অতনু । কম কথা বলে । অনেকক্ষণ টানা কথা বলতে পারে না । খেই হারিয়ে যায় । কথা বলতে-বলতে ওর মনে হয়, এঁর সঙ্গে এসব আলোচনা করার মানে হয় না । তরুণীদের এড়িয়ে চলে । কেউ ওর সঙ্গে কথা বললে, ওর তার সংক্ষিপ্ততম জবাব দ্যায়, হ্যাঁ, না, ও, আচ্ছা, তাই বুঝি, ঠিক আছে, চলি ।

অতনুর হাতে মানসী বর্মণের গচ্ছিত রাখা বাদামি নরম ফোম রেকসিনের ব্যাগ । কয়েক লক্ষ টাকার নোংরা-হাফনোংরা নোট, আর অসীম পোদ্দারের ডায়েরি আছে তাতে । টাকাগুলো তেকচিটে আধমরা অসুখী । ডায়েরিতে স্বীকৃতি আছে যৌন যথেচ্ছাচার থেকে কুড়োনো রোগের । ব্যাগে টাকার ডাঁই আবিষ্কারের সঙ্গে সঙ্গে , রাত্তিরেই, খাটের তলা থেকে টেনে স্তম্ভিত, এই বেরিয়ে পড়ার নির্ণয় নিয়ে ফেলেছিল ।

দূরের ক্ষণজন্মা বিদ্যুৎগুলো এবার ফুরিয়ে গেছে । মেঘের হাত ধরে ছোটো-ছোটো তারারা গুটিগুটি পায়ে আসছে ওই সংসারে । আলুথালু পোশাক সামলে ঘরে ফিরছে বকযুবতী । একটা লরি চলে গেল হেডলাইটের শানবাঁধানো আলো জ্বেলে । গলা শুকিয়ে ধু-ধু করছিল বলে, এবার উঠে দাঁড়াল অতনু । আনমনা হয়ে উঠেছে চারপাশের বর্তমান । বহুক্ষণ বসে থাকার দরুণ ঠ্যাং দুটি ভঙ্গিসর্বস্ব । আড়মোড়া ভেঙে কিছু-ভারি ব্যাগটা তুলে কাঁধে ঝুলিয়ে নিলো । উদ্দেশ্যহীন জীবন হয়তো এবার প্রহেলিকাময় হবে । জীবনের মোড় পালটাবার জন্যে তার সামনে বেশ কয়েকটা বিকল্প থেকে যে-কোনো একটা বেছে নিতে হবে ওকে । ক্ষুধা আর স্বার্থের বাইরে জীবনযাপন আছে কি, যেখানে বেঁচে থাকার জন্যে কোনো চাবিকেন্দ্র চাই না !

যদিও ওরা দেশভাগের উদ্বাস্তু নয়, অতনু কো০নো রাজ্যের ভূমিপুত্র হতে পারেনি, তার জন্য দরকার কোনো জায়গায় ন্যুনতম থাকার প্রমাণপত্র ্র বাবার ছিল না স্হির সাকিন আর ঠাকুর্দার ছিল না স্হাবর ধানপাটের তৌজি-মৌজা । কেউই কোথাও থাকেননি বেশিদিন । শেকড় গজিয়ে ফেলতে ভালো লাগত না ওনাদের । সত্যি, একই বাড়িতে, একই পাড়ায়, একই শহরে, একই লোকজনের মাঝে, মাসের পর মাস, ঋতুর পর ঋতু, বছরের পর বছর, কাটিয়ে দিতে পারে কেউ-কেউ, গর্ব করে অমন মরচেপড়া জীবনযাপন নিয়ে । ভস্মপূঞ্জ জমে যায় না কি তাদের চোখের পাতায় আর ভুরুর চুলে, ভেবেছে অতনু ।

আচমকা খেয়াল করল অতনু,  অন্ধকারে, যুঁই ফুল তার সুগন্ধ দিয়ে ছড়াচ্ছে আন্তরিকতা । এক হাজার বছর পরেও এই সুগন্ধ থেকে যাবে । কোনো রেশ থাকবে না অতনুর । বাবাও তো থিতু হবার আগেই ইঁদুর মারা বিষ খেয়ে আত্মহত্যা করা নিজের ছেলেকে চাকরিটা পাইয়ে দিয়ে গেলেন । জানতেন ছেলেটা নিজে কিছুই করে উঠতে পারবে না । প্রাতিষ্ঠানিক সমবেদনা । গোড্ডা বিহটা লাহেরিয়াসরায় জপলা বা বকসরের কোনো ছাদহীন মাটির দেয়ালের স্যাঁতসেতে স্কুলে, এই চাকরিটা নে পেলে, অর্ধেক মাইনেতে, চরবাহাদের পড়াতে হতো হিন্দির মাধ্যমে ইংরেজি, ওই ভাষায় স্নতকোত্তর হবার মাশুল । মাইনের আর্ধেক দিয়ে দিতে হতো শিক্ষা বিভাগের সরকারি পেয়াদাদের ।

বাবা কেন আত্মহত্যা করেছিলেন ? মাও বলতে পারেননি । অতনু তাই দায়টা নিজের চাকরির ওপর চাপিয়ে নিয়েছে ।

চাকরিটা আসলে কেরানি আর মজুরের দোআঁশলা, শুনতে জমজমাট, ব্যাংকনোট এগজামিনার, টাকাকড়ি পরীক্ষক, অথচ যারা চা কিংবা মদ পরীক্ষা করে, তাদের কতো র‌্যালা । অতনুর কাজ  টাটকা নোট আর পচা নোট আলাদা করা, একশোটা নোটের প্যাকেট তৈরি, দশটা প্যাকেটের বাণ্ডিল, দিনের পর দিন, দিনের পর দিন, দিনের পর দিন, দিনের পর দিন, দিনের পর দিন, দিনের পর দিন, মাসের পর মাস, মাসের পর মাস, মাসের পর মাস, মাসের পর মাস, মাসের পর মাস, মাসের পর মাস, ঋতুর পর ঋতু, ঋতুর পর ঋতু, ঋতুর পর ঋতু, ঋতুর পর ঋতু, ঋতুর পর ঋতু, ঋতুর পর ঋতু, গ্রীষ্মের পর বর্ষা, বর্ষার পর শরৎ, শরতের পর হেমন্ত, হেমন্তের পর শীত, শীতের পর বসন্ত, বছরের পর বছর, বছরের পর বছর, বছরের পর বছর, বছরের পর বছর, বছরের পর বছর, বছরের পর বছর, বাছাই ছাঁটাই, গোনার পর ভালো নোটগুলো চলে যায়  ব্যাংকে আর ট্রেজারিতে । পচা নোটগুলোয় গোল-গোল চাকতির মতন গোটাকতক ছ্যাঁদা, ঝপাং ঝপাং ডাইস দিয়ে করার পর, নোটগুলো মরে গিয়ে অচল হয়ে গেছে ভেবে, যাতে আবার না বেঁচে উঠে ব্যবহৃত হয়, ছ্যাঁদা-ছ্যাঁদা নোটের প্যাকেট আর ঝরে পড়া গোল চাকতি, বস্তাবন্দি সিলমারা চটের থলেতে চলে যায় অন্য বিভাগে পুড়ে ছাই হবার জন্যে ।

প্রথম দিকে অতনু, তেএঁটে ফাঁকিবাজ হবার আগে, এদেশের ভার্জিন কর্মচারীদের যেমন হয়, মন আর সততা খরচ করে, টাটকা আর পচা নোট আলাদা করত, গুনত, পচা নোটগুলোই কেবল নষ্ট করাত গোল-চাকতি ছ্যাঁদা করিয়ে । সহকর্মীরা ধমকাতে আরম্ভ করেছিল ; আর হুমকি দিয়েছিল ভাজপা, জদ, ইনকা, সপা ইউনিয়ানের কত্তারা । কে আর সৎ হয়ে প্যাঁদানি খায় ! ভালো নোট হোক খারাপ নোট ওক, পচা হোক বা আনকোরা, প্যাকেটের সবকটা টাকাকে, প্রতিটি, অতনু পচা ছাপ মেরে নষ্ট করিয়েছে । কমিয়ে ফেলেছিল কাজের চাপ । সৎ হবার ফালতু বোঝা, নোয়ম মেনে চলার লাফড়া, প্যাকেট খোলার আর ঝঞ্ঝাট নেই । দরকার নেই গোনার । এহাতে প্যাকেট নাও, ছ্যাঁদা করাও, নিজের কোড চিহ্ণ দাও শেষ নোটে, এবার তুলে দাও সহকারি খাজাঞ্চির হাতে, যে নিজের টেবিলে বসে জনর রাখে কেউ গ্যাঁড়াবার তাল করছে কিনা, যদিও দরোজায় চেকিং হয় বেরোবার সময় । অতনুর তাড়াতাড়ি কাজ শেষ, ছুটি, বাড়ি যাও, বা বাইরে বেরিয়ে যা ইচ্ছে করে বেড়াও, সহকারি খাজাঞ্চি খুশি, খাজাঞ্চি খুশি, খুশি সব্বাই, স্মুথ সেইলিং । দশটা-পাঁচটার টুঁটি টেপা চাকরি হয়ে গেল এগারোটা-একটা । না-গোনার মধ্যে ঝুঁকির তড়াস । সে ঝুঁকি সবাই নিচ্ছে । অতনু কেন মাঝখান থেকে সৎ হতে যাবে ! চাকরির জন্যে তো আর কারোর প্রতি দায়বদ্ধতা গজায় না । তাই চাকরিকে চাকরি বলে মনে হচ্ছিল না অতনুর । ভেতো জীবন হয়ে উঠেছিল নিরলস কুঁড়েমিতে মুখর । সেকশানের লোহার জাল দেয়া জানলার বাইরে শিমুল গাছটায়, আহ্লাদে ফেটে পড়া লাল ফুলগুলোয় লুকিয়ে বউ কথা কও পাখি নির্দেশ দিয়েছে অতনুকে, নোট গুনে নাও, নোট গুনে নাও, নোট গুনে নাও, নোট গুনে নাও ।

অতনুর সহকর্মীরা বসন্তঋতুকে বলে ফগুয়া । গাঁও চলে যায় অনেকে, বউয়ের কাছে । বসন্তঋতু তো বউদেরও ডাক দেয় । কোথায়-কোথায় সেসব গ্রাম । বাসে-ট্রেনে-নৌকোয়-পায়ে হেঁটে কোশের পর কোশ । রোহতাসের কারমু পাহাড় এলাকায়, ভাগলপুরের কহলগাঁও সুলতানগঞ্জ বহিপুরে, সীতামড়হির মানেচওকে, অওরংগাবাদের মদনপুরায়, দলেলচৌক বধৌরায়, চাতরার প্রতাপপুর হাণ্টারগঞ্জ ইটখোরিতে যেখানে খয়েরের চোলাই হয়, জাহানাবাদের আরওয়ালে, বিষ্ণুগঞ্জে, মখদুমপুরে, পোরমগাঁও আর হিঁডিয়ার নকসল্লি মাওওয়াদি জামাতে, নওয়াদা জেলার হিঁসুয়ায়, মুঙ্গেরের শেখপুরায়, কুঁওর সেনা সানলাইট সেনা ব্রহ্মর্ষিসেনা আজাদ সেনা শ্রীকৃষ্ণ সেনাদের বাভন বনিয়া রাজপুত কোইরি কাহার কুরমি আহির গাঁওয়ে, সোনাপাস রুগড়ি সুপাইসায়, কোতওয়ালসায়, তেলাইডি বড়াউরমা সিংগাড়ি লোসোদিকি পিতকলাঁ মাদেউবটা গ্রামে, যেখানে ধুলোবালি ছাড়া আর কিছুই নিজের মনে ঘোরাঘুরি করে না । কোথাও যায়নি অতনু । সহকর্মীরা বলেছে, আবে চল, তনিক হিলাকে-ডোলাকে মৌজমস্তি কর ফগুয়ামেঁ । সেসব গ্রাম দেখতে ইচ্ছে করেছে কিন্তু যেতে ইচ্ছে করেনি অতনুর । পাটনার কাছে-পিঠের বাইরে যায়নি কোথাও ।

সময় কাটাবার জন্যে একজোড়া কাকাতুয়া কিনেছিল ; আর কিনেছিল শাদাঝুঁটিটার জন্য বাংলা ছড়ার সিডি, আমি হব সকালবেলার পাখি, সবার আগে কুসুমবাগে উঠব আমি ডাকি ।  হলুদঝুঁটির জন্য রবীন্দ্রসঙ্গীতের, আমি হিয়ার মাঝে লুকিয়েছিলে দেখতে আমি পাইনি তোমায় । ছড়ার বা রবীন্দ্রসঙ্গীতের জন্যে কেনেনি, কিনেছিল কাকাতুয়া দুটোর জন্য । এত মিঠে গলা পাখিদুটোর, সত্যি । অডিওগুলো না বাজালে, সকাল থেকে গলিতে গালমন্দের যে তারস্বর আদানপ্রদান হয়, তা শিখে ফেলত পাখি দুটো ।

চাপচাপ অসন্তোষ মাখানো, নোংরা তেলচিটে আধমরা পচা টাকার দু-চোখ জুড়োনো রূপে, চাকরির বছর দেড়েকের মাথায়, নিষ্পৃহ হয়েছিল অতনু । অতিশয়োক্তির মতন কোটি-কোটি কেগজের স্যাঁতসেতে ছাতাপড়া নীলসবজে টাকার টিলা । একশো টাকার, পাঁচশো টাকার, হাজার টাকার, পঞ্চাশ কুড়ি দশ পাঁচ টাকা থেকে সারাবছর শুকনোপচা পাতার বুনো জঙ্গুলে গন্ধ । সেসব আদুলগা টাকার সঙ্গে কথা বলা এদানতি বন্ধ করে দিয়েছিল অতনু । মূল্যহীন অঢেল ।

গলায় চোঙবাঁধা সুশান্ত অতনুর বিভাগে এলে আলাপ । সুশান্তই প্রথম দিন বলেছিল, ‘তোর নাম তো অতনু চক্রবর্তী ? আমি সুশান্ত ঘোষ । দেখেছি তোকে, অমন একা ম্যাদামারা হয়ে পড়ে থাকিস কেন ? চলিস আমাদের বাড়ি, তোর ভাল্লাগবে ।’

একটার পর, শেষশীতের দুপুরে, কাজ শেষ হলেই, অফিস ছুটি, সুশান্তর মোটর সাইকেলে । চালাতে শিখে গেল অতনু, ধুতি পরেই, চটি পায়ে । নাটুকে নষ্টকুমার-কুমারীদের মতন, শীতের বসন্তঋতু মেজাজি পাগলাটে ছায়া-চেহারাগুলোর নিঝুম দাপাদাপি, দৃষ্টিতে রক্তমাখা ছুরি নিয়ে তাপটগবগে হলকার পিচগলা গ্রষ্ম, দিলখোলা বর্ষার প্যাচপেছে হাঁটু-কাদা রাস্তা, ছুটেছে দিশেহারা মোটর সাইকেল । কখনও পেছনে সুশান্ত, কখনওবা পেছনে অতনু । পাটনা সাহেব থেকে দানাপুর-খগোল, এরাস্তা-সেগলি-রাজপথ । কিন্তু ধুতি-পাঞ্জাবি থেকে শার্ট-প্যান্টে যেতে পারেনি অতনু । শীতে আলোয়ান । এদিকে সুশান্ত, বিহারি জোতদার পরিবারের যুবকদের মতন, রাজপুত ভূমিহার কুরমি যারা, কিংবা ব্রাহ্মণ কায়স্হ বিহারি আমলার শহুরে ছেলেদের ধাঁচে, অফিসে প্রতি ঋতুতে হালফ্যাশান এনেছে । জ্যাকেট জিনস টিশার্ট উইন্ডচিটার, ব্রাণ্ডেড । দপতরের গৃহবধু কর্মীদের নজরে সুশান্ত অবিনশ্বর জাদুখোকন, লিচুকুসুম, মাগ-ভাতারের অচলায়তনের ফাটল দিয়ে দেখা মুক্ত দুনিয়ার লালটুশ । গেঁজিয়ে যেতে পারে, চোখে চোখ রেখে, ননস্টপ, যান বাজে বকার মধ্যেই পালটে যাচ্ছে হিজড়েতে, সবায়ের অজান্তে ।

কী হয় অমন কথা-বলাবলিতে, এক্সচেঞ্জ হলে সুশান্তর পাশে চুপচাপ, বাচাল গৃহবধুদের মাঝে ঠায় অপ্রস্তুত, আধ থেকে এক ঘণ্টা দাঁড়িয়ে-দাঁড়িয়ে, ঠোঁট বন্ধ রেখে হাইতোলা চেপেছে অতনু । মহিলাকর্মীদের বিভাগ আলাদা । তিনটে-চারটে বেজে যাবার ভয়ে, যখন কিনা কাজ সেরে একটায় বাড়ি কেটে পড়া নৈতিক । মহিলাকর্মীরা নাকি সৎভাবে কাজ করে, ইউনিয়ানগুলো ওনাদের টলাতে পারেনি । লম্বা টিকোলো আঙুলে টরটরিয়ে দরকচা নোট গোনে, পচা নোট বাতিল করে, সেগুলোতে ছ্যাঁদা করায়, প্যাকেটের পেছনে যে যার নিজের কোডের ছাপ মারে, কেবল হাফকাটা নোট বাছাই করে ফেরত পাঠায় । মহিলাদের সততার চাবিকেন্দ্র, শরীরের তুলতুলে জায়গাগুলোয় লুকোনো থাকে বলে, এও মনে হয়েছে অতনুর, সৎপুরুষ আর সতীনারীর কী অবাঞ্ছনীয় তফাত । ওনাদের সুখপাঠ্য মুখশ্রী, অম্লমধুর স্তন, দুষ্প্রাপ্য নিতম্বের আদেখলাপনায়, শ্রাবণের বিকৃত-মস্তিষ্ক বুড়িগণ্ডক বা পুনপুন নদীগুলোর মতন, নিজেকে মশগুল আর অনিশ্চিত রেখেছে ভারজিন অতনু ।

গায়কের ইশারায় যেভাবে ধ্বনিপরম্পরা টের পায় তবলাবাদক, তেমনই, নৈশভোজে বেরোনো টিকটিকি যুবকের মতন, মহিলা সহকর্মীদের অবান্তর কথাবার্তা, ভোজপুরি হোক হিন্দি-বাংলায়, বলার জন্যেই বলা, একপলক দূরত্বে দাঁড়িয়ে গিলেছে সুশান্ত । কোনো যুবতী মুখে রুমাল চেপে থাকলে অতনুর সন্দেহ হয়েছে যে এবার নির্ঘাৎ ইনফ্লুয়েঞ্জা ধরবে সুশান্তকে, এত কাছে কী করে দাঁড়ায়, শ্বাস-প্রশ্বাসের দূরত্বে !

–অররে সুশান্তজি, একদম টইয়র লগ রহেঁ হ্যাঁয় আজ !

–বাঃ, বেশ মানিয়েছে তো লাল সোয়েটারটা হলদে স্কার্ফের সঙ্গে । শিমলা থেকে বুঝি ?

কৃষিবিজ্ঞানে স্নাতক সুশান্ত, আরও স্বচ্ছলতার আপ্রাণে, ট্রাকে করে শীতে দাক্ষিণাত্য থেকে আম, কোংকন থেকে এঁচোড়-কাঁঠাল, গ্রীষ্মে শিমলা থেকে টোম্যাটো কড়াইশুঁটি ফুলকপি, পুণা হায়দ্রাবাদ থেকে ব্রয়লার, রায়গড় থেকে সফেদা, ভুসাওয়াল থেকে কলা এনে ছেড়েছে পাটনা শহরের বাজারে, ওর কাকার সঙ্গে ব্যবসায় । পিপারিয়ার জমিদারি হাতছাড়া হলেও বর্ধমানের মেমারিতে আছে এখনও বসতবাড়ি আর কিছু তৌজি-মৌজা খামার-খতিয়ান । ওদের পারিবারিক কিংবদন্তি অনুযায়ী, ঠাকুর্দার ঠাকুর্দা ছিলেন নামকরা ঠগি । বাড়ির সবাই এখনও রঙিন রুমাল রাখে । ঠগিদের বংশধর হবার গোপন গর্ব আছে সুশান্তর ।

কৃষিবিজ্ঞান পড়ে নোটপরীক্ষক । এনজিনিয়ার, জীববিজ্ঞানে ডক্টরেট, উচ্চ গণিতে স্নাতকোত্তর, জেনেটিকসে বিশারদ, সংস্কৃতে সান্মানিক স্নাতক, হরেক রকম শিক্ষিতের ছড়াছড়ি এই চাকরিতে, মজুর আর কেরানির এই দোআঁশলা কাজে ; একবার এই এগারোটা-একটার আরামে ঢুকে গেলে বড় একটা বেরিয়ে যায় না কেউ । দশ-বারো বছরের মাথায় কেরানিগিরির সাধারণ বিভাগে পদোন্নতি হলে কাজের ধারা পালটায়, কাজের সময়ও দশটা-পাঁচটায় আটকে পড়ে ।

অতনুকে ছাড়ে না পচা নোটের জীর্ণ গন্ধ, যে গন্ধে ওর চারিপাশে ঘনিয়েছে দুর্বহ স্বচ্ছ অন্ধকার । পোড়াবার সময়, চুল্লি থেকে ভেসে আসে মড়া পোড়াবার হুবহু, অথচ ছাইয়ের রং সোনালি ! চুল্লিতে নোট ফেলার সময় ননীদা হরিবোল দ্যান, রাণা রামদেও সিং আওয়াজ দিয়ে ওঠে রামনাম সৎ হ্যায় । চাকরির দোটানায় বেশির ভাগ স্বপ্নই স্বল্পপরিসর ।

উচ্চাকাঙ্খী মহিলাদের তিনজন, যারা পদোন্নতি পেয়ে ইউডি কাউন্টার আলোকিত করে, যদিও জোচ্চুরির ওই ঘেমো অঞ্চলে পুরুষদের  একচ্ছত্র, কেননা জনগণের বেহুদা কিচাইন, টু-পাইস অফুরন্ত, খুল্লম খুল্লা । একটাকা দুটাকা পাঁচটাকার তরতাজা করকরে নোটের আনকোরা প্যাকেট, দশ-কুড়ি টাকা বেশিতে ঝাড়া যায়, বিয়ের মরশুমে প্রায় দ্বিগুণ, হাতজোড় কন্যাদায়গ্রস্তের কাতার । জোড়াতালি, তাপ্পি, ছেঁড়া, উইচাটা, ঝুরঝুরে, তেলচিটে, ছাতাপড়া, কাহিল, ভ্যাপসা নোট, যেগুলো কেউ নিতে চায় না, ছুঁতে চায় না, কুষ্ঠরোগাক্রান্ত, সেগুলো নিয়ে হাজিরা দ্যায় মুচকিমুখ দালালরা, আবডাল হলেই যারা মনে-মনে আর ফিসফিসিয়ে মাদারচোদ গধে-কা-লণ্ড রণ্ডি-কে-অওলাদ ভোঁসড়ি-কে-জনা কুত্তে-কা-চুত আওড়ায়, অতনুর সুশান্তর মানসী বর্মণের অসীম পোদ্দারের দপতরের উদ্দেশে, কাউন্টারের টেলরদের উদ্দেশে । দালালরা বাঁধা কমিশন হাতপাচার করে । দালালগুলো, কাউন্টারে কিউ দেবার জন্যে অফিসের সিকিউরিটির পালোয়ানদের টাকা খাওয়ায়, কেননা কিউতে প্রতিদিনের বরাদ্দ কেবল চল্লিশজন । ভিজিল্যান্স ধরেছিল সিকিউরিটে অফিসারকে, শর্ট সারভিস কমিশনের সেনাক্যাপ্টেন, সে ব্যাটা এখন ট্রান্সফার হয়ে ত্রিভান্দ্রম না নাগপুরে ।

কতরকমের নোট যোগাড় করে আনে দালাল নোট-বদলকারীরা । এত সূক্ষ্ম জোড়াতালি, শাদা চোখে টের পাওয়া যায় না কিচ্ছু । অফিসাররা পরখ করার জন্যে টেবিলের ওপর এনামেলের গামলায় ছাড়লে, কিছুক্ষণে আলাদা হয়ে ছিতরে যায় তাপ্পি দেয়া জোড়াতালি নোট । হয়তো দুকোণের সংখ্যাগুলো আলাদা, আদ্দেক আসলের সঙ্গে জোড়া আদ্দেক নকল, কিংবা কুড়ি টাকায় দুটাকার তাপ্পি, পাঁচশো টাকায় পাঁচ টাকা, সাতটা একশো টাকার নানা টুকরো জুড়ে একটা আস্ত । চিনে ছাপিয়ে এনে পাকিস্তানিরা নকল নোট ভারতের বাজারে ছাড়ার পর কিচাইন বেড়েছে । দালালগুলো আলট্রাভায়োলেট আলোর যন্ত্র কিনে যাচাই করে নেয় নোটগুলো নকল পাকিস্তানি না আসল ভারতীয় । পাকিস্তানি নোট হলে পুলিশের প্যাঁদানি, জেলহাজত, হুজ্জোতের শেষ নেই ।

আসল নোট যত বেশি পচা, যত বেশি নষ্ট, আবদার তত বেশি, পরিবর্তে অনুমোদিত টাটকা নোট পাবার নিয়ম তত খুঁতখুঁতে, পাশ করার অফিসারের পাদানি তত উঁচু । জুড়ে-জুড়ে কাঠ হয়ে গেছে যেসব নোটের প্যাকেট-বাণ্ডিল, গায়ে গা সেঁটে আলাদা হতে চায় না, উইচাটা থিকথিকে, গ্রামীণ আটচালায় ছিল সোঁদা দেয়ালবন্দি, খামার বাড়ির মাটির অযাচিত গভীরে কলসিবদ্ধ, গাছতলায় পোঁতা গোমোট কাঠের বাক্সে, আত্মহত্যাকারিনীর সঙ্গে জ্বলে আধখাক বা আধসেঁকা ঝুরঝুরে, চেহারা পালটে কাগজ না নোট বোঝার উপায় নেই, এসেছে হয়তো জেলা মুজফফরপুরের মিঠুনপুরা মোহোল্লার রমইরাম বিধায়কের রক্ষিতার বাড়ি থেকে ঘুষের ফাউ, ধানবাদের এ এস পি রেজি ডুংডুঙের ধরা ব্যংক ডাকাতের বস্তা থেকে, সন্ত কানেশ্বরের অমরপুরী আশ্রমের তহখানায় বহুকাল লুকোনো, সে-সব বহুরূপী নোট পাস করেন আরও বড়ো সায়েব । দালালদের বরাদ্দ খাতিরে হাফসায়েব ছোটোসায়েব বড়োসায়েবরা দিনকানা । কোন অফিসের কোন বড়ো সায়েবের দুর্বলতা ঠিক কী আর কতটা নামতে পারেন, দালালরা, ভারত দেশে ছড়ানো অদৃশ্য নাইলনজালের বুনোটে, জানে, না-জানলে চলে না, আর বদলি হলে কাঁড়ির তাড়া বেঁধে ধাওয়া মারে সে-শহরে । দেখতে ভিকিরি সে-সব দাঁত-ফাঁক দালালরা, দাঁতের ফাঁক থেকে টুথপিক দিয়ে মোরগের ডানা বের করতে-করতে, হাওয়াই জাহাজে পাড়ি দ্যায় এক রাজধানি থেকে আরেকে, তোবড়ানো তোরঙ্গে নোটের পচা লাশ নিয়ে । কারোর বা অজানা শহরে বেনামা ব্যাংক খাতায় আড়মোড়া ভাঙে বখশিশ । দেওয়ালি দশেরায় পেস্তা কাজু খোবানি মুনাক্কা আনজির কাগজিবাদামের রঙিন ডিবে । স্টেনলেস স্টিলের, লা ওপালা চিনামাটির ডিনার সেট । শিভাস রিগ্যাল, ব্ল্যাক ডগ, কিং অফ কিংস, আবসোল্যুট ।

গত বছর গরমকালে সুশান্ত, এক শনিবার মহঙ্গুর দোকানে বিকেল ছটায় অপেক্ষা করতে বলেছিল, বগেড়ির মাংস খেয়ে জীবনের অ্যাকশান রিপ্লে দেখাতে নিয়ে যাবে । অতনুর বাসা মহেন্দ্রুতে । সব রকম মাংস পাওয়া যায় মহঙ্গুর দোকানে । ওর নোলানির্ভর রান্না আরম্ভ হয়নি তখনও । কড়াই ডেকচি ঘুমোচ্ছে পোঁদ উল্টে, কোনে ঠেশান দিয়ে জিরোচ্ছে খুন্তি হাতা সানচা । বুকের বসনখোলা তনদুরি চিকেনগুলো গায়েহলুদের মশলা মেখে দোল খাচ্ছে দড়িতে, শিকে গেঁথা খরগোশ, পাঁঠার ঠ্যাঙের ডাঁই অ্যালুমিনিয়াম পাতে ঢাকা টেবিলে, পায়রার গোলাপি মাংস,  বারকোশে পোস্ত আর সাদাতিল মাখা কিমার কাঁচাগোল্লা, ভগ্নস্বাস্হ্য ছাগলের হাড় থেকে চলছে কাবাবের মাংসের চাঁছাই ।

মোটর সাইকেলের পিলিয়নে হেলমেট পরে বসতেই, সুশান্ত বললে, চল, অকুস্হল কাছেই । বুঝলি তো, বিগ বস খান্না সায়েব রিটায়ার করার আগে সিক লিভ খরচের জন্যে একমাসের ছুটিতে । তাঁর কাজ সামলাতে হেড অফিস থেকে এসেছেন ডেলিওয়েজ কড়ারে মুখার্জিসায়েব । চল্লিশোর্ধ টাকমাথা, কড়া লোক হিসেবে কর্মীমহলে পছারিত, দু-বার ঘেরাও আর সাতবার ধর্নার খেতাব আছে ।

ফ্রেজার রোডে, সম্রাট হোটেলের পার্কিং লটে, দোচাকে দাঁড় করাতে, অতনু বললে, ‘, এসব তেলফেল দেয়া আমার দ্বারা হবে না ।’

‘ধারণা করতে পারবি না, এমন ব্যাপার,’ বাঁ চোখের বাঁ কোণ সামান্য কুঁচকে জানিয়েছিল সুশান্ত ।

রিশেপশানে খোঁজ করে সাততলার সাতশো বত্রিশ নম্বর ঘরে কোকিল-ডাক কলিং বেলে টোকা দিতে, দরোজা সামান্য ফাঁক, ভুরু কোঁচকানো চাউনি চারিয়ে এক ঝটকায় মেপে নিলেন দুই কুতূহলী খোট্টাকে । সিঁথে উল্টে চুল বাড়িয়ে টাক-ঢাকা মাঝবয়সী দোহারা । ফরসা । পাজামা ধবধবে । মেরুন সিল্কের ড্রেসিং গাউন । উড়ছে আড়িপাতা বিলিতি পারফিউম আবছা অন্ধকার শীতাতপে । বিছানায় গোলাপি মখমলের চাদর দেখা গেল ফাঁ দিয়ে । মুখার্জি মশায় একটু পেছোতেই, ঘরের ভেতর ফুলদানি রাখা টেবিল-থামের পাশে দাঁড়িয়ে সুশান্ত ভদ্রতার অভিনয় করল, ‘আমার নাম সুশান্ত ঘোষ, আপনার আনডারে কাজ করি, ডি সেকশানে ।’

‘ও, আমি এক্ষুনি বেরোবো, আপনারা যদি রবিবার সকালের দিকে আসেন ।’ ভেসে এলো হুইস্কি-প্লাবিত চেতনা ।

‘ঠিক আছে স্যার, রবিবার সকালেই আসব, এর নাম অতনু চক্রবর্তী, একই সেকশানে ।’

‘ওওওও, বারিন্দির বামুন ।’ হাসলে কপালের শিরা ফোলে । ‘সাতটা শকুন মরলে একটা বদ্যি, আর সাতটা বদ্যি মরলে একটা বারিন্দির ।’ কাঁধের ওপর ঘাড়-বেঁকানো, মুচকি দিয়ে দরোজা ভেজিয়ে দিলেন ।

‘জিরিয়ে নেয়া যাক ।’ জাজিমে ঢাকা সিএফএল প্রায়ান্ধকার করিডরের শেষ প্রান্তে রাখা উনিশ শতকী ঢাউস অ্যান্টিক সোফার কালো ফোমনরম কোলে বসে, কাচের টেবিল থেকে চকচকে বিদেশি পত্রিকা হাতে নিয়ে জানালো সুশান্ত, বলল, ‘তুইও একটা পত্রিকা তুলে মুখ ঢেকে ওই দিকে উঁকি দে ।’ সবুজ কার্পেট পাতা নিঝুম ছমছমে, পেতলের ঝকমকে গামলায় ঘরকুনো  গাছালির ফিকে সবুজ পাতায় ঘন সবুজের ফোঁটা । বাস্তবকে রহস্যখুশি দিয়ে যতটা অবাস্তব করা যায় । কারই বা বাস্তব ভাল্লাগে ।

চিকন রঙিন পত্রিকার বিদেশিনী মাই খোলার এক ফাঁকে, দেয়াল ঘড়িতে সাতটা বাজার কুহু শেষ হয়নি, লিফ্ট থেকে একজন চৌখশ নীল-পাগড়ি আধবুড়ো শিখ দালাকে দেখা গেল খুঁড়িয়ে বের হতে, পেছন-পেছন হলুদ শালোয়ার লাল কামিজ হলুদ ওড়না মাথায়, প্রায় ফর্সা স্বাস্হ্যবতী, যাকে মুখার্জির শীতল ঘরে টোকা দিয়ে ঢুকিয়ে, লোকটা মাথা ঝুঁকিয়ে ফেরত গেল লিফটে । করিডর আবার ফাঁকা নিস্তব্ধ ।

‘দেখলি তো ? তার মানে রোজ সন্ধে সাতটায় ।’

‘রোজই হয় বুঝি ? কে খবর দিলে তোকে ?’

‘এ ব্যাতার রোজ নতুন মডেল চাই । এর বড়ো ছেলে কানপুরে না খড়গপুরে আইআইটিতে পড়ে । শালা বাঙালির নাম ডোবালো ।’

‘লিঙ্গের কোনো জাত ধর্ম ভাষা দেশ হয় না ।’

কথাটা বলে ফেলে অতনু টের পেল, অজান্তে অদ্ভুত সত্যি কথা বেফাঁস উগরে ফেলেছে । লিঙ্গ এক উপহাসাস্পদ আবরদক । বেশিটা জীবন কেটে যায় এর ওপর ভর দিয়ে অথচ জিনিশটা কত অনুর্ভরযোগ্য । কত তাড়াতাড়ি একে জ্বালাতন করা যায়, ধোঁকা দেয়া যায়, হাল ছেড়ে দেয়া যায় এর । কিন্তু এমন ভান করে যেন অজাতশত্রু, মালিককে জাদুক্ষমতা দিয়ে দিতে পারে এমন অস্ত্র যেন, পেশীহীন আঙুল-পোকাটাকে তাই সদম্ভে চেষ্টা করে যেতে হয় সর্বনাশের বিরুদ্ধে লড়তে । কিছুই করার নেই মুখার্জির ।

‘তাই তোকে বলেছিলুম, গেলবার হরিহর ছত্তরের মেলার সময় নাংগা ক্যাবারে দেখে আসি শোনপুরে ; গেলি না । দেখলে তো আর চরিত্র তোর নষ্ট হবে না।’

সুশান্ত নিজে গিয়েছিল যদিও, মোটর সাইকেলে । তখন গঙ্গার ওপর পাটনা সিটির কাছে এপার-ওপার পোলটা হয়নি, এপারে মহেন্দ্রুঘাট থেকে ওপারে পহলেজা ঘাট বাচ্চাবাবুর স্টিমার যেত দিনে চার খেপ, ঢাউস ঢেউ তোলে, নামে স্টিমার হলেও মাপে বিরাট । সে-বছর বৈশালীর বিধায়ক বীর মহোবিয়া মেলা থেকে একটা পাগলা হাতি কিনে নিয়ে গিয়েছিল, একশো লেঠেলের পাহারায় । মহোবিয়ার কাছ থেকে হাতিটা কিনেছিল পালামৌ জেলার বিশ্রামপুর বিধানসভা এলাকার বিধায়ক বিনোদ সিং, সি সেকশানের কয়েননোট এগজামিনার দেবেন্দর পরসাদ সিংএর ফুফেরা কাকা, যে কিনা দিনদুপুরে পুলিশ খুন করে যশশ্বী হয়েছিল, খ্যাতি পেয়েছিল নিজের বিরাদরিতে । মালহানের ফজল মিয়াঁ, কমরুদ্দিন, সহজ গঞ্জুকে পিটিয়ে করেছিল আধমরা, চিত্তবিনোদনের জন্যে । চিত্ত সেরকম হলে শির উচ্চ হয় । পাগলা হাতি কিনে জোতদাররা শির উচ্চ করার উপায় খুঁজে পেয়েছিল । হাতিটাকে মাঝরাতে শেকল খুলে এমন খেপিয়ে দিত বিনোদ সিং যে জেগে থাকতে বাধ্য হতো গ্রামবাসী । ব্যাটাকে অবশ্য খুন করতে বাধ্য হয় সহানুভূতিশীল লোকেরা, যারা রাতে একটু ঘুমিয়ে নিতে চায় । উচ্চ শিরকে মাঝরাতেই নামিয়ে দিয়েছিল কেউ ; নামিয়ে পাগলা হাতির পায়ের তলায় ।

‘বিম্বিসার অশোক জরাসন্ধ অজাতশত্রু এদের থেকে খুব একটা তফাত নেই, না ?’

‘আচ্ছা, কার কাছ থেকে জানলি মুখার্জির ফাইভস্টার অভিসারের কথা ?’

‘মোটা টাকার পচা বাণ্ডিল পাশ করার এই একটাই আবদার লোকটার । মাগি খায় । ভিজিল্যান্স বোধহয় আদিরসের স্টক নিয়ে ঘাঁটায় না কাউকে । আমরা প্রোমোশান পেয়ে ওই পোস্টে উঠতে-উঠতে বুড়িয়ে যাব ।’ সত্যিকার আফশোয সুশান্তর গলায় ।

কুড়ি মিনিট পড় মাথায় হলুদ ওড়না দাঁত চেপে ঢালু কাঁধ ত্রস্ত মেয়েটা লেফটের বদলে পাকানো সিঁড়ি বেয়ে অদৃশ্য হতেই, সুশান্ত সোফা থেকে তড়াক, অতনুর হাত ধরে হালকা পায়ে, তারপর সাতশো বত্রিশে কলিং ঘণ্টি বাজায় আর দরোজা খুলতেই, ‘স্যার, আমার গগলসটা ফেলে গেছি ।’ সায়েবের কোমরে গোলাপি তোয়ালে, সাজানো টাকের চুল উস্কোখুস্কো, ধামসানো বিছানার চাদর চেয়ারে দলা । দরোজার পাশে উঁচু পাতলা স্ট্যাণ্ডে রাখা গ্ল্যাডিওলির গামলার পাশ থেকে চশমাটা তুলে, ‘সরি স্যার, ডিস্টার্ব করলুম ।’

মুখময় কুয়াশামাখা মুখার্জির সামনে, স্তম্ভিত দাঁড়িয়ে থাকা লোকটার, দু-চোখ জুড়ে অগাধ দূরত্ব । লোকটা আবিষ্কার করছিল ওরা দুজন তার দিকে প্রখর চাউনি মেলে তাকিয়ে ।

লিফটের দরোজা বন্ধ হতেই, ‘হাঃ হাঃ হাঃ হাঃ হাঃ হোঃ হোঃ হোঃ হোঃ, পেট ফেটে গেল ।’

সুশান্ত : না, বালিশের পাশে কনডোমের প্যাকেট ছিল ।

সুশান্ত : রেকর্ডারে মোৎসার্টের বাইশ নম্বর কনচের্টো লাগিয়ে রেখেছেন ভদ্দরলোক ; পিয়ানো আর অর্কেস্ট্রা ।

সুশান্ত : টাক থেকে ভুরুর কাজল মোছার সময় হয়নি !

সুশান্ত : ভাবতেই পারেনি, ঢুঁ মারব ।

সুশান্ত : দেখে নিস, নির্ঘাৎ হোটেল পালটাবে কাল ।

সুশান্ত : একেলে ? সেকেলে ? আধুনিক ? উত্তরাধুনিক ? কী বলা হবে লোকটাকে ?

পরের দিন, বুধবার সন্ধেবেলা, বধিরদের মধ্যে কেচ্ছা যেভাবে একান-সেকান হয়, একই শিখ নোট এক্সচেঞ্জার দালালের সঙ্গে ময়লাপানা ডাগরচোখ শাদা টিপ শাদা অরগ্যাণ্ডি শাড়ি, পীনোন্নত ব্লাউজে, গলায় নকল মুক্তোর মালা, ঢ্যাঙা ছিপছিপে । পাটলিপুত্রা হোটেলে, কেননা গোপন রাখতে ঠাঁই পালটেছেন সম্রাট থেকে এই হোটেলে । দরোজায় কান রেখে সুশান্ত বলেছিল, ‘হিউগো মনটেনেগরোর ফিস্টফুল অফ ডলার্স ।’

পঁয়তাল্লিশ দিন জুড়ে হরেকরকম নারীর আনাগোনার মাঝে ওরা শুনল, হোয়াম-এর দ্য এজ অফ হেভেন, মাইকেল জ্যাকসনের ‘আই অ্যাম ব্যাড’, সন্ধ্যা মুখোপাধ্যায়ের ‘গানে মোর কোন ইন্দ্রধনু উউ উউ উউ উউ’, ফিল কলিনসের ‘অনাদার ডে ইন প্যারাডাইস,’ বনি এম-এর ‘ব্রাউন গার্ল ইন দ্য রিং,’ মোৎসার্টের সোনাটা পনেরো, সোনাটা ষোলো, এলভিস প্রেসলির ‘বোসসা নোভা বেবি, বড়ে গুলাম আলি খাঁ-এর ‘কা করুঁ সজনী আয়ে না বালম,’  দ্বিজেন মুখোপাধ্যায়ের ‘আজি এই গন্ধবিধুর সমীরণে,’ বাখ-এর চার নম্বর কনচের্টো, লোপামুদ্রার ‘ছাতা ধরো হে দেওরা এইসান সুন্দর খোঁপা হামার ভিঁজ গেলাই না ।’ শুনলো নজরুল, অতুলপ্রসাদ, আব্বাসউদ্দীন, হেমাঙ্গ বিশ্বাস, পূর্ণদাস বাউল, কিশোর কুমার, মোহম্মদ রফি, কুমার শানু, শ্রেয়া ঘোষাল, লতা মঙ্গেরশকর, আশা ভোঁসলে । জানে না বলে কারা গেয়েছে, কী গান, হদিশ করতে পারল না সুশান্ত, তা কিশোরী আমনকর-এর বসন্তবাহার, পণ্ডিত যশরাজের রাগ ভবানীবাহার, ভীমসেন যোশীর হিন্দোল বাহার, মল্লিকার্জুন মনসুরের বসন্তি কেদার ।

–লোকটা তো হরফনমওলা । এমন বাঁধাধরা সময় করে ফেলেছে । ও তো পাভলভের কুকুর । গড়িতে সাতটার ঢং ঢং হলেই, দুপায়ের মাঝখানে চিতচোর কেলেঙ্কারি । একেবারে ঠাপ্পু ওস্তাদ !

–সেই জন্যে রোজ আলাদা-আলাদা গান বাজায় । বউয়ের সঙ্গে শোবার সময়েও নিশ্চই বাজায় । বাড়িতে প্রচুর গানের স্টক করে ফেলে থাকবে । ঘোড়ার ডাক্তারি, বি ভি এস পড়ে আমাদের পরের ব্যাচে চাকরিতে ঢুকেছে জীবন দে সরকার আর অখিলেশ শ্রীবাস্তব, ওদের জিগ্যেস করেছিলুম ।

–আমার মধ্যে দুটো সুড়সুড়ি চালু হয়েছে । গানবাজনা বুঝতে আরম্ভ করেছি ।

–অন্যটা ? ভুরু কোঁচকায় সুশান্ত । আঁচ করে ফেলেছে । হোসটেলে পুসায় পড়ার সময়ে, অনেক কাল আগে ওর মধ্যেও খেলেছিল । দুটো ব্লক ছিল ছাত্রাবাসের, হোমো ব্লক আর হেটেরো ব্লক । জবাবদিহি চাইবার মতন গলার আওয়াজ টাকরায় ঠেকিয়ে, তাই :’বল ? অন্যটা ?’

–কিছু কিছু ব্যাপার আগে কুকাজ ভাবতুম, এখন আর সেসব তেমন খারাপ মনে হচ্ছে না । কেমন যেন লিবারেটেড ফিল করছি । বোধহয় গানের প্রভাব।

বুদ্ধ মার্গের পাশের রাস্তায়, ধোঁয়া-ডিজেলের ছিন্নাংশে মোড়া ব্যস্ত শহর পাড়ার ভিড়ের মাঝে, লাল মোটর সাইকেলের থ্রটলের গলাখাঁকারি তুলে, জড়োয়া ঝিকমিকে বাজারের সামনে, ছুটন্ত মোটরগাড়িগুলোর শ্যেনদৃষ্টি আলোয়, ফ্যাস করে এক মুহূর্তের জন্যে ফোঁপানির ঝলক তুলে নিজেকে সামলায় সুশান্ত ।

অতনু : আজ ওব্দি তুই বললি না, কার কাছ থেকে জেনেছিলি !

সুশান্ত : রমা বউদির কাছ থেকে ।

অফিসের কেয়ারটেকারের বউ রমা, টেলিফোন অপারেটার । সকলের কথাবার্তা আড়ি পেতে শুনে মশলাদার গল্প চেপে রাখেন আর হাসেন নিজের মনে গিগ গিগ । ওনার বিয়ের আগে কেয়ারটেকার রাঘব সান্যালকে লেখা রমা ব্যানার্জির আট পাতার চিঠি, কাগজের এদিক-ওদিক খুদে-খুদে হাতের লেখায়, পড়েছিল অতনু-সুশান্ত ।  আত্মহত্যার চিরকুটে প্রেমপত্রের মিশেল । রাঘবের জাঁতাকাল অনুনয়, ‘একটা খসড়া লিখে দাও না অতনু । ওর সবকিছু এতো ছোটোছোটো কচিকচি , রুখতে পারলুম না । ‘অতনু উপদেশ দিয়েছিল, চোখমুখ থেকে অভিনয় এক্কেবারে বাদ দিয়ে, ‘বিয়ে করে ফেলুন না, ওসব ফালতু লেখালিখে দিয়ে কী করবেন !’

অফিস বিলডিঙেই সাজানো-গোছানো কোয়ার্টার পেয়েছিল রাঘব । বোতামখোলা একাকীত্বে অকালমৃত স্তনেরা জীবন ফিরে পায় । প্লাসটিকের তৈরি বাঁশপাতার সবুজ খড়খড়ি তুলে ঢুকে পড়ে হাসিমুখ রোদ্দুরের আবালবৃদ্ধবনিতারা । সৈন্য বাহিনীর শর্ট সারভিস কমিশন থেকে ফিরে আসা রাঘব কী একখানা ছিল । অফিস এলাকাকে যুদ্ধক্ষেত্র আর যগ্যিবাড়ির চনমনে চেহারা দিয়েছিল, এ সে-ই । জিপের ট্রেলারে, তাঁবুর তলায়, তুষারের মেঝেতে, গান ক্যারেজে, ট্যাংকের মধ্যে বসে, উটের ছায়ায় মরুভূমির বালিতে, হোমো করার ফিরিস্তি । মেয়েমানুষের অনুপস্হতি দিয়ে ঘেরা দুর্ভেদ্য যৌনতার নড়বড়ে আর নাছোড় স্ট্যাগ কিংবদন্তি । সৈন্য জওয়ানদের জন্যে মুখস্হ হিন্দি হুকুমগুলো চারিয়ে যায় কামিন কামিলা মজুর দারোয়ান ঝি চাকর আরদালি পিওন চাপরাসি খানসামা ঝাড়ুদারদের দুনিয়ায় । আর্মি ক্যানটিনের ঘোড়াছাপ রাম । আফরিকানিবাসীদের মতন ঠাশবুনোট চুল ওর, আঁচড়াতে হয় না, তেল দিতে হয় না । রনা বউদির দেওয়া কোনও খবর গোপন রাখতে পারে না রাঘব ।

রাঘবের দেয়া মুখার্জি মশায়ের বিদেয় পার্টির শেষে, পটলের দোরমা চিংড়ির মালাইকারি গোবিন্দভোগের পায়েস হয়েছিল । অতনু সুশান্ত আনন্দ বোস অরুণ মুখার্জি মণিমোহন মুখার্জি মলয় রায়চৌধুরী প্রদীপ দাশগুপ্ত বাইরে পোর্টিকোয় বেরিয়ে দ্যাখে গেটের কাছে হকিস্টিক সাইকেল চেন লাঠি নিয়ে মারপিট চলছে দু-দল কর্মীর । চন্দ্রকেতু সিং-এর রাজপুত-ভূমিহার গ্যাঙের সঙ্গে তফসিলি গ্যাঙের । ইউনিয়ান নেতা ছিল চন্দ্রকেতু সিং, বছর চারেক, কলকাতা থেকে বদলি নিয়ে আসার পর, কলকেতিয়া স্লোগানবাজি দলাদলি ল্যাং-মারামারি চুকলি শিখে কুরমি কায়স্হ আর গোয়ালারা ওকে ঠেলে ওরই চেলা বেচয়েন লালকে ইউনিয়ান নেতা বানিয়ে ফেলেছিল । মারপিটটা এইজন্যে যে একজন দুসাধ কেরানি নিজেকে রাজপুত হিসেবে পরিচয় দিয়ে চন্দ্রকেতুর গোপন মিটিঙে যোগ দিত, তা ফাঁস হয়ে গেছে । রামচিজ সিং, দুসাধকে, ধোলাই দেয়া আরম্ভ হতে, লাঠিসোঁটা নিয়ে বেরিয়ে এসেছে সবাই, দু-দলের পালোয়ানরা ।

–ওঃ, কী করে এমন একটা অসভ্য দেশে থাকেন । মুখার্জি সায়েব কোঁৎ পাড়েন । চলন্ত মারপিটের মাঝ দিয়েই ওনার গাড়ি বিমানবন্দর যাবে ।

–গেটের বাইরে ওসব, চিন্তার কিছু নেই স্যার ।

–অনেক বাঙালি পরিবার নাকি বিহার ছেড়ে চলে যাচ্ছে ।

–হ্যাঁ, দিল্লি লখনউ মুম্বাই আর তা না হলে পশ্চিমবঙ্গ ।

কথাটা সত্যি, অতনুর মনে হল । গঙ্গাভিলার ছেলেরা চলে গেছে । লঙ্গরটুলির রায়রা । নাগ ডাক্তার । রেডিও টিউটোরিয়ালের বাঁড়ুজ্জে । সমরেণ চক্রবর্তী আর ওর ভাইরা । জীবনময় দত্ত আর ওর বউ, কলকাতায় সাহিত্য করবে বলে । গরদানিবাগ, চাঁইটোলা, লোদিপুর, কংকরবাগ থেকে, পরিবারের পর পরিবার । বাঙালির প্রিয় মাছগুলোই আর আসছেনা পাটনার বাজারে । এখানের জাতপাতের লড়াইতে বাঙালিরা কোন দিকে, নাকি যে যেমন জাতের সেই দিকে যাবে কিনা নির্ণয় নিতে পারছে না বলে পালাচ্ছে । ইসকুলগুলোয় আর বাংলা পড়ানো হয় না । সরকার বাংলা টেকস্টবুক ছাপায় না । বাংলা শিক্ষক নিয়োগ করে না । হিন্দিতেই বাড়িতে কথা বলা আরম্ভ করে দিয়েছে বহু বাঙালি পরিবার । বাংলা অ্যাকাডেমির সভা হলে বাইরে পানের দোকানে দাঁড়িয়ে হিন্দিতে কথা বলেন কোনো-কোনো সদস্য । বিহার ছেড়ে পালাচ্ছে বাঙালিরা । যাদের জো নেই তারা ভাগলপুরের বাঙালিদের মতন স্হানীয় সংস্কৃতিতে মিশে যেতে বাধ্য । সাংস্কৃতিক চাপ থেকে চাগিয়ে ওঠা দুঃখের খতিয়ান রাখে না কোনো ভূভাগের ইতিহাস । মিলিয়ে যায় হরপ্পাবাসী বা মিশরীয়দের মতন।

মারামারির মধ্যে দিয়েই এগোলো অফিসের গাড়ি, মুখার্জি আর রাঘবকে নিয়ে । একাধজনের মাথা ফেটে গেছে, জামায় রক্ত, তেড়ে হিন্দি গালাগাল চলছে । গাড়ির কাঁচ তুলে না দিলে পটল চিংড়ি গোবিন্দভোগ উগরে দিতেন মুখার্জি ।

‘জায়গাটা বড্ড ড্রাই’, সুটকেসে কেবিন ব্যাগেজের টভাগ বাঁধতে-বাঁধতে বিমানবন্দরে বললেন মুখার্জি । বখশি৯শের নিয়মমাফিক লোভে ড্রাইভার রমাকান্ত দাঁড়িয়ে ছিল কিছুক্ষণ, পেল না । মুখার্জি সিকিউরিটি চেকে সেঁদিয়ে গেলে, রাঘব বেরিয়ে আসছে, রমাকান্ত’র উষ্মা, ‘স্যার, লোকটা লুচ্চা, পর-পর তিনটে রবিবার নৌকোয় মেয়েমানুষ নিয়ে ফুর্তি করেছে গঙ্গায় ।’

‘তুই কী করে জানলি ?

‘আমার ট্যাকসি করে ঘাটে গিসলো ।’

গাড়লের মতন কাশতে পারে এমন একটা সাত গ্যারেজের তেল খাওয়া ট্যাকসি কিনেছিল রমাকান্ত । অফিসের নতুন গাড়ি থেকে কলকব্জা মায় টায়ার চালান হয়ে গেছে তাতে । ঘাঁটালে, রমাকান্ত মুরমু ওর ঝাড়খণ্ডি বেরাদর দিয়ে চটিয়ে দেবে মজদুর ইউনিয়ানকে, আর অফিসের মারাঠি ম্যানেজার রাঘবকে বলবে তুমি ট্যাক্ট জানো না । ট্যাকসিটা রমাকান্ত’র ছেলে ছিরিকান্ত চালায়, এটা-সেটায় লাগে । রাঘব সত্যিই অবাক পেল নিজেকে, ওর ছেঁদো খুচরোর লোভ দেখে, বলে ফেলল, ‘কেন, ভদ্দরলোকদের নুনু হয় না বুঝি ? যতো নুনু বাঞ্চোৎ ফুটপাতিয়াদের । জিভের আড় থেকে সৈন্যজওয়ানদের বিটিং দি রিট্রিট হয়নি আজও । সুবেশ মধ্যবিত্ত বাঙালি চোস্ত হিন্দি গালাগাল আরম্ভ করলে থম মেরে যায় বাতাস ।

বিমানবন্দর থেকে ফেরার সময়ে অফিসবাড়ির পেছনের গলিতে ঢোকার মুখে চায়ের দোকানে স্যাঙাতদের সঙ্গে চন্দ্রকেতু সিং, মাথায় ব্যাণ্ডেজ । ‘সব মিটমাট হয়ে গেছে তো ?’ গাড়ির জানলা দিয়ে মুখ বের করে রাঘব জিগ্যেস করায়, চন্দ্রকেতু জবাব দ্যায়, ‘আরে গান্ধিজি বেঁচে থাকলে এসব আম্বেদকরাইটদের রাস্তা মাপিয়ে দিতুম ।’

ভেতর, চটের পর্দার আড়ালে, তিন পাত্তির জুয়া খেলছে কয়েকজন কেরানি নোট-পরীক্ষক আর চতুর্থ শ্রেণির কর্মী ; জুয়া খেলায় শ্রেণি বিভাজনের পাঁচিল হয় না । বোর্ড মানি নেবে বলে, বাঁশের বেঞ্চের ওপরে ঠ্যাঙে ঠ্যাং তুলে বসে আছে চন্দ্রকেতু ; বালিয়া জেলায় ওর বাপের দোশো একর ধানজমি আর পঞ্চাশ একর গ্যয়েরমজরুয়া জমি রেখেছে দখলে । পাটনায় রাজেন্দ্রনগরের একতলা  ফ্ল্যাটের চারপাশে বেড়া তুলে সরকারি জমিতে মোষ পুষেছে । দুধ আর ঘুঁটে বেচে । অফিসে কাজটাজ ছোঁয় না । বললে, ‘হেঃ হেঃ, ইউনিয়ান কা কাম, জানতে হি হ্যাঁয় ।’

ফ্ল্যাটে ফিরে রাঘব জানতে পারল, ঝিয়ের চোদ্দ বছরের মেয়েটা, যাকে ওর বাপ পরশু শশুরবাড়িতে পৌঁছে দিয়ে এসেছিল, আজ সকালে তার লাশ পাওয়া গেছে, কোইলওয়র নদীর বালিতে পোঁতা । পুলিশ তার শশুর আর খুড়শশুরকে গ্রেপ্তার করেছে, বলাৎকার, খুন আর লাশ লোপাটের চেষ্টার দায়ে । মেয়েটার বাপ-মায়ের আছাড়ি-পিছাড়ি কান্নাকাটি চলছে রাঘবের কোয়ার্টারের দোরগোড়ায় ।

রাঘব : ছোটোবেলায় কতবার গেছি কোইলওয়র চড়ায় পিকনিক করতে ।

রমা : কই, আমায় নিয়ে যাওনি তো কখনও !

 

 

Leave a comment

Filed under উপন্যাস

দুই

ঢ্যাঙা ময়লা দোহারা গোলমুখো রাঘব । বেহেড রাম টেনে পেশী গলছে, রক্তে চিনি অবশ্যম্ভাবী, হিসিতে পিঁপড়ে লাগতে শুরু । টুকলি-স্নাতক বলে ওর ছুটির দরখাস্ত, ফিনাইল সাবান ঝ্যাটা ডাসটার সোয়াইপার ন্যাপথালিন, মানে অফিসকে ঝকঝকে রাখার জন্য যাকিছু দরকার, তার আর্জি, যা আগে অতনু লিখে দিত, এখন রমা লেখে । পদাতিক জওয়ানের ওপর যুদ্ধ লড়ার ভার দিয়ে তাঁবুতে আয়েশ করেন ব্রিগেডিয়ার ।

অতনু : টাকা গোনার কেরানিগিরির চেয়ে ঢের ভালো কাজ এই মেথর-ঝাড়ুদার খ্যাদানো ।

ন্যাতানো হিলহিলে সাতবাস্টে পোকালাগা ঝিমিয়ে-পড়া তেলচিটে নোংরা নোটের পাহাড়-ঘেরা উত্যকায় বসে একনাগাড়ে বিচলিত হবার চেয়ে, ও-কাজ অনেক আরামের । নোটের মাঝখানে বসলেই টেনশান । রক্তে গিরগিটি সাঁতরায় । তলপেটে পাঁকাল মাছ কিলবিল করে । প্রথম দিকে তো ঘুমই হতো না ।

রাঘব : শুধু ঝাড়ুদার খ্যাদাই কে বললে আপনাকে ? বেসমেন্টে ফুটবল মাঠের মাপে যে ভল্টটা আছে, দেখেছেন ? চারপাশে আয়না-লাগানো এনটার দ্য ড্র্যাগন করিডরে রাইফেলধারী প্যারামিলিটারি চব্বিশ ঘণ্টা ? আমাকেই খেয়াল রাখতে হয় । সিকিউরিটির অ্যালার্ম বেলের পাগলা ঘণ্টির মহড়ার সময় দেখেছেন ? সবচেয়ে বেশি ছোটাছুটি করতে হয় এই রাঘব বোয়ালকে ।

আগ্রহ নেই বলে দেখেনি অতনু । কী আর এমন আছে দেখার ! কর্মচারীরা ইচ্ছে করলে নিজেদের জরুরি কাগজপত্র দলিল-দস্তাবেজ গয়নাগাটির বাকসো সিল মেরে রাখতে পারে ওখানে, বিনে খরচে । অন্য কোথাও লকার নিতে হবে না । ইনকাম ট্যাক্স সেলস ট্যাক্স সিবিআইরা অতর্কিত হানায়, যা আজকাল আখছার বলে অ্যাকাউন্টস অফিসার বিরক্ত, যে সোনাদানা হিরেমুক্ত পাউণ্ড ডলার ইউরো থাক-থাক নোট পায়, পেল্লাই কালো-কালো তোবড়ানো ট্রাঙ্কে ভরে, ফেলে রেখে যায়, হাভাতে প্যাংলা জনাচারেক দিনমজুরের কাঁধে চাপিয়ে । সহজে ফয়সালা হয় না সেসব কেসের, পড়ে থাকে বছরের পর বছর । কালো প্যাঁটরার ওপর জমতে থাকে কালো প্যাঁটরার পাহাড় । অ্যাকাউন্টস অফিসার চেঁচায়, ‘বাঞ্চোতগুনো সুইস ব্যাঙ্কে রাখলেই পারতো, নিজের বাড়িতে কেন যে লুকিয়ে রাখে ।’

ব্যাপারটা দেখার অনুসন্ধিৎসায় সুশান্ত একটা ফাঁকা চুরুট বাকসো, ওর জ্যাঠার, চটে মুড়ে সিল করে রেখে এসেছে । ননীগোপাল বসু সেদিন ভল্টের বিঘত লম্বা চাবির গোছা ঝুলিয়ে, নাকে রুমাল বেঁধে, পচা টাকার গোটা পঞ্চাশ বস্তা পোড়াতে নিয়ে যাবার জন্যে বের করছিলেন, সুশান্তকে বললেন, ‘বাঃ, এই বয়সেই গুছিয়ে নিয়েছ বেশ ।’

পাটনা শহরে যেবার বন্যার কোমর-উঁচু জল ঢুকেছিল, বেসমেন্টের নতুন-পুরোনো সব নোট গলে হালুয়া হয়ে গিয়েছিল তিন দিনে । চরম ক্ষতি হয় রাম ইকবাল সিং হিন্দি অনুবাদকের । নেপাল থেকে দু’কিলো ভালো জাতের আফগানি চরস এনে রেখেছিল, ঠাকুরের গয়না বলে ।

ননীগোপালবাবুর কাজটা উচ্চপদ্সহ মুদ্দোফরাসের । দিনের পর দিন নাকে রুমাল, টাকে তোয়ালে, অলস দুপুরের টাক-ঝলসানো রোদে,  চুল্লির জানলাফোকর দিয়ে, গুণে-গুণে অগুনতি বিষাক্ত বাণ্ডিল ফেলা, কেরোসিন ছিটিয়ে আগুন ধরানো, দাউ-দাউ ওব্দি শিমুল গাছের ছায়ায়, উনুনবাড়ির চুল্লির খিড়কিতে তালা দেয়া, তালা টেনে দেখা, পরের দিন সকালে এসে ছাই খুঁচিয়ে পরখ কোনো নোট বেঁচে আছে কিনা । সে-সময়ে ময়লা নোটের শ্বাসকষ্টে ঠাস করে ফেটেছে, ননীবাবুকে অবাক করে, শিমুলের উদাসীন বিগতযৌবন তুলোকৌটো ; মুহূর্তখানেকের জন্যে ননীগোপাল-যন্ত্রকে খোকাপুরুষে পালটেছে  বসন্তঋতুর ইয়ার্কি ।

হেডঅফিস থেকে উড়ো খবর এসেছে যে নোট পোড়ানো বন্ধ করে এবার নোটের পাল্প তৈরি হবে আর তা থেকে কাগজ তৈরি হবে । পাল্প তৈরির মেশিন বসবে কয়েকটা সরকারি কেন্দ্রে । সেখানে চালান যাবে বস্তাভরা পচা নোট ।

চুল্লিটার দেয়ালে এক অবিবেচল অশ্বথ্থগাছ, পাত্তা না পেলে এসব গাছগাছালির যেমন হয়, হু-হু বেড়ে চলেছে, কেউ ওপড়াতে চায়নি । এখন কাটতে কারোর সাহসে কুলোয় না, কাটলে বংশরক্ষা হবে না । রাঘব খুঁজে-খুঁজে কাহার কুর্মি দুসাধ মুসহর চামার হাজাম পাশি ডেকে এনেছে । তারপর শিয়া সুন্নি কুরেশি বোহরা আহমেদিয়া শিখ খ্রিস্টান কাঠুরে ছুতোর বা কসাই । ‘হায় বাপ, পিপল,’ বলে পালিয়েছে সবাই ।

‘রাঘববাবু, ইউ ক্যান নট কাট ডাউন দি পিপল,’ বাঁ হাত দিয়ে ডান কান থেকে রুমালের খুঁট তুলে বলেছেন ননীগোপাল, অনেকের মতে কমরেড ননীগোপাল ।

ননীবাবুর এই অনুমান যে যতদিনে জোয়ান গাছটা চুল্লিটাকে খাবে, ততদিনে অবসর প্রাপ্তি ঘটে যাবে ওনার, কপালের ওপর আব বেড়ে আলুর মতন হয়ে গেলেও ক্ষতি নেই । ধারণাটা ঘা খায়, চুল্লিটার ওপর প্রচণ্ড বৃষ্টির রাতে লকলকিয়ে বাজ পড়লে । অশথ্থ গাছটা জাগ্রত প্রমাণ হওয়ায়, কর্মচারী অফিসার ফিরিঅলা দালাল সবাই সেলাম ঠোকে গোড়ায় । বেচয়েন লাল সেখানে পয়সা ফেলার বাকসো রেখেছে কোঅপারেটিভ ক্রেডিট সোসায়টি আর কোঅপারেটিভ স্টোরের সিংকিং ফাণ্ডের জন্য । রাণা রামদেও সিং কোঅপারেটি স্টোরের সচিব থাকাকালে, তালের টিন গুঁড়োদুধের টিন জ্যাম জেলি স্কোয়াশের বোতল ইঁদুর আরশোলা আর মাকড়সায় খেয়ে ফেলেছিল । অডিটাররা বিশ্বস করেছে রানা রামদেও সিং-এর বক্তব্য ।

মুখার্জি এসেই বেচয়েন লালের বাকসো সরাতে চেয়েছিলেন । হেডঅফিসে ফ্লপিতে লিখে নোট পাঠিয়েছিলেন, কুরিয়ারে, তখন ইনটারনেট বসেনি পাটনা অফিসে । যাবার দিন গাছটার গোড়ায় সশ্রদ্ধ প্রণাম জানিয়ে একটা পাঁচশো টাকার নোট ঢুকিয়ে গেছেন বাকসোটায় । উনি যেসব অখদ্দে নোট পাস করেছেন, সেগুলো পুড়ে নষ্ট হবার পরই ধ্বসেছে চুল্লিটা । আসছে মাসের ছাব্বিশ লাল পেনসিল হাতে তারিখে অডিট পার্টি এসে পড়বে ।

রাঘব : ননীদা তো স্বেচ্ছা অবসর নিয়ে নিলেন গো । সোনালি করমর্দন । গ্র্যাচুইটির টাকায় বাংলাদেশি মেয়ে কিনছেন কোন নোট এক্সচেঞ্জারের কাছ থেকে । হিন্দি মতে বিয়ে করবেন ।

রমা : উনি নাকি ভারজিন ?

রাঘব : হ্যাঁ, বিহারে থেকেও ভারজিন রয়ে গেলেন । আমাকে বিয়ের যোগাড়যন্তর করতে হবে আর সম্প্রদান ।

রমা : যাক, একজন সুপারঅ্যানুয়েটেড জামাই বোনাস ।

রাঘব : গোলমাল হবে না তো ? মেয়েটা বগুড়ার মুসলমান । ঝি-গিরি করে থাকা-খাওয়া কুলোচ্ছিল না, তারপর শরীর বেচত । হিন্দু-মুসলিম দাঙ্গাফাঙ্গা না বেধে যায় ।

রমা : তুমি অত ভিতু কেন ? বাংলাদেশ স্বাধীন করতে যুদ্ধ করতে গিসলে, আর এটুকু সামলাতে পারবে না ? তা ননীদার খর্চাখরচ কেমন পড়ল ?

রাঘব : পনেরো হাজার । দেখতে-শুনতে নাকি দারুণ । ইচ্ছে করে নোংরা সেজে থাকে মেয়েটা, যা শহরের অবস্হাগতিক ।

রমা : ননীদার তো কোনও টেলিফোন আসে না ।  নোটের ছাই ঘাঁটতে-ঘাঁটতে  মড়ার সোনার আঙটি !

বিয়ের রাতে, ক্লার্ক অওয়ধ হোটেলের ব্যাংকিয়েট হলে, লোহার হোমকুণ্ড থেকে হিলহিলে ধোঁয়াক্কারে, লিট্টি, বথুয়াশাক, মেথিফোড়ন-দেয়া খোসাসুদ্দু আলুরসুন, বেগুনের ভরতা, লাউয়ের পায়েস, আটার কাচাউড়ি খেতে-খেতে সুশান্ত আর অতনু থ, স্তম্ভিত, হতবাক, এঁটোহাতে কর্তব্যবিমূঢ় ।

সম্রাট হোটেলে মুখার্জির ঘরে যে মেয়েটি ঢুকেছিল প্রথম দিন, আর অতনুর দেহ  ওর জীবনে অর্গলবর্জিত হতে প্রশ্রয় দিয়েছিল, সেই রহস্যময়ীর নাবাল সুগন্ধ, দুজনের কাঁধে ভর দিয়ে, আলপনা আঁকা পিঁড়ের ওপর, সে এক বিপর্যয় । ওরা দুজনেই মনে-মনে চেঁচাচ্ছিল, যা কেবল ওরা দুজনেই, সুশান্ত আর অতনু শুনতে পাচ্ছিল, “ননীদার কাছে যেও না ; আমরা আওরংজেবের অর্ধেক রাজত্ব দিয়ে দেব ।”

‘আর করলার খোসা শুকিয়ে খাবেন না ননীদা, ঠোঁট দুটো মিষ্টি রাখবেন, বহুমূত্র, সরি, অ্যাঁ, ডায়াবেটিস সামলাবার বদ্যি তো পেয়ে গেলেন’, প্রশাসন বিভাগের অরিন্দমের মন্তব্যে নিজেদের সামলে ওঠার সময় আর সুযোগ পেল সুশান্ত আর অতনু ; আর সেই ফাঁকে পকেটে বাঁ হাত ঢুকিয়ে তটস্হ ভাব দূর করতে চাইল সুশান্ত, অতনু ধুতির কোঁচায় । ঘাড়ের কাছটা, লাল ব্লাউজের ওপর যেটুকু খোলা, সুশান্ত মনে-মনে সেখানে ঠোঁট চেপে রইল ।

মালাবদল করতে-করতেই, ননীগোপাল ধমকে উঠলেন অরিন্দমকে, ‘অতনু-সুশান্তদের ক্যাশ সাইড থেকে ক্লারিকাল সাইডে বদলির কেসটা চেপে রেখেছিস কেন ?’

চন্দ্রকেতু সিং জানালো, সবাই বাংলায় কথা বলছে বলে, কিছুই টের পাওয়া যাচ্ছে না । ওর রাজপুত ভূমিহার স্যাঙাতরা ওর সমর্থনে হইহই করে ওঠায়, বেচয়েন লাল বাঙালিদের তরফ নিয়ে নিলে তড়িঘড়ি, কেননা এদান্তি ও কমিউনিস্ট নেতা জগন্নাথ সরকারের সঙ্গে ওঠবোস চালু করেছে, ইউনিয়ানের নির্বাচনে বাঙালিদের ভোট টানতে হবে ।

চশমা, বাইফোকাল, পরে যাতে শুভদৃষ্টি করতে না হয়, তাই নরম কনট্যাক্ট লেন্স, বশ অ্যান্ড ল্যাম্বে ধোয়া, করিয়েছিলেন ননীদা । আর তেমন বুড়িয়ে যাওয়া ঘোলাটে ঘোলাটে দেখাচ্ছিল না ; গোঁফে কলপ, ঠোঁটে হালকা লিপ্সটিক, দামি পারফিউম, শ্যাম্পু-করা বুকে আধপাকা চুল, দুবাই থেকে ঝকঝকে জুতো, নেপাল থেকে চিনা-সিল্কের পাঞ্জাবি, ঢাকা থেকে ধুতি, যতোটা দেখন-জোয়ান করে তোলা যায় ।

মামুদ জোহের ওর পুরো নারী-নারকো গ্যাঙ নিয়ে, অসীম পোদ্দার, দেবেন্দর প্রসাদ, মলয় রায়চৌধুরী, শিবু পালিত, সজল, অশোকতরু, কমলেশ, প্রতুল, নরেশ, রবীন দত্ত, পুলক, সুশীল প্রায় সবাই হাজির । সারারাত সে কি নাচ ! দমাদম মস্ত কলন্দর, কোই মুঝে পগলা কহে, দম মারো দম, ডিজের ফাটা রেকর্ড ঝমাজঝম । সবাই টঙ । টাল্লি । টাইপিস্ট বাহাদুর চউবে, কর্মচারীদের দশ টাকায় দশ পয়সা প্রতিদিন হিসেবে ধার দেয় । একপাশে দাঁড়িয়ে নিজেদের দলে মানসী বর্মণ, শ্যামলী কর্মকার, উমা ভর্মা, নয়নিকা জায়সওয়াল আরও অনেকে । দপতরি গুলাব শর্মা, ছোটো জাতে বিয়ে করে আর ফেরত যেতে পারেনি গ্রামে । ভাজপা, ইনকা, ভাকপা, জপা, জদ গোষ্ঠীর অনেকে । দালালরা নতুন পোশাকে । এলাহি ।

দিনভর জোয়ান হয়ে ওঠার অফুরন্ত নাড়িস্পন্দনের দাবদহে ননীগোপাল নিজের সঙ্গে তর্কে ব্যস্ত, চাউনি দিয়ে ঘেরাও । জানলায়, হলদে নরম কলকে ফুলের দুর্বল ডালে, ভোরবেলায়, দোয়েল পাখির বন্দিশ আশ্রিত গান । পৃথিবীতে এর আগে কলকে ফুল দোয়েল পাখি ছিল না । হুড়মুড় কোথ্থেকে এসে পড়েছে বর্ষাকাল । অন্ধকারের অন্দরমহলে নক্ষত্রদের অবাধ গতিবিধি । বার্ধক্যের কাছাকাছি যখন, বিয়ে করে, শৈশবে হারানো বগুড়া ময়মনসিংহ খুঁজে পেলেন তার অপাপবিদ্ধতার গভীরে, সেখানে, সে অতল-গভীরে, রুই মাছের পিচ্ছিল ঝাঁক পাশাপাশি রুপোলি বাসা বাঁধে ।

ননীগোপালের বিয়ের রাতেই কিছুটা অপ্রকৃতিস্হ দেখাচ্ছিল অরিন্দমকে, মদ তো খায়নি ও । তবু কথায়-কথায় ‘না।’ কেউ কিছু না বলতেই, বাসর জাগার মাঝে, ‘না।’ ‘না।’

–এই অরিন্দম ।

–না ।

–কী হয়েছে ?

–না ।

–আরে, কী হয়েছে ?

–না ।

–যাঃ ।

–না ।

–ইয়ারকি রাখুন তো ।

–না ।

–বোকা নাকি !

–না ।

–নাটক বন্ধ কর দিকিনি ।

–না ।

এক্কেবারে মাথা খারাপ হয়ে গেল শুমুলতলা থেকে ফেরার পরই । ওর মামা চালান করে দিলেন কলকাতার লুম্বিনি পার্ক । ‘কেমন যেন অসংলগ্ন কথাবার্তা বলছিল এদান্তি, তোমরা কিছু জানো ?’ পাশের ফ্ল্যাটের তিরিশোর্ধ গৃহবধুর সঙ্গে অফিস পালিয়ে দুমদাম দুপুর কাটাচ্ছে, জানত ওরা । বলল, সুশান্তই বলল গোবেচারা মুখে দুশ্চিন্তার অভিনয় টাঙিয়ে, ‘না, আমাদের তো কিছু বলেনি ও।’ অরিন্দমের থেকে সাত বছর বড়ি পীনোন্নত মহিলা আসল কাজটা করতে দিচ্ছেন না, অথচ চলছে দুবছর, মুখ আর আঙুল দিয়ে পারস্পরিক যেটুকু হয় । শেষ হাসিখুশি ছিল অরিন্দম শিমুলতলার ক’দিন । তারপর আবিষ্কৃত হয় লুঙ্গি গেঞ্জিতে মোগলসরাই স্টেশানে । নতুন টাকার ষোলোটা প্যাকিং বাকসো বেনারসে স্টেট ব্যাঙ্কে পৌঁছে ফেরার সময় শিবু পালিত ওর কাঁধে হাত রাখতেই, ‘না’। ব্যাপার কী জানতে চাওয়ায় একদলা থুতু বাঁ হাতের তেলোতে নিয়ে কপালে ছপ । সেই কবে বাবা মারা গেছেন অরিন্দমের । বোনের বিয়ে হয়েছে আকাশবাণীর এক গায়কের সঙ্গে । মা আর ছোটো ভাই ।

অরিন্দমের মামার বাড়ির বাইরে বেরিয়ে, গেটের কাছে, ‘পাশের ফ্ল্যাটেই চলছে দু’বছর অথচ ওর মা কেন টের পাননি ?’ প্রশ্নের মধ্যে প্রমেথিয়াসের মতন মুকখু হয়ে উঠতে চাইছিল অতনু ।

শিমুলতলায় ইউনিয়ানের হলিডে হোমে হুড়দংগ । অতনু সুশান্ত মৌলিনাথ অরিন্দম । রাত্তিরে পাথুরে পথে জোনাকি-ওড়ানো অন্ধকার বুনো বাতাসে চারজন উদোম উলঙ্গের লাট্টুপাহাড় জয় । দুপুর পাহাড়ি নদীর জলের তলায় ডুবে জলেতে কেবল উচ্ছৃত শিশ্নটুকু ভাসাতে, মৌলিনাথের ওয়াটার অর্কিড দর্শণ আর চিৎকার । জলে কিছুতেই নামতে চাইছিল না গৌর-গা মৌলিনাথ । অরিন্দম কালো, শৈশব থেকে সর্ষের তেল মালিশ-খাওয়া চিকনত্বক কালো, নার্ভাস হলে নাক খোঁটে ।

‘চেহারা তো কয়লার খাদান, কী করেই বা মেয়েমানুষটা হ্যাণ্ডল করছে আপনাকে,’ অরিন্দমের ভাসমান শিশ্নকে উদ্দেশ্য কে ক্রুদ্ধ মৌলিনাথ, মোটা কাচের চশমায় খুদে-খুদে চোখ । অফিসে বসে দুপুরের লাঞ্চ-খাওয়া হাই তুলতে গিয়ে রেটিনা ফ্র্যাকচার । ভর্তির পরীক্ষায় কেরানিদের তালিকায় শীর্ষে ছিল মৌলিনাথ । রমা ব্যানার্জির জন্যে রাঘবের সঙ্গে অসম প্রতিযোগিতায় নেমেছিল রোগা পাতলা কালো অরিন্দম । অরিন্দম জিততে-জিততে ছেড়ে দিলে । পাশের ফ্ল্যাটে ততদিনে বগলকাটা ব্লাউজের খাঁজ নামতে নামতে করাঘাতের আওতায় ; সন্দেহের অতীত তখন হয়ে চলেছে জীবনের সার্থকতা ।

–ননীদার বউয়ের নাম জানেন নাকি ? মৌলিনাথ প্রসঙ্গ পালটাতেই জলের তলা থেকে শেকড়ের ঝুরিসুদ্ধ উঠে এসেছিল তিনটে তিন রঙের অর্কিড ফুল ।

–সুলতানা, সুলতা বলে ডাকেন ননীদা ।

–তুই কী করে জানলি ?

–রাঘব নেমন্তন্ন করেছিল ওনাদের ।

–ননীদার বউ কি শাড়ি পরে না শালোয়ার ?

–শাড়ি, শাড়ি । তোর প্রেমিকাদিদির মতন ল্যাংটো থাকবে নাকি, ঠিক দুকুরে !

–না, মানে…

–ননীদার কিন্তু উচিত ছিল আমাদের ফিইস্ট দেয়া ।

–তারপর আপনি ঢুকে পড়ুন ওনার হেঁসেলে ।

–ঢুকতে দিলে ঢুকব ।

–ছুঁচ যখন ফাল হয় তখন ছুঁচের কষ্ট কেই বোঝে না ।

–শাল্লাহ ।

চানটান করে ফেরার পর গায়ে, মানে চুলহীন বুকে, আর ভাতখোরের সদ্যনতুন নেয়াপাতিতে পাউডার মেখে, হলিডে হোমের গাড়িবারান্দার সিঁড়িতে বসেছিল, পরিপাটি চুল, কাঁধে পৈতে, স্মৃতির ধোঁয়াটে এলাকায়  ঘুরছিল এক মনে অরিন্দম । মৌলিনাথ বেশ কিছুক্ষণ যাবত অরিন্দমের খোলা পিঠের বাঁ দিকে আলতো ঘুষি সহযোগে, ‘প্রেম করা হচ্ছে ! পরকীয়াবাজি ! অ্যাঁ ?’ বড়বড় করে যাচ্ছিল অবিরাম । আচমকা খেঁকিয়ে অরিন্দমের ককিয়ে ওঠা, ‘কী হচ্ছে কী, লাগে না নাকি !’ শিশুরও লা্বে না এমন আদর-ঘুষি, ওরা তিনজন স্তম্ভিত, বিব্রত । চুপচাপ ।

গলা খাঁকারি দিয়ে অতনু, ‘যাই, দাড়িতা কামিয়ে আসি’, আর সঙ্গে-সঙ্গে সুশান্ত, ‘চল, আমায় একটা শ্যাম্পুর স্যাশে কিনতে হবে।’ রাস্তায় রাস্তায় ফ্যা-ফ্যা শেষে সন্ধে নাগাদ ফিরে এসে ওরা দুজন দেখল, কাঠের বাসন্তী আঁচে সুস্বাদু খরগোশ ঝলসাচ্ছে মৌলিনাথ আর অরিন্দম, লোহার শিকেতে ন্যাকড়ামোড়া দুটো দিক বাঁ-হাত ডান-হাত করছে । মুখময়, দু-জনেরই, উপশমহীনতার আভা । চোখে-মুখে নগর জিয়ন উপভোগের করুণ ও দয়নীয় আনন্দপ্রবাহ । খেতে-খেতে, খাবার পর, শুতে যাবার সময়, কেউ কোনও কথা বলেনি । সকালে মিটকি মেরে পড়ে থেকে চারজনেই দেরিতে একে-একে উঠেও কথাবার্তা না-হওয়ায়, সুশান্ত চেঁচিয়ে উঠেছিল, ‘শিমুলতলা তো দেখা হয়ে গেল । আর কী ? ফেরা যাক তাহলে ।’ ও, সুশান্ত, নিজের ব্যাগ গোছানো আরম্ভ করলে, অরিন্দম মৌলিনাথ অতনুও দেখাদেখি ।

মনের মধ্যে বিতর্কিত মতান্তর চলছিল চারজনের । যে যার নিজের ।

মৌলিনাথ : কোথ্থেকে এই পাতিপুরুষ নোটগুনিয়েদের পাল্লায় পড়লুম । না আসলেই ভালো ছিল । চারদিনের ছুটি নষ্ট । ঘোরাঘুরি আর খাওয়া । বই নেই কাগজ নেই টিভি নেই । পড়াশুনা করে না, গবেটের দল । ছ্যাবলামি আর নোংরামো । ভদ্রতা নেই, আদর্শ নেই, চিন্তা নেই । অফিসে চারদিনে অনেক কাজ জমে যাবে । অ্যাকাউন্টেন্ট মিত্র সায়েব হাসি-ঠাট্টা করবেন । জ্যোতিন্দর প্রসাদকে বলে আসা হয়নি । তাড়াহুড়োয় ছুটির দরখাস্তটা কমরেড এ কে সিনহাকে দিয়ে এসেছিলুম ।

সুশান্ত : জায়গাটায় কোনো ব্যবসার জিনিস কালেক্ট করার সুযোগ নেই । এটা এক্কেবারে ট্যুরিস্টদের স্বাস্হ্য ফেরাবার আড্ডা । প্রেমিক-প্রেমিকা টাইপের ছেলে-মেয়েও রয়েছে, কনডোম তো গেস্টহাউসেই গোটাদশেক পড়ে থাকতে দেখেছি, নানা রঙের । প্রেমের আবার রঙও হয় । দুধের মিষ্টি এখানে প্রচুর হয় বটে, কিন্তু তা পাটনায় নিয়ে গিয়ে বিক্কিরি লোকসান । ফলটল বাইরে থেকে আসে । লর্ড কর্নওয়ালিসের পেয়ারের জমিদারদের স্বাস্হ্য ফেরাবার কিংবা মোসাহেব সঙ্গে নিয়ে মাগিবাজি করবার বাগানবাড়িগুলো ভেঙে পড়ছে, প্রোমোটারদের নজরে এসেছে মনে হচ্ছে । কয়েকটা পালটে গেছে হলিডে হোমে, যদ্দিন টেকে, ধ্বসে না পড়ে । হোমগুলোর জন্যে মদের দোকান চলছে । আরেকটু খোঁজখবর করা যেত । ভেস্তে দিলে অরিন্দম আর মৌলিনাথ । পরে কাকার সঙ্গে আসব একবার । মা-বাবারও ভাল্লাগবে জায়গাটা । আসাম থেকে এক ট্রাক আনারস আনার জল্পনা করছিল কাকা । কদ্দুর এগোলো কে জানে।

অরিন্দম : আমার অবস্হা তো কেউ আর বুঝবে না । মিথ্যে নিয়েও কী গভীর সম্পর্ক গড়ে ওঠে । অসহ্য । এই দুর্গতি থেকে আরোগ্যের উপায় নেই । অথচ জীবনে বিরুদ্ধে আমি কিছুই করিনি । পালাতে হবে । দুঃখের নিজস্ব আনন্দ থেকে পালাতে হবে । কোথায় যাব ? নিঃশ্বাস ধরে রাখার ক্ষমতা আর আজ আমার নেই । পালানো কি নৈতিক বিজয় নয় ! ধাতানি খেয়ে গড়াতে-গড়াতে মানুষ নিজের ঠাঁই টের পায় । জানাজানি হলে আত্মহত্যা ছাড়া উপায় নেই । কী ভাববেন মা ? না । না । ছেড়েছুড়ে চলে যাব অন্য কোথাও । কাশি গঙ্গোত্রী হরিদ্বার দ্বারকা রামেশ্বরম । কলকাতায় বদলির দরখাস্তটা মঞ্জুর হয়ে গেলে বেঁচে যেতুম ।  ওখানেও যদি জেনে যায় সবাই ? ফালতু ছেঁদো লোকেরাও ঘেন্না করার টিটকিরি মারার বিচার করার ক্ষমতা পেয়ে যায় । কেন যে এমন একটা বিপদে আটকে গেলুম ! নেকড়েরা কবর খুঁড়ে লাশ খাবে । পাড়াপড়শি সহকর্মী মৌলিনাথ সবাই জুরি । অবুঝ । ওদের নিয়ম-নীতির বাইরে গেলেই প্রতিশোধ নেবে । ওফ ।

অতনু : জায়গাটা সত্যি, পৃথিবীর বোধহয় সব জায়গাই, কেমন যেন ভালো লেগে যাবার ব্যবস্হা করে রাখে । এরা সব নিজের হ্যান নিজের ত্যান নিজের অমুক নিজের তুসুক নিয়ে কাটিয়ে দিলে । আমিও তো, অন্যের কোনও কাজে এলুম না । নিজেরই বা কী কাজে এলুম ? আমার বেঁচে থাকার মানে কি কেবল আমার ? অরিন্দমের প্রশ্বাসেও রয়েছে স্বীকারোক্তি : প্রেম চাই, নারীর দায়-দায়িত্ব চাই না । অবশ্য, একজন মানুষের গোপনীয়তা তার নিজের । কেন কিছু ব্যাপার গোপনীয় ! এটা আসলে একরকমের চুরি । তালা তো আগে তৈরি হয়, চাবি পরে । জীবনে অনেক ঘটনা এমন যে অপরাধ আর বিচারের তফাত থাকে না । পিঠে লাঠি খেয়ে অনুভবের নতুনত্ব আসে । তা নতুন তো বটে !

 

‘–চল, ইস্টিশানে গিয়ে ট্রেনের টাইম দেখে নেব । কোনও না কোনও ট্রেন তো থাকবে । আমি রেজিস্টারে সই করে চৌকিদারের হিসেব মিটিয়ে দিয়েছি ।’ সুশান্ত জানালো ।

স্টেশানে পৌঁছে প্রচণ্ড ভিড় । শ’দুয়েক লোক প্ল্যাটফর্মে । ট্যুরিস্ট নয় । কালো আটপৌরে সাধারণ মানুষ, নোংরা, গরিব, স্নানহীনতার দুর্গন্ধ । অনেকের হাতে ঝাণ্ডা, কে জানে কোন দলের । দূর থেকে দেখা যাচ্ছিল পাটনাগামী ট্রেন আসছে । চুম্বকে আলপিনের মতো ঝুলছে মানুষ, ট্রেনের ছাদে, এনজিনের সামনে । খাটোধুতি, প্ল্যাটফর্মে বসে-থাকা এক বৃদ্ধের কাছে সুশান্ত, তার হাত থেকে ঝাণ্ডাটা চেয়ে নিয়ে, জানতে পারল, গত আট আগস্ট জামশেদপুরে ঝাড়খণ্ড মুক্তি মোর্চার তরুণ তুর্কি নেতা নির্মল মাহাতো খুন হয়েছেন, তার মানে যেদিন ওরা এখানে এসেছিল, সেই দিনই । এরা সবাই পাটনা যাচ্ছে গুসসা অভিযানে ।

ট্রেনের ঢোকা কেবল দুষ্কর নয় অসম্ভব আঁচ করে, হাতের ঝাণ্ডা উঁচু, ট্রেন এসে পড়েছে প্ল্যাটফর্মে, সুশান্ত ঝাণ্ডা উঁচু করে, যত জোরে পারে চেঁচিয়ে উঠল, ‘নির্মল ঞাহাতো জিন্দাবাদ ।’

: জিন্দাবাদ, জিন্দাবাদ ।

: মাহাতোজি অমর রহে ।

: অমর রহে, অমর রহে ।

: নির্মল মাহাতো ।

: জিন্দাবাদ ।

: জিন্দাবাদ, জিন্দাবাদ ।

: নির্মল মাহাতো জিন্দাবাদ ।

: ঝাড়খণ্ড মুক্তি মোর্চা ।

: জিন্দাবাদ, জিন্দাবাদ ।

তাকে ঘিরে-ওঠা ভিড়কে সঙ্গে নিয়ে একটা কামরায়, শোষক আর শোষিতের আবহমান সম্পর্ককে কাজে লাগিয়ে, ট্রেনের কামরায় ঢুকে গেল সুশান্ত । ওরা তিনজন পারল না উঠতে । ছেড়ে দিল ট্রেন । ট্রেন অদৃশ্য হলে স্টল থেকে একটা খবরের কাগজ কিনলে মৌলিনাথ ।

দক্ষিণ বিহার জুড়ে হরতাল । গমহরিয়ার কংগ্রেসি অমরেন্দ্র সিনহা, ডুমারিয়ার বনরক্ষক প্রয়াস পাসওয়ান, আদিত্যপুরের সতীশ শর্মাকে  কুপিয়ে মেরেছে রাগি জনতা । রাঁচি চাইবাসা জামশেদপুর দুমকায় ভয়ে কেউ বেরোচ্ছে না রাস্তায় ।

টিসকোর চামারিয়া গেস্টহাউসের পোর্টিকোয় পৌড়ায়াটের ঝাড়খণ্ডি বিধায়ক সুরজ মণ্ডল আর নির্মল মাহাতো কথা বলছিলেন স্হানীয় দুই সংবাদদাতা এন কে সিং আর সুনীল ব্যানার্জির সঙ্গে । অওতার সিং তারির মায়ের শ্রাদ্ধ ছিল, তাই রাঁচি থেকে আসার সময়ে মোর্চার কর্মকর্তা বাবুলাল সোয় আর শিবাজি রায়ও মাহাতোজির সঙ্গে ছিলেন । সকাল সাড়ঢ নটা নাগাদ দেখা করতে এসেছিলেন ম্যাজিস্ট্রেট টি এন শর্মা । তারপর কালীপদ মাহাতো যে গাড়িটা কিনেছিল, যেটাকে ঝাড়খণ্ড ক্রান্তিরথে পালটে বিহার বাংলা ওড়িশা ঘোরার পরিকল্পনা, সেটার অনুমোদন শেষে পোর্টিকোয় কিছুক্ষণ অপেক্ষা করছিলেন দুজনে । আচমকা ঘঢ়টানি খেয়ে একটা গাড়ি এসে থামতে, পাখির ডানার মতন গাড়ির চারটে দরোজা একসঙ্গে খুলে, দুমদাম তিনজন বন্দুকধারীর সঙ্গে নামে জামশেদপুরের রংবাজ বাহুবলী বীরেন্দর সিং আর তার দুই ভাই পণ্ডিত-পপপু । চিৎকার করে হুকুম দেয় বীরেন্দর, ‘দুটোকে আজকে এখানেই উড়িয়ে দে ।’ দুজন ঠিকেদার সুনীল সিং আর শংকর সিংও দাঁড়িয়ে ছিল পোর্টিকোয় । ভ্যাবাচাকা কাটিয়ে ওঠার আগেই চলতে থাকে গুলি । নির্মল মাটিতে, রক্তে । সুরজ মণ্ডলের ডান হাত এফোঁড় ।

আগের বছর সোনারিতে, নভেম্বরে, বীরেন্দরের ওপর কয়েকজন লোক চড়াও হয়ে খুন করতে চেয়েছিল ওকে । নির্মলসুদ্দু মোর্চার ছ-সাত জনের নামে পুলিশে এফ আই আর করেছিল ও, বীরেন্দর । এও জানিয়েছিল যে সুবর্ণরেখা পরিকল্পনায় নির্মল বাইরের ঠিকেদারদের আনত, প্রায় নিয়মিত । ঠিকেদারির মালকড়ির বাঁটোয়ারায় নাকি গণ্ডোগোল । এদিকে সুরজ মণ্ডল বলছে যে পুরো ষড়যন্ত্রটা সেচ আর সংসদীয় মন্ত্রী রামাসুর পরসাদ সিং-এর, আট বচ্ছর যাবত বিশ সূত্রীর পুরো টাকা, সিংভূমে খরচ করার বদলে নিজে হড়পে নিয়েছে । বীরেন্দর ওর স্যাঙাত ।

তাত আগের বছর, মানে আগের বছরের আগের বছর, গরমকালে, সাহেবগঞ্জের ঝাঁঝিতে, গলায় ঝোলানো নতুন ডুগডুগি বাজাতে-বাজাতে একজন সাঁওতাল যুবকের পেছন-পেছন তীর-ধনুকধারী সাঁওতাল পুরুষ আর খোঁপায় ফুলগোঁজা নারীদের বিশাল মিছিলের ওপর পুলিশ যাণ পড়পড়িয়ে গুলি চালায়, যেন দোলের পিচকিরি নিয়ে রঙ খেলছে, পনেরোটা লাশ পড়ে গেলেও পালায়নি কেউ, কাননা মন্তর পড়ে নাচতে-নাচতে প্রায়-উদোম জানগুরু  ঝাড়ফুঁক দিয়ে হাপিস করার চেষ্টা করছিল পুলিশ আর গুলিগোলার । ঝাঁঝি থেকে দিকুগুলোকে বিঠলাহা করার জন্য গ্রামে-গ্রামে সবুজ পাতা পাঠিয়ে বার্তা পৌঁছে দেয়া হয়েছিল আগেই । কারি-পাহাড়পুর রকসি সবৈয়া কান্দর বড়াকেঁদুয়া জরদাহা পোখরিয়া এসব দুর্গম গ্রামে পুলিশের সঙ্গে ষড় করে দিকুরা মেরে ফেলেছে অনেক সাঁওতালকে । এই তালে, আইনশৃঙ্খলার গোঁজামিলে, উপজাতি এলাকার পাদরি, ফাদার অ্যান্টনিকে গুলি করে মেরে ফেললে পুলিশের দল, সাঁওতালদের ওসকানোর গুরু ঠাউরে ।

গণ্ডোগোলটা আরম্ভ হয়েছিল, জঙ্গল ইজারার ঠিকেদার, কঠের চোরাচালানি দিকু মোতি ভগত আর বনরক্ষক এরিক হাঁসদার হিসসা ভাগ নিয়ে । পুরো যতটা হিসসা হওয়া উচিত, তা পাচ্ছে না, এই উষ্মায় এরিক হাঁসদা বোরিয়া থানায় মোতি ভগতের বিরুদ্ধে এজাহার ঠুকে দিতে, মোতি ভগত থানার সবাইকে তোড়ে করকরে মিষ্টিমুখ করাবার ফলে, ভগত পেল কংগ্রেসের লোকজন, আর হাঁসদা পেল ঝাড়খণ্ড মুক্তি মোর্চা । একদিকে দিকু আর রাষ্ট্র, অন্যদিকে অরণ্য আর উপজাতি ।

 

মৌলিনাথ চশমার পুরু কাঁচ পুঁছতে-পুঁছতে, ‘কবে সেই বিভূতিভূষণের আরণ্যক পড়ে ছিলুম ; আমরা তাহলে আজ কোথায় দাঁড়িয়ে ?’

‘–ভেবে লাভ নেই, ঘুরেফিরে সব বাঙালি পরিবার ওই কথাই ভাবছে।’ অতনু ফুট কাটল ।

অরিন্দম কোনও কথা বলা দরকার মনে করেনি । শিকারের আগে গোখরো যেমন মাথা তুলে ব্যাঙকে অভিবাদন জানায়, কিংবা পুলিশের কবর খুঁড়ে গুমখুন লাশ তুললে মৃতদেহ যেমন নিজের মনে হাসে, ও-ও, অরিন্দম, ‘সকলেই অস্হিরতা্য় ভুগছে’, ভাবল ।

‘আর তো সন্ধে ওব্দি ফেরার গাড়ি নেই, চলুন না, দেওঘর বৈদ্যনাথধাম যাই ট্যাকসিতে,’ মৌলিনাথ প্রস্তাব দিতেই, আশ্চর্য, অরিন্দম সায় দিলে, ‘হ্যাঁ, হ্যাঁ ।

অতনু জানালো, পুকুরের ঠাণ্ডা জলে নামছে এমন সন্তর্পণে, ‘থ্যুৎ, আমি তো ধর্মের কিচ্ছু বুঝি না । নিউক্লিয়ার ফিজিক্স, টিশ্যু কালচার, পিনাল কোড, জয়েসের ইউলিসিসও যা, ধর্মও তাই ।’

অরিন্দম বিড়বিড় করছে দেখে, ফেলে পালানো সুশান্তর উদ্দেশে চাপা ক্রোধে মৌলিনাথকে জানালো, ‘পৈতে আকটা পরি, বিনা মন্তরের, অফিসের শাদা টোয়াইনের, নইলে মা অশান্তি করেন । রামাশ্রে পাসওয়ানকে বললেই নতুন টোয়াইন দিয়ে তৈরি করে দ্যায়, অফিসের ড্রয়ারে স্টক করা আছে । এখন ওব্বেশে দাঁড়িয়েছে । আমি দিগভ্রান্ত থাকতে চাই।’

খোকাবয়ব মৌলিনাথ দেখল ড্যাবড্যাবে, ফিসফিস করে বলা কথায় যে পুইরোনো তাচ্ছিল্য থাকে, বলল, ‘আরে, চলুন, চলুন ।’ মৌলিনাথ অরিন্দমের মধ্যে তুইতোকারি । অতনুর বেলায় বিশেষ মেশে না বলে, আপনি । নিজে থেকে এই প্রথম বাড়ির বাইরে বেরিয়েছিল অতনু । বাবা মারা যাবার পর । অরিন্দম আর ওর বাড়ির খবরাখবর জানলেও, কিছুই জানে না মৌলিনাথের পরিবারের বিষয়ে । বরানগরে ওর আত্মীয়রা থাকেন, হয়তো, বাবা-মাও, কিন্তু দ্যাখেনি কাউকে কখনও ; আলোচনা করে না বাড়ির ব্যাপারে । পাটনায় এসে মেসবাড়িতে, তারপর একটা ঘরভাড়া, এখন অফিসের কোয়ার্টারে । একা থাকে, একা রাঁধে, একা খায় ।

সামনের সিটে অরিন্দম, পেছনে মৌলিনাথ ঢুলছে অতনুর পাশে । ছুটন্ত পিচপথের দুপাশে যত রকমের সবুজ হয়, সোনাঝুরি আকাশমণি মহুয়া সিরিষ আম দেওদার শিশু অর্জুন তমাল আমলকি বট অশথ্থ তাল খেজুর পিয়াল বকুল মাতামাতি করছে, বাতাসের আদর খেয়ে । প্রতিধ্বনি থেকে নিজেকে মুক্ত করে নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে পাহাড়তলি । অতনু ভাবছিল, অরিন্দমকে বলবে, পশ্চাত্তাপ মানুষকে খাটো করে, কিন্তু বলতে পারল না ।

মৌলিনাথ আর অরিন্দম গেল শিবের পুজো দিতে, বাংলা জানা এক পাণ্ডার হেপাজতে । পাণ্ডার দেয়া ধুতি পরে । ওদের জামা জুতো হাতঘড়ি মানিব্যাগ পাহারা দিতে-দিতে সুশান্তর প্রশংসা করছিল অতনু । সুশান্ত কতো অনায়াস ; বেঁচে থাকার এজেণ্ডা সর্বদা তৈরি, মুহূর্ত অনুযায়ী এজেণ্ডা ।

জলপ্যাচপেচে দালানে খালি-পা, গ্যাঁদাফুলের মালা গলায়, চন্দনের তেলক কপালে, আঁজলায় কচি শালপাতার ঠোঙায় প্রসাদ নিয়ে ফিরলে, অতনু জানতে চাইল, ‘কতো গচ্চা গেল ?’ তাইতে অরিন্দম, ‘ঠাকুরদেবতা নিয়ে ঠাট্টা করবেন না ; পৈতেটা দেবতাকে উৎসর্গ করে দিলুম, আর পরব না ।’

মৌলিনাথ বলল, ‘তাড়াতাড়ি ছাড়ান পাবার জন্যে মানত করেছিস তো ? কাটিয়ে দে, কাটিয়ে দে ।’ অরিন্দম প্রতিক্রিয়া এড়িয়ে গেল ।

জামাকাপড় পরে ওরা অনুকূল ঠাকুরের আশ্রমের দিকে, এক্কাগাড়িতে । মৌলিনাথ গলা ছেড়ে দিয়ে, ‘বেএএদনায় ভোওওরে গিয়েছে পেয়ালাআআআ, নি্য়ো হে নিয়ো, হৃদয় বিদারি হয়ে গেল ঢালা, পিয়ো হে পিয়ো…’ । এক্কাচালক মৌলিনাথকে উদ্দেশ্য করে বলল, ‘আশ্রম মেঁ পিনা মনা হ্যায় ।’

গেটের কাছে নামতেই, এক আশ্রমিক যুবক অরিন্দম কে বলল, ‘স্যার, আপনার কানে-কানে একটা মন্তর ফস করে বলে দেব, জীবন জুড়িয়ে যাবে ।’ একটু দূরে নিয়ে গিয়ে, বকুল গাছের ছায়ায়, ছেলেটি অরিন্দমকে বলল, ‘স্যার দশটা টাকা দেবেন, দরকার আছে ।’ দিয়ে দিলে । দিতে গিয়ে মানিব্যাগে রাখা মহিলাটির ফোটোটা বের করে উড়িয়ে দিল কুটিকুটি ।

আশ্রমে ঘুরতে-ঘুরতে, এক বিশাল বাদামি কুঁজউঁচু সাহিওয়াল ষাঁড় পাঁচিল ঘেরা চৌহদ্দিতে দাঁড়িয়ে ছুঁচলো গোলাপি শিশ্ন বের করে পা পটকাচ্ছে দেখে, অরিন্দম হনহনিয়ে আশ্রমের অফিসঘরে পৌঁছে, সামনের প্যাংলা চেহারা চশমাচোখ মাঝবয়সীকে, ‘দাদা, দিয়ে দিন না একটা গোরু, কতো কষ্ট পাচ্ছে প্রাণীটা, ওই তো অত্তো গোরু রয়েছে ওখানে, ওর মধ্যে থেকে দিয়ে দিন না একটা ।’ ওনারা, বৈরাগী কেরানিরা, অরিন্দমের মুখের দিকে বলদ-চাউনি মেলে, নিজেদের সেরেস্তাদারি বাক্যালাপে ফেরত যায় ।

আবার এক্কাগাড়িতে, গানহীন, স্টেশানের কাছে হোটেলে খেয়ে, ট্রেন ধরল ওরা, তখন রাত অনেক । গাড়ির হ্যাঁচকায়, আচমকা রুকে গেল বলে, বাংক থেকে ঝুঁকে মৌলিনাথ জানতে চাইল, ‘কোন স্টেশান রে অরিন্দম ?’ তারপর সাড়া না পেয়ে আবার, কিন্তু জবাব না পাওয়ায় ঝুঁকে বুঝতে পারল সিটে নেই অরিন্দম । সামনের বাংকটায় অতনু বেঘোর । ঝিমুনির মাঝে সহযাত্রীদের কথাবার্তা থেকে কে একজন কাটা পড়েছে  শুনের বাংক থেকে নিচে লাফিয়ে ডাকল অতনুকে, ‘অরিন্দম সিটে নেই, কে একজন কাটা পড়েছে, গাড়ি থেমে আছে বেশ কিছুক্ষণ ।’

‘কী বলছেন কী,’ অতনু হতচকিত, ও-ও নামে লাফিয়ে, চটিতে পা গলিয়ে কামরা থেকে পাথরের ওপর, দৌড়োয় যেদিকে একদল লোক ভিড় করে দাঁড়িয়ে, আর পৌঁছে জোর দিয়ে ঠেলে  ভিড়ে সেঁদিয়ে যায় । বীভৎস । থেঁতো হয়ে গেছে একেবারে । হাত আর মাথা ধড় থেকে আলাদা ।

–সামনেকি গাঁও কি অওরত হ্যায় কোই । খুদকুশি করলি বেচারি ।

রক্তে জবজবে শাড়ি, কাটা হাতে সবুজ কাঁচের চুড়ি, ভাঙেনি, আতঙ্ক আর উদ্বেগ স্তিমিত হলে, লক্ষ্য করে ওরা দু’জন । কামরায় নিজেদের জায়গায় যখন ফিরল, তখনও আসেনি অরিন্দম । গাড়ি ছেড়ে দিল । ওরা নিজেদের মধ্যে অরিন্দমকে নিয়ে বলাবলি করছিল, কিছুটা চাপা উত্তেজনায়, আঁচ করে সামনের বুড়োটে লোকটা, বোধহয় কৃষক, বেশ চওড়া হাতের তালু, পাকানো রোদে পোড়া গড়ন । জানালো যে আপনাদের সাথী বাড় কিংবা বক্তিয়ারপুরে নেমে গেছে । শুনে, বিরক্তি আর রাগ হল দুজনেরই । ট্রেনটা আস্তে-আস্তে ফতুহা স্টেশান পার হচ্ছিল ।

ফতুহা !

এখানে, এই ফতুহায়, দেশ স্বাধীন হবার পাঁচ মাস আগে, তখন বিহারে কংগ্রেস দলের অন্তরিম সরকার, একটা ছুটন্ত মোটরগাড়িকে হাত দেখিয়ে, থামতে বলেছিল একদল পুলিশ । সবাই হিন্দু । ডাকাত ধরতে বেরিয়েছে । গাড়ির পেছনের সিটে কংগ্রেস দলের অধ্যক্ষ আবদুল বারি । দেশ স্বাধীন হলে উনিই হবেন রাজ্যের প্রথম মুখ্যমন্ত্রী । মোহনদাস করমচন্দ গান্ধি পাটনা আসছেন বলে বারি সাহেবের তাড়া । পুলিশ দল জানালো তারা বারি-ফারি কিছু জানে না, আর টেনে হিঁচড়ে গাড়ি থেকে রাস্তার ওপর ফেলেই একাধিক থ্রি নট থ্রি দিয়ে ঝাঁঝরা, ছলনি । মুখ থুবড়ে পড়লেন আর মারা গেলেন আবদুল বারি, শাহবাদ জেলার কোইলওঅর গ্রাম থেকে সবকিছু ছেড়েছুড়ে নুন বানাতে গিয়েছিলেন গান্ধির সঙ্গে । বলেছিলেন, পাকিস্তান-ফাকিস্তান মানি না । লড়াইটা হিন্দু মুসলমানের গোপন ষড়যন্ত্রের কাজিয়া, না রাজনৈতিক হত্যাকাণ্ড, তা কেউ জানতে পারেনি । অ্যাডিশানাল জজ রায়সাহেব পি কে নাগ নামে এক বাঙালির এজলাসে পুলিশগুলোর বিরুদ্ধে মাসকতক মামলা চলার পর, ব্যাস, ভুলে যায় সবাই, সাংবাদিকরাও । বিহারের মুখ্যমন্ত্রীর তখতে বসলেন বিহার কেশরী নামে খ্যাত শ্রীকৃষ্ণ সিংহ, আর শুরু হয়ে গেল জাতপাতের খেয়োখেয়ি । বারি সাহেবের দুই ছেলে সালাউদ্দিন আর শাহাবুদ্দিনকে বারোকাঠা পুসতইনি জমি থেকে খেদিয়ে দিয়েছিল স্বাধীনতার প্রথম প্রজন্মের গুণ্ডারা । ভারতবর্ষের ভিড়ে হাপিশ হয়ে গেছে ওরা, আর ওদের ছেলেমেয়ে ।

অতনুদের বাড়ির কাছ থেকে পুর্বদিকে মাখানিয়া কুঁয়া চাঁইটোলা নয়াটোলা মছুয়াটুলি লঙ্গরটুলি দরিয়াপুর হাথুয়া মার্কেট বাকরগঞ্জ হবে যে রাস্তাটা গান্ধি ময়দানে গিয়ে পড়েছে, সেটার নাম এখন বারি পথ, মুসলমান ভোটদাতাদের জন্য কনসোলেশান প্রাইজ । গান্ধি ময়দানের দক্ষিণে, অতনুদের অফিসবাড়ির বিশাল অট্টালিকা । বারিপথের দু’পাশে সমস্ত ফাঁকা জায়গায় বাঁশের খুঁটি পুঁতে, চট টাঙিয়ে, অ্যালুমিনিয়াম হাঁড়িকুঁড়ির ষষ্টিপূজক ছট মাইয়ার সংসার, ভাত ডাল রুটি আলুসেদ্ধর দোকান, চুলকাটার, তাড়ির, গাঁজার, জুয়ার, তেলেভাজার, খাজা আর বেসনলাড্ডুর, রিকশ আর ঠ্যালা রাখার, বাঁশ আর শালখুঁটির, টিপ-সিঁদুর-চুড়ির পশরা দোকান, নানা দেবীদেবতার মিনিমন্দির ।

বারি পথের সমান্তরাল, গঙ্গার পাশ দিয়ে, পশ্চিমে পাটনাসাহেব থেকে পুবে খগোল ওব্দি এগিয়ে গেছে, দু’পাশে ঝকমকে দোকানপশরা কলেজ বিশ্ববিদ্যালয় হাসপাতাল টাউনহল গোলঘর সাজিয়ে অশোক রাজপথ । সারা পাটনা শহর দেখা যায় গোলঘরের টং থেকে । দুর্ভিক্ষের শষ্যভাঁড়ার হিসেবে তৈরি হয়েছিল মন্বন্তরে, এখনও তাই, গর্ভগৃহে চ্যাঁচালে তেইশবার প্রতিধ্বনি হয় । পায়ে-পায়ে ক্ষয়ে গর্ত হয়ে গেছে গোলঘরের একশো পঁয়তাল্লিশটা দাঁত বের-করা সিঁড়ি । মেরামতের টাকা, ইংরেজরা চলে যাবার পর,  ফিবছর ভাগাভাগি হয় । রাস্তা সারাবার বরাদ্দও তাই । নালি-নর্দমা পড়ে আছে কন্ঠরুদ্ধ হয়ে পচা পাঁকে ; বর্ষায় রাস্তাগুলো নিজেরাই নিজেদের দুর্বিসহ পায় । গান্ধি ময়দানের পূর্ব-দক্ষিণ দিকটা, ফ্রেজার রোড বেইলি রোড ডাকবাংলো রোড বোরিং রোড নষ্ট আর অসহ্য নয় ততোটা । মন্ত্রী আমলা জজ উকিল ঠিকেদাররা থাকে ওদিকে । টিমটিমে হলেও, সন্ধের পর আলো জ্বলে ওদিকের পথে-গলিতে-মোড়ে । বারিপথ তখন প্রায়ান্ধকার, ছমছমে, ক্রমশ ফাঁকা । মাঝে-মাঝে যাত্রী-ঠাশা মিনিবাস, ধাক্কা খেয়ে আর মেরে দোমড়ানো, অটো থেকে ঝুলন্ত বাড়তি যাত্রী, অবিরাম হর্ন বাজিয়ে আওয়াজ দিয়ে আলোর কাজ চালায় ।

বারিপথে কেবল ছটপুজোয় সারারাত আলো জ্বলে, রাস্তার দুপাশে বেআইনি খুঁটি পুঁতে, হুজিং করে ঝোলানো হাজার চিনা টুনির রিমঝিম আলো । ওই একদিনই ঝাঁট পড়ে রাস্তায় । ভোর রাতে সধবার দল উদোম স্নান করবে । কেউ-কেউ পথের ওপর সাষ্টাঙ্গ প্রণাম করতে-করতে ঘাটে যাবে । ছোকরা মাস্তানরা, বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্ররা, ভেঙে পড়ে ঘাটে-ঘাটে বাইনোকুলার হাতে, পারিবারিক বাইনোকুলার, যা দিয়ে বাপ-জ্যাঠাও একই কাজ করেছিল, অজস্র উলঙ্গ নারীর জোয়ান সুঠাম দেখার লোভে । গঙ্গার পাড় বরাবর তাই ঘাটে-ঘাটে তেরপলের পর্দা টাঙানো থাকে মহিলা পুলিশ পাহারায় । ছটের সময় ঠেকুয়া তৈরি হয় ঘরে-ঘরে । চারপাঁচজন পড়শি দিয়ে যায় অতনুদেরও, শক্ত মুচমুচে নরম ঘি জবজবে নানা রকমের মিষ্টি ঠেকুয়া । অনেকদিন ওব্দি থাকে ।

বেলা হয়ে আসছে, কখন পাটনায় পৌঁছোবে কে জানে, নিজের ব্যাগ থেকে একটা ঠেকুয়া মৌলিনাথকে দিয়ে অতনু বলল, ‘অরিন্দমের ব্যাপারটা সুশান্তকে জানিয়ে দেবেন, বাড়ি না ফিরলে কেলেংকারি, সুশান্ত ওর মা আর ভাইকে ম্যানেজ করে নেবে ।’

 

বাড়ি ফেরেনি অরিন্দম । শিবু পালিত ওকে আবিষ্কার করেছিল মোগলসরাই স্টেশনে, খালি-পা, কদিনের দাড়ি, লাল চোখ, চুল উস্কোখুস্কো , উদভ্রান্ত, কিছু খায়নি দিনকতক । ডানায় ঠোঁট গুঁজে ঘুমন্ত পাতিহাঁসের মতন একা । চেহারা দেখে, মনে হয়েছিল শিবু পালিতের, বেঁচে থাকার ইচ্ছের বাইরে চলে গেছে । শিবু ভুলিয়ে-ভালিয়ে নিয়ে গেল পাটনায় । কলকাতায় নিয়ে গেলেন ওর ডাক্তার মামা ; মানসিক রোগের হাসপাতালে ঠাঁই পেল ।

‘পাগল হবার আগে অরিন্দম তোদের ক্লারিকালে ট্রান্সফারের কেসটা হিল্লে করে গেছে তো ? সারা জীবন নোট গুনবি নাকি ?’ একদিন অফিসে এসে বলে গেলেন ননীগোপাল । আর বললেন, ‘রাঘব তো সিকিউরিটি অফিসার হয়ে চলে যাচ্ছে কলকাতা । হেডাপিস থেকে যে আসছে, তাকেই  মুরগি আর ছানার পায়েস খাওয়াচ্ছে রমা । নতুন সব বিভাগ খোলা হবে, তোরা ঝপাঝপ প্রোমোশান পেয়ে যাবি ।’

অতনু নিজেকে নিঃশব্দে বলল, ‘প্রোমোশান নিয়ে কী করব !’

অফিসের নতুন বাড়িটা ননীগোপালের সামনেই তৈরি । তখন গান্ধি ময়দানের রেলিং ছিল না, গেট ছিল না । শুলভ শৌচালয়ের গ্যাস-আলো জ্বলত না, ময়দানের মধ্যে রেলিঙের কিনারঘেঁষা হাঁটা পথে, যার ওপর এখন জগিং করতে বেরোয় হাফপ্যান্ট যুবকেরা । ময়দানের উত্তরে ডুমো-ডুমো শ্রীকৃষ্ণ হলটা হয়নি । আবদুল বারি মারা যাওয়ায়, শ্রীকৃষ্ণ সিং মুখ্যমন্ত্রী হয়েছিল, ভূমিহার । এখন ভূমিহারদের দিনকাল গেছে । উঁচু জাতের রাজনীতিকদের দিনকাল কোনঠাশা হয়ে গেছে । তফসিলিরাই নিজেদের মধ্যে দলিত-মহাদলিত ভাগাভাগি চালাচ্ছে ।

অফিসে নতুন বাড়িতে তৈরির সময়ে, সিমেন্টে গঙ্গামাটি মেশানো হাতেনাতে ধরেছিল ভিজিল্যান্স । ফলে, এগজিলিউটিভ ইনজিনিয়ারে পদোন্নতি পেয়ে মুম্বাই বদলি হয়ে গেছে মারাঠি ক্লার্ক-অফ-ওয়র্কস । স্হপতি, নামকরা, শতকরা একভাগের আধ ভাগ । বেশি নিয়েছিল সিপিডাবল্যুডির রেটের চেয়ে । ব্ল্যাকলিস্টেড ঠিকেদার, নতুন নামে কোম্পানি খুলে পেয়েছিল ঠিকেটা । পুরোনো দপতরবাড়ি থেকে আসবাবপত্র আসার পথে, নতুন বাড়িটায় আসতে-আসতে, দুটো গোদরেজ আলমারি আর একটা গোদরেজ টেবিল, কুণ্ডলিনী জাগ্রত হয়ে প্রাণ পাবার দরুন, মাঝরাস্তা থেকে লোপাট । ননীদার কাছে অনেক পুরোনো গল্পের ডাঁই । চাকরি ছেড়েও অনেক খবর রাখছেন, যা সবাই জানে না । তার মানে ননীদার ওয়ানরুম ফ্ল্যাটে বেশ মুখরোচক আড্ডা জমছে আজকাল । যাবে একদিন, ভেবেও অতনু কুন্ঠিত ।

 

রাঘব-রমা ট্রান্সফার হয়ে, ছলছলে হাসি বিলিয়ে, কলকাতা যাবার পর, শীতাতপ যন্ত্রের হরিয়ানাবাসী ইলেকট্রিশিয়ান, যার এসি পার্টসের দোকান ফ্রেজার রোডে, আর যে ভ্যায়েনচো ভ্যায়েনচো ভ্যায়েনচো ছাড়া কথা বলে না, পদোন্নতি পেয়ে রাঘবের পোস্টে কেয়ারটেকার হয়ে গেল । অফিসটা কেন্দ্রীয় এসি । ড্রয়ারে শাল-সোয়েটার রাখে কেউ-কেউ । বাচ্চার খেলনার মতন থারমোমিটার ঘুরিয়ে-ঘুরিয়ে হিউমিডিটি মাপার এক ফাঁকে মুচকি হাসি বিলিয়ে যায় টাকমাথা সুপারভাইজার, ‘ঝপ করে এগারো ডিগরিতে নেমে গেল।’ বাইরে তখন রাস্তার পিচ গলাচ্ছে গ্রীষ্ম, আর দুপুর বেলার গোঁয়ার রোদ্দুরকে আস্কারা দিয়ে মাথায় তুলেছে সূর্য । শীতাতপ না হলে অতনু-সুশান্তদের ফ্যানের হাওয়ায় নোট গোনা আর বাছাই অসম্ভব । মৌলিনাথ আর অরিন্দমের সে-সুযোগ নেই, ওরা কেরানি ।

রোজ জতো পুরোনো নোট জমা পড়ে, তার মধ্যে থেকে প্রত্যেক নোট-পরীক্ষক কর্মচারীর মাথাপিছু দিনকার বরাদ্দ অনুযায়ী, পচে নোট আর ভালো নোট বাছাই করার কাজ, যাতে পচা নোটগুলো জ্বালানো আর ভালোনোটগুলো বাজারে ছাড়া যায় আবার । অতনু প্রায় ছেড়ে দিয়েছে বাছাবাছি-গোনাগুনির কাজ । সুশান্ত তো একদমই । নারী-নারকো গ্যাঙের সবাই । মহিলারা কেবল গোনে, বাছাই করে, এক মনে, ধৈর্য ধরে । অতনুর মনের মধ্যে এর জন্য একটা খচখচ থাকলেও, প্রায় সবাই যখব সেই কাজ করছে, তখন সৎ হওয়ার অনেক হ্যাঙ্গাম, বেশ বিপজ্জনক । পাঞ্জাবি এক বড়োসাহেব এসে, ক্লোজ সার্কিট টিভি বসিয়ে নজর রাখতে চাইছিল । বেচয়েন বলেছিল, ‘শালা বিজলি থাকে না বলে এসি চলে না অনেক সময়ে, লিফট চলে না, ঘুরঘুট্টি বেসমেন্ট, উনি চলেছেন টিভি লাগাতে ।’

সত্যি, শীতকালে, অফিস ছুটির সময়ে, আলো চলে গেলে, গায়ে-পড়া পুরুষের ইচ্ছাকৃত ধাক্কা বাঁচাবার জন্য মহিলাতরা অনেকেই, দ্রুত টর্চ বের করে নিজেদের কাঁধব্যাগ হাতব্যাগ থেকে, আত্মরক্ষার জন্য । কেউ-কেউ সিগারেট লাইটার হাতে ফ্লোরেন্স নাইটিংগেল । যেমন মানসী বর্মণ, এককালে ওদের বিরাট বইয়ের দোকান ছিল, ননীগোপাল ওর বাবাকে দেখেছেন, রাশিয়ার নেতাদের মতন বপু-হোৎকা আর মোদো-গোলাপি চেহারা ।

শিমুলতলা দেওঘর থেকে ফেরার পরের দিনই, অতনুর সেকশানে ঝপাং শব্দে ডাইস মেশিনে একাধিক গর্ত করে নোট নষ্ট করছিল রসিক পাসওয়ান, চাপরাসি । ব্যস্ততার মাঝে, কর্মরত অতনুর কপালে এসে ছিতকে লাগল রসিকের তর্জনীর কাটা ডগাটা, লেগে, ওর কপালে রক্তের টিপ পরিয়ে, ওরই টেবিলে পড়ল । বুঝে ওঠা মাত্র ও স্তম্ভিত ।  পেট মোচড় দিয়ে বমি উঠে আসছিল আরেকটু হলে । পকেট থেকে রুমাল বের করে প্রায়-নির্বিকার রসিক জড়িয়ে নিলে কাটা রক্তঝরা আঙুলে, আর আঙুলের টুকরোটা দেখাতে গেল প্রধান খাজাঞ্চিকে । সুশান্তকে বলতে ও জানিয়েছিল, ওদের আঙুল-টাঙুল বীমা করিয়ে রেখেছে অফিস । দুর্ঘটনার বিরুদ্ধে বীমা করানো থাকে । আঙুল কাটার অঢেল ক্ষতিপূরণ দিতে হয় । তর্জনীর জন্যে তো মোটা টাকা পাবে । ওর বোধহয় টাকার খাঁকতি, তাই নিজের আঙুল কেটে ফেলেছে নিজেই ।

গরমকালেও রসিকের সর্ষের তেল, শীতকালে শাদা উর্দির কলার তেলচিটে, বর্ষাকালে রবার জুতোর ক্যাঁকোঁ, পানিবসন্তের শ্রীছাঁদ । রসিকের ঘটনার পর অতনু লক্ষ করেছে, সুখচৈতি রাম, হরবিলাস, ট্যাঙোয়া মাহাতো, রামপুজন সিং, খলিল আহমদ সকলেরই একটা করে বা দুটো আঙুল কাটা ।

বিশ্বসভঙ্গের বিরুদ্ধেও বীমা করানো আছে । মানুষের অভাব-অনটনের দুঃখে গড়া মতিগতি । আগেকার দিনে, ইংরেজদের সময়ে,  প্রধান খাজাঞ্চি আসত সরকারের সঙ্গে চুক্তি করে, নোট গোনানো বাছাই আর পোড়াবার জন্যে । সে ভর্তি করত নিজের চেনাজানা নির্ভরযোগ্য লোকজন । এখন টাকাকড়ি পরীক্ষকরা এলডি থেকে ইউডি, উপখাজাঞ্চি হয় । কেউ যদি নোটফোট গেঁড়িয়ে লোকসান করায়, তাই বিশ্বাসভঙ্গের বিরুদ্ধে বীমা । দিনের পর দিন চারধাতরে এত টাকা, পচা গন্ধমাখা টাকার ঢিবি, থাক-থাক টাকা, যে অতনুর ভয়-ভয় করে । ভয়ের বিরুদ্ধে বীমা নেই । মানুষের সম্পর্ক ভেঙে যায় বিশ্বাসভঙ্গের দরুন, তার জন্য তো বীমা হয় না ! হলে, আর দু’পক্ষ মেনে নিলে, অনেক কষ্টের সুরাহা হতে পারত ।

হাতে-হাতে টাকা এত নোংরা কী ভাবেই বা হয়, ভেবেছে অতনু । তুলতুলে হয়ে ওঠে । মানুষের হাতে তো অমন ময়লা থাকেনা, যতো জমে যায় নোটে ! ময়লা, হাতে থাকলেও, থাকে গরিব মজুর কুলি কামিন চাষির চেটোয় । আর টাকা ঘুরে বেড়ায় ধনীর, সচ্ছল মানুষের, হাত ফেরতা । কতো করকরে থাকে যখন নতুন । অন্ধকারের আগল ঠেলে কী দশা হয় শেষে, পুড়ে মরার আগে । একেবারে মানুষের মতন, সারা জীবন নিজের অস্তিত্বে জড়ো করা ময়লা নিয়ে পুড়তে যায় । এতো গাদাগাদা নতুন-পুরোনো টাকা যে ফুটবল মাঠের মাপের স্ট্রং রুমেও বস্তাবন্দী কুলোবে না । বেশ কয়েক মাস আগে থাকতে ক্লায়েন্ট ব্যাংককে জানিয়ে রাখতে হয় যে তারা কতো বস্তা বা বাকসো পচা নোট জমা দেবে অতনুদের ভাঁড়ারে । কবে যে কাউন্টিং মেশিন আর শ্রেডার আসবে, কেবল গুজবই শোনা যায় । তেলচিটে হিলহিলে নোটগুলো তো কাউন্টিং মেশিনে দিলেই ছিঁড়ে পাকিয়ে দলা হয়ে যাবে ।

আইন পালটে, সরকারি খরচ মেটাবার জন্যে, রাজনীতিকদের পোয়াকে বারো করার জন্যে, যতো ইচ্ছে নোট ছাপা যায়, বাজারে ছাড়া যায় । ননীগোপাল যখন চাকরিতে ঢুকেছিলেন তখন বাজারে পাঁচশো কোটি টাকার নোট ঘুরে বেড়াতো । চাকরিতে ইস্তফাদেবার সময়ে তা এক লক্ষ ষাট হাজার কোটিও । বেড়েই চলেছে প্রতিবছর । সব গেছে হিল্লি-দিল্লির নেতা ঠিকেদার আমলা চোরাকারবারী সঞ্চয়চোরদের গবভে । ডাকাত আর বিধায়ক গোপাল সিং । সতবীর সিং, সুরেন্দ্র সিং রাঠি, মোহম্মদ ইলিয়াস, শাহাবুদ্দিন, শ্রীপাল, ধর্মপাল যাদব, হরিশংকর তেওয়ারি, বীরেন্দ্র শাহি, রঞ্জিত, শারদা প্রসাদ রাওয়ত, বিলায়তি রাম কত্যাল, রাজু ভটনাগর, রাজেশ কুমার সিং, মিত্রসেন যাদব, বিনয় কাটিয়ার, নাজির আলি, লটুরি সিং, রমাকান্ত যাদব, রিজওয়ান জহির, দুধনাথ যাদব, পপ্পু যাদব, ওম প্রকাশ গুপ্তা, শমিউল্লা খাঁ, কৃষ্ণকিংকর সিং, রামপাল শর্মা, বাবুলাল তিওয়ারি, মঙ্গলপতি ত্রিপাঠি, সঞ্জয় সিং, বালেন্দু শুকলা, কুঁয়র অশোক বীরবিক্রম সিং, গণপতরাও ধুরবে, জগমাল সিং, রাজকুমার জয়পাল, বীরভদ্র সিং, আবদুল লতিফ, সি এম ইব্রাহিম, পাপ্পু কালানি, হিতেন্দ্র ঠাকুর, মির্জা হাজি মস্তান, ইউসুফ প্যাটেল, করিম লালা, বরদারাজন মুদালিয়ার, দাউদ ইব্রাহিম, টাইগার মেমমন, সুকুর নারায়ণ বখ।ইয়া, সূর্যদেও সিং, আলমজেব, মহেশ ঢোলকিয়া, রমাকান্ত নায়েক, আমিরজাদা সমদ খান, সতীঋ খোপকর, বিনায়ক ওয়াগলে, বিটঠল চভান, থিম বাহাদুর থাপা, চার্চিল আলেমাও — এদের হাতে-হাতে ফিরেছে মোটা টাকার আর পাতলা টাকার নোট ।

অতনুর মনে হয়, ওর নিজের মাইনের টাকা, আর এই সমস্ত গিজগিজে টাকা  এক জিনিস নয় । মাইনে পেলে ও অঙ্ক গোনে টাকায় । এসব পচা নোটগুলোর অঙ্ক যাই হোক, তাদের সংখ্যা গোনে । পঞ্চাশ টাকার একশোটা নোটও যা পাঁচশো টাকার একশোটা নোটও তাই ।

বরাদ্দ ছুটির শেষে রসিক পাসওয়ান কাজে যোগ দিলে, সুশান্ত জানতে চেয়েছিল, কী গো, আঙুলের ঘা শুকিয়ে গেছে তো ? কাটলে কেন আঙুলটা জেনেশুনে।’

–‘নাতনিটার বিয়ে দিলুম । ছুটিও পেলুম, টাকাও ।’ রসিক পাসওয়ান অমায়িক ।

‘–মাইনে তো যথেষ্ট পাও।’ সুসান্তর খোঁচা ।

‘–ছেলেটাকে তো কোথাও ঢোকাতে পারলুম না । প্রভিডেন্ট ফাণ্ড থেকে টাকা তুলে একটা মুদির দোকান করে দিয়েছিলুম । চালাতে পারলে না ।’

‘–তাই বলে আঙুল কেটে নিলে ?’ সুশান্তর বিস্ময় ।

‘–ওই একটাই নাতনি । ভালো দেখে বিয়ে দিয়ে দিলুম ।’

ভালো শব্দটার কী ভাবে খোলোশা হয়, অপেক্ষা করছিল অতনু । হাল ছেড়ে দিতে বাধ্য হয় সুশান্ত ।

‘–কী করব বলুন । ছেলেটা গধহা বেরোলো । এখন ছ’টা নাতিকে মানুষ করতে হবে । লেখাপড়া শিখছে । মাইনের টাকা তো ওদের জন্যেই খরচে ফেলি পুরোটা । ছেলের বউটা শেষ বাচ্চা বিয়োবার সময় বাঁচেনি ।’

‘–ওদের ঠাকুমা আছে তো ?’

‘–হ্যাঁ, আছে বলেই রক্ষে ।

‘মানুষ করা’ আর ‘গধহা’ শব্দ দুটোয় আরেকবার আটকালো অতনু । রসিকের বাড়ি অওরঙ্গাবাদের দরমিয়া গ্রামে, শুনেছে । অনেকে বলে ও থাকে ওয়ারিসআলি গঞ্জে, নওয়াদা জেলায় । দরমিয়া আর ওয়ারিসআলিগঞ্জ দুটোই নকসল্লি মাওওয়াদিদের গঢ়, ক্রান্তিকারী কিষাণ সমিতি জনআদালত বসায় । গত বছর আশ্বিন মাসে ওর ছেলের নামে হুলিয়া বেরিয়েছিল, আর রসিকের খোঁজখবর করতে শাদাপোশাক পুলিশ এসেছিল অফিসে, সুশান্তর কাছে জেনেছে অতনু ।

 

আশ্বিন মাসের সেই সন্ধেবেলা তিরিশ-চল্লিশজনের জামাত পৌঁছেছিল অম্বিকা সিং-এর বাড়ি, ভালা ভোজালি বরছা গঁড়াসা নিয়ে । বাড়ির দালান থেকে  ইন্দ্রদেব-এর ছোটো ভাই ভীমকে কব্জা করে ওকে দিয়েই দরোজায় টোকা দেওয়াতে, অম্বিকার দাদা জগন্নাথ সিং-এর সদরের দরোজা খুলতে বাধ্য করায় । রামলেশ, প্রমোদ, মুরারী আর বারো বছর বয়সী গয়া সিংএর হাত যারা পিছমোড়া করে বেঁধেছিল, রসিক পাসওয়ান তাদের একজন । ভিড়ে একজন, ‘তোদের বাপগুলো কোথায়,’ বলে উঠতেই, শুনতে পেয়ে, অম্বিকা সিং স্ত্রী গাজরদেবীকে একটু উঁকি মেরে দেখতে বলে কী ব্যাপার । গাজরদেবীর হুঁশিয়ারি শোনামাত্র, চালার গোলটালি সরিয়ে পালায়, লুকোয় গিয়ে অড়হর খেতের মধ্যে । অম্বিকা আর জগন্নাথ সিংকে না পেয়ে রসিকের দল রামলেশ, প্রমোদ, মুরারী, গয়া, গাজরদেবী, অম্বিকার মেয়ে গীতা আর জগন্নাথের মেয়ে পুষ্পার মাথা ওখানে দাঁড়িয়ে আলাদা করে দিয়েছিল ধড় থেকে । তারপর ওরা, ঝিঁঝিডাকা জোনাকি-জ্বলা ওই রাতেই, মরদনবিঘায় গিয়ে, বৈদ্যনাথ সিং, অলখদেও সিং আর ওর ছেলের বউ উষা আর বৈদ্যনাথের মেয়ে শকুন্তলাকে ছিন্নভিন্ন করার পর, আওয়াজ দিয়েছিল, ‘রক্তের বদলে রক্ত চাই লাশের বদলে লাশ ।’ আসলে ঠিক সতেরোদিন আগেই, দরমিয়ার ছ-সাত কিলোমিটার উত্তর-পশ্চিমে, পরসডিহায়, উঁচু জাতের লোকেরা, অম্বিকা-জগন্নাথের লেলিয়ে দেবার দরুণ, বন্দুকের গুলি মেরে ষাট বছরের জগন্নাথ সাহু, নব্বই বছরের চামার সাহু আর তার ছেলে রাজেশ্বর সাহু, রাজারাম সাহু আর দুই নাতি সঞ্জয় আর বিনয়ের লাশ নামিয়ে দিয়েছিল ।

আরেকজন চাপরাশি ঝুনুরাম কিসকুর কাঁধে হাত রেখে মসকরা করতে-করতে রসিক পাসওয়ান সিঁড়ি দিয়ে মেজানাইন ফ্লোরের দিকে এগোলে, অতনু সুশান্তকে বলতে বাধ্য বোধ করল, ‘সবায়ের ব্যক্তিগত ব্যাপারে এত নাক গলাস কেন ?’

সুশান্ত বলল, ‘সকলেরই নকল গল্প আর আসল গল্প দুটোই জানি, সবকটা আঙুল কাটা চাপরাসির । মুঙ্গের থেকে বন্দুক কি৯নবে রসিক । রামখেলাওন ওর রক্ষিতার হার গড়িয়ে দিয়েছিল সবজিবাগের কণকমন্দির জুয়েলার্স থেকে । শেখ আলি পাঁচ হর্স পাওয়ারের ডিজেল পাম্প কিনেছে ।’ তারপর কিছুক্ষণ অন্যমনস্ক থেকে, ‘দিনকতকের জন্যে সিক লিভ নেবো । কাকার সঙ্গে আসাম যাচ্ছি দু ট্রাক আনারস আনতে ।’

অতনু জানতে পারল, শনিবার বিকেলে, অ্যানেকসি বিলডিঙে ক্যানটিন কমিটির নির্বাচনে ভোট দিতে গিয়ে, চন্দ্রকেতু সিং দিলে খবরটা, বাঁ-চোখের পাতা সামান্য কাঁপিয়ে, ননীদা সস্ত্রীক হনিমুনে গেছে সুশান্ত আর ওর কাকার সঙ্গে, কামাক্ষ্যা আর গণ্ডারের অভয়ারণ্যে, বয়সের স্বামী-স্ত্রীর বয়সের পার্থক্য মেটাতে । সুশান্ত তার মানে চেপে যাচ্ছে কিছু-কিছু । চন্দ্রকেতু চশমা পুঁচছিল । চশমা খুলে ফেললে মনে হয় ব্যক্তিত্ব হারিয়ে ফেলেছে ।

সুশান্ত-অতনুর সম্পর্কে যেটুকু লুকোছাপা না হলে নয় । অতনু কুঁড়ে, আরামপ্রিয়, যে-কোনো ছাপা কাগজ পড়তে ভালোবাসে, বসার চেয়ে ওর ভালো লাগে গড়িয়ে পড়তে, মেঝেতে বসলে দেয়ালে ঠেসান দিয়ে, বাসে-ট্রেনে উঠেই হাতল খোঁজে, অতিথি বা বয়স্করা বসার আগেই বসে পড়ে । বিছানায় বসলে এলিয়ে পড়ে বালিশ টেনে । সুশান্ত খবরের কাগজ বই ম্যাগাজিন পড়ে না, শেয়ার দরে ওঠানামার দরটুকু ছাড়া । খেলার খবর, রাজনীতিতে আগ্রহ নেই, অথচ একনাগাড়ে বকবক করতে পারে । সকলের বাড়ি-বাড়ি চষে বেড়ায় মোটরসাইকেলে । ছোঁয়াচে উৎফুল্লতায় ভোগে । অতনু মেয়েমহলে অস্বস্তি পায় । সুশান্ত সহজ । অফিসারদের অ্যাসোশিয়েশান, কর্মচারী ইউনিয়ান, ক্যানটিন, সমবায়, স্পোর্টস ক্লাব কিছুতেই অংশ নেয় না ও, সুশান্ত, কিন্তু খবর রাখে পুরো । গান-বাজনার ও কুইজ মাস্টাত, বিদেশি হোক বলিউডি হোক ইন্ডি পপ হোক । অডিও ডিভাইস কানে লাগিয়ে মোটর সাইকেল চালায় । বললেই টুইস্ট রক অ্যান রোল র‌্যাপ ট্যাংগো হিপহপ রুম্বা ফ্রি ফর অল নেচে দেবে সুশান্ত । অতনু তো নতুন পরিচিতের সামনে বেশিক্ষণ দাঁড়ালে আড়ষ্ট হয়, দ্রুত কেটে পড়ার ছুতো খোঁজে ।

সুশান্তদের একান্নবর্তী পরিবারে প্রতি সপ্তাহে গ্যাস সিলিণ্ডার লাগে । ঢিলেঢালা অগোছালো খোকাখুকুরা চোর-পুলিশ খেলতে-খেলতে পাক খেয়ে যায় বনেদি ড্রইংরুমে । জ্যাঠাকাকাদের অট্টহাসির ছররা ছিটকোয় তিনতলা থেকে একতলা । প্রতিটি ঘরের দেয়াল জুড়ে দোল খেলার রং । এক তলায় সিঁড়ির নিচে ডাঁই করা চটি আর জুতো, যার যেটা ইচ্ছে পায়ে গলিয়ে বেরিয়ে যায় । সুশান্ত আর ওর বড়জ্যাঠামশায় ছাড়া, যিনি এখনও সাইকেল চালিয়ে আন্টাঘাট কিংবা চিড়াইয়াটাঁড়ে বাজার করতে যান, আর কারোর স্নান করার আর খাবার বাঁধাধরা সময় নেই । সুশান্তদের বাড়িতে ঢুকলে অতনুর ইচ্ছে করে পরিবারের সদস্য হয়ে যেতে । ও এত চাপা যে নিজে থেকে কোনো হুল্লোড় আরম্ভ করতে পারে না । অন্যের বানানো হুল্লোড়ে ঢুকতেও ইতস্তত ।

নিজের মাইনের টাকা ওব্দি অন্যের সামনে গুনতে লজ্জা করে অতনুর । চাকরির প্রথম মাইনের একটা পাঁচ টাকার  প্যাকেট, লুকিয়ে গুনতে গিয়ে অফিসের পায়খানায় পড়ে গিয়েছিল । পড়ে যেতেই ফ্লাশ । অফিসকে তাই জানিয়ে দিয়েছে, মাইনেটা ওর ব্যাঙ্ক অ্যাকাউন্টে জমা দিতে ; ব্যাঙ্ক থেকে তো আর থোক অতো টাকা তুলতে হবে না । সুশান্তই পরে অতনুকে খোসা ছাড়িয়ে বের করে আনতে পেরেছে । স্কুল-কলেজে অতনুর নিকটবন্ধু ছিল না । অতনুর কাছ থেকে কলম বা বই নিয়ে কেউ ফেরত না দিলে ওর মন খুঁতখুঁত করে ; নোটসের খাতাও স্নাতকোত্তর পড়ার সময়ে সহপাঠিনীদের কাছ থেকে ফেরত চাইতে পারেনি । সুশান্তর মোটর সাইকেলও যে যখন ইচ্ছে চেয়ে নিয়ে যায় ।

অখিলেশ ঝা আই এ এস দিয়ে সফল হবার পর গ্রামের রাজপুত দারোগা যখন পুলিশ এনকোয়ারি নিয়ে খেলাচ্ছিল তখন সুশান্তর মোটর সাইকেলে অখিলেশকে বসিয়ে তদবিরের জন্যে চন্দ্রকেতু সিং নিয়ে গিয়েছিল ওরই, মানে চন্দ্রকেতুর গ্রাম, উত্তরপ্রদেশের বালিয়া জেলার সোনিয়া-রানিগঞ্জ গ্রামের মাফিয়া সরদার সুরজদেও সিং-এর ভাই রামাধীরের কাছে । দারোগাটা রামাধীরের শালা । রামাধীরের বিরুদ্ধে তখন অবশ্য ফৌজদারি চলছিল ৩০২, ৩০৭, ৩২৪ আর ৪৫২ ধারায় । রামাধীরের একটা টেলিফোনে কাজ হয়ে গিয়েছিল । কিন্তু ফেরার সময় বিহটার কাছে গ্রামের আধন্যাংটো ছেলেরা গোটাকতক মোষের ল্যাজ মুচড়ে, ওদের দিকে হাঁকিয়ে দেওয়ায়, রাস্তা থেকে নেমে মোটর সাইকেলটা কাঁঠাল গাছে ধাক্কা খায় আর সঙ্গে-সঙ্গে দুজনেই অজ্ঞান, গায়ের ওপর খসে-পড়া এঁচোড় । ঘণ্টা দুয়েক ওরা ওখানেই পড়েছিল । গ্রামবাসীরা কলম ঘড়ি আঁটি টাকাকড়ি যা কিছু ওদের পকেটে আর ছিল, মায় কাঁধব্যাগও, হাতিয়ে কেটে পড়েছে সেই সুযোগে । বিডিও দেখতে পেয়ে জিপে তুলে নিয়ে যায় । ওদের আর দোমড়ানো মোটর সাইকেলকে । মামুদ জোহেরের ম্যাটাডর নিয়ে বিহটা থেকে মোটর সাইকেল আর হাতে-মাথায় ব্যাণ্ডেজ বাঁধা দুই সহকর্মীকে ওদের বাড়ি পৌঁছে দিয়েছিল সুশান্ত ।

কোন আগ্রহ গিঁথে রেখেছে সুশান্তদের বিরাট পরিবারটাকে, যখন কিনা পাটনায় কোনো একান্নবর্তী পরিবার আর টিকে নেই, যে পরিবারের মধ্যে চুপচাপ সেঁদিয়ে যেতে চেয়েছে অতনু, তা অনেক ভেবেও বুঝে উঠতে পারেনি অতনু । বর্ধমানের বর্ধিষ্ণু চাষি পরিবারের কৃষিবিজ্ঞানে স্নাতক, অথচ ঢুকেছে আজেবাজে পচা নোট বাছাইয়ের চাকরিতে । গ্লানিবোধ বা দুঃখ, নজরে পড়ে না । মেমারিতে জমিজিরেত চাষবাস তদারক করেন সুশান্তর ন-কাকা নতুনকাকা, তাঁরা আসেন কখনও কখনও পশ্চিমে বেড়াতে আসার নাম করে । নতুনকাকার বড় ছেলে নকশাল হয়েছিল, বাড়ি ফেরেনি আজও । পাটশাক, জামরুল, আঁশফল, নোনা, কামরাঙা, গোলাপজাম ওদের বাড়িতেই প্রথম দেখেছে অতনু, মেমারি থেকে আনা ।

অতনুর বাড়িতে বিধবা মা । তিরিক্ষি দুর্গন্ধের নালির গায়ে সটান শাদা বাড়ি ওদের । একতলা । দোতলা অর্ধেক হয়ে আধখেঁচড়া ইঁট-বেরোনো । মায়ের শাদা থান আর অতনুর শাদা ধুতি-পাঞ্জাবি ছাড়া অন্য কোনো রং নেই পোশাকের । কাকাতুয়া দুটো শাদা । বাড়ি ফিরলেই ওর মন খারাপ, তার কোনো কারণ নেই, উৎস নেই । মায়ের সঙ্গে বড়ো একটা কথাবার্তা হয় না । অতনু মাছমাংস কেনে না । ডাল ভাত আলুভাতে তরকারি । ডাল তরকারি আলুভাতে ভাত । শাদাকালো টিভিটা পালটে রঙিন টিভির প্রস্তাবে রাজি করানো যায়নি মাকে । বহুকাল অন্ধ আর বোবা হয়ে পড়ে আছে ।

সুশান্তর বাড়িতে পুঁটলি তোরঙ্গ বাকসো প্যাঁটরা এলে বাড়িসুদ্দু সবাই হুমড়ি খেয়ে কী আনলে গো, ওটা কী গো, একটু দেখতে দাও না গো, পছন্দের বলিহারি, সুশান্তর ছোটো ভাই অপাংশু সবচেয়ে বেশি উৎসুক । অতনুর কোনো আত্মীয় নেই । আছে কি না তা জানেও না অতনু । কেউ আসে না । কেউ যায় না । কেউ চিঠি লেখে না, বিয়ে পৈতে অন্নপ্রাশন শ্রাদ্ধের কার্ড পাঠায় না ।

অতনুর জন্মের সময়ে ওর মায়ের প্রসবক্রিয়া নষ্ট করতে বাধ্য হয়েছিল ডাক্তার । ভাইবোন নেই । পড়াশোনায় চিরকেলে ছাপোষা, দ্বিত্বীয় শ্রেনিতে, অথচ মুখে বই গুঁজে থাকতে ভালোবাসে সারাক্ষণ । খেলাধুলাহীন । আগ্রহ নেই । কেউ কখনও জানতে চায়নি বড়ো হয়ে ও কী হতে চায় । জিগ্যেস করলে জবাব দেবার মতন ভাবনা ছিল না ওর আকাঙ্খায় । বাবা কেন যে ইংরেজি পড়ালেন ! কখনও ভালো লাগেনি ভাষাটা । রসকসহীন সাহিত্য । যদিও প্রতি ক্লাসে প্রতিবছর ইংরেজি পেপারে সবচেয়ে বেশি মার্কস অতনুই পেয়ে এসেছে । ইংরেজিতে পড়লে ওর মুখস্হ হয়ে যায় ; বাংলা আর হিন্দিতে হয় না । উচ্চাশা না থাকলেও, ভবিষ্যতের ধারণা না থাকলেও, কেউই বোধহয় নোট আর পয়সাকড়ির পরীক্ষক হতে চায় না । ভালো নোট, খারাপ নোট, আসল নোট, নকল নোট,সচল নোট, অচল নোট, আস্ত নোট, কাটা নোট, বাছাই নোট, ছাঁটা নোট, তাজা নোট, পচা নোট, কারোর উচ্চাকাঙ্খায় জাগে কি ! বালকের কিশোরের তরুণের যুবকের ? তার বাবার ঢুকেছিলেন এই চাকরিতে । বছর দু’তিন চাপরাশি থাকার পর নোটপরীক্ষক হয়েছিলেন । নাগপুরে । তারপর মুম্বাই, হায়দ্রাবাদ, মাদ্রাজ, বাঙ্গালুরু, পাটনা । পাটনায় মারা গেলেন বলে বাবার দৌলতে অতনু পেল চাকরিটা । মাইনে যথেষ্ট, দুপুরেই ছুটি, এরকম আয়েশের চাকরি তো আর পাওয়া যাবে না । সেঁটে গেল অতনু ।

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

Leave a comment

Filed under উপন্যাস

তিন

সুস্হ অরিন্দম ফিরে এসে কাজে যোগ দিলে, সবাই ওকে ঘিরে ধরেছে যখন—

: পাশের খাটালটায় গয়লাগুলো দুধে জল মেশাতো রোজ । আমরা পাগলরা একদিন হইচই করে সেটা বন্ধ করালুম ।

: মানে ? পাগল হোসনি তুই ?

: বাহ ! পাগল আবার হতে যাব কেন ?

: আর এই যে এত কাণ্ড-কারখানা করলেন ?

: কী করব ! ছাড়াতেই পারছিলুম না নিজেকে । ভালোলাগাটাই খারাপ লাগতে আরম্ভ করেছিল ।

: আর মানিব্যাগে ফোটি নিয়ে ঘুরলি ! সবাইকে দেখিয়ে-দেখিয়ে বেড়ালি যে ?

: জানি । প্রেম সম্পর্কে ধারণাটা লটকে গেছে । ওটার দরকার ছিল ।: সকলেরই জীবনে ভুল ভাঙার সুযোগ আসে ।

: মজা তো যথেষ্ট লুটলেন !

: অমন জাঁতিকলে পড়লে বুঝতেন । জীবনটা নষ্ট করে ফেললুম ।

: বিয়ে করে ফ্যাল এবার, বিয়ে করে ফ্যাল ।

: পাগলামির বদনামটা আগে কাটিয়ে নিই ।

: আরে কন্যাপক্ষ শুধু চাকরি আর নুনুর রঙ দেখবে । আর তাছাড়া কাট মারলেই পারতেন । পাগল সাজার দরকার তো ছিল না ।

: ও আপনারা বুঝবেন না । যাকগে, যখন পাগল ছিলুম, তখন দশ টাকার রুপোর কয়েন বেরিয়েছিল । আমার জন্যে রেখেছে কি না ?

: পঞ্চানন সিনহার কাছে খোঁজ নিন । রেখেছে নিশ্চই । আপনাকে বাদ দিতে সাহস পাবে না ।  পাগল হয়েছেন খবর পেয়েও ম্যানেজমেন্ট কাউকে পোস্ট করেনি আপনার জায়গায় । তবে মেড়ো পার্টিদের একেকটা কয়েন পনেরো-কুড়ি টাকায় বেচেছিল পঞ্চানন । কাউন্টারে ও-ই তো ছিল তখন । বাজারে এখন পঁচিশ টাকা রেট যাচ্ছে । কালীপুজো-দেওয়ালিতে পঞ্চাশে উঠবে ।

পঞ্চানন সিনহা ভাগলপুরের । বলে, আরে ভাই, ম্যায় বঙ্গালি হুঁ । কায়স্হ । ঘোষ বোস মিত্রা সে শাদি হোতা হ্যায় হম লোগোঁ কা । বংলা কা চর্চা নহিঁ হ্যায়, ভুল গয়ে । নদিয়া পুরেইলিয়া জলপাইগুররি মেঁ কাফি সগে-সমবন্ধি রহতে হ্যাঁয় ।

কী ভয়াবহ । এভাবে নিশ্চিহ্ণ হওয়া । অতনুর মনে হয়েছে । সুশান্ত বলেছে, তাতে কি ! ভাষা আবার কোনও ব্যাপার নাকি ? কিছু একটা বলতে আর বলে বোঝাতে পারলেই হল ।

অরিন্দম সত্যই পাগল হয়ে গিয়েছিল কি না, কথার মারপ্যাঁচে সে ব্যাপারে সহকর্মীদের মাঝে অবুঝ সন্দেহ চাউর করে দিতে পেরেছে বেশ সহজে । অরিন্দম যখন চিকিৎসার স্মৃতিহীন ঘেরাটোপে, অফিসের কোয়ার্টার রাজেন্দ্রনগরে রেলফাটকের কাছে, বিলির জন্যে তৈরি হয়ে যাওয়ায়, ওর নামে, অনুপস্হিতিতে বরাদ্দ হয়ে গিয়েছিল একটা ফ্ল্যাট । মা আর ছোটো ভাই নতুন কোয়ার্টারে । পুরোনো  ভাড়া বাড়ির পাশের ফ্ল্যাটের প্রতিবেশিনীর মুখোমুখি হবার সম্ভাবনা আর নেই, কিংবা তার থলথলে খলবলে স্বামীর, যে বাড়তি রোজগারের ধান্দায় অহরহ ট্যুরে ।

পাগল হয়ে অরিন্দম মোটা হয়ে গিয়ে খানিক । ভুঁড়ি এখন বপু । ঘিরে থাকা মুখমণ্ডলের ওপর দৃষ্টিকে আনাগোনা করিয়ে, পিয়ানোর রিডের ওপর যেমন আঙুল, ডো রে মি ফা, ভাঙা গলায় বলে উঠল অরিন্দম, ‘আচ্ছা, অতনু-সুশান্ত জুটিকে দেখছি না, ওরা আমার জয়েন করার খবর পায়নি বুঝি ?’

শিবু পালিত, মানে আশিয়ানা বিলডিঙের শৈবাল, যে নাটক করে, মানে গ্রুপ থিয়েটার, বিপ্লবী উৎপল দত্তের সঙ্গে রঙ্গিলা উত্তমকুমারের মিশেল দিয়ে জানালো, ‘সুশান্ত গেছে দু-ট্রাক কড়াইশুঁটি আনতে, আর অতনু গেছে রেমিটান্স নিয়ে ।

‘অতনু আর রেমিট্যান্স ?’

রেমিট্যান্স মানে বন্দুকধারী  প্যারা মিলিটারি পুলিশ পাহারায় অনেকগুলো কাঠের বাক্সে থাক-থাক টাটকা নোট  ট্রেনের ওয়াগনে করে পাততাড়ি । সেগুলো তুলে দেয়া নির্ধারিত কর্তৃপক্ষের জিম্মায় ; যে নিয়ে যাচ্ছে যে বুঝে নেবে প্যাকেট আর বাণ্ডিল । যারা নেবে তারা গুণে যাচাই করে নেবে । গোনাগুনি করতে তাদের যতদিন সময় লাগে ততদিন সেখানে ঘাঁটি গেড়ে বসে থাকতে হবে । নিয়ে যাবার হরেক হ্যাঙ্গাম । ওয়াগন ব্রেকারের ভয় । লক্ষ লক্ষ কোটি কোটি টাকার সঙ্গে সফরের ভয় । ট্রেন থামলেই গাড়ি থেকে নেমে দেখে নাও সব ঠিকঠাক । তালা টেনে যাচাই করে নাও । ঘুমের দফারফা । বারবার হিসি পাবে । গোনাগুনতিতে দিনের পর দিন কাটাতে হয় অচেনা জায়গায় । থাকার হোটেল নেই অনেক শহরে । মুখে দেয়া যায় না এমন খাবার । মশা । রোগের বালাই । নোংরা জল । লোডশেডিং । ধুলো । লু । বৃষ্টি । একা ।

পুরোনো হিলহিলে নোটের স্যাঁতসেঁতে গুঁড়ো০গুঁড়ো ধুলোয় অতনুর অ্যালার্জি হয়েছিল । চাকরিতে ঢুকেই । চোখের জলে নাকের জলে রুমাল ভিজে, ধুতির খুঁট ভিজে, সহ্যশক্তি না গজানো ওব্দি অ্যালাজেসিক আর অ্যালার্জির বড়ি খেয়ে অর্ধনিমিলিত, ক্যানটিনের বেঞ্চে বা ডিসপেনসারির স্ট্রেচারগাড়িতে চিৎ । বড়ো খাজাঞ্চি, যাঁর টেবিলের বিশাল কাঁচের তলায় ভারতের প্রতিটি তীর্থের দেবী-দেবতার রঙিন-শাদাকালো ছবি,  বলেছিলেন, ‘এ চাকরির অনেক হ্যাপা আছে, কিন্তু সয়ে যাবে, এরপর যদি আঁস্তাকুড়ে শোও তাহলেও অসুখে পড়বে না ।’

নামকরা কেরানি বলে দশটা-পাঁচটায় নির্ভুল আটক অরিন্দম । পাগলোত্তর জীবনে একদিন চারটে নাগাদ, যখন ও মনে-মনে একটা খসড়া বাংলা থেকে ইংরেজিতে তর্জমা করছে, ধাড়ি নোট-পরীক্ষক গৃহবধুদের মুখরা দল নানা সুগন্ধের বেড়ায় ঘিরে ধরল ওকে । উমা ভর্মা, মানসী বর্মণ, শ্যামলী কর্মকার, হেমা শ্রীবাস্তব, সরিতা যাদব, আরও কয়েকজন । একজন বলল, ‘আমরা নালিশ জানাতে এসেছি, সাকসেনা সাহেব সবাইকে দেখিয়ে-দেখিয়ে আমাদের কনফিডেনশিয়াল অ্যাপ্রেজাল রিপোর্ট লিখেছেন আর হাসিঠাট্টা করেছেন ।’

‘জানি,’ অরিন্দম মুখ না তুলেই বলল, ‘মানসী বর্মণের পোটেনশিয়ালিটির কলামে লিখেছিলেন “আনপ্রুভড”, কারেক্ট করিয়ে নেয়া হয়েছে ।’

মানসী বর্মণ কাছে ঘেঁসে দাঁড়িয়ে বলল, ‘বৃন্দাবন পার্কে ছিলেন শুনলুম ।’ মানসী দৃষ্টিকটুভাবে সুশ্রী, আকর্ষণিয়ভাবে উন্নাসিক, ফুলোফুলো ত্বরান্বিত আঙুলে নোট গোনার অকল্পনীয় ব্যুৎপত্তি ।

‘না, লুম্বিনী পার্কে,’ গা বাঁচায় অরিন্দম, মুখ না তুলেই ।

উমা ভর্মা হিন্দিতে বলল, ‘ওঃ, ভাগ্যিস মথুরায় নয় ।’

অরিন্দম চোখাচোখি এড়াতে চাইছিল । কে জানে মৌলিনাথ উসকেছে কি না এদের । এরা ওকে দলবেঁধে হেনস্হা করতে এসেছে । প্রতিবেশিনীর কানাঘুষো দূতী । তার পাগলামির খবরের সঙ্গে মুখরোচক আরও গুজব রটে থাকবে, সত্যিকে ফেনানো অতিকথা । গ্লানিকে পাগলামি দিয়ে সারাবার প্রক্রিয়াকে তাহলে রুদ্ধ করতে চাইছে এরা । একজন মানুষের ভাবনাচিন্তাকে আঘাত করার ঠিক কতটা অধিকার, সামাজিক প্রাণী হিসেবে, আরেকজনের থাকতে পারে ? মানসীর তো বরের সঙ্গে ছাড়াছাড়ির গুজব । লক্ষ কি সত্যিই অরিন্দম !

‘মথুরার রাজায় গিজগিজ করছে অফিসটা ।’ শ্যামলী কর্মকার, ময়লা, কোঁকড়া চুল, দেখতে দশ-পনেরো দিনের পোয়াতি, মন্তব্য করল । গায়ের রঙ ময়লা নয়, তবু বাবা-মা শ্যামলী নাম রেখেছে বলে হয়তো কৃষ্ণ আর তার লীলার ওপর ওর রাগটা আমার ওপর ঝাড়ল, নিজেকে নিঃশব্দে বলল অরিন্দম।

চলে গেলেন গৃবধুরা, মোজেকজমিনে ময়ূরপঙ্খী নৌকো বেয়ে । শিশির ফোঁটারা বেরিয়েছেন নৈশভ্রমণে । শ্যামলী কর্মকারের দু’কাঁধে আর পিঠে মাংসের আদরনীয় তিরিশোর্ধ পরত জমতে শুরু করেছে, না তাকিয়েও দেখতে পাচ্ছিল অরিন্দম, ফর্সা পিঠে শিরদাঁড়ার দুপাশে জড়ুল আঁকা ডানাছড়ানো নরম মাংসের প্রজাপতি ।

অরিন্দম জানে ও পাগল হয়ে গিয়েছিল । কেন তাও মনে আছে ওর । অ্যাটেনডেন্স রেজিস্টার থেকে জানতে পেরেছে কবে থেকে ছুটিতে ছিল ও । কিন্তু কোন মুহূর্তে পাগল হয়ে গিয়েছিল, মনে নেই, কবে কখন, কোথায় । উন্মাদ হয়ে ওঠার মুহূর্তটা জানতে চায় অরিন্দম, নিজেকে নিজের বাইরে থেকে জানতে চায়, দেখতে চায়, আহ্লাদের অনিকেত মুহূর্তটা, সেই উজ্বল বিস্ফোরণ, বিগ ব্যাং, নীহারিকাপূঞ্জ, অন্য জগতে স্হানান্তরন । হাসপাতালের কাগজে ইলেকট্রোকনভালসিভ থেরাপির অঙ্কময় লেখাজোখা । বোবাদের বিনির্মাণ করলে কতরকম গোলমেলে অরিন্দম বেরিয়ে আসবে,  যে অরিন্দমদের ও চেনে না । বুড়ো কাউনসেলার সেরে যাবার পর বলেছিলেন, আপনার আত্মবিশ্বাস আপনাকে সারিয়ে তুলেছে । সেটা কোন অরিন্দমের আত্মবিশ্বাস ?

নিকট বন্ধুদের কাছ থেকে লুকিয়ে রাখেনি । জানা ছিল, এই সম্পর্কের উত্তরণ নেই । কিন্তু নরম মাংসের নেশায় একরোখা অন্ধত্ব জাপটে ধরল ওকে । নিজের সঙ্গে বিশ্বাসভঙ্গ দিয়ে শুরু ।

অফিসের কাচের বাইরে তাকাল অরিন্দম ; এক গূড়দর্শী শঙ্খচিল সাঁতরাচ্ছে আকাশের রোদ্দুর-মাখানো ঢেউয়ে ।

ওদের সংস্হায় প্রত্যেক বছর একজন পাগল হয় । গেল-বার দুবেজি হয়েছিল, তার আগের বছর এম কে ঝা পাগল হয়ে আর ফেরেনি । আসছে বছর কার পালা কে জানে । এর চেয়ে, অসীম পোদ্দার মামুদ জোহের মিলে যে সান্ধ্যদল গড়ে তুলেছে, যাকে সবাই নারী-নারকো গ্যাঙ বা না-না লেচার বলে, তাতে ঢুকলে পাগল হওয়া থেকে রেহাই পেত হয়তো ।

বি সেকশানের নোট পরীক্ষকদের কেউ বড় একটা ঘাঁটায় না । সংস্হা যাদের ঘ্যাঁচড়া বজ্জাত আড়বুঝো বদরাগি ঝগড়ুটে কর্মচারী মনে করে, তাদের পাঠায় ওই সেকশানে । মামুদ জোহরের কাছে জানলায় সানফিল্ম লাগানো ফিকে নীল রঙের ম্যাটাডর ভ্যান, সানফিল্ম লাগানো বেআইনি হওয়া সত্বেও লাগিয়েছে, ড্রাইভারের পেছনে সানমাইকার দেয়াল । পেছনে কি চলছে দেখা যায় না । ড্রাইভার পেছনের ট্র্যাফিক দ্যাখে রিয়ারভিউ আয়নায়, তাই ভাড়া করা ড্রাইভার রাখে না, গ্যাঙের সদস্যরা নিজেরাই চালায় । সানমাইকার দেয়ালের পেছনে, দুদিকের সিট টানলে সোফা-কাম-বেড, মখমালের চাদর দেয়া বিছানা গড়ে ওঠে । মাইক্রোবায়োলজিতে গবেষণা মাঝপথে ছেড়ে দিয়ে মামুদ জোহের ঢুকেছিল চাকরিতে । নিজের শহর, নিজের প্রাসাদোপম বাড়ি, এখানেই চাকরি, ব্যাস ।

অসীম পোদ্দারের জানলায় পর্দা ঢাকা শাদা ডিজেল অ্যামব্যাসাডর । অ্যামবাসাডর উঠে যাচ্ছে বলে মনখারাপ থাকে । জেনেটিকসে পিএইচডি অসীম পোদ্দার । কেন্দ্র সরকারের বায়োটেকনোলজি বিভাগে অধস্তন বৈজ্ঞানিকের চাকরি পেয়েছিল, কিন্তু নোটপরীক্ষকের চেয়ে মাইনে কম বলে যায়নি ; অফিসে, এমনকি চায়েরদোকানে, পেছনের গলিতে তাড়ির আর জুয়ার ঠেক-এ ওর নাম ডকটর ।

অফিসের কাজ শেষ হলে, একটা-দুটোর মধ্যেই হয়ে যায়, পেছনের গলিতে, যেখানে পোড়া নোটের ছাই দিয়ে একটা পোর্টেবল গন্ধমাদন ঢিপি, ওরা গিয়ে দল বেঁধে তাড়ি খায় চায়ের কাপে, সিপ মেরে, তাড়ির ঋতুতে । ভাঙের ঋতু হয়, দিশি মদের, আফিমের, গাঁজার, চরসের, স্ম্যাকের । গাঁজাগুঁড়ো তামাক-চরসে মিশিয়ে আইভরি পাইপে । মেডিকাল কলেজের নাইজেরিয় ছাত্ররা হেরয়িন এল এস ডির ব্যবস্হা করে । ম্যাটাডরে ফার্স্ট এইড বাক্সে অ্যালুমিনিয়াম পাত, চামচ, ডিস্টিলড জল, সুঁই নেবার পিচকিরি, কাঁচি, লাইটার, ছিলিম, টয়লেট পেপার, তুলো । আর আছে বিদেশি-স্বদেশি নিরোধ বা কনডোম, রঙবেরঙ, নানা সুগন্ধের । আছে অকুস্হলকে তুলতুলে করে তোলার মলম । শনিবার-শনিবার হল্লাবোল । সেদিন যে একটারও আগে ছুটি । সেদিন ওদের দলে বেশ কয়েকজন অফিসারও শহরের অন্য কোনো নির্দিষ্ট মোড়ে গিয়ে ঢুকে পড়ে ওদের দলে । দাশগুপ্ত, বোস, আগরওয়াল, রায়চৌধুরী, মুদলিয়ার, খান্না, মুখার্জি ওরা সব । লটারি অনুযায়ী ফি-হপ্তায় দুজন, ট্রেজারার আর ম্যানেজার হয়, যারা গাড়ি চালায়, ছোঁয় না কিছু । সন্ধে নাগাদ কোনও হাফগেরস্হ যুবতীকে এই কড়ারে তোলা হয়, দশ বারোজন তার সঙ্গে রতিভ্রমণ করবে ম্যাটাডরের সোহাগ বিছানায়, আর তারপর তার আসতানায় ছেড়ে দেয়া হবে কাজ শেষে । দুদিন বা তিনদিন একসঙ্গে ছুটি থাকলে ওরা অমন যুবতীকে নিয়ে বাইরে কোথাও চিটফান্ডের লটারি খেলতে যায় । মেয়েটির সঙ্গে লুকোচুরির খেলা । যে জেতে সে মেয়েটিকে আর চিটফাণ্ডের নির্দিষ্ট অংশ পায় ।

এই দলটার সঙ্গে মেশার অসুবিধে, তাদের অনৈতিকতা আর উচ্চশিক্ষার গর্ববোধ ছাড়া, নিজেদের মধ্যে কনভেন্টে পড়া ইংরেজিতে কথা বলে । মৌতাত ছাড়া, কারোর কোনো উচ্চাকাঙ্খা নেই, বা নেই কেরিয়ার সম্পর্কে চিন্তা । যতটুকু আয় তাকে মনে করে যথেষ্ট । ওদের কথা বলার ঝাঁঝ থেকে জানিয়ে দেয় যে কেউ কিছু হয়ে ওঠে না, বুদ্ধিজীবির কাজ আদর্শবাদকে এড়ানো, বেঁচে থাকাটা জ্বরভারে আনন্দ, স্মৃতি জিনিসটা বানানো, বাস্তব বলে আদপে কিছু হয় না বলে কোনো দুশ্চিন্তায় ভোগার দরকার নেই । অসম ধ্যানধারণার কারণে, অনেকে হেঁ-হেঁ হাসতে-হাসতে দ্রুত পাশ কাটায় । বংশরোপণ সিং যাদব ওই ভাবে পাশ কাটাতে গিয়ে থলে ভর্তি অফিস থেকে চুরি করা গোটা দশেক রঙিন পেপারওয়েট নিয়ে ওদের হাতে ধরা পড়েছিল । চাপরাশি থেকে উঠতে-উঠতে অবসরপ্রাপ্তির বছরে অফিসার হয়ে হেনস্হা ।

মামুদ জোহের সব সময় গম্ভীর, চিন্তিত । অন্য মুসলমান কর্মচারী বা অফিরাররাও ওর ধারে কাছে যায় না । কিছুটা কুঁজো আর গাঁট্টাগোঁট্টা, বেশ ফর্সা, কুঁজো হলেও ঢ্যাঙা, নিজের নাক দেখিয়ে বলে এটাই আরবদেশের, বাদবাকি ইনডিয়ান । অসীম পোদ্দারের বাঁ হাতে, এমনকি নাচগান-হুল্লোড় আর যৌন-অভিসারের সময়েও, একটা ডায়েরি, টুকটাক লিখে নিচ্ছে কিছু । দলে আছে বাইশ থেকে চল্লিশ বয়সি । রেগুলার দেবেন্দর, অভিজিৎ, শৈবাল, হরিশ, রবীন, অশোক, নরেন, প্রতুল, অনিমেষ, সুশীল, সুধীর, কমলেশ — বাঙালি বিহারি পাঞ্জাবি ওড়িশি ।

সুশান্ত, সব ব্যাপারে নাক গলানোর সুবাদে, অসীম পোদ্দারকে একবার অনুরোধ করেছিল, গরদানিবাগ হাই স্কুলে পড়া স্হানীয় ইংরেজি এড়িয়ে বাংলাতেই, অ্যামব্যাসাডরটা চালিয়ে দেখবে । চালু কিরতে গিয়ে বোঝে গাড়িটায় ক্লাচ নেই । কমলেশ, অটোমোবিল এনজেনিয়ারিং পড়ে যে ছোকরাটা নোট-পরীক্ষকের চাকরিতে ঢুকেছিল, ক্লচ বাদ দিয়ে দিয়েছে । কত গাড়ি বারিপথ বুদ্ধমার্গ অশোক রাজপথ থেকে দিনদুপুরে হাপিস হয়ে যায় রোজ, ওদেরটা হয়নি । চাকা ব্যাটারি ওয়াইপার ওব্দি চুরি যায়নি । অথচ চুরি হতে পারে না এমন অস্হাবর এমন কিছু পাটনা শহরে নেই, জীবজন্তু এমনকি মানুষও, মাঝপথ থেকে আচমকা উধাও ।

নিসপিসে বাঁ পা দুচারবার নাড়ানাড়ি করে বিস্ময়ে গাড়ি থেকে বেরিয়ে এসেছে সুশান্ত, ‘হিন্দমোটরে পাঠিয়ে দিন না প্রোজেক্টটা ।’

‘না, অনেকের চাকরি চলে যাবে ; তাছাড়া এর ড্রিং তো অনেককাল আগে এসে গেছে ইনডিয়ায়, অটোমোবিল ইনডাসট্রিতে সম্পূর্ণ রদবদল ঘটে যাবে কয়েকবছরে । তখন আমাদের ইনডিয়ান গাড়ি কমপিট করতে পারবে না , ‘ বলেছিল অসীম পোদ্দার । অসীম এখনও বাংলায় কথা বলে, অথচ ওর জাঠতুতো ভাই তরুণ পোদ্দার, যার বাবা ক্ষেত্রমোহন পোদ্দার ব্রাহ্মস্কুল রামমোহন রায় সেমিনারির প্রধান শিক্ষক ছিলেন, আর পায়জামার ওপর ধুতি পরতেন, ও, তরুণ পোদ্দার বাংলা জানলেও বলে না, বাঙালিদের সঙ্গেও হিন্দিতে কথা বলে । তরুণের বড়দা, কল্যাণ পোদ্দার এখন প্রধান শিক্ষক, নিজেকে বাঙালি পরিচয় দিতে কুন্ঠিত হয় । ব্রাহ্ম শিক্ষক পাওয়া যায় না বলে উনিই প্রধান শিক্ষক, বংশপরম্পরায় চলবে স্কুল । বাংলা পড়ানো হয় না, কেননা সরকার আর বাংলা টেক্সটবুক ছাপে না ; স্কুলও বাঙালি শিক্ষক পায় না ।

সুশান্তকে কিন্তু মামুদ জোহের সমীহ করে, ট্রাকে করে ভিন্ন রাজ্য থেকে অসময়ের ফল-আনাজ আমদানির খাটুনি-প্রতিভার জন্যে । কেননা প্রায় সবাই মনে করে খাটুনির প্রতিভা একেবারে নেই বাঙালি যুবকদের, ঝুঁকি নেবার, অথচ অনেকেই মাওওয়াদি হবার ঝুঁকি নিয়ে বনপার্টিতে চলে যায় । মামুদ জোহেরের গ্যাঙের অনেকে যেতে চেয়েছে সুশান্ত’র পেছন-পেছন, কিন্তু ওর কাকা বলেছেন ব্যবসাপাতির ঘাঁতঘোঁত সবাইকে জানানো উচিত নয় ।

ননীদার বিয়েতে পৌঁছেছিল মামুদ জোহের অসীম পোদ্দাররা, রাত একটা নাগাদ আকাশের তারা মাথায় করে, টং, ঝিমন্ত বাসরের টনক নড়িয়ে, বেদম বাজনা ম্যাটাডরের মিউজিক সিসটেমে, পরিত্রাহি আশা ভোঁসলে আর ডি বর্মণের সুরে । ওদের গুরুমাতাল শৈবাল পালিত  শুধু লিট্টি খেয়ে বলেছিল, ‘চিংড়ি কাটলেট চিকেন টিক্কা চিজ পকোড়া করতে পারতেন, নইলে আর প্রভিডেন্ট ফাণ্ড কেন ?’ কিন্তু ওদের সঙ্গে নকল কোঁকড়াচুল টকটকেঠোঁট চোখেকাজল গালেরুজ  হাতেমেহেন্দি তরুণীটি বথুয়া শাক দিয়ে গোগ্রাসে গিলেছিল পুরি, মানে বড়ো মাপের মোটা-মোটা লুচি, নিজের সঙ্গে একটা হোমসার্ভিস প্যাকেটও তৈরি করিয়ে নিয়েছিল ।

ননীদা বললেন, ‘যাক, বিয়েতে এই পূণ্যিটা অন্তত করে নিলুম, কী বল হে মামুদ, জীবনে যে কখনও এমন নেমন্তন্ন খায়নি, তার আশীর্বাদ পেলুম।’ রাজেন্দ্রনগরের কমিউনিটি সেন্টারের সামনের বাড়িটায়, রাস্তার ওপারে, সারা রাতের ভগবতী জাগরণের জগঝম্প চলছিল পুরোদমে । নরক, ব্যাস, রাত দেড়টা-দুটোয় লোডশেডিং গুলজার ।

মামুদের দলের অফিসাররা, জানাজানি এড়াতে যাদের নির্ধারিত জায়গা থেকে তুলে নেয়া হয়, ননীদার বিয়েতে আলাদা এসেছিল একে-একে । ওদের লাম্পট্যের উল্লেখ করে প্রচুর উড়ো অভিযোগ এসেছে বেনামে । অফিস নির্ণয় নিয়েছে, সেরকমই কেস তৈরি করেছিল অরিন্দম, অফিসের বাইরে যে যা করে তা তার নিজস্ব ব্যাপার, সংস্হার কোনও দায়দায়িত্ব নেই । ‘ভাগ্যিস আপনি অবৈধ সম্পর্ক পাতিয়েছিলেন,  বাঁচাবার পথ কেটে বের করতে পারলেন,’ ওর কানের কাছে মুখ নামিয়ে বলেছিল মুদালিয়ার ।

রমাবৌদি সবচেয়ে আগে ধরে ফেলেছিলেন এই নানা গ্যাঙের কাজকারবার, উপস্হিতি । ‘কাউকে শিগগির পাঠিয়ে দ্যাখো তো ও-ফুটে গেটের সামনে লাল শাড়ি-পরা একটা মেয়ে দাঁড়িয়ে আছে কি না’, টেলিফোনে বলেছিলেন রাঘবকে । রাঘব তখন দুপুরের ভোজন সেরে টুথপিক দিয়ে দাঁতের ফাঁক থেকে ছাগল বের করছিল, দৌড় দিলে দোতলার ওর কোয়ার্টার সংলগ্ন  বারান্দায় । ‘হ্যাঁ, রয়েছে একজন কারোর অপেক্ষায়, চোখে কালো চশমা । কাঁচ তোলা সাদা অ্যামবাসাডর তুলে নিয়েছিল সুবেশা তন্বীকে, পেছনে ফলো করছে একটা ম্যাটাডর ভ্যান ।’

‘দাশগুপ্ত সায়েবের কাছে কলগার্লের ডায়রেকটরি আছে গো,’ জানিয়েছিল রমা । শুনে রাঘবের  মদে চিকনগাল বিখ্যাত ঘিঘিক-ঘিঘিক হাসি, হেঁচকিকে হাসিতে রূপান্তরিত করে ফেলেছে অভ্যাসবশত ।

দাশগুপ্ত যখন লাঞ্চ করতে লাউঞ্জে, ব্রিফকেসে পাওয়া গেল সুদৃশ্য ছোট্ট ডাইরেকটরি, সিঙ্গাপুরে গ্লসি কাগজে ছাপানো । টালিফোন নাম্বার, চেহারা, উচ্চতা, বয়স, কতোগুলো ভাষা জানে, সাংকেতিক না, কয়েকজনের খোলাবুক ফোটো । প্রত্যেকের দরদাম ডলার আর দিনার-দিরহামে । এদেশের সেরা খরিদনারীদের তালিকা । কিছু টেলিফোন নম্বর নিজেই লিখে রেখেছে  দাশগুপ্ত । টিক দেয়া কয়েকটায় । প্রথম পৃষ্ঠায়, ‘উইথ গ্রেট অ্যাডমিরেশান ফ্রম এস পি মুখার্জি,’ মুক্তোর মতন ।

অরিন্দমের সেসময়ের মণিব দাশগুপ্ত, প্রশাসনের অধিকর্তা । ব্রিফকেসে নিখিল ভারত কলগার্ল ডাইরেকটরি আবিষ্কার শান্তি দিয়েছিল অরিন্দমকে, বিপথগমনের সাহস যুগিয়েছিল, কেননা ও তখন বিবাহিতা অভিজ্ঞ প্রতিবেশিনীর দুই থলথলে শ্যামল উরুর খিলে আটক । অন্যের অনুপস্হতিকে পুষিয়ে দিচ্ছে নিজের নির্ভেজাল কৌমার্য দিয়ে ।

তার দিনকতক পরেই নিজের ঘোরানো চেয়ারে পাক খেয়ে হৃদরোগে কার্পেটে ঠিকরে পড়ে যখন দাশগুপ্ত মৃত্যুমুখী, অরিন্দমের দুহাতের চেটোয় হিম জমে উঠছিল ফোঁটায়-ফোঁটায়, ঘামের সন্দিহান বিন্দু বিনবিনিয়ে উঠেছে কপালে । মামুদ জোহের কাঁদতে-কাঁদতে না-না গ্যাঙের সহমর্মীদের নিয়ে অকালবৃদ্ধের লাশ গাড়িতে তুলে ছুটেছিল কুরজি মিশনারি হাসপাতালে ।

শ্যামলী কর্মকার যাখন শ্মশান অভিমুখী ফুলে ঢাকা দাশগুপ্তর শবের কপালে হাত বুলিয়ে বলেছিল, ‘যৌনতা বাদ দিলে লম্পটদের চরিত্র আদারওয়াইজ ভালো হয়,’ তখন অরিন্দম আচমকা, ‘কী বলছেন কী আপনি ? দাশগুপ্ত সায়েব আর লম্পট ! দাম না দিয়ে কোনও সেবা কারোর থেকে নিতেন না ।’

অফিসের গৃহবধু কর্মীরা থ, যেন অরিন্দমেরও যোনি ছিল কখনও, কোনও বয়সে ।

দাশগুপ্তের মৃত্যুর পর, অফিস যখন অফিসের মতন নির্লিপ্ত নৈর্বক্তিকে ফিরেছে, উকিল ভৈরোঁনারায়ণ শুক্লা স্টাফ সেকশানে ঢুকে জানিয়ে গেল, দাশগুপ্ত নিজের সম্পত্তি দিয়ে গেছে সান্ধ্যদলের পাঁচজনকে, স্হাবর সম্পত্তিও বেচে তাদের মধ্যে টাকা ভাগ করে দেয়া হবে ।

তেরো দিনের মাথায় রাজেন্দ্রনগরের কমিউনিটি হলে শ্রাদ্ধ-উৎসব । উৎসবের কাণ্ডারী না-না গ্যাঙের সদস্যরা । অরিন্দম শ্রাদ্ধে গিয়ে দ্যাখে ও-ই  একলা শুধু ধুতি পাঞ্জাবি পরে বাঙালি সেজে পৌঁছেছে । এতদিন কাছাকাছি থেকেও নিজের নিকট ওপরঅলাকে বুঝতে পারেনি, মিশতে পারেনি দাশগুপ্তর কমবয়সী সঙ্গীদের সাথে । চরিত্র জুড়ে তক্কে-তক্কে থাকার সতর্কতা অরিন্দমকে সব ব্যাপারেই উটকো করে ফেলেছিল ।

সবাইকে অবাক করে কিন্তু ভিড়ে গেল, এতদিনকার চর্চিত দূরত্ব মুছে, অতনু ।

ঘরকুনো মনমরা নিঃসঙ্গবিলাসী গররাজি অতনু বাধ্য হয়েছিল টাকা ঠাসা কাঠের বাক্সগুলো নিয়ে অনেকদূরে যেতে, কারণ এবার আর তার বদলে কেউ রাজি হয়নি । এর আগে এড়িয়ে যেতে পেরেছে প্রত্যেকবার । ট্যুরের টিএ-ডিএর লোভে চলে গেছে ওর বদলে আরেকজন । প্রথমে ভেবেছিল লম্বা ছুটি মেরে ডুব দেবে দায়িত্ব থেকে । অবাক হয়ে গেল নিজের মধ্যেই ইচ্ছেটা আবিষ্কার করে ।  অনিচ্ছার মধ্যে বোধহয় পরাজয়বোধের ঘুণপোকা পাক খাচ্ছিল এতকাল । তাছাড়া শরীরের কষ্টবোধকে মনে হতো সবচেয়ে বড়ো শত্রু । রোপনি আর কাটাই ঋতুতে বেশির ভাগ বিহারি কর্মচারী গ্রামে যায় ; তাই অতনুর বদলে এবার যাবে না কেউ ।

যাদের জমিজমা নেই, ব্রাহ্মণ কায়স্হ দলিত-মুসলমান বা অবিহারি, তারা বললে, এবার নিজের পায়ে দাঁড়াও ; তোমার হয়ে আমরা আর কতো সেইব ! গুলিগোলা খেতে আমরা যাচ্ছি না ।

: ওখানের লোকেরা কুকুর-বেরালের মাংস খায় ।

: সবরকম পাখি খায়, কাকও, তারিয়ে ।

: সাপখোপ খায় ।

: প্রকৃতি কিন্তু অপূর্ব ।

: মেয়েরা অপূর্ব সুন্দরী । টকটকে রঙ । দেখে মনে হবে আনটাচড ।

: পুরুষগুলো কিন্তু অফিসেও মাল টেনে ভোম হবে থাকে ।

: নোট গুণে দেখে-শুনে নাবার জন্যে রোজ হাতজোড় করতে হবে তোকে । বিরক্ত হয়ে যাবি । এক ঘণ্টায় যা গোনা যায় তা গুনতে দিন কাবার হয়ে যাবে।

: ঘোরাঘুরিরও তেমন স্কোপ নেই ।

: কদ্দিন যে গিয়ে পড়ে থাকতে হবে কে জানে !

: একদম টাইমপাস হয় না ; তার ওপর সন্ধে হয় তাড়াতাড়ি, দুটো বাজতেই বিকেল ।

: মালটানা পাতাফোঁকার ওব্বেস থাকলে তেমন অসুবিধে হতো না ।

: সাবধানে মেলামেশা করবেন । ওদিকে খুব এডস-ফেডস হয়, সেদিন দেখাচ্ছিল দূরদর্শনে । ধুতিটা পালটে এবার ফেডেড জিনস ধরুন । কাপড়-ফাপড় কাচাকাচির অনেক ঝুঠঝামেলা ।

: গরম কাপড় নিয়ো সঙ্গে । শুধু আলোয়ানে কুলোবে না ।

: থাকার জায়গাও পাওয়া যায় না সহজে । যাও বা দুচারটে হোটেল আছে বা গেস্ট হাউস, সরকারি অফিসারদের কব্জায় ।

: আরে অফিসারগুলো নিজেদের ইচ্ছেমতন শহরে ফেরত যায়, দু-তিনটে বছর কোনও রকমে কাটিয়ে । বাড়তি মাইনে, বাড়তি এল টি সি, তবু কি নাকে কান্না ।

: খোঁজাখুঁজি করলে দু’তিনঘর বাঙালি পেয়ে যাবেন । বাঙালি কোথায় নেই !

বেচারা । অতনুর সবই জানা । অফিসের সকলেই জানে এসব । উৎসাহ দেবার বদলে ভয় পাইয়ে দিচ্ছে । কারণ হ্যাঙ্গাম পোয়াতে পারে না বলে, কাছাকাছি শহরেও ক্যাশ রেমিট্যান্স নিয়ে যাবার কাজ এড়িয়ে গেছে এর আগে । সবাই তা জানে । এখন তিরিশ-চল্লিশ বাকসো  পাঁচশ একশ পঞ্চাশ কুড়ি আর দশ টাকার নোট পুলিশ পাহারায় ট্রেনে, তারপর ভ্যানে, ইনার লাইন পারমিটের ভ্যানতারা, স্হানীয় পুলিশকে জানানো, ওফ কি ঝকমারির চাকরি । কিছু অঘটন হলে, যদি বেঁচে থাকে, অতনুকে নিয়ে টানাটানি । গুলি খেয়ে পটল তুললে তো কথাই নেই । অফিস বীমা করিয়েই খালাস ।

মা-কে একলাই চালাতে হবে । সুশান্তকে বলে যাবে বাজার-টাজার করে দিতে । ও বাইরে গেলে মুশকিল ।

সকালেই ভাগলপুর থেকে ফিরেছে সুশান্ত । ওর বড়দা, বড়জ্যাঠামশায়ের ছেলে, যা ডাক্তারের ক্লিনিকে কাজ করে, অনেককাল কমপাউণ্ডার, সেই সত্যেন বোসরায়ের সতেরো বছরের মেয়ে পাপড়িকে বাড়ি থেকে জোর করে তুলে নিয়ে গেছে গুণ্ডারা ।

হিন্দিতে লেখা স্টেটমেন্ট, এফ আই আর-এর জেরক্স অতনুকে দিয়েছিল সুশান্ত ।

“আমি ডক্টর সত্যেন্দ্রমোহন বোসরায়ের স্ত্রী অর্চনা বোসরায় সাকিন বড় পোস্টাপিসের কাছে, কপতোয়ালি থানা, জেলা ভাগলপুর । আজ সতেরো ডিসেম্বর দুপুর একটায় ভাগলপু মেডিকাল কলেজ হাসপাতালস্হিত পুলিশ শিবিরের জমাদারের উপস্হিতিতে মেডিকাল কলেজের এমার্জেন্সি ওয়ার্ডে বয়ান দিচ্ছি যে দুপুর বারোটা নাগাদ যখন আমি পুজোর ঘরে ছিলুম, হঠাৎ আমার মেয়ে পাপড়ির মা-মা চিৎকার শুনতে পাই । চিৎকার শুনে বাইরে বেরিয়ে এসে দেখি চার-পাঁচজন জোয়ান ছেলে আমার মেয়েকে টেনে বাইরে নিয়ে যেতে চাইছে । তাদের মধ্যে জিন্দো এলাকার সাবোর থানা-নিবাসী রামদাস মণ্ডলের ছেলে প্রবীণ সিংহকে চিনতে পারি । অন্য আরেকটা ছেলেকেও চিনি যে ডাক্তার আর এন ঝার স্ত্রীর সঙ্গে দিনকুড়ি আগে এসে প্রবীণের সঙ্গে পাপড়ির বিয়ের প্রস্তাব দিয়েছিল । ওই প্রস্তাব আমি সঙ্গে-সঙ্গে প্রত্যাখ্যান করেছিলুম । আমার মেয়েকে ধরে টানাটানি রুখতে যেই আমি ওদের মধ্যে গিয়ে পড়ি, তক্ষুনি নীল রঙের জ্যাকেট পারা বেঁটে মতন এক ছোকরা আমার দিকে পিস্তল তাক করে । ভয়ে আমি যেই পুজোর ঘরে ঢুকেছি, মেয়ের বাঁচাও-বাঁচাও চিৎকার শুনে তক্ষুনি বাইরে এসে দেখি, প্রবীণ এক হাতে আমার মেয়ের চুলের মুঠে আর অন্য হাতে পিস্তল নিয়ে বেরিয়ে যাচ্ছে । আমাকে দেখে পাপড়ি আমার দিকে এগিয়ে আসতেই, প্রবীণ চে!চিয়ে উঠল, ‘প্রদীপ ঝা, এর মুখ বন্ধন করে দাও ।’ রোগা ফর্সা ছেলেটা আমার মুখে লিউকোপ্লাস্ট এঁতে দিল । তারপর প্রবীণ বলল, ‘এই সুরেশ বুধিয়া, দেখছিস কি, তাড়াতাড়ি উঠিয়ে নিয়ে চল ।’ যে ছেলেটা পিস্তল নিয়ে দাঁড়িয়েছিল, সে এই ফাঁকে পিস্তলটা দিয়ে বেশ জোরে আমার মাথায় মারে, আর হিঁচড়ে নিয়ে যায় আমার মেয়েকে । আমি আবার বাধা দেবার চেষ্টা করলে প্রবীণ গুলি চালায় । রাস্তার সিঁড়িতেও আটকাতে গেলুম তো সেখানে দুটো লোক দাঁড়িয়ে ছিল, দেখলে চিনতে পারব, কোনও ভারি জিনিস দিয়ে আমার মাথা ফাটিয়ে দিলে । এর মধ্যে আমার দেওর আর ওর স্ত্রী এসে পড়ে ওদের আটকাতে গেলে প্রবীণ আবার গুলি চালায় । আমরা চেঁচাতে-চেঁচাতে ওদের পেছন-পেছন গেট পর্যন্ত পৌঁছলে, ওরা একটা শাদা মারুতি গাড়িতে আমার মেয়েকে তুলে নিয়ে পালিয়ে যায় । গাড়ির নম্বর ডি আই ডি ২৮৯৬, আর গাড়িটার কাছে ২২২৩ নম্বরের আরেকটা গাড়ি ছিল । ভেতরে তিন-চারজন, সেটাও মারুতির সঙ্গে পালায় । গাড়ি দুটো বিহার হোটেলের দিকে চলে গেল । আমি আমার ছ’বছরের মেয়ে অর্পিতার সঙ্গে রিকশয় চেপে প্যাটেলবাবু রোডে আমার স্বামীর ক্লিনিকে যাই, আর ঘটনা জানাই । তারপর আমার স্বামী কমপাউণ্ডার শচীন ঘোষকে নিয়ে ভাগলপুর মেডিকাল কলেজ হাসপাতালে চিকিৎসার জন্যে আসি । আমি নিশ্চিত যে প্রবীণ সিংহ, প্রদীপ ঝা, সুরেশ বুধিয়া আর অন্য ছ;সাতজন ষড় করে আর পিস্তল চালিয়ে আমার মেয়ে পাপড়িকে অপহরণ করেছে ।”

পড়ার পর, অতনু জোরে বলে ফেলেছিল, ‘এবার কী হবে তাহলে ?’ সুশান্তর জ্যাঠামশায় নামছিলেন দোতলা থেকে, বললেন, ‘হবে আবার কী ! মারুতি গাড়িটা মুখ্যমন্ত্রীর শালা বাচ্চা ঝা’র । তারপর একটু থেমে, ‘এদেশ থেকে পাততাড়ি গোটাতে হবে ।’

সুশান্তকে এই প্রথম, এত বছরের পরিচয়ের পর, গম্ভীর আর চিন্তিত দেখে, অতনু বিমর্ষ হয়ে পড়েছিল ।

সুশান্তর বাড়ি থেকে একটা ব্লোপ্লাস্ট সুটকেস, কানে ঠুলি দেবার অডিও ডিভাইস, ওর নিজে ট্যুরে যাবার পাতলা বিছানা, ফোলানো বালিশ নিয়েছে, আর সুশান্তর মেজদার একটা ফুলপ্যান্ট জ্যাকেট, যদি দরকারে পড়ে, তাই । যেখানে যাচ্ছে সেখানে জিনসের জামা-কাপড় কর্ডুরয় জুতো বিদেশি অনেক জিনিস পাওয়া যায়, সুশান্ত জানিয়েছে । সস্তায় । সুশান্তর মাধ্যমে, মানসী বর্মণ দিয়েছে ফ্রানসের ইউ ডি কোলোন আর মাস্ক পারফিউম আনতে । আলু ছেঁচকি রুটি আর স্কুলের সময়ের রঙিন ওয়াটার বটল দিয়েছেন মা । উনি ততো চিন্তিত নন কেননা বাবা প্রায়ই যেতেন অমন বাইরে ট্যুরে, অফিসের কাজে । মায়ের সঙ্গে কেমন যেন দূরত্ব গড়ে উঠেছে ক্রমশ, খুব কম কথা হয় । অতনু নিজে ছাড়া কেউই ওর প্রথম ট্যুর নিয়র চিন্তিত নয় । চিন্তায় পাকিয়ে উঠেছে ওর দুশ্চিন্তা ।

কিসের দুশ্চিন্তা, নিজেই ঠাহর করে উঠতে পারছিল না । পেটের মধ্যে পাক খাচ্ছে পিচ্ছিল পাঁকালের দল ।

অতনুর ঊর্ধতন অফিসার, যার এসব কাজের দায়, এসেছিলেন স্টেশানে, লোডিং ঠিকমতো হল কিনা যাচাই করতে, ওয়াগন বন্ধ হবার পর তালাগুলো নাড়িয়ে দেখলেন অনেকবার, সিল করে দিলেন সবকটা তালা অফিসের সিলমোহর মেরে । সুশান্তও এসেছিল, বলল, ‘পাপড়িকে জোর করে বিয়ে করেছে প্রবীণ, কেস দায়ের হয়েছে, কিন্তু পাপড়িকে ওর বাবা-মা ফেরত নিতে চাননি, বেশ গণ্ডোগোল আরম্ভ হয়েছে ।’ আরও থমথমে হয়ে উঠল অতনু, বিমর্ষ, আক্রান্ত, নিঃসঙ্গ ।

ট্রেন ছাড়তে, হাত নাড়িয়ে বিদায় সম্ভাষণ জানাবার মাঝে, অতনুর মনে পড়ে গেল, আচমকা, চিরুনি টুথব্রাশ পেস্ট সাবান দাড়ি কামাবার সরঞ্জাম নিতে ভুলে গেছে ও ।

ট্রেন থামলেই, প্ল্যাটফর্মে নেমে, ওয়াগানটার দিকে খেয়াল রাখছিল অতনু । বারবার ওর ওই প্রকাশ্য উদ্বেগে বিরক্ত প্যারা মিলিটারির সঙ্গী হেড কন্সটেবল জানালো, অত চিন্তার কিছু নেই, অমন ঢের ক্যাশ বাকসো সঙ্গে নিয়ে গেছে ওরা, ডাকাতরা এ-মাল ছুঁতে ভয় পায়, আর এই রুটে মাওওয়াদি পড়ে না ; মাওওয়াদিরাও এই ওঘান ভাঙতে চায় না, নতুন নোটের নম্বরের ট্রেল অনুসরণ করে প্রশাসন ওদের ধরে ফেলতে পারে ।

ঠিক আছে, যা হবার হবে, দেখা যাবে, ভেবে, রুটি আলু ছেঁচকি খেয়ে, বিছানা পেতে শুয়ে পড়ল অতনু । স্বপ্ন দেখল, বাবা পায়ে হেঁটে ট্রেকিং করে, মিউলের পিঠে দু’পাশে টাকার বাকসো ঝুলিয়ে, সঙ্গে লাল মুরেঠা-মাথা বন্দুকধারী পুলিশ, ছ’টা বাদামি কালো মিউলের পাশে-পাশে মালবাহকদের পিঠে সুটকেস বেডিং, যাচ্ছেন হিমালয়ের কোনো ব্যস্ত গঞ্জের কারেন্সি চেষ্টে । হনুমান টুপি, মাফলার, দস্তানা, বালাপোষের কালো কোট । দূরের অস্বচ্ছ হিমবাহের উড়ন্ত শ্বাস খেলে বেড়াচ্ছে সিঁড়ি-ভাঙা সবুজ ধানখেতের ওপর । পায়ের কাছে হলুদ প্রজাপতির চনমনে দল, এই শীতেও, বসন্ত ঋতুকে ডানায় করে নিয়ে চলেছে বাবার জন্য । চড়াই থেকে নেমে ভাঙছেন উৎরাই । সাদা-বেগুনি ঘাসফুলের ছিটে । গলায় ঘণ্টি-বাঁধা উদাসীন গাইগোরু মুখ তুলে আগন্তুকদের এক পলক দেখে, জাবর কাটায় মন দ্যায় ।

ঘুম ভাঙল সেপাই নুরুদ্দিন মণ্ডলের দাড়ি-ঝোলানো ডাকাডাকিতে । ঘুম ভাঙতেই আশঙ্কিত, ভাবল বুঝি গোলমাল, ছিটকে উঠে বসল । না, সকাল । টুথব্রাশ পেস্ট আনেনি শুনে নিমদাঁতন দিয়ে গেল আর দাঁতন হয়ে গেলে গরম চপ আর চা । সুশান্তর উপদেশ অনুযায়ী সেপাইগুলোকে গুড হিউমারে রাখার জন্য এসব ভদ্রতা অতনুরই করার কথা । কিনউ অপ্রস্তুত ভাব কাটিয়ে উঠতে পারছিল না । চা-চপ খেয়ে নিল গোবেচারা নৈঃশব্দে, আলগা চটি বুড়ো আঙুলে ঝুলিয়ে । গন্তব্যে না-পৌঁছানো ওব্দি, ওখানে সরঞ্জাম কেনার পরই দাড়ি কামাবে ।

নুরুদ্দিন আবার খোঁজ করতে এলে, ‘আমি ঠিক আছে, অত ভাবছেন কেন—,’ অতনু বলল ।

‘না, মানে সাহাব বলেছেন আপনি কখনও যাননি রেমিট্যান্স নিয়ে, তাই ।’

‘আরে ঠিক আছে, কেন কষ্ট করছেন মিছিমিছি’— কে এদের এসব বলেছে কে জানে ! অযথা অপদস্হ করা । সবাইকে সব কথা কি না বললেই নয় । স্টেশানে এসেছিলেন শ্রীনিবাসন, ওঁরই কীর্তি, নির্ঘাৎ । ছি ছি ।

পরের স্টাশানে নুরুদ্দিন হিন্দি খবরের কাগজ দিয়ে গেল ।

‘আপনি কি পুলিশে ? একজন মোটামতন বয়স্ক সহযাত্রী, উসখুস বাদ দিয়ে জানতে চায় সরাসরি ।

‘না’ । নোট পরীক্ষক বললে বুঝতে পারবে না আঁচ করে উত্তর দিল অতনু ।

‘ও । সি আই ডি ? সি বি আই ?’

চুপ মেরে থাকাটা বরং ভালো । আর জবাব দিল না অতনু । আবার জেরা আরম্ভ হতে পারে আঁচ করে ওপরে নিজের বার্থে উঠে গেল । সহযাত্রীদের মধ্যে ইন্দিরের খুন, অপারেশান ব্লু স্টার, বোফোর্স, নাগমণির স্ত্রী হত্যা, নির্মল মাহাতো হত্যা, বৈশালীতে মহোবিয়া খুন, জগন্নাথ মিশ্রর বলুয়া গ্রামের কাছে কমরেড রাজকিশোর ঝার হত্যা, বেগুসরায়ে ভাজপা, মাকপা, ইনকা নেতাদের বেরহম পিটুনি, জয়প্রকাশের চ্যালা লালু যাদব নীতিশকুমারদের জাতপাত রাজনীতি, বিধান পরিষদের উপসভাপতি রাজেশ্বরী দাশের দত্তকপুত্রী শ্বতনিশা  ওরফে ববিকে নিয়ে মন্ত্রী বিধায়ক আর তাদের জোয়ান ছেলেদের বেলেল্লাপনা, দলেলচৌক বধৌরায় মুখ্যমন্ত্রী বিন্দেশ্বরী  দুবের হাত, জয়প্রকাশ নারায়ণের সচিব আব্রহাম কী ভাবে শোভা চক্রবর্তীকে ঠকিয়েছে, ধানবাদের মাফিয়া মকদ্দমায় সূর্যদেব সিং সত্যদেব সিং শংকরদয়াল সিং সকলদেও সিং রঘুনাথ সিং কেমন হেসেখেলে ছাড়া পেয়ে গেছে, আর সমস্ত অপদার্থতার কারণ পুলিশ সি বি আই সি আইডির অফিসাররা, এসব গল্প চলে অতনুকে উদ্দেশ্য করে ।

অতনু খবরের কাগজ দিয়ে মুখ ঢেকে নিল নিজের বার্থে শুয়ে । কাগজে লিখেছে, প্রবীণ সিংকে ১০৭, ১৪৮, ১৪৯, ৪৫২, ৩৬৭, ৩৪১, ৩৪২ দণ্ড সংহিতার ধারায় আর অস্ত্র আইনের ২৭ ধারায় গ্রেপ্তার করা হয়েছে । প্রশাসন প্রবীণের আস্তানার খবর পেলেও পুলিশ সে রাতে তাকে বারাহাটে গ্রেপ্তার করতে যায়নি। বারাহাটে ওরা বাহুবলী নেতা ওংকার রামের বাড়িতে উঠেছিল । সেখানেই প্রথমে ধর্ষণ, তারপর বিয়ে ।

অতনুর আবার মনে হল, ‘এবার কী হবে ?’ প্রত্যেকে, সবাই, গোটা রাজ্য উচ্ছন্নে যাবার আর কোনও নজির নেই বোধহয় ।

 

হাতিদহের পোলটা দেখা হল না । খাগাড়িয়া কাটিহার নিউ জলপাইগুড়ি পেরিয়ে গেছে । বিহার থেকে পশ্চিমবাংলায় ঢোকার নিসর্গ পরিবর্তনের মধ্যে শিহরণ বোধ করছিল অতনু ; পরিচিত স্বপ্নের চলচ্ছবির মধ্যে ছুটছিল ট্রেন, বাতাসের গন্ধেও পরিবর্তন ঘটে গেছে যেন ।

গৌহাটিতে ওয়াগন থেকে প্যারা মিলিটারি পাহারায় মাল গুনে-গুনে নামিয়ে তোলা হল অন্য ওয়াগনে । সারারাত স্টেশানে, মশা, কাঁধ ব্যথা, ঘুম নেই, । সকাল দশটায় ইনার লাইন পারমিট সংগ্রহ । শিলচর । বন্ধ কালো ভ্যান । সামনে জিপ পেছনে জিপ । উবড়ো খাবড়া চড়াই । অপ্রতিদ্বন্দ্বী নিসর্গের নয়নাভিরাম নষ্ট হয়ে যায় শরীরের সহ্যশক্তির অসহায় পরাজয়ে । দুর্গম প্রকৃতি আর অনভিপ্রেত ভয়ে বিরক্ত হয় অতনু, ঘুমিয়ে পড়ে ।

 

 

 

Leave a comment

Filed under উপন্যাস

চার

মাল নিয়ে অতনু যখন গন্তব্যে পৌঁছোল, শাখা ম্যানেজার ওর খোঁচা-খোঁচা দাড়ি, উস্কোখুস্কো চুল, নোংরা ধুতি পাঞ্জাবি, চোখের কোণে কাহিল অন্ধকার দেখে, মুখে অমায়িক, করমর্দনের শেষে বললেন, হ আর দন্ত্য স মেশানো কেমন যেন অচেনা ইংরেজিতে, চূড়ান্ত ক্লান্তি সত্ত্বেও বিসদৃশ লাগছিল, কাগজগুলো দিন, রিসিভ করে নিচ্ছি । গোনাগুনি কাল থেকে শুরু করলেই হবে । আজকে বরং জিরিয়ে নিন, খুবই ধকল গেছে দেখছি । কাছেপিঠে হোটেল আছে কিনা জিগ্যেস করতে, উনি জানালেন, থাকার ব্যবস্হা করা হয়েছে, বেয়ারা পৌঁছে দেবে ।

বাকসোগুলো তালিকায় টিক দিয়ে ভল্টে রাখা হলে, ক্যাশিয়ারের নিঃশ্বাসে ভক করে মদের গন্ধ ওড়ায় বিচলিত হয় অতনু । পেচ্ছাপ করতে যাওয়ার নাম করে চাবিটা বেঁধে নিল পৈতেতে ।

বাইরে বেরিয়ে, পিওনের পেছন-পেছন তিন ফার্লংটাক হাঁটার পর যে বাড়িটায় ওরা ঢুকল, তার দেয়ালে ‘ইনডিয়ান ডগস গো ব্যাক’ কালো মোটা বুরুশে, লেখা দেখে হঠাৎ নিজেকে একা বোধ হল অতনুর । আসার সময় রাস্তায় দেখেছে বেশিরভাগই স্হানীয় মহিলা, পুরুষ কম । বাইরে থেকে আসা, কেন্দ্রিয় ভূখণ্ডের একজনকেও দেখতে পায়নি । মনটা চঞ্চল হয়ে উঠল । ওরা ওরা, আমরা আমরা –ওদের আর আমাদের এই বোধের ঝগড়াঝাঁটি থেকে মানুষ বোধহয় কখনও বেরিয়ে আসতে পারবে না । ভিন্ন গ্রহ থেকে বুদ্ধিমান প্রাণী এলে পৃথিবীর মানুষ পারস্পরিক হিংসে থেকে বেরোতে পারে, মনে তো হয় ।

‘এ বাড়ির লোকজন আপনার দেখাশোনা করবেন ।’ কাউকে কিছু বলা নেই কওয়ানেই, খোলা সদর দিয়ে ঢুকে দোতলার একমাত্র ঘরটায় ওকে পৌঁছে দিয়ে, সেলাম ঠুকে চলে গেল বেয়ারা বা পিওন । টিপস দেয়া ঠিক হবে কিনা, এই কুন্ঠা থেকে মুক্ত হবার আগেই, চলে গেল লোকটা, পিওনও বেশ ইংরেজি জানে, হ আর দন্ত্য স মেশানো হলেই বা ।

বাড়ির কেউ খোঁজ নিতে আসবে মনে করে অপেক্ষা করছিল অতনু ।

ঘরটা সাজানো । পোরোনো অ্যান্টিক খাটে শাদা বিছানা-বালিশ, পায়ের কাছে পাট করা কম্বল, ছোট্ট পড়ার টেবিল, সঙ্গে কুশন-দেয়া চেয়ার, ডান দিকে আলোর তলায় বেতের আরামকেদারা, পাশের দেয়ালে গোল, সামান্য পারা-ওঠা আগেকার কালের সোনালি-ফ্রেম আয়না, টেবিলের ওপর দুটো  ওলটানো কাচের গেলাস, জলভরা ঢাকা-দেয়া জাগ খাটের শিয়রে শাদা পর্দা টানা জানলা । রোমান সংখ্যার পুরোনো দেয়ালঘড়ি । মেঝেতে নস্যিরঙা ড্রাগেট ক্ষয়ে গেছে কয়েক জায়গায় । উনিশ শতকী ছমছমে সব মিলিয়ে । এই প্রথম অতনুর হাতে ঘামা ভয়-ভয় ভাব এলো ।

এখন সাড়ে তিনটে বেজেছে । এর মধ্যেই বিকেল । সিঁড়ি দিয়ে নেমে বাইরে বেরিয়ে বাড়ির অবস্হান, ইনডিয়ান ডগস গো ব্যাক লেখা দেয়াল, রাস্তার ওপাশের বাড়ি দুটোর টালির ছাদ আর বাঁশের বারান্দা মগজের স্মৃতিঘরে তুলে রাখল অতনু, যাতে ফেরার পথে হারিয়ে না যায় । মহিলাদের, যারা ওর দিকে অনুসন্ধিৎসু তাকিয়ে পথ দিয়ে যাচ্ছিল, সত্যিই দেখতে ভালো । সমস্ত মোঙ্গোলয়েড নারীর থাকে অপার্থিব চটক, যেন কেউ ছোঁয়নি কখনও, পরাগমাখানো ত্বক । খোকাখুকুগুলোও কেমন গোলাপি । গাল টিপে দিলে কি আক্রান্ত হবে ? কেমন জীবন্ত চনমনে ।

সবাই তাকেই দেখছে । ইনডিয়ান ডগরা বোধহয় বেরোয় না এ-সময় । গায়ে ধূসর আলোয়ান, ধুতি-পরা ডগ দ্যাখেনি । বুড়ো-জোয়ান সব পথচারীই প্যান্ট পরে বেরিয়েছে । মেয়েরা পরেছে স্কার্ট বা শায়ার মতন কিছু ।

ভেতরে কিছু পরে ? অন্তর্বাস পাওয়া যায় এখানে ? এমনিতে দেখে তো মনে হচ্ছে দেহের যা কাঠামো, অন্তর্বাসের প্রয়োজন নেই । অফিসে গৃহবধু আর অবিবাহিতা কর্মীদের আঁটো শাড়ি ছাপিয়ে, অনেকেরই জাঙিয়া ফুটে ওঠে ।

একটা দোকান দেখে থামল অতনু । একটা রাস্তা চলে গেছে পাক খেয়ে দোকানটার ওপরতলার দিকে । সাবান তেল ওষুধ চাল ডাল শুঁটকি মাছ সবই । ক্ষুদে ডিপার্টমেন্টাল দশকর্মা । কোন ভাষায় কথা বলবে অস্বস্তির মাঝেই, দোকানের মহিলা প্রথমে ভাঙা হিন্দি আর তারপর পরিষ্কার ইংরেজিতে জানালেন, যা চাই সবকিছু পাওয়া যাবে, কনডোম থেকে বিশুদ্ধ স্কচ । টুথব্রাশ পেস্ট সাবান চিরুনি সেফটি রেজার ল্যাদার দু-রকম বিদেশি পারফিউম কিনল অতনু ।

করকরে নোটগুলো হাতে নিয়ে  দোকানি বললেন, ‘ও, তুমি এসেছ এবার ? রোসাংলিয়ানাদের বাসায় উঠেছ ? তোমার এগে মোহন রাজবংশী নামে একজন এসেছিল, একশো চব্বিশ টাকা না দিয়ে চলে গেছে ।’

‘আমার থেকে নিয়ে নিন’, অতনু কুন্ঠিত । ‘আমি এসেছি মুম্বাইয়ের হেড অফিস থেকে’, অসৎ লোকের থেকে নিজের পার্থক্য দাঁড় করাতে বেমালুম মিথ্যে বলে ফেলে বিমর্ষ বোধ করল ও । কোথায় যে উঠেছে নিজেই জানে না এখনও । হোটেলের নাম কি ইনডিয়ান ডগস হতে পারে ?  দোকানি জানালেন, টাকাটা উনি ব্র্যাঞ্চ ম্যানেজারের কাছ থেকে আদায় করেছেন ।

ঘোরাঘুরি করতে-করতে অতনু টের পাচ্ছিল যে এখানে কায়িক শ্রম করে মেয়েরা । পুরুষরা কী করে কে জানে ! রাস্তাঘাট ফাঁকা হয়ে আসছে । তার মানে সন্ধে নামলেই জায়গাটা একদম খাঁ-খাঁ ।

রাজবংশীটা শালা এখানেও এসেছিল, রেমিট্যান্স নিয়ে । পাটনায় অফিসারদের ছেলেমেয়েদের জন্যে মাধ্যমিক-উচ্চমাধ্যমিক পরীক্ষক আর ট্যাবুলেটারদের টাকা খাইয়ে বেশি নম্বর পাইয়ে দেবার কাজ করে । এনজেনিয়ারিং ডাক্তারির পরীক্ষায় টুকলির ব্যবসা ।

–কবিতা পিসি, আমরা এই রাস্তায় এসেছিলুম গো ।’

আরে, বাংলা, বাঙালি, এখানে ! অতনু ঘুরে দেখল, হাফপ্যান্ট-পরা কিশোর আর শাদা থানে অশীতিপর বৃদ্ধা, কিশোরের হাত ধরে । কথা বলতে চেয়েও, বলল না, কুন্ঠিত লাগছিল । এই থুথ্থুরে বুড়ির নাম কবিতা । পঁচাত্তর বছর আগে লাগসি ছিল । এখন শুধু পিসি বললেই হয়, রাঙাপিসি ফুলপিসি নতুনপিসি যা হোক । কবিতা নামে যে যুবক ডাকতো সে তো কবিতাকে মর্ত্যে ফেলে রেখে গদ্যের আকাশে । কদমছাঁট ছেলেটির হাত ধরে নেমে গেলেন বৃদ্ধা ।

ঘরে ফিরে অতনু দেখল টেবিলে রাখা রয়েছে টোস্ট আর একটা ফ্লাস্ক, বোধহয় চা বা কফি । টয়লেটে ঢুকে তোয়ালে সাবান আর লাল প্লাস্টিকের বালতি দেখল, গরম জল, চটি, শ্যাম্পু । দাড়ি কামিয়ে স্নান সেরে নিলো ; হোটেলটায় ব্যবস্হা বেশ ভালো ।

কফিটা গরম তখনও, খেয়ে ফেলল টোস্ট দিয়ে । গড়াগ্গড় কম্বল টেনে বিছানায়, পার্স আর সুটকেসের চাবি বালিশের খোলে শিয়রের তলায় ।

ঘুম না আসা ওব্দি ও, অতনু,  ভেবে কুলোতে পারছিল না ইনডিয়ান ডগস কি বাইরের সবাই, ওই কবিতা পিসিও, ডগই বা কেন, বাঁদর গাধা কাক নয় কেন, আমরা বাঙালিরা কাদের ঘেন্না করি, আগে যারা বাঙালিদের ঘেন্না করত তখন তাচ্ছিল্য করে, ধুতি পরে বেরোনো ঠিক হবে না, সুশান্তর দেয়া প্যান্টটা মাপে বড়ো, প্যান্ট দেখে কি ভাববে মা, পৌঁছোনোটা লেখা হল না মাকে, মানসী বর্মণ গায়ে কোথায় লাগাবে পারফিউম, শ্যামলীর বগল শীতকালেও ভিজে থাকে, পচা নোটের গন্ধ ভালো লাগে না, এখানে কদ্দিনে নোট গোনা শেষ হবে, এখানে জমা পচা নোটগুলো  ফেরত নিয়ে যেতে হবে পুড়িয়ে নয্ট করাবার জন্য…..

তার পদবি ধরে ডাকা হচ্ছে শুনে ঘুম ভাঙতে অতনু দেখতে পেল, ঘরের টিমটিমে বিজলি আলোয়, তার মাথার কাছে ঝুঁকে সামান্য মোটা অথচ প্রায় বোজা-চোখ কাঁধ ওব্দি চুল, লাল কার্ডিগানে এক যুবতী, আর তার পাশে বেশ ঢ্যাঙা আরেকজন, গায়ে পশমের স্কার্ফ চোখে শ্লেষ মেশানো কৌতূহল যুবতী, চোখ ততো বোজা নয় । উঠে বসল বিছানায় ।

খাটো মেয়েটা কিছুটা নার্ভাস, বললে, ‘স্যার আজকে নিরামিষই রেঁধেছি, আপনি কি আমিষ খান ?’

‘হ্যাঁ,’ অতনু বুঝল পরিষ্কার আওয়াজ বেরোয়নি গলা থেকে, তাই আবার জানাল, হ্যাঁ, শুধু ডিম আর মুরগি খাই ।’

‘মাছ খান না ?’ জানতে চাইল ঢ্যাঙা যুবতী, জিনসের ঘাগরা । ‘তুমি তো বাঙালি ?’

আবোল তাবোল মাংস আর শুঁটকির বোটকা ভয় অতনুর । বরং নিরামিষ খেয়ে চালিয়ে দেবে । যুবতীর কন্ঠস্বর কিছুটা ভাঙা ভাঙা, শোনেনি এর আগে। এত কাছাকাছি একজন যুবতীর সঙ্গে, একজন নয় দুজন, সে কথা বলতে পারছে । ছি ছি, মিথ্যে কথা বলা উচিত হয়নি ।

‘তুমি ফ্যামিলি আনতে পারতে ।’ বেঁটে মতন যুবতীর খোঁজখবর ।

‘বিয়ে করিনি এখনও ।’ বিছানা থেকে নেমে, টেবিলে রাখা ফ্রাইড রাইসে এক নজর লোভী চাউনি, বলল অতনু । এদের ইংরেজি সত্যি কত ভালো, হ আর দন্ত্য স নেই । নিজেরটায় বাঙালি টান, ভজকট ।

‘ভালো কথা’, এক সঙ্গে বলে উঠল দুজনে । একজন আরেকজনের মাথায় আলতো চাঁটি মেরে, ‘গুড লাক।’

ওরা চলে গেলে, কাঁটা-চামচ থাকা সত্ত্বেও, হাত দিয়ে খাওয়া আরম্ভ করেছে যখন, টেবিলে বিদেশি স্কচের বোতলটা দেখতে পেল অতনু, কিছুটা খালি, পাশে একটা ফুলকাটা কাচের গেলাস । একটু খাবে কি খাবে না নির্ণয় নিতে অস্বস্তি হচ্ছিল । খেয়ে গলমাল করে ফ্যালে যদি, যুবতীদের সঙ্গে অসদ্ব্যবহার করে ফ্যালে যদি নেশার ঘোরে, পিঠের ছাল ছাড়িয়ে নেবে এই বেঙ্গলি ডগের । খায়নি তো আগে । সুশান্তর মতে মদ খাওয়া খারাপ । দেখাই যাক সামান্য । গেলাসে একটুখানি ঢেলে, যদি মাথা ঘোরে, ঘুম না আসে, আবার বোতলে ফেরত ঢেলে দিল অতনু, এঁটো হাতে ।

‘কী হল ? মিশেল দেয়া নয় । আমরা অতিথিদের সঙ্গে জোচ্চুরি করি না ।’ দরোজার কাছ থেকে খাটো মেয়েটার কন্ঠস্বরে অতনু স্তম্ভিত । তার ওপর নজর রাখা চলছে । হোটেল নয় বোধহয় এটা । ধরা পড়ে যাওয়ায় বিব্রত লাগছিল ।

‘না, আমি কখনও মদ খাইনি ।’

‘খাওনো ? তোমার বয়স তো যথেষ্ট !’

‘আমাকে কেউ কখনও খেতে অনুরোধ করেনি । কে জানে কেন খাইনি । ঠিক জানি না ।’

কাছে এসে অতনুর কাঁধে হাত রাখে মেয়েটি । ‘আমি বলছি, খাও । তুমি বোধহয় কোনো নেশাই করো না, তাই না ? ইনোসেন্স রয়েছে তোমার চোখে মুখে আচরণে ।’

মেয়েটির স্পর্শে মানসিক শারীরিক বিচলিত অতনু বলল, সত্যি । আমি কিছুই চেষ্টা করে দেখিনি । তোমাদের এই হোটেলটার নাম কি রোসাংলিয়ানা ?’

‘না।’ চটে যায় যুবতী । ‘আমরা ইংচুঙার । আর এটা হোটেল নয়, গেস্ট হাউস ।’

অতনু কাঁচুমাচু, মেয়েটির পারফিউম কিছুটা ধাতস্হ করে ওকে । একগাল খাবার তোলে ।

‘বান্ধবী নেই ?’ এবার অতনুর কাঁধে আঙুলের চাপ দিয়ে মেয়েটি সহজ করে তোলার চেষ্টা করে আবহকে ।

‘না’ । আমূল নড়ে ওঠে অতনুর টনক ।

‘কিন্তু তোমার তো বয়েস হয়েছে বেশ ।’ কাঁধ থেকে হাত সরিয়ে মাথার চুলে বিলি কাটে মেয়েটি ।

অতনুর গলায় শ্লেষ্মা জমে ওঠে, শরীরে সাড়া বোধ করে । ‘অনুভব করিনি কখনও ; কেউ আমার প্রতি আকৃষ্ট হয়নি, তাই ততটা অনুভব করিনি ।’

‘তুমি তো ভারজিন?’

অতনু বিস্মিত বিচলিত হতবাক । একই সঙ্গে শীত করে, গরম লাগে । এত কাছ থেকে নারীর শরীরের সুগন্ধ পায়নি এর আগে । দেহের কোন গোপন গ্রন্হি থেকে আসে এই ঘ্রাণের সংকেত । মা-ও এভাবে হাত বুলিয়ে দেয়নি কতকাল । ওকি তাকাবে মেয়েটির দিকে ? তাকালে যদি চোখাচুখি হয় ? মেয়েটি যদি ওর চোখে উদ্দেশ্য খুঁজে পায় ! নাঃ, এখন থাক, পরে সময় মতন খুঁটিয়ে দেখে নেবে দুজনকেই ।

গেলাসে সামান্য হুইসকি ঢেলে, জল না-মিশিয়েই, গিলে ফেলল, আর গা গুলিয়ে উঠল সঙ্গে সঙ্গে । বাকি ফ্রাইড রাইস খাওয়া যাবে না আর । কী অভাবনীয়! সামান্য এক চিলতে স্পর্শে তার চরিত্রের গিঁটগুলো খুলে যাচ্ছে । অস্তিত্বের অচেনা জটিল দুঃখ জমাট বেঁধে গেছে গলায় । কই, জীবন নিয়ে তো ও অসন্তুষ্ট ছিল না এতকাল । কোথায় আর কেনই বা লুকিয়ে ছিল গোপন ফোঁপানি !

থালা গেলাস তুলে নিয়ে যেতে-যেতে মেয়েটি জানিয়েছিল, ওরা দু’জনে এই গেস্টহাউসের হাউসকিপার রাঁধুনি ঝি ধোপা সবকিছু । প্রতিদিনের খর্চাখরচ জানিয়ে দিয়েছে তো ম্যানেজার ? অতনু যেন সবাইকে বলে না বেড়ায় ।

নেশাটা বেশ ভালো লাগছে টের পেয়ে বেশ শিহরিত হচ্ছিল অতনু । বিবেক কাকে বলে ! বিবেকের ভালো লাগছে । পাটনায়, বিহারের পথে শহরে গ্রামে গঞ্জে যা ঘটছে, তা ? দরোজায় ছিটকিনি তুলে, মশারি টাঙিয়ে, আলো নিভিয়ে, শুয়ে পড়ল ও । বাইরে শুরু হয়ে গেছে বৃষ্টির টাপুর । সজ্ঞানে বাড়াবাড়ি করছিল বাতাস । অতনু ভাবছিল লোকে কি করে মিজো নাগা কুকি মণিপুরি নেপালি নেওয়ারি ভুটানি খাসি লেপচা চিনা জাপানি ভিয়েতনামির তফাত করে ? ফর্সা হলে, অনেকটা চ্যাপ্টা চেহারার বাঙালিও গুলিয়ে যাবে ।

 

দরোজার কড়া নাড়ানাড়ির শব্দর ঘুম ভাঙতে, কম্বল মুড়ি দিয়ে ছিটকিনি খুলতেই ব্র্যাঞ্চ ম্যানেজার । জিনস, চামড়ার জারকিন, কুতকুতে হাসি, বলল, ‘স্যার দরোজা জানলা বন্ধ করে ঘুমোচ্ছেন ! এখানে চুরি-ডাকাতির ভয় নেই । বাইরে চেয়ে দেখুন তো কি টাটকা বাতাস, বুক ভরে টেনে নিয়ে যান নিজের দেশে, সারা জীবন কাজে দেবে । দেখছেন তো কত শিগগির সকাল হয়। খাওয়া-দাওয়া ঠিকমতন হয়েছে তো রাত্তিরে ? এরা দুই বোন খুবই ভালো । অসুবিধা হবে না আপনার । ছোটো দেখতে, ও-ই অবশ্য বড়, জুলিয়েট । লম্বা দেখছেন যাকে, ছোটো, জুডিথ ।

ভোরবেলা উঠেই টাকার কথা পাড়া বিসদৃশ, কে জানে এখানে রোজকার খরচ কত, এমন ঢালাও ব্যবস্হা । লোকটাকে বসতে বলে টয়লেটে ঢুকল অতনু । হেগে, দাঁত মেজে, ঠাণ্ডা জলে মুখ ধুয়ে টয়লেট থেকে বেরিয়ে বলেই ফেলল অতনু, ‘কিন্তু এখানে থাকতে বেশ খরচ পড়বে মনে হয় ।’

‘না না, কে বললে ? আপনারা রোজকার যা হলটিং পান, তার চেয়ে অনেক কম। যাবার সময় কেনাকাটার পয়সা থাকবে । একদিন আমাদের অফিসের গাড়িতে ঘুরিয়ে আনব আপনাকে । রবিবার চলুন না । এরপর তো আর এসব জায়গা দেখা হবে না ।’

যাক, লোকটা বকবক করতে পারে । অতনু আশ্বস্ত । ওকে বেশি কথা বলতে হবে না ।

‘যে-জন্যে সাত সকালে এলুম, সন্ধে তাড়াতাড়ি হয়তো, তাই ওভারটাইমটা সকালে হয় । আর ছোটো ডিনোমিনেশানের নোটগুলো গুনটে একটু সময় লাগে । আপনি রেডি-টেডি হয়ে সময়মত আসুন ।’

ট্রেতে দু’কাপ কফি আর নোনতা বিস্কুট নিয়ে এসে টেবিলে রাখল কালকের খাটো মেয়েটি । কাঁধ ওব্দি কালো চুল আঁচড়ে নিয়েছে এই ভোরেই । নীল কার্ডিগান, পশমবোনা হলুদলাল স্কার্ট । ফিকে হলুদ আর গোলাপির মাঝামাঝি গায়ের রঙ । নখ খায়, কফি এগিয়ে দেবার সময় আঙুল দেখে মনে হল ।

‘ঠিকমতো দেখাশুনা করছ তো এনার ? এনারাই বাজারে টাকা ছাড়েন যখন যত ইচ্ছে । পুড়িয়ে নষ্ট করেন যখন যত ইচ্ছে । কী বলেন স্যার ?’

‘উনি বেশ ভিতু, দরোজা বন্ধ করে ঘুমোন ।’ রাশভারি যুবতীর কন্ঠস্বর ।

‘মুখ ধোবার গরম জল ছিল না’, অতনু বলে ফেলল ।

‘এনেছিলাম, দরোজা বন্ধ ছিল ।’ পর্দা সরিয়ে নেমে যায় তরতর ।

অত গরম কফি সপাসপ চুমুক মেরে উঠে দাঁড়াল ম্যানেজার । ‘আমি তাহলে উঠে, আপনি তাহলে তৈরি হয়ে চলে আসুন ঘণ্টা দেড়েকের মধ্যে ।’

নিচে থেকে খিলখিল হাসাহাসি শোনা গেল । খাটের শিয়রের দিকের জানলার পাল্লা খুলে অতনু বিমূঢ় । রাতের বৃষ্টি কোনও প্রমাণ রেখে যায়নি । কোঁকড়া কেশদামের মতন ঘন সবুজ পাহাড়ের পাদদেশে আলুলায়িত বাঁশঝাড় । জানলা থেকে ধাপে ধাপে নেমেছে টালির ছাদের চালাঘর । ঝকঝকে আকাশে বেরিয়ে পড়েছে হুড়ো মেঘের দল । প্রায় প্রতিটি পাহাড়েই আধখোলা বিনুনির মতন দোল খাচ্ছে দু-একটা ঝরণা । অনেক নীচে এক চিলতে উপত্যকায় দশ-বারোটা শাদা-কালো ছাগল; গোরুও হতে পারে । ট্রেনে-ভ্যানে সফর করার সময়ে ঘটেনি তো এরকম ভালোলাগা ।

পৃথিবী এখানে দিন গুজরান করে । চরাচর জুড়ে, এক গৃহবিমুখ নিভৃতি । ভাব বিনিময়ে মশগুল মোহিনী বাতাস । হালকা হাওয়ায় অদৃশ্য বস্তুকণাদের নিঃশব্দ বেতার গুঞ্জন চলছে ।

–স্যার, আপনার ব্রেকফাস্ট । গরম জল দিয়েছি বাথরুমে । চান করবেন না বেশি, শরীর খারাপ হবে ।

ঢ্যাঙা যুবতী । মেরুন ডেনিমের ফ্রক । বাদামি কর্ডুরয়ের ডাঙ্গারি । ববচুল । কাঁধের ওপর ঝটপট মাথা ঘোরায় । নখে নখপালিশ । টানা ছোটো-ছোটো চোখ । অত ফর্সা নয়, তবুও যথেষ্ট ফর্সা । বেশ আলাদা দেখতে দুজকে ।

–তোমাদের দু’জনের মধ্যে কে বড় ?

বলে ফেলে, আনন্দ হয় অতনুর । কথাবার্তা নিজের তরফ থেকে, আরম্ভ করতে পেরেছে । এরকমটা তার কাছে নতুন ।

–জানি না ।

অতনু বুঝতে পারল না, এটা উদাসীনতা, বিরক্তি, না সম্পর্ক সহজ করার তারল্য ।

স্নান সেরে সুশান্তর দেয়া শার্ট-প্যাণ্টে পালটাল নিজেকে । ব্রেকফাস্ট মানে টোস্ট আর ডিম । কানে গানের ঢুলি লাগিয়ে বেরোবার সময়, সিঁড়ির শেষ ধাপে দাঁড়িয়ে, ভেতরে উঁকি দিয়ে কাউকেই দেখতে পেল না ।

রাস্তায় আর তেমন দৃষ্টি আকর্ষণ করছিল না পথচারীদের । আশ্বস্ত লাগল । কারোর ব্যস্ততা নেই । অতনুও নিজের তাড়াহুড়োয় ঢিলে দিলো, দিয়ে আরাম বোধ হল কানে; সুশান্তর প্রিয় গজল, পঙ্কজ উদাসের । ম্যানেজার, কে জানে কী নাম লোকটার, পরিচয় দেয়নি নিজের, জানালো , কর্মচারীরা কেউ আসেনি এখনও, তবে চিন্তার কিছু নেই, যতদিন গুনে বুঝে নিতে সময় লাগে, আরাম করুক অতনু । ইচ্ছে করলে কাছেপিঠে ট্রিপল এক্স ভিডিও পার্লারে যেতে পারে, আফরিকান,আমেরিকান, থাই্যাণ্ডের ফিল্ম । যদি চায় তো অন্য শহরে যেতে পারে । বাড়ি থেকে ঘুরে আসতে পারে দিন দশেক । যারা রেমিট্যান্স নিয়ে আসে সবাই করে এসব । রাজবংশী তো বর্মায় গিয়ে অনেক কেনাকাটা করেছিল ; টাকাই সীমান্তের পাসপোর্ট-ভিসা।

–আমি এক জোড়া জুতো কিনতে চাই ।

–আনিয়ে দেবখন দোকান-টোকান খুলুক । আপনার চটি জোড়া দিয়ে দেবেন, ওই মাপের নিয়ে আসবে ।

–আমি বরং একটু ঘোরাঘুরি করে আসি ।

–তা কেন, আমি লোক দিয়ে দেব আপনার সঙ্গে । সকলে তো আর ইংরেজি জানে না । যদিও কেউ ঠকাবে না আপনাকে । বেলা আরেকটু বাড়ুক, তারপর বেরোনো যাবে ।

কাঁচুমাচু অতনু বসে থাকে চুপচাপ, কানের গানে এবার আশা ভোঁসলে । বাইফোকালে স্হানীয় খবরের কাগজ পড়ে আপাতগম্ভীর ম্যানেজার । কর্মচারীরা একজন-দুজন করে আসতে থাকে, অলস হাত তুলে সুপ্রভাত জানায়, একই ভঙ্গীতে অতনু ।

জীবন এখানে অতিবাহিত হয় । নির্লিপ্ত নিসর্গ মানুষের সাতে-পাঁচে নেই । এখানে বোধহয় আদিকাল থেকে কেউ কখনও চিৎকার করেনি ।

–আচ্ছা, একটা মোটর সাইকেল পাওয়া যাবে ? ভাড়ায় ?

–মোটর সাইকেলে যাবেন কো০থায় ? শেষে ছেলে-ছোকরাদের হাতে বিপদে পড়বেন ।

–তাহলে সাইকেল, জায়গাটা দেখি ।

–না না, সাইকেলে কী ? দুদিনে সবাই জেনে যাবে । আপনি আমার অতিথি । সাইকেল মানায় না ।

–এখানেও আছে ওসব ?

–বড়ো-ছোটো সব জায়গাতেই আছে স্যার । তাড়া কিসের ? জিপে করে সব দেখিয়ে দেবো । এই তো এসেছেন ।: দুচারদিন শরীর এলিয়ে দিন । আরাম করুন । বলেন তো বিয়ার আনাই ।

–আনান । বলে ফেলতে পারল অতনু । বলে ভালো লাগল ওর, ভারমুক্ত মনে হল । অফিসে বসে বিয়ার জিনিসটা মন্দ নয় । বিয়ার জিনিসটা সম্পর্কে ধারনা হবে । খটকা লাগছিল অতনুর । কাছে-পিঠে চেনা-জানা কেউ নেই বলে কি খোলামেলা অনুভব করছে, নাকি বাঁক দিতে চাইছে নিজের ঘটনাহীণ উদ্দেশ্যহীন জীবনকে, নাকি ও আর অতনু থাকতে চায় না, বিরক্তি ধরে গেছে একঘেয়ে অতনুতে !

কাচের জাগ উঁচু করে চিয়ার্স হল । বেশ কিছুক্ষণ বসে-বসে কয়েক জাগ । সামনের চেয়ার টেনে তার ওপর ঠ্যাং তুলে চোখ বুজল । ঘুম-ঘুম আমেজে পড়ে রইল ডান কাঁধে নিজের মাথা ফেলে । ঘুমিয়ে পড়েছিল ।

‘আপনার চাবিটা দিন, কাজ আরম্ভ করাই’, ম্যানেজারের কন্ঠস্বর শুনে আচমকা উঠে দাঁড়ায় অতনু, সোয়েটার শার্ট খোলে, চাবিসুদ্দু পৈতে কাঁধ থেকে নামায়, পৈতেটা ম্যানেজারের হাতে দিয়ে সোয়েটার পরে । ঘাড় গুঁজে ঠ্যাং তুলে বসে থাকে, আগের মতো । অপরিচিত ঘূর্ণীঝড়ের ঝিমঝিমে কুয়াশাময় রাজধানি প্রতিষ্ঠিত হচ্ছিল মগজে ।

–ঠাণ্ডা না লাগে ; আপনি আরাম করুন । চিন্তা নেই । ক্যাশিয়াররা সামলে নেবে ।

যাঃ, হঠাৎ মনে পড়ল অতনুর । পার্স আর সুটকেসের চাবি রয়ে গেছে বালিশের খোলে । ফিরে যাবে কি ? কোনও ছুতো ? ছিঃ, এরকম ভাবনাচিন্তা অনুচিত । জেটজাহাজের ঘনঘোর আওয়াজ বিরক্তি ঘটায় । বহুক্ষণ চুপচাপ ।

–আমি বাই এয়ার গৌহাটি হয়ে পাটনা ফিরব । একটা ওপন টিকিট কাটিয়ে দেবেন ।

–আজই কেটে রাখছি । যেদিন যেতে চাইবেন । ভিআইপি কোটায় পেয়ে যাবেন । কোনও চিন্তা নেই ।

–আচ্ছা, এখানে লাইব্রেরি নেই ?

–লাইব্রেরি ? চার্চের আছে ।

–চার্চ ? থাকগে, চাবির সঙ্গে আমার পৈতেটাও দিয়েছি, দেখুন তো, পৈতে মানে ব্রাহমিন’স স্যাকরেড থ্রেড ।

–এই যে, খামে ভরে রেখে দিয়েছে ক্যাশিয়ার ।

পৈতের খামটা  পকেটে পোরে অতনু । বাবা কালীঘাটে নিয়ে গিয়ে দিয়েছিলেন । মন দিয়ে ভেবে দ্যাখেনি এতদিন, রুটিনের মধ্যে আটক থেকেছে, বোকার মতন পৈতে পরে থেকেছে, মানে হয় না কোনও । অরিন্দম তো পাগল হবার আগেই ফেলে দিয়েছে । সুশান্ত নিচু জাতের কচি মেয়ের সঙ্গে নিশ্চই মানিয়ে নিয়ে সংসার করছে । আমিই যতোসব ফালতু আচার-বিচারে আটকে থেকেছি ।

–আপনাকে বর্মা মানে মাইনামার আর বাংলাদেশ থেকেও ঘুরিয়ে আনতে পারি । যাবেন নাকি ?

–আমার তো পাসপোর্ট নেই ।

–ওসব দরকার হয় না, লোকে দুবেলা যাচ্ছে আসছে ।

গোঁজ হয়ে বসে থাকে অতনু, হাঁ-মুখ সামান্য খোলা, নেশার অনভ্যাস, ভাবছিল । সুযোগ হাতছাড়া করা বোকামি । জীবনে অনেক সুযোগ হারিয়ে যায়, আর আসে না, বুড়িয়ে মরে যায় মানুষ । মুখার্জি ছিল যতদিন, হাতছাড়া করেনি,সুযোগ, জল ঝড় জ্বর ক্লান্তি শরীর খারাপ হাঁচি-কাশি যা-ই হোক, । অরিন্দম নিয়েছে ছোটো-ছোটো সুযোগের সকাল দুপুর সন্ধে, হয়তো না ভেবেই, মেরুর টান এড়াতে পারেনি । অসময়ের ফল আর আনাজ এনে ব্যবসা করত সুশান্ত । সুযোগ, সুযোগ, সুযোগ ।

–হ্যাঁ, যাবো, যাবার আগে জুতো কিনতে হবে ।

–চলুন আমার কেবিনে গিয়ে বসবেন । ঠিকমতো আয়েস করতে পারবেন ।

কার্পেট পাতা বিরাট কেবিন । অনেক বড়ো টেবিল । বেশ উঁচু গ্রেডের ম্যানেজার তার মানে । কথাবার্তায় আচরণে টের পাওয়া যাচ্ছিল না । সোফায় আধশোয়া, তন্দ্রার কুয়াশায় ভেসে বেড়াচ্ছিল অতনু । কাচের পার্টিশানের ওধারে, দেখল, আধভেজা চাউনি ভাসিয়ে, পাথরঘষা প্যান্ট আর স্পোর্টস জুতো পরা বাবরিচুল কর্মচারীরা ঢুলু চোখে, জলভেজা স্পঞ্জে আঙুল ছুঁইয়ে, ও নিজে যেমন গুনত চাকরিতে নতুন ঢুকে, অলসচাকা মেশিনের ঢঙে গুনে চলেছে একের পর এক প্যাকেট । কাউন্টারে মহিলা কর্মী সোয়েটার বুনছে সবুজ উলে, সবুজ গোলাটা উল ছেড়ে-ছেড়ে পাক খাচ্ছে মেয়েটার কোলে । ম্যানেজার মগ্ন চারভাঁজ সংবাদে । জীবন সব জায়গায় বোধহয় একইরকম । এই প্রবাহকে বিরক্ত করে এগিয়ে চলে, রেশ কাটাতে-কাটাতে, মানুষের সমাজ । সত্যি, অতনুর মনে হচ্ছিল, বাস্তব ব্যাপাটাই আজগুবি ।

লাঞ্চ করতে গেস্ট হাউসে ফিরে ভাত আর মুরগির মাংস ভালো লাগল অতনুর । বাড়ি থেকে বেরিয়ে ওব্দি খাওয়া হয়নি ঝরঝরে গরম ভাত । রুটি পাঁউরুটি চপ সিঙাড়া ওমলেট কাটলেট ফুলুরি লুচি চিনেবাদাম পেঁয়াজ-মুড়ি খেয়েছে, পেলে চার বেলা, না পেলে অভুক্ত । পেটের ভুটভাট ভাতের ধবধবে শরীর দেখে থেমে গেছে । খেতে-খেতে নজরে পড়ল, টেবিলের ওপর পার্স আর চাবি, বিছানা গোছগাছ । হাত ধুতে গিয়ে টয়লেটে দেখল গেঞ্জি আন্ডারওয়্যার কেচে অ্যালুমিনিয়াম আলনায় মেলে দেয়া ।  ট্রেনের ধুতি পাঞ্জাবি নেই । ভালো লেগে উঠল এক ঝলক ।

আর ব্র্যাঞ্চে ফিরে না গিয়ে, কুঁকড়ে চাদর চাপা দিয়ে, গান শোনার ঠুলি আর যন্ত্র বালিশের পাশে, জামা-ট্রাউজার পরেই শুয়ে পড়ল অতনু । দেয়ালে মুখ গোঁজ করা ঘড়িতে দুপুর একটা, পাটনার দুপুর, এখানে বিকেল হয়ে এসেছে । ঘুমিয়ে পড়েছিল ।

আবছা রবীন্দ্রসঙ্গীত শুনে, মুখ বের করে দেখল, গোধুলীর আলোরাঙা প্রায়ান্ধকার, জুলি একটা ট্রানজিসটার হাতে, শিয়রে রেখে বলল, ‘ঢাকা, বাংলাদেশ, তোমার গান।’ মম চিত্তে নিতি নৃত্যে কে যে নাচে তাতা থৈথৈ তাতা থৈথৈ তাতা থৈথৈ তারি সঙ্গে কী মৃদঙ্গে…

মেয়েটির কথায় কাঁজি ভাতের স্নিগ্ধ সুরভি । অতনু বলল, প্রায় স্বগতোক্তি, কিন্তু আত্মসমর্পণের স্বরে, ‘তোমার দাঁত কত সুন্দর।’ ধন্যবাদ জানিয়ে চলে যায় মেয়েটি । কেমন রেশমের মতন মসৃণ চুল । যমের তেজ দিয়ে এই চুলই তৈরি হয়েছিল নিশ্চই । বুক ? চাঁদের আলো দিয়ে হয়তো গড়া । বরুণের বরাভয় দিয়ে পায়ের গোছ আর উরু । এ বাড়ির একজন যুবতী সম্পর্কে এরকম চিন্তাধারা অনুচিত । কিন্তু কী করবে, ভেবে ফেলছে যে ! ইনডিয়ান ডগ হয়ে গেছে ভেতরে ভেতরে ।

জুলির ডাকে ঘুম ভাঙল অতনুর । কপালে হাত রেখে মুখ নামিয়ে আলতো বলেছিল, ‘স্যার।’ এত নিকট থেকে এর আগে কখনও দেখেনি কোনো যুবতীকে, কোনো মহিলাকে, মাকে ছাড়া । কেমন বিসদৃশ অচেনা গন্ধ এর উপস্হিতিতে, বুনো আর তেতোতেতো অথচ আকর্ষক । বিব্রত ও, অতনু । উঠে বসে ধড়মড় ।

‘চলো আমাদের সঙ্গে চা খাবে ; একা-একা তোমার সময় কাটবে না, মুখ ধুয়ে নাও ।’ বলল জুলি, সামান্য হাসি, লিপ্সটিকহীন গোলাপি ঠোঁটে ।

মুখ ধুয়ে জুলির সঙ্গে নিচে নামল অতনু । নিচের তলাটা দেখার ইচ্ছে ছিলই । কতজন থাকে । কে কী করে । আর ক-জন আছে গেস্ট হাউসে । ঘরগুলো কেমন সাজানো । বাড়ির লোকেরা কোন ভাষায় কথা বলে, কেমন লাগে শুনতে । তাছাড়া, কোনো যুবতীকে সম্পূর্ণ জানতে গেলে তার বাড়িটাও দেখতে ইচ্ছে করে, মনে হল ওর ।

হলঘর । একপাশে রান্নাঘর । অন্যপাশে বোধহয় দুটো শোবার ঘর । হলঘরে জানলা নেই । হলঘরেই, রান্নাঘরে ঢোকার মুখে, গোল ডাইনিং টেবিল ঘিরে ছটা গথিক ঢঙ চেয়ার, শোবার ঘরের দিকটায় বাদামি ফোমলেদারের ঢাউস সোফার দুপাশে টিপয়ের ফুলদানিতে বেগুনি রঙের অচেনা ফুলের তোড়া, সুগন্ধ বিলোচ্ছে ফুলগুলো, বা হয়তো জুডি । রান্নাঘর থেকে জুডি বেরিয়ে এসে, ‘হভালো’ । অতনুও ‘হ্যালো’ প্রত্যুত্তর দিয়ে সোফার দিকে বসার জন্য এগোতে, জুলি বলে উঠল, ‘স্যার, কিচেনে এসো, আমাদের সাহায্য করবে ।’ রান্নাঘরে ঢুকে, জানলা দিয়ে দেখল অতনু, সন্ধ্যাকাশে গুটিগুটি বেরিয়ে পড়েছেইসকাপন রুইতন চিড়িতন হরতনের দুরি তিরি নওলার দল ।

অতনু : আমি তো কিছু করতে জানি না, কী সাহায্য করব ?

‘কেন ? বাড়িতে কোনও কাজ করো না ?’

‘বাড়িতে তোমার কে-কে আছেন ?’

অতনু : মা আছেন ।

‘মাকে সাহায্য করো না ? উনি একলাই সব করেন ?’

‘বাবা নেই ? ভাই-বোন ?’

অতনু : না, কেউ নেই । বাবা আত্মহত্যা করেছিলেন । উনি মারা যাওয়ায় এই চাকরিটা পেয়েছিলুম ।

‘তোমার বাড়ির বেশ দুঃখের গল্প আছে, না ? বোলো আমাদে, পরে । এখন আমাদের সাহায্য করো । বাড়ি ফিরে গেলে মাকে সাহায্য করতে পারবে । এক মাসে আমরা তোমায় অনেক কাজ শিখিয়ে দেবো । তোমার মাকে বলতে পারবে, অনেক সাংসারিক কাজ শিখে এসেছ । মায়ের শরীর খারাপ হলে একাই সামলে নিতে পারবে ।’

‘আচ্ছা, দেয়ালে মিলিটারি পোশাকে ওই ফোটোটা কার ?’ প্রসঙ্গে পালটাতে চায় অতনু । জুলি-জুডির কথা শুনে প্রথমবার ওর মনে হল যে সত্যিই তো, মাকে সাহায্য করা উচিত ছিল ওর; কখনও তো ভেবে দেখেনি যে মাকে সব কাজ একা করতে হচ্ছে ; বাবা তো মাকে কত রকমভাবে সাংসারিক কাজে সাহায্য করতেন ।

বহুকাল পর, ফিরে যাবার কয়েকদিন আগে, ছুটির দিনের সকালে, ফোটোটা কাছ থেকে দেখে, বিভ্রান্ত হয়ে গিয়েছিল ও, অতনু । বিপর্যস্ত আর হতচকিত ।

‘ফোটোটা আমার বাবার ।’ জুলি জানিয়েছিল, যে কথার মধ্যে, বলবার ঢঙে, বেশ বোঝা গিয়েছিল, কেমন যেন এক ধাঁচের জাতি-স্বাতন্ত্র্যের অহংকার । জুডি বলেছিল, ইনডিয়ান আর্মির হাতে মারা যান ।’

এখন, ফোটোর কাছ থেকে সরে এসে, প্রসঙ্গ বদলাতে নিজেকে বাধ্য করল অতনু । চোট্টো ট্রানজিসটারটা দেখিয়ে, ‘এই হিন্দি গানটা সিমন গারফাংকেলের এল কোনডোর পাসার নকল । আর বলে ফেলেই, ফিরে এলো প্রসঙ্গটায়, ‘তোমার বাবার মানে ? জুডি তো তোমার বোন !’

‘আমাদের মা এক কিন্তু বাবা আলাদা ।’

‘মা-ও মারা গেছেন বুঝি ?’

‘না, ঠিক জানি না, মাও আবার বিয়ে করেছিলেন । তুমি কি গানের বিষয়ে পড়াশোনা করেছ ?’

‘এস পি মুখার্জি, আমাদের অনেক বড়ো অফিসার, ওনার কাছে হাতেখড়ি ।’ প্রতি রাতে সন্ধে সাতটায় মৃদুমন্দ আলুলায়িত গান, আর নিশি পাওয়া পারফিউম, আর শীতাতপ বিছানা, আর মনমাতানো নারীদের গল্প, দু’জন অবিশ্বাসী কাহিনিখোরের চাউনিকে পুলকিত করে, বিস্ফারিত শোনালো ও, অতনু । দাশগুপ্তের গল্প । অরিন্দমের গল্প ।

‘ভালোবাসা চিরকাল ক্ষণস্হায়ী ।’

‘আর ক্ষতিকর ।’

প্রখর মন্তব্যে অতনু থ । হালকান । বোঝার চেষ্টা করে দু’জন যুবতীর অগাধ দৃষ্টির থমথমে চপলতায় অভিজ্ঞতা নাকি শিক্ষা নাকি প্রতিদিনের গতানুগতিক যাপন, কোন ঝড়ের কেন্দ্র জুগিয়েছে এমন আপোশহীন মন্তব্যের আশ্রয় ! নিজেকে কেমন যেন অনুগ্রহভাজন মনে হল । কেমন যেন অবাক শিহরণ । কেমন যেন অকথিত রোমাঞ্চ । কেমন যেন মুক্তির আবেশ । কেমন যেন সমুদ্র-তলদেশের তোলপাড় । কেমন যেন উৎকন্ঠা, উদ্বেগ, শঙ্কা ।

‘পেঁয়াজের পাতাগুলো ছোটোছোটো করে কাটব ?’

কাঠের ক্ষয়ে যাওয়া চৌকো তক্তার ওপর ছুরি দিয়ে পেঁয়াজ কাটে অতনু । বরবটির মতন দেখতে অথচ ছোটোছোটোসবুজ সবজি কাটে । টোমাটো । ডিম ফাটাতে শেখে । চামচে দিয়ে ফেটাতে । আলু আর গাজর ছাড়াতে । শুয়োরের মাংস ধুতে, চাল আর ডাল বাছতে । শুয়োরের মাংসে খিছুড়ি, রেঁথে গর্ব হয় অতনুর । দুজনের দেহের সঙ্গে ছোঁয়ায় অতনু পুলকিত হতে থাকলেও, কাজে উৎসাহিত হতে থাকলেও, ওরা তা নিয়ে  একেবারেই চিন্তিত নয়, অস্বাভাবিক মনে করছে না । অতনুকে সহজ করে তুলতে চাইছে ওরা, বাড়ির একজন সদস্য করে তুলতে চাইছে, মনে হল ওর ।

কুকারে শুয়োরের মাংস সেদ্ধ হবার নির্ধারিত সময়ের অপেক্ষায় যখন ওরা তিনজন খাবার টেবিল ঘিরে, আলো জ্বালানো হয়নি হলঘরে, নিজের বাড়ির গল্প করে ফেলেছে অতনু, রাঘব আর রমা বৌদির, সুলতানা আর ননীদার, মানসী বর্মণের রূপের, শ্যামলী কর্মকারের ঠেকার আর পিঠে প্রজাপতি-জড়ুলের, পিওন রসিক পাসওয়ানের আঙুলকাটার, ইন্দিরা গান্ধির হাতির শুঁড়ের ধাক্কায় সুশান্তর গরদান ঘুরে যাওয়া, শিমুলতলা, পাপড়ি বোস, নির্মল মাহাতো, তখন হঠাৎ ট্রানজিসটারে একটা হিন্দি গান আরম্ভ হলে অতনু বলল, ‘এই গানটা বিটলসদের অ্যাণ্ড  আই লাভ হার সুরের নকল ।’

অতনুর এই প্রথম খেয়াল হল যে, গান ওর ভালো লাগত না, গান সম্পর্কে জ্ঞানও, তা ভেবে দ্যাখেনি, আশ্চর্য । এই যুবতী দুজনের ক্ষণিক সঙ্গও ওকে গানের দিকে টেনে নিয়ে চলেছে ; এদের ছোঁয়ায় রয়েছে সঙ্গীতের উৎস । এতকাল ও একাকীত্ব এনজয় করত, নিঃসঙ্গ থাকতে ভালো লাগত, সকলের সঙ্গে কথা বলতে চাইত না । নিজস্ব একাকীত্বের পরিসর তৈরির জন্য কানে গানের ঠুলি দিয়ে রাখত যাতে কেউ যেচে কথা বলতে বিব্রত বোধ করে ।

রান্নাবান্না হয়ে গেলে অতনু শিখল, যেন ও প্রথম নাচতে শিখছে, কেমনভাবে থালা বাটি গেলাস চামচ ছুরি কাঁটা সাজানো হয় টেবিলে । রান্নাঘর পরিচ্ছন্ন । গোছগাছ । খাবার টেবিলের আসেপাশে মেঝেতে পড়ে থাকা নোংরা পরিষ্কার । ওরা দুজনে হাতমুখ ধুয়ে পরিচ্ছন্ন হতে গেলে, এত সহজে এত কথা বলতে পারছে বলে আত্মতৃপ্তির স্মার্টনেস অনুভব করছিল অতনু ।

দুজনে প্রায় একই সময়ে বেরিয়ে এলো নিজেদের ঘর থেকে, চুল আঁচড়ে, পোশাক পালটে, পারফিউম লাগিয়ে, লিপ্সটিক বুলিয়ে । দাঁড়িয়ে অপেক্ষারত আনমনা অতনুর দুপাশ থেকে তাকে জড়িয়ে ধরে, তার দুগালে ঠোঁট চেপে ধরে দু’জনে, দুদিক থেকে একই সঙ্গে, আর তক্ষুণি, হৃৎপিণ্ডের শীতল রক্তউচ্ছ্বাসে, ঝলকের মতন, ও, অতনু, টের পায়, এটা হোটেল নয়, গেস্ট হাউস নয় ; এটা আসলে ভূতল দেহগ্রাহকের গোপন পান্হশালা । ওর মনে হয়, ও গভীর বিপদে পড়তে চলেছে, ও এই বিদেশ-বিভূঁয়ে একবারে একা, আর ফিরে যেতে পারবে না, ওর পায়ের আঙুলগুলো ঠাণ্ডা, বাঁ দিকে গলার কাছ থেকে ফুসফুস হয়ে তলপেটের দিকে নেমে যাচ্ছে হাজার হাজার বরফের পিঁপড়ে ।

তাহলে তাই হোক, নিজেকে নিঃশব্দে বোঝাল অতনু, দুদিকে দুজনের কাঁধে বাহু রেখে নিজের ভার ওদের ওপর ছেড়ে দ্যায় ও, অতনু । ওরা ওকে এনে যখন সোফায় বসাচ্ছে, ওদের মুখের ভেতর থেকে, একেবারে হাঁ-মুখের আলজিভ থেকে, প্রথম বৃষ্টির সোঁদা মোহক গন্ধে দীপায়িত নিজের শারীরিক সমর্পণ স্বীকার করে অতনু । এই দুটি তরুণীর মাধ্যমে নিজেকে ব্যঞ্জিত করতে পারছে ।

: তুমি কি নার্ভাস ?

: না, আমার যেন কেমন ভয় করছে, যেন এক্ষুণি একদল লোক দরোজা ভেঙে ঢুকে পড়বে আমার খোঁজে, জবাবদিহি চাইবে, বলবে আমি সীমালঙ্ঘন করছি ।

: যাঃ । অনেক রাত হয়েছে, এখন আর কেউ জেগে নেই ।

: জানি ।

: অল্প ড্রিংক করো । ওয়াইন খাবে ? শেরি ?

: আমি বরং একটু হুইসকি খাবো । কালকেরটাই ।

অতনু অল্প আর ওরা দুজনে তার দ্বিগুন হুইসকি খায়, রয়ে-সয়ে । তারপর গরম গরম খিচুড়ি । আড়ষ্টকন্ঠে বলে ওঠে, ‘ভালো হয়েছে।’

: তবে ? তুমি বলছিলে শুধু ডিম আর মুরগি খাও ।

: চুপ করে গেলে কেন ? তোমার গল্প বলো ।

অতনু : মিথ্যে কথা আমি বলি না । বলে ফেলে খারাপ লাগছিল । আর মা মাছ-মাংস খান না, তাই বাড়িতে হয় না কিছু ।

: ওসব হোটেলে-রেস্তরাঁয় খাও ?

মছুয়াটুলির মহংগুর দোকানের গল্প বলে অতনু । পিন্টু হোটেলের গল্প । চাঁইটোলার দাদুর দোকানের আড্ডা । ডাকবাংলো মোড়ে কফিহাউস । আধখ্যাঁচড়া কালীদাস রঙ্গালয় । রবিন্দ্রভবনে নাটক । সালিমপুর হাহারার এই এম এ হল-এ অফিসকর্মীদের নাচগান । লঙ্গরটুলির দুর্গাপুজো । সবজিবাগে চর্বিদার পাঁঠার মাংস । সেই চর্বির পরোটার দোকান । গঙ্গা, গোলঘর, সোমবারী মেলা । এদের মনের পৃথিবীকে অন্য জগতে নিয়ে যেতে চায় অতনু ।

: তুমি কি সাপের মাংস খেয়েছ ? রাঁধব একদিন ।

অতনু : ব্যাঙ হরিণ খরগোস কচ্ছপ হাঙর খেয়েছি । গোরু শুয়োর মোষ সাপ বেড়াল কুকুর এসব খাইনি ।

: আমরা খাওয়াব তোমায়, যদি পাওয়া যায় ।

: খাবার সময়ে টের পাবে না কিসের মাংস ।

মুখ ধুতে গিয়ে অতনু বুঝতে পারে, এই যুবতীদের সামনে কুলকুচি করতে ওর লজ্জা করছে । তাই অস্বাভাবিক কায়দায়, যাতে বিশেষ আওয়াজ না হয়, আলতো কুলকুচি করে । পায়ের ধাপ সামান্য ভিন্ন পড়তে, ওর মনে হল টলছি না তো, এরা ভাবছে না তো যে এই সামান্য মদ খেয়ে নিজেকে সামলাতে পারেনা, কেমনতরো মরদ !

দুজনে দুদিক থেকে টলায়মান অতনুর বাহু আঁকড়ে, ওকে ওপরের ঘরে নিয়ে যায় । সিঁড়ি দিয়ে উঠতে-উঠতে, ওর দুই হাত দুই যুবতীর বহরে, ওদের পোশাক ঝাপটাচ্ছে অতনুর গায়ে, একজনের শরীরগ্রন্হির বুনো আর তেতো সুগন্ধ বেসামাল করে ফেলছে, বুকের মধ্যে আবার আরম্ভ হয়ে গেছে অদৃশ্য শুশুকদের জলঘাই । ওর ঘরে হিটার চালিয়ে রেখে ঘর গরম করে রাখা হয়েছে । উষ্ণতার তাপে অতনু আশ্বস্ত হয় । কে জুলি আর কে জুডি খেয়াল থাকে না । দুজনের মুখের দিকে তাকালে, তাদের ইশারাময় হাসির সঙ্গে পরিচিত হয় ও, অতনু ।

শিয়রের বন্ধ জানলার শার্শি তখন দুহাত দিয়ে কচিশীতল কুয়াশা মাখছিল মুখে । অতনুর বুকের বাঁ দিকে নৃত্য পরিবেশন করছিল উদীয়মান ঘুর্ণি ।

ওরা দুজুনেই সোয়েটার খুলে কাঁধের ওপর থেকে নিজেদের বসন, যেন কোনও আলতো ফাঁসে ধরা ছিল এতক্ষণ, ফেলে দেয় মেঝেতে । বিস্ফারিত শিহরণে স্তম্ভিত অতনু । আজ ওব্দি ও যুবতী শরীরের এতখানি দ্যাখেনি । হাঁটু গেড়ে বসে পড়ে । দু-বাহু দিয়ে দু-জোড়া করুণাময়ূ উরুর প্রীতিকর তাপ নিজের গাল কপাল ঠোঁটের ওপর চেপে ধরে বারবার, আর চেপে রাখার চেষ্টা সত্ত্বেও, ডুকরে ওঠে নিঃশব্দে ।

‘এ কী,কী হল ?’

তার চোখের জল ওদের সুঠাম সাবলীল উরু থেকে নিজের কপাল দিয়ে মুছে দিল অতনু । ওকে তুলে দাঁড় করায় ওরা । ওর পোশাক খুলতে সাহায্য করে দুজনে, আর বিব্রত উদোম অতনুকে জিগ্যেস করে জুলি, ‘অমন দিশেহারা হয়ে উঠেছিলে কেন ?’ যার উত্তরে অতনু বলতে পেরেছিল, ‘জানি না’ । ব্যাকুল উষ্ণ করে-তোলা শীতের অনুসন্ধিৎসু প্রায়ান্ধকারে, দুজন মানুষীর সারীরিক গর্বের আলোকছটায়, নগ্নভাবে প্রকাশ হয়ে পড়েছিল অতনুর দুর্বল নগ্নতা ।

‘তুমি ব্যায়াম করো না ?’

‘না’, বলল অতনু, বিচারবুদ্ধি নষ্ট আর ন্যায়-অন্যায় বোধ লোপ পাবার মুহূর্তটায় ঘাপটি মেরে থাকা তীব্র আনন্দের মাঝামাঝি সম্ভাব্য বিপদের প্রতীক্ষায় দাঁড়িয়ে ।

অতনু ওদের পারস্পরিক আর ওকে বলা কথা শুনতে পাচ্ছিল না । বিস্ময়ে, ঢেউ-খেলানো দু-রকমের নয়নাভিরাম বুক, গোলাপি আভায় চোবানো দু-জোড়া ছোটো-বড়ো বৃন্ত, চুনিপাথরের প্রাণপ্রাপ্ত পুঁতি । ঘোরলাগা অসহায় স্পর্শ চালিয়ে, পরখ করে সুডোল নাভি, কোমরের অনর্গল পাক, বুকের পাশ থেকে লতিয়ে ওঠা প্রবাহিত বাহুমূল, মসৃণ থুতনি, তুলতুলে গাল, পিঠ থেকে দৌড়ে নেমে সহসা উঁচু হয়ে ওঠা নরম মাংস, দু-উরুর মাঝখানে সংবেদনশীল সযত্নলালিত রহস্য, আঙুলের ফাঁকে গলে-যাওয়া পশম । ব্রহ্মাণ্ডকে মালিকহীন মনে হয় অতনুর । মায়ের আঁচল ভিজিয়ে মুখ পুঁছে দেবার স্মৃতি, এতকাল পর, একেবারে আচমকা, ফিরে আসে ।

অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ, আলাদা-আলাদাভাবে, নারীশরীরের সমগ্রতা থেকে পৃথক, এত আকর্ষণীয়, এত প্রিয় এরকম স্নিগ্ধ হতে পারে, জানা ছিল না । সত্যি জানত না ও, একজন মেয়েমানুষের রহস্যের সঙ্গে, এমনকি সে যদি বোবা কালা অন্ধ নুলো খোঁড়া হয়, তাহলেও আরেকজনের সঙ্গে মিল হয় না ; প্রত্যেকে সম্পূর্ণ একটি ভিন্ন রহস্যজগত ।

: কত তফাত তোমাদের দুজনের মধ্যে ।

: তোমার পছন্দ ?

: এই অনুভূতিকে বোধহয় পছন্দ বলে না ।

: এসো, শুয়ে পড়ি ।

: তিনজনে কুলোবো ?

: শীতকাল তো ; শীত বাড়তে থাকবে রাতে; শীত তো মানুষের ঘনিষ্ঠতা বাড়িয়ে তোলার ঋতু ।

রুমহিটার নিভিয়ে শুয়ে পড়ল তিনজনে । দুজনকে দুপাশে, ফ্যারাওয়ের দুই বাহুতে মাথা রেখে দুই মিশরীয় রাজমহিষী, কম্বলের তলায় শুয়ে পড়ার পর, দুদিক থেকে দুজন হাঁটু তুলে দিল অতনুর উরুর ওপর ।

: তোমার কিছু হচ্ছে না ? ইচ্ছে করছে না ?

: করছে । কিন্তু তোমরা যে দুজন ।

: তুমি কাকে চাও ।

: দুজনকেই ।

: আগে কাকে চাও ।

: একসঙ্গে দুজনকে ।

: কী করতে হবে জানো ?

: পেরে যাব মনে হয় ।

: আগে জুডিথের পালা, ও ছোটো তো, ও তোমাকে দেখিয়ে দেবে । তোমার সামন্য ছড়ে যেতে পারে । জ্বালাও করতে পারে । ভয়ের কিছু নেই । প্রথমবার সকলেরই হয় । তোমাকে গোলাপি রঙের ভ্যানিলা-গন্ধের কনডোম পরিয়ে দেবে । কাক থেকে তুমি নিজের ইচ্ছেমতন কনডোম বেছে নিয়ে পোরো, কেমন?

: বুঝে গেলে তো জুলি যা বলল ? আমি তোমার ওপর বসব । তোমার কষ্ট হবে না তো, আমার ভারে, অতনু ? যখন তুমি আর আমি উত্তেজিত হতে থাকব, তখন তুমি ওঃ জুডি, আহ জুডিথ, আমি তোমায় ভালোবাসি, কোনওদিন ছেড়ে যাব না, তোমায় ছাড়া বাঁচব না, উঃ ওফ, এই সব আবোল তাবোল বকতে থেকো । আমিও তোমার নামে অমন করেই বলতে থাকব । এটা শিষ্টাচার ।

জুডি দুই পাশে দুই পা ছড়িয়ে বসলে, ও নির্ধারিত প্রক্রিয়া আরম্ভ করে, প্রতিদানে জুডিও, অতনু ঘামতে থাকে, বলতে থাকে শিষ্টাচারের কথাগুলো, মনে হয় নিজের কথাই বলে চলেছে যা কাউকে কখনও বলা হয়ে ওঠেনি, জমে থেকে গিয়েছে মগজে, এলিয়া পড়ে জীবনের প্রথম নারীকে আষ্টেপৃষ্টে জড়িয়ে । মনে হয় স্ফূর্তির অতীত এই পাথেয় । জুডি নিজের জায়গায় ঢলে পড়ে । অতনু জুডিকে জড়িয়ে ঘুমিয়ে পড়ে । জুলি ওকে পেছন থেকে জড়িয়ে থাকে ।

কিছু পরে ঘুম ভেঙে যায় সেই তীব্র সন্মোহক সুগন্ধে, বুনো আর তেতোতেতো । পাশ ফিরে শুয়ে আছে জুডি । অগোর । ঘুমন্ত ঠোঁটে চুমু খেয়ে জুলির দিকে পাশ ফিরে ও, অতনু, দ্যাখে, জুলি মিটিমিটি জেগে । হাত ধরে অতনুকে নিঃশব্দে বিছানা থেকে নামায়, আর চিৎ হয়ে হাঁটু উঁচু করে শুয়ে পড়ে মেঝেতে আগে থাকতে পাতা ধূসর তোয়ালের ওপর । শাঁখনীলাভ উপশিরার কারুকাজ করা চাপা অথচ বর্তুল বুকে মাঝে ক্রুশবিদ্ধ যিশুর সোনালি লকেট নজরে পড়ে অতনুর । টের পায় জুডি কেন শ্রমটা নিজের দেহে নিয়েছিল ; যাতে জুলির জন্য অতনুর দেহে যথেষ্ট ক্ষমতা বজায় থাকে । এলিয়ে পড়ে কিছুক্ষণ পর, টের পায় অতনু, গন্ধটা আর নেই । পরস্পরকে জড়িয়ে থাকার সময়ে জুলি অতনুর কানে ফিসফিস করে জানা্য়, কালকে আমরা তোমাকে ফোএপ্লে শিখিয়ে দেবো, মেয়েদের অরগ্যাজম একটু সময় নিয়ে হয়, তাই আমাদের জন্য ফোরপ্লে করতে হয়, তারপর তোমার উৎসার,  । পালঙ্কে উঠে চাপা দিয়ে তিনজনে ঘুমিয়ে পড়ে পাশাপাশি ।

তারপর, প্রথমে কুন্ঠা বোধ করলেও, অতনু মুখমেহন করতে আর করাতে শেখে ; এ এক নিভৃতির রসিক বালখিল্য । ওরা গিলে ফেলছে দেখে ও, অতনুও গিলেছে ; দুজনের স্বাদ এক্ষেত্রেও আলাদা, যেমন  বৃন্তকে ঘিরে গোলাপি বৃত্তের মাপ আর রঙ দুজনের আলাদা ।

 

নিজের সামনে নোট গোনাবার আগ্রহ, কর্মচারীদের গাফিলতির আশঙ্কা, তাড়াতাড়ি কাজ মিটিয়ে ফিরে যাওয়া, এসব উবে গেছে অতনুর ভাবনা থেকে । এসে মাকে পৌঁছানো সংবাদ দিয়েছিল একটা, তারপর আর জানা্য়নি । ম্যানেজারের নাম রোসাংলিয়ানা, ওর একটা হোটেল আছে নেপালি পাড়ায়, তবুও সেখানে থাকতে বলেনি । ওপন এয়ার টিকিট কিনে দিয়েছিল, পাওনা মিটিয়ে দিয়েছে অতনু । বাকি পুরো টাকা, করকরে নোট, দিয়েছে জুলি-জুডিকে । ছুটি বাড়িয়েছে আর মাইনে চেয়ে নিয়েছে স্টেট ব্যাঙ্কের মাধ্যমে, সেই করকরে নোটগুলো দিয়েছে জুলি-জুডিকে । যেদিন ওরা তাড়িয়ে দেবে ফিরে যাবে অতনু । তার আগে ও কিছুতেই ফিরবে না । ছুটি নেবে । দুজনকে একসঙ্গে ভালোবাসবার ছুটি । এই অভিজ্ঞতা ফিরবে না ।

কাজ শেষ হয়ে যাবার পর, কাগজপত্র বুঝে নেয়া হয়ে গেছে, অসুস্হতার অজুহাতের একমাসের ছুটি ফুরিয়ে যাবার পর, আরও এক মাস ছুটি নিয়েছে অতনু । মাকে জানিয়েছে, জায়গাটা ভালো লেগেছে, মন আর শরীর দুইই ভালো ।

এখানে এসে অতনু কেবল দাড়ি কামিয়েছে ; চুল কাটায়নি । ওর দীর্ঘ শ্যাম্পু-করা চুল আঁচড়ে পেছন দিকে রাবার-ব্যান্ড বেঁধে দ্যায় জুলি বা জুডি ।

যৌনতার অপ্রতিরোধ্য অলিগলি দিয়ে, প্রতি রাতের নতুন আঙ্গিক, ফোরপ্লে, কখনও-সখনও ওর আবদার মেটাতে দিন দুপুরে, সম্পূর্ণ আলাদা এক সংস্কৃতির একেবারে মদ্দিখানে, একটু-একটু করে সেঁদিয়ে যায় ও, অতনু — পান-ভোজন, চার্চ, সংস্কা, বিশ্বাস-অবিশ্বাস, কুসংস্কার, নিয়ম-রীতি, সামাজিক আচার, পোশাক-পরিচ্ছদ, ভয়-ঘেন্না — এ এল আলাদা জগতের সংসার । ওরা বিহারকে ভালো চোখে দ্যাখে না । রোজ খুন ধর্ষণ বজ্জাতি । বলেছে, ‘কী করে থাকো ? ভয় করে না ?’ অথচ আসার সময়ে এই উত্তরপূর্বের অরাজকতার ভয় দেখিয়েছিল অফিসের অনেকে । কোথাও আসলে ভয়ের কিছু নেই । যে ভিতু সে মায়ের গর্ভেও ভয়ে-ভয়ে থাকে, এই বুঝি বাপের জাদুদণ্ড এসে আহত করবে তাকে । স্মৃতিকে বঞ্চনা করে ভয় পায় মানুষ, ভয় তাকে অপরিণতমনা করে তোলে, ভালোবাসতে বাধা দ্যায় । জুডি-জুলির সঙ্গ না পেলে কেবল এই অঞ্চলই নয়, মানবজীবনের বহুকিছু অজানা থেকে যেত ।

অতনুর মনে হয়েছে, সৌন্দর্য ব্যাপারটা আপেক্ষিক । আকর্ষণও আপেক্ষিক । বিহারি বা বাঙালি যুবতীদের বুক কত তাড়াতাড়ি আদর করার ব্যাপার থেকে দুধ খাবার জিনিস, বিয়ের আগে উনিশ কুড়িতে যেতে যেতেই । এখানের মেয়েমানুষদের আদর করার বুকের সঙ্গে দুথ খাবার বুকের তেমন তফাত নেই । বৃন্তকে ঘিরে বর্তুল চক্রের রঙও তো সকলের এক নয় । মানসী বর্মণের বুক কি ঢাউস । লঙ্গরটুলিতে, রাজেন্দ্রপথের আশ্রমে, গরদানিবাগে, কদমকুঁয়ায়, পুজোর সময়ে ঢাউস বুকের বাঙালি যুবতীরা দুর্গাকে পুষ্পাঞ্জলি দ্যায়, দুর্গার চেয়ে, লক্ষ্মী-সরস্বতীর চেয়ে, তাদের অবিবাহিত পীনোন্নত বুক উঁচিয়ে । গঙ্গাভিলায়, দুর্গা সরস্বতী লক্ষ্মীর বুক কিছুটা বড়ো করা হতো পারিবারিক পরম্পরা অনুযায়ী, কিন্তু ফ্ল্যাট বাড়ি করে পয়সা করার ধান্দায় সে পুজো উঠে গেছে । কলকাতায় পালিয়েছে গঙ্গাভিলার ছেলেরা । হয়তো সেখানে গিয়ে পারিবারিক পরম্পরা দান করেছে কোনো পাড়ার পুজোর প্রতিমাদের। ছটের সময়ে বিহারি বুকেরও একই হাল ।

গঙ্গা ভিলার নতুন ফ্ল্যাটবাড়িতে অতনুর বাংলা ভাষা-সাহিত্যের অধ্যাপক-অধ্যাপিকা জিতেনবাবু আর বেলাদি থাকতেন, তাঁদের অবিবাহিত লিভ-ইন সংসারে  শ্রীঅরবিন্দ আর শ্রীমার নৈতিক সমর্থন জুগিয়ে । পাটনা শহরের প্রথম যৌনপ্রগতিবাদী । পাটনা বিশ্ববিদ্যালয়ের আর সব বাংলা ভাষার অধ্যাপকদের থেকে আলাদা ; এনারা দুজনে ছিলেন বেঁচে থাকার জ্ঞানী । তারপর থেকে এসেছে একের পর এক চাকুরে অধ্যাপক । জীবনে ভালোবাসা না পেলে বোধহয় মাতৃভাষাকে ভালোবাসা যায় না ।

অতনু মূর্খের জীবন চায়নি । চেয়েছে রক্তমাংসের গূঢ় তাৎপর্য ; বর্তমানকে ভালোবাসতে চেয়েছে । অতীতের প্রতি ওর উদাসীনতা নেই, নেই চিন্তার প্রতি অবিশ্বাস । জুলি-জুডিকে সাহায্য করে সংসারের কাজে । কুটনো কোটে, রান্না করে, মশলার আন্দাজ, ভাত রাঁধা, বাসন মাজা, ঝাঁট দেয়া, ঝুল ঝাড়া, কাপড় কাচা, ইসতিরি করা, এমনকি জুলি-জুডির পোশাক আর অন্তর্বাসও, মেঝেতে পাতা রাতের তোয়ালে, সারা দিনমান ব্যস্ত । বাজারে গেলে কানাঘুষোর উৎপাত সম্ভব, তাই ওরে যেতে দেয়নি ওকে । অতনু চেয়েছিল ওদের সঙ্গে নিয়ে বেরোয় । ব্যায়াম করে সকালে । আঁটো পোশাক পরে ওরা দুজনেই করে ; যখন একজন করে না অতনু আঁচ করে তার মেন্সটুরেশান চলছে, কপালে হাত রেখে দ্যাখে ।

কিনেছে নতুন ট্রাউজার শার্ট রঙিন-টিশার্ট সোয়েটার জুতো । কয়েকটা রবিবার সারাদিন ঘুরেছে পাহাড়তলিতে ভিনশহরে ব্র্যাঞ্চ ম্যানেজারের জিপে । বর্মা আর বাংলাদেশে লুকিয়ে-চুরিয়ে যেতে চায়নি অতনু । বাংলাদেশে যাওয়াটা, ওই ভাবে, অত্যন্ত অসৎ কাজ হবে, মাতৃভাষার প্রতি বিশ্বাসঘাতকতা ।  সারাদিন ঘুরে এসেও প্রেম করা বাদ দিতে চায়নি । কত করকমের বাঁশের জঙ্গল হয় দেখেছে, নদী আর ঝিল, এখানকার ফুল, পাখির ঝাঁক । সবুজের পর সবুজ, নানা রঙের সবুজ । আর পাহাড়ি বৃষ্টি, যখন-তখন ।

জুলি-জুডির রাঁধা এমন সম্স্ত খাবার ও, অতনু, খেয়েছে, যা আগে ভাবলেও ওর গা গুলিয়ে উঠত । এখন সবকিছু, যা মানুষ খায়, তা ও খেতে পারে । একদিন এগুলো নিশ্চই কাজে দেবে জীবনে । নারীর শরীর আর অদ্ভুত ভালোবাসা ওকে গভীর বোধে তুলে নিয়ে গেছে ।

তরল ইন্দ্রপতনে কেঁপে উঠেছে প্রতিরাতের মুর্হূমুহু প্রায়ান্ধকার, দুর্নিবার সন্মোহন ঘোরের টান ছাপিয়ে ; দুই স্নিগ্ধতার মাঝে গড়ে তোলা মরুঅঞ্চল হয়ে উঠেছে সবুজ । কখনওবা দুপুরের আলোয় অতনু  আবদার করেছে ও আলোকিত অবস্হায় দেখতে চায়, স্পর্শ করতে চায়, গন্ধ পেতে চায়, কন্ঠস্বর শুনতে চায়, জিভের স্বাদ পেতে চায়, মুখমেহনের স্বাদ পেতে চায় । আর কিছু দিন থেকে যায় অতনু ।

ফিরে যাবার কয়েকদিন আগে, রান্নাঘরে টাঙানো মিলিটারি-পোশাক ফোটোটা দেখে ও স্তম্ভিত । অবিকল, হুবহু অতনুর বাবার মতন দেখতে । তাহলে কি ইঁদুরের বিষ খেয়ে উনি মারা যাননি, কাপুরুষের মতন ! গুলি খেয়ে বীর দর্পে শহীদ হয়েছেন । মৃত্যুর রকমফেরে যে উদার গরিমা, অতনু তাতে আপ্লুত হয়ে যায় । মৃত্যু মানে তো স্রেফ স্মৃতির বিনাশ ; মানুষ তাই মরতে ভয় পায়, তার স্মৃতি নিশ্চিহ্ণ হয়ে যাক সে চায় না ।

এয়ারপোর্টে বসে অতনুর মনে হয়, একদিন এদের দুজনকেও ভুলে যাবে । যাবে কি ? এখন কত মনকেমন করছে । এরা দুজন ওকে নিয়ে সাময়িক সংসার পেতেছিল । আবার নতুন কেউ আসবে ; তার সঙ্গে সংসার পাতবে । তারা কি অতনুর মতন ভালোবাসবে ওদের ?  ফোঁপানি সামলায় ও, অতনু । জুলি-জুডি তো একদিন বুড়ি হয়ে যাবে । বিয়ে কেন করেনি, জানতে চায়নি । বুড়ো বয়সে, অবসর নেয়া হয়ে গেলে, অতনু আসবে আরেকবার । তখন এখানে মোনোরেল হয়ে যাবে, বহু হাইরাইজ উঠে যাবে, এয়ারপোর্ট উন্নত হয়ে যাবে ।

কলকাতায় প্লেন বদলে, দমদম বিমানবন্দরে সারা সকাল বসে থেকে পাটনা ফিরেছিল । কলকাতা শহরে ওর কেউই নেই, কোথায়ই বা যাবে ! জ্যামে আটকা পড়ে ফ্লাইট ছেড়ে যেতে পারে । যা মিছিল আর অবরোধ চলছে ।

পাটনা বিমানবন্দর থেকে বেরিয়ে বুঝতে পারল আজকে দোলপূর্ণিমা, একটা দল এসে এক বালতি নর্দমার জল ঢেলে দিল অতনুর মাথায়, এর চুলে মুখে মাখাল চটচটে অ্যালুমিনিয়াম পেন্ট । চূড়ান্ত অশ্লীল লোকগীতি, ঢোলক বাজিয়ে, গাইতে-গাইতে চলেছে একদল ধেনোমাতাল যুবক, আর কলি শেষ হতেই ধুয়ো উঠছে, আরে ভাই র‌্যা র‌্যা র‌্যা  র‌্যা । গোবরমাখা চেহারা দেখে ওরা অতনুকে রেহাই দিলে, নয়তো এতক্ষণে খাবলে ছিঁড়ে ফেলত ওর জামাকাপড় ।

অনেক ধরাধরির পর একজন রিকশচালক রাজি হল ।

 

 

 

 

Leave a comment

Filed under উপন্যাস

পাঁচ

দোলের ছুটির পরদিন অফিসের গেটে পৌঁছে অতনু দেখল অফিস বন্ধ, লাল শালুতে লেখা তৃতীয়-চতুর্থ শ্রেণির কর্মীদের ধর্মঘট । গেটের পাশে তাঁবুতে কম্বল-সতরঞ্চি পেতে লুঙ্গি গেঞ্জি খোঁচা-খোঁচা দাড়িতে অনশন করছে ন্যাতানি সহকর্মীরা । তাস লুডো থান-ইঁট উপন্যাস রজনীশ রামচরিতমানস চলছে । তাঁবুর গায়ে লাল শালুর ওড়নায় লেখা “মানসী বর্মণ সংগ্রাম কমিটি” । ছাপানো হ্যাণ্ডবিলে ধর্মঘটের ইতিহাসের প্রশ্নোত্তর হিন্দিতে বিলোনো ।

ননীদা-সুলতানার বাচ্চা হচ্ছিল না বলে গায়নাকের কারসাজিতে একজনের ধাতুতে আরেকজনের ডিম ফেটিয়ে নলখোকার জন্যে গর্ভের সসপ্যান দরকার পড়ে, কেননা সুলতানার বাচ্চাদানিটা অকেজো, তাঁবুর টুকরো-টাকরা গল্প জুড়ে-জুড়ে বুঝলো অতনু । ননীদা নাকি অনেক দৌড়ঝাঁপ খোঁজাখুঁজি নানা গৃহবধু কর্মীর হাতেপায়ে ধরে শেষে মানসী বর্মণকে রাজি করিয়ে ওর পেটে বাড়তে দিয়েছে বাচ্চাটা । স্হানীয় অফিস বলেছে তার জন্য মানসী বর্মণ ডাক্তার খরচ আর মেটারনিটির ছুটি পাবে না । অরিন্দম এমনভাবে কেস ঘুরিয়ে নোট আর চিঠির খসড়া লিখেছে যে হেড অফিসও বলেছে যে, পাবে না । মা হলেই হবে না ; বৈধ মা হতে হবে ।

ইউনিয়ান এখন দু’ভাগ । বেচয়েন লাল দিনে কুড়িবার কমরেডি কাটিং চা খেয়ে-খেয়ে লিভার ক্যানসার নিয়ে হাসপাতালে, বাঁচবে না । ডাক্তাররা মার্কস লেনিন স্তালিন মাও সব বন্ধ করে দিয়েছে । বলেছে, চুপচাপ শুয়ে আরাম করুন । চন্দ্রকেতু সিং এই তালে ইউনিয়ান দখল নিতে না পেরে, গলায় রজনীশ লকেট ঝুলিয়ে ঘুরছে । মহাদলিত, দলিত, পিছড়াবর্গ আর মুসলমানদের জোট ননীদা আর মানসী পিছড়া জাত আর সুলতানা মুসলমান বলে সুযোগ হাতছাড়া করতে চায়নি । উঁচু জাত থেকে নিচু জাতের আওতায় চলে গেছে ইউনিয়ান ।

বিহারের বাঙালিদের টিকে যাবার এটাও একটা প্রক্রিয়া হতে পারে, মনে হয় অতনুর ।

প্রত্যেক চব্বিশ ঘন্টা পালা করে অনশন, রোজ দশজন, সিনিয়রিটি অনুযায়ী । অতনুকে দেখে শিবু পালিত রঙিন শর্টস সামলে রোমশ দাবনায় চাপড় মেরে উঠে বসে, ‘আপনাকে তো চেনাই দায়, ভেতো চেহারা পালটে শার্ট-প্যাণ্ট, গোঁফ কামিয়ে ফেলেছেন, আগেকার তেল-চুকচুকে চুলে শ্যাম্পু, চুল বাড়িয়ে পিগটেলে রাবার-বভাণ্ড , সেন্ট-পারফিউম কিছু একটা মেখেছেন । হলটিং থেকে বেশ সেভিং করেছেন মনে হচ্ছে । শিবু পালিতের সিগারেটের ফিকে নীল ধোঁয়ায়, এই বসন্তকালে, ছড়িয়ে পড়ছিল হেমন্তের শুকনো-হলুদ পাতা পোড়ানো আধভেজা গন্ধের আমেজ । যারা তাস খেলছিল, নটা-দশটার অফিসমুখো সময়ের দ্রুতিকে জোর করে কুঁড়েমিতে ধরে রেখে, বোধহয় কম পয়সার জুয়া, অতনুর পরিবর্তনকে অনুমোদন জানালো ঠহাকার মাধ্যমে । অসাধারণ বিহারি অট্টহাসি এই ঠহাকা, শৈশব থেকে অমন করে হাসতে না শিখলে রপ্ত করা যায় না, অনেকটা ঠিঁউউউউ বা ফিঁউউউউউ আওয়াজ বেরোয়, যেন অবশ্যম্ভাবী ছিল অতনুর বদলে যাওয়া । শিবু পালিত কিন্তু বলল, যেন কিছু হয়নি, ‘সুশান্ত অবাক হয়ে যাবে ।’

‘সুশান্ত কোথায় ? আসে আপনাদের খোঁজ নিতে ?’

পিপারিয়া বলে একটা জায়গায় ওদের অনেকটা জমিজমা আছে । সেই জমি হাতাবার জন্য ভাগলপুর গেছে ।

ভাগলপুর ? পিপারিয়ে তো মুঙ্গেরে !

ভাগলপুরের বাহুবলী গিরোহটার সাহায্য নিতে গেছে ।

বাপরে ! কী বলছেন কি ? ওকে বাড়ি থেকে যেতে দিয়েছে কেমন করে ?

বাড়িতে বলেনি কাউকে । মৌলিনাথকে বলেছিল ।

ভাগলপুরের নাথনগর আর বিহপুর থানার কসমাবাদ, দুধলা, বৈকুণ্ঠপুর, তেতিস, অমরি, নকরটিয়া, অজমেরিপুর, ভগবতীপুর, দিলদারপুর, রত্তিপুর, ওদেদিয়া, কাহেওয়ারা, গিরিপুর, চোওহদ্দি, রাঘোপুর, গঙ্গাপুর, রসতপুর আর শাহপুর গ্রামগুলোতে রাজত্ব করে একদল খুংখার খুনি— তারিণী মণ্ডল, মলহোরিয়া মণ্ডল, ডুব্বা মণ্ডল আর সন্তান মণ্ডল । আধুনিক মানবসমাজের বাইরে ওই অঞ্চল । ইংরেজদের সময় থেকে কোনও তারতম্য হয়নি আজ ওব্দি এই গ্রামগুলোর মানুষদের জীবনধারায়, সংঘর্ষে, দারিদ্র্যে, শোষণে । যার যত পেশিশক্তি, তার ততো জমিন । ১৯৫৯ থেকে ভাগলপুরে গঙ্গানদীর তীরে একশো আটত্রিশটা গ্রামে ভূমি সংস্কারের চেষ্টা বারবার ভেস্তে গেছে । কাগজে-কলমে জমির মালিক যে-ই হোক না কেন, খুংখার গিরোহদের সমর্থনে দখল রাখতে হয় ছুঁচের ডগার সমান ভূখণ্ডও ।

পিশাচদের অভয়ারণ্যে কত টাকা নিয়ে গেছে সুশান্ত ? এত দিনের ব্যবসা তাহলে এই টাকা তোলার জন্যে ? মলহোরিয়া মণ্ডলকে দিয়ে কাকে ঠ্যাঙাতে চায় ও ?

শিবু পালিতকে অতনু বলল, ‘আপনার ভ্যানগার্ডদের দেখছি না ?’

মামুদ জোহের তো প্রথম দিনেই দশজন মিলে ঢুকে গিসলো অনশনে । পিকনিকে বেরিয়ে গেছে । রাজগির । হরতালের ছুটিটা নষ্ট করে কী লাভ ? আমাকে কেউ খবরটা আগেভাগে দ্যায়নি । কিছুটা হেরো শোনালো শিবু পালিতের কন্ঠস্বর ।

মানসী বর্মণেরবাড়ি জানেন ?

কংকরবাগ কলোনি । কৃষিবিভাগের সিনিয়ার আগরওয়াল থাকে যে বিলডিংটায় । যাবেন নাকি ? যান, দেখা করে আসুন । একটা প্ল্যান আছে, ফিরে আসুন, তারপর বলছি ।

রিকশয় চিড়াইয়াটাঁড় উড়ালপোল । এগজিবিশান রোড, রাজেন্দ্রপথের মোড়ে, ডাক্তার ভট্টাচার্যের কলইনিকের বাইরে রাস্তা ওব্দি উপচে পড়েছে শতছিন্ন শ’খানেক গরিব রোগির রোগাটে খ্যাংরাটে প্রায় খালিগা ভিড়ের ঠেসাঠেসি । মোড়ের লাইট সিগনালগুলো মাঝরাতের মোদোমাতাল লরির ধাক্কায় দুমড়ে হেলে পড়ে দাঁড়িয়ে আবার কোনো কানা ট্রাকের ধাক্কা খাবার অপেক্ষায় আছে । বিজলি থাকে না বলে এমনিতেও দরকার নেই ওগুলোর । রিকশ থেকে নেমে পোলটা হেঁটে পার হয় অতনু । নামতে, চারিদিকে কাঁচা গু । লাফিয়ে লাফিয়ে পার হবার অভ্যাসে বাচ্চারা পোঁছে গেছে যৌবনে । ডিঙিয়ে ডিঙিয়ে অনেকটা এগিয়ে আবার রিকশ নিল অতনু । রাস্তার দু’পাশে গোরু বাঁধা, নানা জাতের গোবরের ডাঁই । দেয়ালে ঘুঁটে ঠোকা একতলা বাড়ির মাথায় ডিশ অ্যানটেনা । তার পাশে-পাশে উঠেছে বহুতল, একের পর এক, বৈভবশালীরা দিল্লি থেকে টাকাকড়ি লুটে নিবেশ করছে ফ্ল্যাটে মালটিপ্লেক্সে মল নির্মাণে । রাস্তার ওপর প্লাসটিকের ঝাঁপ ফেলে, তিসির তেলে পাম তেল মিশিয়ে কচরি-পকৌড়া ভাজছে খালিগা গামছাপরা ময়রামরদ । ধুলো ওড়ার ঋতু আরম্ভ হল।

কলিং বেল টেপার কয়েক সেকেন্ডে সামান্য ফাঁক হয় চেনবাঁধা পাল্লা । টাঙাইল শাড়িতে মানসী বর্মণ, উদাসীন বহিরাবয়ব, সর্বতোমুখী পরিব্রাজক চাউনি, নিঃশব্দ উলুধ্বনির বলয়ে ঘেরা উচ্চারণ-উন্মুখ শরীর । দরোজা খুলে, ‘আরে, আপনি । চিনতে পারিনি প্রথমটা । চুল বাড়িয়ে রাবার বভাণ্ড বেঁধে পপস্টারদের মতন করে ফেলেছেন । অনেক দিন দেখিনি তো । কোথায় যেন গিয়েছিলেন । আসুননা, ভেতরে আসুন । বারমহল আর খাসমহল, আমার এই দুঘরের ফ্ল্যাট । ওপরের ফ্ল্যাটেই আগরওয়াল সায়েব থাকে । বড্ড ছ্যাঁচড়া । তাই চেন দিয়ে রাখি ।’

অতনু আঁচ করেছিল অনেক লোকজন থাকবে মানসী বর্মণের বাসায়, থাকবে ধর্মঘটের রেশ, একাধজন নেতা সাঙ্গপাঙ্গ সুদ্দু । পুরো ঘরটা আসবাব কার্পেট কিউরিওতে ঠাসা, সামলে চলাফেরার পরিসর । কোনও অজানা প্রতিপক্ষের কিংবা পরিচিত গোপন সঙ্গীর অনুপস্হিতির দুঃখ ছেয়ে আছে যেন । এই ঘরে একটা বাচ্চা খেলবে ভেবেই ভুল ভাঙে অতনুর । খেলতো ।

দরোজা বন্ধ হবার আওয়াজ হতেই, ওপর থেকে নেমে এসেছে লুঙ্গিপরা সন্দেহ-বাতিকগ্রস্ত ছোঁকছোঁকে আগরওয়াল । ধর্মঘটের ছুটি লুটছে বাড়িতে বসে । মানসীর দরোজায় চাবির ফুটোয় চোখ কুঁচকে দেখার চেষ্টা করে ভেতরে কী চলছে । কী করেই বা গর্ভবতী হল, সেই সন্দেহর নিরসন চায় আগরওয়াল । ঘরের দেয়ালঘড়িতে বাজনা বেজে ওঠে, যেন একাঙ্কের আরম্ভ । চাবির ফুটো থেকে অতনুর পাছা সরে গেলে পর্দা ওঠে ।

মানসী : ( সোফায় বসতে বসতে ) আসুন না, ওখানটায় বসুন, জানলা দিয়ে ফুরফুরে হাওয়া আসে । ধ্যাৎ, আপনি-আপনি করতে পারছি না । তোমাকে তুমিই বলছি । তুমি তো বেশ ছোটো আমার চে, তাই না ? ( ঘাম না থাকা সত্ত্বেও আঁচল দিয়ে কপাল মুছে ) তুমি তো কোথাও যাও না, কারোর সঙ্গে মেশো না বলে বদনাম । উন্নাসিক, না ? ইংরেজি সাহিত্যের স্নাতকোত্তরের উন্নাসিকতা, না ? কৌতূহল হলো বুঝি ? ইউনিয়ান এমন পাকিয়ে ফেলেছে ব্যাপারটা…

অতনু : ( মানসীর পাশে ধপ করে বসে । পকেট থেকে পারফিউম বের করে এগিয়ে দ্যায় । মানসী হাতে নিয়ে ঘুরিয়ে ফিরিয়ে দ্যাখে ) পুরো ঘটনাটা কেমন যেন অবিশ্বাস্য । ননীদার বিয়ে তো রুপকথার গল্প । তারপর আপনার এই দুঃসাহসী কাজ । ইউনিয়ানও চাইছিল ম্যানেজমেন্টকে আক্রমণ করার ইশ্যু, পেয়ে গেল আপনাকে ।

মানসী : ( মৃদু হাসি । মাথা নাড়িয়ে আলগা খোঁপার ঢল পড়ে যেতে দ্যায় কাঁধে পিঠে । ) ও বাবা, বেশ গুছিয়ে কথা বলতে জানো । ( পারফিউমের ঢাকনি খুলে বাতাসে স্প্রে করে । ) আর কী হবে এসবে ? আমার গা থেকেই এখন মৃগনাভির গন্ধ বেরোয় । ( ডান হাতের তর্জনী রাখে হৃদয়ের জায়গায় ।) তোমার উচিত পারফিউম মাখা ; তোমার গা থেকে যৌবনগ্রন্হির গন্ধ বেরোচ্ছে । অবশ্য তোমার যদি প্রেমিকা থাকে সে অমন গন্ধে মাতোয়ারা হয়ে যাবে ।

অতনু : আপনাকে দেখতে খুব ভালো, এত কাছ থেকেভ দেখিনি তো আগে, বলবে ভেবেও বলল না অতনু ।( তার বদলে ঝুঁকে পড়ে, মানসীর বুকের কাছে মুখ নিয়ে গিয়ে শোঁকে । ) হ্যাঁ, সত্যি, তালশাঁসের মতন গন্ধ ।

মানসী : ( অতনুর চুলে আঙুল বুলিয়ে । ) দুর বোকা, তালশাঁসে কি মৃগনাভির গন্ধ হয় ? মাস্ক পারফিউমের নাম শোনোনি ?

অতনু : ( আচমকা উদাসীন । ) কে জানে, গন্ধটা পেলে টের পাবো । কিন্তু আপনি এতো বড়ো ঝুঁকি নিলেন যে ! কিছু হয় যদি ? যদি কমপ্লিকেশান হয় ? ( সেই বুনো আর তেতো গন্ধের জন্যে আচমকা তীব্র হাহাকার হয় অতনুর । মনকেমন করে ওঠে । )

মানসী : ( খরস্রোতা ভঙ্গীতে । ) কীইইই আবার হবে ! বরের সঙ্গে ছাড়াছাড়ি না হলে আমার ছেলেমেয়ে ফোর-ফাইভে পড়ত এখন । ( চিন্তিত ভ্রুযুগল । )

অতনু : ( মুখ ফসকে অথচ সরাসরি মানসীর দৃষ্টির গভীরে তাকিয়ে । ) ছাড়লেন কেন ? সবাই বলে আপনি তালাক দিয়েছেন ।

মানসী : হ্যাঁ, আমিই ছেড়েছিলুম । ( ক্ষুব্ধ ) হিজড়ে ছিল লোকটা ।

অতনু : ( বিস্ময়ে ) হিজড়ে ? হিজড়েরা বিয়ে করে নাকি ! ( কথাগুলো বলে, মানসীর মুখের দিকে তাকিয়ে মনে হল, হয়তো মানসীর কথায় সত্যতার অভাব রয়েছে । )

মানসী : ( পরাজিত হাসি ) সে হিজড়ে হতে যাবে কেন ! ছোটোবেলায় অসুখ-বিসুখ হয়েছিল কিছু, তাইতে অ্যালিগো স্পারমিয়া হয়ে গিয়েছে । ডাক্তার দেখায়নি সময়মতো । পরে অ্যাজোস্পারমিয়া হয়ে গিয়েছে । ( উষ্মা ফুটে ওঠে । ) অমন বর থাকাও যা, না থাকাও তা । পোকাই নেই তো ডিম ফোটাবে কি দিয়ে ?

অতনু : ( মানসীর মুখ আরও খুঁটিয়ে দেখতে-দেখতে । ) তাতে কী হয়েছে ! এখন যেমন করলেন, তখনও চুপিচুপি কারোর স্পার্ম নিয়ে নিতেন ।

মানসী : ( অবাক । ) কী বলছ কি তুমি ! এখন ব্যাপারটা আলাদা । বর থাকতে ওসব করে কখনও কোনো বউ ? ঢি-ঢি পড়ে যেত । কেলেংকারির একশেষ । বরও মেনে নেবে কেন ? এখন যা করেছি তাতে কতো গর্ব বলো ইউনিয়ানের । টাইমস অফ ইনডিয়াতে বাংলা অ্যাকাডেমির জীবনময় দত্ত আমাকে নিয়ে ফিচার লিখেছেন, তা জানো ?

অতনু : ছাড়াছাড়ির পর আবার বিয়ে করতে পারতেন ।

মানসী : কুমারী মেয়েরাই বসে আছে, বিয়ে হচ্ছে না কতো মেয়ের, ডিভোর্সিকে কে বিয়ে করবে ?

অতনু : কেন ? আমি ।

মানসী : ( অতনুর চোখে চোখ মেলে, কিছুক্ষণ হতবাক ) তুমি ? পাগল নাকি ? ভেবেচিন্তে বলছ ? আগে বলোনি তো কখনও । ভালো করে কথাই বলতে না । বেশি-বেশি পড়াশুনো করো বলে একটা ভয়-ভয় ভাবও ছিল তোমার প্রতি । তোমার মা মেনে নেবেন কেন ?

অতনু : ভেবেচিন্তে বলছি না । আবেগেও বলছি না । মাও মেনে নেবেন না, জানি । কিছুকাল আগে হলে আমিও এমন কথা বলতে পারতুম না । কীই বা এসে যায় তাতেও । কিছুই মানামানির দরকার হয় না মানুষের মতন থাকতে গেলে । জানেন, প্রেম মায়া মমতা ভালোবাসা শ্রদ্ধা লোভ সবকিছুই ক্ষণস্হায়ী । মুহূর্তটাকে ধরুন, ফুরিয়ে গেলে ছেড়ে দিন । বরকে যেমন ছেড়েছেন, পছন্দ না হলে আমাকেও ছেড়ে দিতেন । সিরিয়াসলি বলছি ।

মানসী : ( বিস্ময় আর শ্রদ্ধা । ) কতো কথা বলতে পারো, সত্যি । তোমার চরিত্রের এই দিকটার সঙ্গে পরিচিত ছিলুম না ।

অতনু : ( উঠে দাঁড়ায় । দরোজার দিকে এগোয় । ) কথায় আর কাজে মিল ঘটে গেলে মানুষ আর মানুষ থাকে না ।

মানসী : ( উঠে দাঁড়ায় । অতনুর হাত নিজের দুহাতে নিয়ে । ) আবার এসো, অ্যাঁ, আসবে তো ? চা-কফি কিচ্ছু খাওয়াতে পারলুম না ।

অতনু : ( ম্লান হাসি । মাস ছয়েক আগে হলে মানসীর ঘর্মাক্ত স্পর্শে বজ্রপাত ঘটে যেতো স্নায়ুকেন্দ্রে । ) হ্যাঁ, আসবো ।

দেয়াল ঘড়িতে পনেরো মিনিটের বাজনা বেজে ওঠে । অতনু দরোজার দিকে এগোলে, চাবির ফুটোয় একাঙ্কের যবনিকা । আগরওয়াল লুঙ্গি সামলে পা টিপে-টিপে ওপরে পালায়, আর মিসের আগরওয়ালকে হাঁপাতে-হাঁপাতে, ‘মওগিটা এবার একটা বাচ্চা ছোকরাকে ফাঁসিয়েছে।’

বাইরে বেরিয়ে, ফ্ল্যাট-কলোনির গেটের কাছে, যেখানে বিষন্ন মুখটি নিচু করে বসে আছে করমচা-ঝোপ, রোদ্দুরকে আন্দাজমতন ধরে রেখেছে নরম সবুজ পাতা, সেখানে রিকশর অপেক্ষায় দাঁড়িয়ে অতনু ভাবছিল, মানসীর ছবিটা ছাড়তে চাইছিল না ওকে । মজুর আর কেরানির দোআঁশলা চাকরিতে গড়া এক চিন্ময়ী শরীরে কত অনায়াসে, সামান্য জৈব-রাসায়নিক প্রক্রিয়ায়, মাতৃত্বের সর্বব্যাপী প্রহেলিকা ঘিরে ধরেছে ।

হাঁটল কিছুক্ষণ । যেতে চাইছে না কোনও রিকশ । হুড তুলে উর্দ্ধমুখী ঠ্যাঙে আরম্ভ হয়ে গেছে ভাতঘুম । পাতলা ডাল কাঁচা লঙ্কা সহযোগে প্রচুর সেদ্ধভাতের নেশাময় হামেজের ঘুম ।

ওর নাম ধরে কাউ ডাকছে শুনে চায়ের ঝুপড়িটায় দু-জন অফিসারকে দেখতে পায় অতনু । অরুণ মুখোপাধ্যায় আর তার ভায়রাভাইয়ের ছোটোভাই মলয় রায়চৌধুরী । চায়ের এইসব ঠেকগুলোয় পোস্তফলের খোসা আর এলাচ দিয়ে চায়ের পাতা দুধে ফুটিয়ে চা হয়, কড়ক চা । চেনা খদ্দেররা গাঁজা ভাঙ চরস আফিম তাড়ি খায় ; ঝকঝকে রোদে এই সমস্ত নেশার আলাদা আমেজ হয় ।

–মিস বর্মণের বাড়ি গিসলে ?

–হ্যাঁ ।

–রূপের খোলতাই কেমন দেখলে ?

–আমাদের সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দিও সব মিটমাট হয়ে গেলে ।

অনুনাসিক দোষে দুষ্ট এক মিনিবাস এসে দাঁড়াতে, এদের দুজনকে এড়াবার জন্যে, বাসটার গন্তব্য না জেনেই উঠে পড়ল অতনু । নামল গিয়ে পাটনা স্টেশানের স্টপেজে । দুপুর রোদ্দুরেও হনুমান মন্দিরে পূণ্যার্থীর কাতার, শালপাতায় প্যাঁড়া আর গাঁদাফুল । গাঁদাফুল বোধহয় সব ঋতুতেই হয় আজকাল ।

রিকশ পেতে অসুবিধা হল না । ফ্রেজার রোড ধরে আকাশবাণী ক্লার্ক অবধ হোটেল হাথুয়াকোঠি সুলভ শৌচালয় পার হয়ে পৌঁছোয় ধর্মঘটিদের তাঁবুতে ।ঘুমোবার ভান করছে বা ঘুমিয়ে পড়েছে অভুক্ত হরতালিরা । রাস্তার উড়ন্ত ধুলো এসে সাঁতরাচ্ছে প্লাসটিক বালতির অলস জলে । একঘেয়েমি থেকে চাগিয়ে ওঠা ক্লান্তিতে ভরপুর তাঁবুর বসন্তকালীন বাতাস । নিস্তেজ সংঘর্ষের গতানুগতিক উদ্দেশ্যহীনতায় গন্তব্য খোঁজার জন্য পড়ে আছে এই একপাল মরদ । তাঁবু জুড়ে ঘামনিঃসৃত যৌবগ্রন্হীর গন্ধ ।

শিবু পালিতের সতরঞ্চিতে বসল পা ছড়িয়ে অতনু । জুতো-মোজা খুলে রাখে একপাশে । তাঁবুর একটা ছ্যাঁদা দিয়ে রোদ্দুরের আনাগোনা এমন চলছিল যে সেটাকে এড়িয়ে অসুবিধে হচ্ছিল যুত করে বসতে। বিষুব রেখার এপারে আসছে বোধহয় বসন্তকালের সূর্য । সেই ঝোঁকে অতনুকে বিরক্ত করছে খানিক । ঢুলতে আরম্ভ করেছিল অতনু, শিবু পালিত ভেঙে দিল তন্দ্রা, ‘আরে চক্রবর্তী, ফিরলেন কখন ? আঃ, প্যান্টের ক্রিজ খারাপ হয়ে গেল তো । এদের উচিত ছিল চেয়ার-ফেয়ারের ব্যবস্হা রাখা,’ দু কনুইতে ভর দিয়ে, বুক আর মুণ্দু উঁচিয়ে শিবু পালিতের উক্তি ।

–কখন থেকে না-খেয়ে আছেন ?

–কাল সন্ধে থেকে । ছটা থেকে ছটার ডিউটি ।

–খিদে পায়নি ?

–রাত্তিরে আর সকালের দিকে তেড়ে পেয়েছিল ; দু’ফুঁক মেরে সামলে নিয়েছি ।

–সিগারেট খেলে খিদে মরে যায় ? আমিও সকাল থেকে খাইনি কিছু । দিন তো একটা, দেখি টেনে ।

–সিগ্রেট কে বললে ! চরস, হ্যাশিশ । বেশ মিষ্টি । মিষ্টিখোর বাঙালির জন্যে এরচে প্রিয় আইটেম নেই । শালা এখানকার লোক গাঁজা ভাঙ তাড়ির বাইরে বেরোতে পারল না ।

–কই দেখি ।

–নিন, আলতো টানবেন, নইলে কাশি পাবে ।

নয়ানাভিরাম ধোঁয়া খায় অতনু, রসিয়ে । ক্রমশ চোখের ওপর থেকে কপালের দুপাশ ফাঁকা । জিভ আর মাড়ি সুকোয় । স্মৃতির টুকরো ভাসমান । একাধিক ইঁদুর বিষ খেয়ে মরে পড়ে আছে তবু তাদের ওপর গুলি চলছে । অবিস্মরণীয় স্মৃতিভ্রংশ । রাস্তার ওপারে টেলিফোনের তারের ওপর কাক-পরিবারের কুশীলবদের সমবেত অভিনয় । অতনুর কানে তুলো গুঁজে দিয়েছে কেউ, ঝিম ঝিম ঝিম ঝিম ঝিম ঝিম । পেতলের খোকা কৃষ্ণের হামাগুড়ি, মানসী বর্মণের কাচের আলমারিতে । দু’কানের পাশে নাছোড় বাতাসের পীড়াপীড়ি । মাছি মূমাছি বোলতা ভ্রমর ভিমরুল গঙ্গাফড়িঙের ধাতব গুঞগজন । বিজ্ঞাপনের মডেল তারকা সাবান মাখতে মাখতে হাসছেন হোর্ডিং জুড়ে । বাহ্যজ্ঞানশূন্য আদুলগা । মানসী বর্মণ আদুল গা ! মাথা নাড়িয়ে ছবিটা মুছতে চেষ্টা করে অতনু । ঘাড় নিচু করে বসে থাকে কিছুক্ষণ

–খিদে তো যায় না । শুধু নেশা হয় । স্মৃতিতে অদ্ভুত সব অবিশ্বাস্য ছবি ভেসে উঠছিল, বাকি অংশটা শিবু পালিতের হাতে দিয়ে বলল অতনু ।

–ব্যাস । কাৎ হয়ে পড়ে থাকুন ; মাথা ঘুরতে দেবেন না, মাথা ঘুরতে দেবেন না,  ঘুমিয়ে পড়ুন চোখ বুজে, মৌতাত নিতে থাকুন, এনজয় করুন । মৌতাত কেটে গেলে বাড়ি যাবেন । আপনার অনশানের পালা কবে ?

–কে জানে ! খোঁজ নিইনি । আমার মাথা কিন্তু কোনো কারণেই ঘোরে না ।

শৈবাল পালিত কন্ঠস্বর নামায়, প্রায় ফিসফিস, ‘চলুন না কালকে রাজগির, আমাকে নিতে ওরা ভ্যান পাঠাবে সকালে । আমার বাড়িন জানেন তো ? আশিয়ানা বিলডিং । এসে যান ভোর ছটা নাগাদ ।’

–আচ্ছা, আপনারা ঠিক কী করেন ? ঠিক কী ধরণের ফুর্তিফার্তা ? নাচ-হইহল্লা, না কী ?

–চলুন না । মানব জন্ম তো একবার ।  কিন্তু আমি তো আপনাদের মতন গড়গড় করে ইংরেজি বলতে পারি না ।

–ওও, ডিয়ার, ইংরেজিতে কথাগুলো ভালগার মনে হয় না । হিন্দি-বাংলায় কেমন যেন ডার্টি আর অবসিন মনে হয় । বাংলায় ফাক কান্ট শিট বুলশিট আসহোল মাদারফাকার ফাকইউ বলা যায় ? ছি ছি । ইংরেজিতে মা আর দিদির সামনেও বলা যায় । আর আপনি তো শেক্সপিয়ার টিএস এলিয়ট আওড়াতে এক্সপার্ট । ঝেড়ে দেবেন দুচার লাইন কেউ ট্যাঁ-ফোঁ করলে ।

–ঠিক আছে । পৌঁছে যাব ।

মৌতাত কেটে গেলে অতনু বাড়ি গিয়ে খেয়ে-দেয়ে ঘুমিয়ে পড়ে । ঘুম থেকে উঠে চা তৈরি করে । অবাক মা ।

–বিদেশ থেকে শিখে এলি বুঝি ? তোর বাবা তো সব পারত । বড়ি দিতে পারত, জানিস ?

–তোমায় আর কিছু করতে হবে না । কালকে অবশ্য যাব এক জায়গায়, ফিরতে দিন দুয়েক লাগবে ।

–হ্যাঁ, বন্ধুবান্ধবদের সঙ্গে একটু মেলামেশা কর । আর কত দিন মুখে বই গুঁজে ঘরকুনো থাকবি !

 

ম্যাটাডর ভ্যানটা পার্ক করা ছিল শিবু পালিতের ফ্ল্যাটবাড়ির রাস্তায় । গাড়িতে ঢুকে অতনু দ্যাখে শিবু আগে থাকতে ড্রাইভারের সিটে, ছিটের রঙচঙে বুশশার্ট আর জিনস-ছিঁড়ে হাফপ্যান্ট । ফর্সা উরুতে ঘন কোঁকযা চুল । কিছুক্ষণ পর গাড়ি গিয়ে ঢোকে গোলঘরের পেছনে এক ঘিঞ্জি গলিতে । ঘিঞ্জি বলতে কালচে কাঠ, ফ্যাকাশে প্লাস্টিক, ত্যাবড়ানো টিনের দেয়াল, বাঁশের নানা মাপের বেড়ের খুঁটি, আধপচা নারকেল দড়ি, হলুদ নাইলন দড়িতে বাঁধা, খরখরে চুনবালি, চটের পর্দা, উদাসীন বুড়ো, টিনের ডিবে হাতে গঙ্গার পাড়ে হাগতে যাচ্ছে গামছাপরা মাস্তান ছোকরা, দাঁতনরত ল্যাঙটপরা ষণ্ডা ।

স্তুপের আকারে ১৭৮৬ সালে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির ক্যাপ্টেন জন গার্সটিনের পরিকল্পনায় তৈরি গোলঘরে এখনও চোদ্দ লক্ষ টন চাল বা গম মজুত রাখার ব্যবস্হা আছে ; ১৭৭৭ সালের বাংলা-বিহার দুর্ভিক্ষের পর তৈরি হয়েছিল ১৪৫টা পাকানো সিঁড়ির গোলঘর । তারই পেছন দিকে দারিদ্র্যের চূড়ান্ত ।

‘একজনকে পিক আপ করতে হবে,’ শিবু পালিত নেমে যায় আর মিনিট পনেরোর মধ্যে ফিরে আসে কালো কুচকুচে ছিপছিপে এক যুবতীকে সঙ্গে নিয়ে, দু’হাতে প্লাসটিকের আসমানি চুড়ি, নাকে ফিরোজা পাথরের নাকছাবি । কালো শিফনের শাড়ি, আসমানি ব্লাউজ, চুলে চাঁপাবেলির গোড়ে, চোখে আইলাইনার । এরকম একটা অখদ্যে জায়গায় থেকেও মেয়েটা কত টাটকা উচ্ছল প্রাণবন্ত সপ্রতিভ চনমনে । দারিদ্র্যের মধ্যে কোথায় অস্তিত্বের স্পন্দন তাও ঠিকমতন খুঁজে নিজেদের আনন্দকে প্রবাহিত রাখছে মানুষ ।

ওদের দুজনের মাঝে ঝপাং বসে পড়ে মেয়েটি, তার ছোঁয়াচে প্রাণপ্রাচুর্য নিয়ে অতনুর দিকে অনুসন্ধিৎসু চাউনি । ‘আপনাকে দেখিনি তো আগে কখনও,’ কোলের ওপর রাখে ওড়িশার পিপলি গ্রামের কাঁধ ব্যাগ, কথায় খাঁটি বিহারি টান ।

–না, ও এই প্রথমবার আমাদের সঙ্গে । ওর নাম অতনু ।

–আর আমার নাম শেফালি । সবাই আমাকে টু বলে ডাকে । আরে, তোমার হাত কত নরম, তোমার হাত কি ঘামে ?

‘তোমার কথায় অত হিন্দি টান কেন ?’ অতনু জানতে চাওয়ায় মেয়েটি জানায় তার বাবা বিহারি মা বাঙালি । কলকাতার কাছে চটকলে ওর বাবা মজুর ছিল । বাবার সঙ্গে পালিয়ে এসেছিল মা । মা কিন্তু বামুন বাড়ির মেয়ে, হুঁ । বাবারা দেওঘরের বাউরি ।

–দেওঘরের বাউরি ? ওরা তো বাঙালি । বলল অতনু ।

শুবু পালিত বলল, ‘না হে, এ বাউরি সে বাউরি নয় । দেওঘরের বাউরিরা পাণ্ডাদের বাসন মাজত আর এঁটোকাঁটা খেত আগেকার দিনে ।

–আর এখনকার দিনে তোমরা আমাদের খাও না ? শেফালি বলল সামনের আয়নায় দুজনের দিকে তাকিয়ে ।

–পেলে খাই । শিবু পালিত বলল শেফালিকে ।

–হুররররররেএএএএ । চেঁচিয়ে ওঠে মেয়েটি আর দুহাত দুজনের কাঁধে রেখে নিজের দিকে টানে যার দরুণ গাড়িটা হঠাৎ মাঝরাস্তা থেকে বাঁদিকে প্রায় ঘাসের ওপর চলে যায় ।

–এই টু, অ্যাকসিডেন্ট হবে রে !

অতনু হিমশিম । কী ধরণের চরিত্রে তাকে অভিনয় করতে হবে জানে না । মুখে ধুলোমাখা রোদ-কণিকার দল হুড়মুড়িয়ে উঁকি মারে গাড়ির জানলায় । কিছুক্ষণেই নোংরা হয়ে যায় শার্শি ।

‘তোমার ভুরু, চোখের পাতা আর চুলে ধুলো জমছে,’ অতনুর বলা শেষ হবার আগেই মেয়েটি তার মুখ আর মাথা মুছে ফ্যালে অতনুর বুকে । শার্ট নোংরা হওয়া সত্ত্বেও অতনু স্পর্শমুগ্ধ । ফুলের গন্ধ ছাপিয়ে পুরুষকে মুহূর্তে আড়ষ্ট করার নারী সুগন্ধ –এই নারী-সুগন্ধের সঙ্গে পরিচিত ছিল না অতনু, কাঁচা তারুণ্যের সন্মোহক গন্ধ ।

‘এবার তোমরা কতজন গো ?’ শিবুকে জিগ্যেস করে টু ।

‘ষোলোজন । অতনুকে নিয়ে সতেরো । কাহিল হয়ে যাবে না তো ?’

‘আমি ? তোমরাই ভিরমি খাবে একে-একে । সবাইকে জানি কার কত মুরোদ । একটুতেই জিব বেরিয়ে যায় । কত টাকা করে দিচ্ছে সবাই?’

‘পনেরোশো করে, সবসুদ্ধ চব্বিশ হাজার, অতনুকে ছেড়ে।’

‘আমার কাছে হাজার দুয়েক টাকা আছে।’ বলল অতনু, মেয়েটির দিকে আয়নায় তাকিয়ে ।

‘ও বাবা, নতুন হলে কি হবে ! এতো ডুবে-ডুবে জল খেতে চাইছে গো । আটঘাঁট বেঁধে বেরিয়েছে।’ অতনুকে দুহাতে জড়িয়ে ধরে শেফালি, তারপর শিবুর দিকে তাকিয়ে জিগ্যেস করে, ‘কোথায় হবে ব্যাপারটা ?’ ছাড়ে না অতনুকে ।

‘নালান্দায়, ধ্বংসাবশেষে তোমাকে গড়ে তোলা হবে, বুঝলে ভিক্ষুণী।’

অতনুকে ছেড়ে দিয়ে, ‘ঘরভাড়া নেয়া হয়ে গেছে ? খাওয়া-দাওয়ার ব্যবস্হা ? এবার কে তোমাদের নেতা গো ?’

‘এবার কো-অর্ডিনেটার রবীন দত্ত ।’

‘চশমা পরা, ঢ্যাঙা, সে ?’

‘হ্যাঁ।’

‘ওঃ, খুব জমবে ।’

হকচকিয়ে অভিভূত অতনু । রাইখয়রার মতন এমন ফুরফুরে এক ছিপছিপে অপলকা শ্যামাঙ্গী, এক ঝটকায় এক হাতে তুলে নেবার মতন সুঠাম কোমর, ঝোটন বুলবুলির কোঁকড়াকুচি চুল, গলায় আসমানি পুঁতির মালা, কানে নকল মাকড়ি, পাতলা ঈষদুষ্ণ ঠোঁট, ফটিকজল চাউনি, এই অতি সাধারণ প্রাণচঞ্চল মেয়েটা মরে যাবে না তো, এতগুলো ভুখা জোয়ান মরদের ঝাপটায় ।

‘কি দেখছ গো অমন করে?’ মেয়েটি জিগ্যেস করে অতনুকে ।

‘তোমাকে ।

‘আমাকে ? এই নাও দ্যাখো, আমি আমার মায়ের কোল অন্ধকার করে জম্মেছিলুম তো, তাই সবাই আমাকে দেখতে চায় ।’ আচমকা অতনুর নাকে নাক ঠেকিয়ে চোখে চোখ রাখে শেফালি । দৃষ্টি আর হাঁ-মুখের সোঁদা শ্বাসে, পলকে, বনসৃজন ঘটে যায় অতনুর অনুভূতিতে । পৃথিবীর অপূরণীয় ক্ষতি ঘটে যাবে এই নারীর যৌবন ফুরিয়ে গেলে । জীবন তো কেবল একবার, কালকেই বলেছিল শিবু, যা যায় তা আর ফেরে না ।

‘তুমি প্রেম-টেম করোনি এখনও ?’ জানতে চায় শেফালি । নাক থেকে নাক তোলে না, চাউনিও বিঁধছে অতনুকে । নিজের হাঁ-মুখে মেয়েটির নিঃশ্বাসকে সেঁদিয়ে যেতে দেয় ও ;  শেফালি আবার অতনুর কোমর জড়িয়ে ধরে, বলে, ‘তোমার মতন ঝুঁটি-বাঁধা কারুর সঙ্গে এখনও প্রেম করিনি ; চুলের ওই ঝুঁটি খুলে দু’হাতে টেনে যা প্রেম হবে না, টেরটি পাবে কারে প্রেম কয় ।’

‘প্রেম করিনি, ট্রেম করেছিলুম । দুটো জাপানি পরির সঙ্গে । তারা উড়ে চলে গেছে আমায় ফেলে ।’ অতনু চুমু খাবার ইচ্ছেকে দমিয়ে রেখে নাক থেকে নাক সরিয়ে নিয়ে বলল ।

‘দু’জন ! হুঃঁ । একটাকেই সামলাতে পারবে না ওই নাদুস চেহারায়, তো দু’জন । দেখব অখন একদিন ; চোলো একদিন দেখব কে আগে দৌড়ে গোলঘরের ছাদে পৌঁছোয় ।’

‘তুমিই জিতবে, তোমাকে আমি জেতাবোই, গোলঘরের টঙে উঠতে হোক বা ট্রেমে।’

‘হারজিত ছাড়া আর ভাবতে পারো না তোমরা ? দুজনে হাত ধরে উঠব, দুজনেই জিতব ; ট্রেমেও হারজিত হয় না মোশাই, বুঝলে ? যেদিন আমার সঙ্গে ট্রেম করবে সেইদিন জানতে পারবে ; একসঙ্গে দুজনের আনন্দকে একই সময়ে মিশিয়ে ফেলতে হয়, তবে তো প্রেমের জয় ।’

 

ধুলোবালি মেখে আত্মনিমগ্ন বিকেলে, বক্তিয়ারপুরে, ঢাবায় রুটি-তড়কা খাবার পর, রাজগিরে এক বাগান বাড়িতে পৌঁছোলে স্বাগতম জানায় দলের বর্তমান অভিভাবক রবীন দত্ত আর বাড়ির মালিকের ছেলে নোট পৃইক্ষক দু-নম্বর দেবেন্দর প্রসাদ । অতনুকে পেয়ে সকলের হই হই, নতুন মোরগ মুবারক । গেট দিয়ে ঢুকেই ভঠ্গীসর্বস্ব পাম গাছের সারি এগিয়েছে দু-দিক থেকে । পোর্টিকো ওব্দি । ইংরেজের তেলমারার খরচে তৈরি গথিকধাম জমিদারি একতলা।

দেবেন্দর যখন ফার্স্ট ইয়ারে, ওর নাকে বন্দুকের নল ঠেকিয়ে কন্যাপক্ষ ওকে তুলে নিয়ে গিয়ে বিয়ে দিয়েছিল । সে বউকে আনেনি বাড়িতে । পাঁচশো বিঘে ধানক্ষেতের লোভে বিয়ে করেছে আবার । পালামৌ-এর বালুমঠ ব্লকে ওদের পুসতয়নি বাড়ি । বিনোবা ভাবেকে অনেক জমি বিলিয়ে ছিল দেবেন্দরের বাবা জ্যাঠা কাকা । লেঠেল লাগিয়ে কেড়ে নিয়েছে সে সব পাথুরে কাঁকুরে জমি বিরহোড় আদিবাসীদের থেকে । চাষিদের নিজের জমিও মেরে দিয়েছে এই তালে । ওদের গ্রামে রিলিফের টাকাটাই প্রথম দ্বিতীয় তৃতীয় ফসল । ওদের এককালের জমিদারির প্রজা যারা এখনও প্রজাত্ব ছাড়িয়ে বেরোতে পারেনি, সেই বিরহোড় উপজাতিরা থাকে কুমভা নামের ঝুপড়িতে । বঁধুয়া মজুর সব ।

এখন বনপার্টির জোয়ানরা উপজাতিদের জলপাই পোশাক আর বন্দুক হাতে দিয়ে ঘন জঙ্গলে প্রশিক্ষিত করে তুলছে ; এতকালের জমিদারির বদলা নিতে চাইছে তারা । দেবেন্দর জানে মারামারি-কাটাকাটি অনিবার্য । তার আগে বেঁচে থাকার যাবতীয় মজা লুটে নাও ।

রাজগিরের এই বাড়িটার এখানে-সেখানে এখনও ল্যাংটো পাথরের এলিয়ে-পড়া বিদেশিনীরা । আম্রপালীর উরু আর নিতম্বে গড়া ভেনাস । উর্বশীর খোলা স্তন মেলে হেলে রয়েছেন হেলেন অফ ট্রয় । শকুন্তলার কটাক্ষ বিলোচ্ছেন মার্বেল পাথরের শীতল ক্লিওপ্যাট্রা । দেশ ছেড়ে যেতে পারেনি এ-সমস্ত জারজ মেমের দল ।

বাঘপায়া মেহগনি পালঙ্কের লাল হলুদ সবুজ কাঁচ জানলার বিশাল টিমটিমে ঘরে অতনুকে পৌঁছিয়ে রবীন দত্ত বলল, ‘রাত্তির সাড়ে আটটায় ডাইনিং হল ।’

তৈরি হয়ে পৌঁছোয় অতনু । বিরাট লম্বাটে ডাইনিং টেবিল সাজানো কাচের প্লেট গেলাস স্টেনলেস স্টিলের ছুরি কাঁটা চামচ আর শাদা ভাঁজকরা রুমালে । দেবেন্দর প্রসাদ দুটো কাঁধ-উঁচু চেয়ার দেখিয়ে অতনুকে অবিশ্বাস যোগায়, ‘এইখানে বসেই এডউইনা মাউন্টব্যাটনকে প্রথম চুমু খান জোহারলাল নেহেরু।’

ঠহাকা হাসির মাঝে কেউ বলে উঠল, ‘আর এডউইনা ওনাকে বলেন, মত ঘাবরাও, তুমহারা কাম হো জায়গা ।’

রবীন দত্ত তদারক করতে করতে জানায়, ‘ওকে বিশ্বাস করবেন না । গতবার আমাদের বেলেছিল এই ঘরে বসে হিন্দু কংগ্রেসিরা আবদুল বারিকে খুন করার প্ল্যান করেছিল ।’ রবীন দত্ত সবাইকে অনুরোধ করছিল, কেউ যেন মদ না খায়, নেশাভাঙ না করে,  আজেবাজে জিনিস না খায়, এমনকি এখানকার জলও নয় । খনিজ জলের বোতল রাখা আছে ঘরে ঘরে । খেয়েদেয়ে সবাই তাড়াতাড়ি শুয়ে পড়ুন । শরীর খারাপ করলে চলবে না । কালকের জন্যে চাঙ্গা থাকতে হবে সবাইকে ।

অতনু দেখল দূরে বসে কাঁধ ঝাঁকিয়ে হাসছে শেফালি । বাতাসে ঝাঁক বেঁধে উড়ছে ওর খোঁপার ফুলের সুগন্ধ । একেই বোধহয় মথিত হওয়া বলে ।

কম মশলা দেয়া মাংস, সেদ্ধ সবুজ সব্জি, লেটুস বিট গাজরের স্যালাড, আটা আর বেসনের রুটি, ভাত আর পুডিং । পাশে-বসা অসীম পোদ্দারকে অতনু , ‘ওই তো একরত্তি মেয়ে’, বলে প্রশ্নবাচক হতে চাইলে, অসীম বলে উঠল, একরত্তিদের হ্যাণ্ডল করে বেশ তৃপ্তি ।’ তারপর অতনুকে দেখে বিস্মিত, আর গলা নামিয়ে, ‘কেমন আছে জুডি-জুলি ? সুখে আছে তো ওরা ?’

পরিষ্কার হয়ে যায় এবার, কার নির্দেশে তাকে ইংচুগার খরিদনারীদের আড্ডায় তোলা হয়েছিল । অতনুর বুকের কাছে মাথা এনে আপ্রাণ ঘ্রাণের পর অসীম পোদ্দার, ‘এখনও স্বর্গের গন্ধ যায়নি আপনার গা থেকে । কোনোদিন যাবে না দেখবেন । ওটাই তো আনন্দ, কী বলেন !’

অতনু থ । অভিজ্ঞতার অংশীদার আড়াল থেকে এভাবে বেরিয়ে এলে নিজের অভিমানবোধ ওকে খেলো করে । নানা উপাদেয় রান্নার স্মৃতির দরুণ সেদ্ধ খাবার মনে হচ্ছিল জোলো ।

কাল সকাল আটটায় ব্রেকফাস্ট আর ন’টায় সবাইকে গাড়িবারান্দায় পৌঁছতে হবে । জানিয়ে চলে গেল রবীন দত্ত । আঁচাবার সময় অশোক চোপড়াকে জিগ্যেস করেছিল অতনু, ‘আজকে কার ঘরে শোবে শেফালি ?’

‘আজকে ? কেন ? আজকে ও একলাই শোবে !’ অশোক চোপড়ার পাশে দাঁড়িয়ে ছিল সুশীল, সে জানিয়ে দিল ওপর-পড়া হয়ে ।

বরাদ্দ ঘরটায় পৌঁছে অতনু নিজের অভিজ্ঞতার অভাবের সঙ্গে পরিচিত হয় আবার । একটা পায়জামা ধুতি বা লুঙ্গি আনা উচিত ছিল । আনেনি । জামা কাপড় খুলে উলঙ্গ শুয়ে পড়ল অগত্যা চাদর ঢাকা দিয়ে । শুয়ে-শুয়ে ভাবছিল, এতো ফুর্তিফার্তা নেশাভাঙ হই-হুল্লোড়ের ঘন-ঘন খরচ কোথা থেকে জোগায় সবাই ! মাইনে কি বাড়িতে দিতে হয় না একটুও ?

তন্দ্রার মধ্যে অতনু টের পাচ্ছিল, বাইরে, দ্রুতলয়ে ঝিঁঝির ডাক অন্ধকারকে ফেনিয়ে তুলছে ।

সকালে স্নান করে ডাইনিং হলে হ্যালো-হাই, ব্রেকফাস্ট করছে, নিজের সঙ্গে নিজে নিঃশব্দ মন্ত্রণা করতে-করতে চলে যাচ্ছে । টেবিলে তখন পুলক, মামুদ জোহের, কমলেশ আর দেবেন্দর । পোচ টোস্ট কলা কফি । টু বোধহয় খেয়ে চলে গেছে কিংবা আসেনি এখনও । ভিড়ে কথা বলাবলি কম । দু’একজন হলে কথা বলার সুবিধে । এতকাল ধরে বজায় রাখা দূরত্বে কী কথাই বা কার সঙ্গে বলবে ! কোন বিষয়ে ? খেলা ? বিহারের রাজনীতি ? বিজ্ঞান ? মেয়েমানুষ ? অফিস ? ইউনিয়ান ? মার্কসবাদ-লেনিনবাদ ?

খেয়ে নিল চুপচাপ, মুখ নিচু করে ।

বাইরে, পোর্টিকো থেকে এগিয়ে, গেটের কাছে হলুদ কল্কে ফুলের ভেতরে সেঁদিয়ে কারিগর মৌমাছিরা তখন কারচুপির গুঞ্জন চালাচ্ছে । অতনু দেখল অ্যামবাসাডর গাড়িগুলো ভরে গেছে । ভ্যানে ড্রাইভারের সিটে আত্মমগ্ন মামুদ জোহের । অনেকে ম্যাটাডরের পেছনে ; অতনুও বসল তাতে । বাড়ির ভেতর থেকে রবীন দত্ত আর টু বেরিয়ে আসতে সবকটা গাড়ি থেকে শেফালিকে আবদার জানানো হল তাদের গাড়িতে বসার জন্য ।  শেফালি মামুদ জোহেরের পাশে গিয়ে বসতে, রবীন দত্তও উঠল তাতে । স্টার্ট দ্যায় গাড়িগুলো ।

রাস্তার দু’পাশে কচিসবুজ কচিমেরুন পাতার ঠাণ্ডা বাতাস । একটু পরেই রোদের তাত আরম্ভ করবে ধুলো ওড়ানো । কচু খেতে জল দিচ্ছে কৃষক । ফসল কেটে তুলে নিয়ে যাবার পর সোনালি গোড়া । সেচের অভাবে মাঠের পার মাঠ তেপান্তর । বাবলা গাছের কাঁটাঢ্যাঙা ঝাঁকড়া । দূরে, পোড়ামাটির ছাপ্পর-ছাওয়া গ্রাম । সবকিছু কত উদাসীন, যেন গৌতম বুদ্ধের পরের সময়কার উদাসীনতা থেকে মুক্তি পায়নি উন্মুক্ত প্রান্তর ।  যৌথ সন্ত্রাস, জাত-ঘৃণা আর পার্থিব মালিকানার নিষ্ঠুর প্রতিদ্বন্দ্বিতাকে কত চুপচাপ লুকিয়ে রেখেছে নিসর্গ । ঠাণ্ডা মাটির দেয়ালে অন্ধকারাচ্ছন্ন হেলান দিয়ে আছে বয়ঃসন্ধির ছেলেমেয়ের মতন প্রায় সব বাড়িতেই দাঁড়িয়ে আছে তরতাজা ভালা বরছি গঁড়াসা কুঠার গাদাবন্দুক পেতলসোঁটা ।

পৌঁছে গেল ওরা নালান্দার ধ্বংসাবশেষে । বোধের অতীত মনে হল অতনুর । যিশুখ্রিস্টের পাঁচশো বছর আগে জায়গাটা ছিল বৌদ্ধ মহাবিহার, চিন তিব্বত ইরাক সিরিয়া মধ্য এশিয়া থেকে দশ হাজার ছাত্র এসে পড়ত এখানে ; আর দু’হাজার শিক্ষক ছিল, বিশাল গ্রন্হাগার ছিল । জৈন তীর্থঙ্কর মহাবীর, গৌতম বুদ্ধ, নাগার্জুন, কতো জ্ঞানীগুণী এসেছেন এখানে । জায়গাটাকে দুর্গ মনে করে বখতিয়ার খিলজি ধ্বংস করে দিয়েছিল, গ্রন্হাগার পুড়িয়ে দিয়েছিল । বইয়ের ওপর শাসকদের এতো রাগ কেন কে জানে । বৌদ্ধধর্মের অবসানের সঙ্গে নালান্দার অবসান । আর আমরা তাদেরই উত্তরপুরুষ, শেফালিকে নিয়ে ফুর্তিফার্তা করব । অবিশ্বাস্য । কিন্তু কিছু করার নেই । দেখা যাক সবাই কী করে, ভাবল অতনু ।

গাড়িগুলো থেকে সবাই নেমে গাছের ছায়ায় দাঁড়ালো । কালো চশমায় শেফালি । কচি কলাপাতা অরগ্যাণ্ডি । কাঁধে লাল-সবুজ ঝোলা । পিঠে ছড়ানো আধভিজে এলোচুল ।

‘আচ্ছা, যারা কালো, তারা বিদঘুটে পোশাক পরে কেন ?’ কন্ঠস্বর নামায় পুলক । আরও ফিসফিস কন্ঠে অশোক চোপড়া, ‘আমি আজ ওব্দি এত কালো মেয়েমানুষকে নেকেড দেখিনি। ওর মাইটা কেমন হবে, বোঁটা, তার চারিধারের গোল ? সেক্সের জন্যে নয়, জাস্ট দেখার জন্যে ।’

সত্যি, জুলি-জুডির থেকে একেবারে আলাদা এই অজানা পৃথিবী । প্রেম আর পারভারশানে বোধহয় তফাত নেই । শেফালির ট্রেম ।

সকলে রবীন দত্তকে ঘিরে ধরলে আরম্ভ করে ইউনিয়ান নেতার বাঁধাগৎ-বক্তৃতা । ‘ফ্রেণ্ডস রোমানস কান্ট্রিমেন, লেণ্ড মি ইয়োর ইয়ার্স । ও ! জাজমেন্ট, দাও আর্ট ফ্লেড টু ব্রুটিশনেস, অ্যান্ড মেন হ্যাভ লস্ট দেয়ার রিজনস…শেফালি পাবে পাঁচ হাজার…যেজিতবে সে পাবে শেফালিকে আর দশ হাজার…বাদবাকি রাহা-খাওয়া…দেবেন্দর ওর চাকর চাকরানিকে হুকুম দিয়ে এসেছে একতা ঘরে ফুলশয্যা তৈরি করে রাখতে…যে জিতবে তার জন্যে…খরচের অ্যাকাউন্ট অডিট করে প্রমাণপত্র দেবে অশোক চোপড়া…শেফালি ধ্বংসাবশেষের মধ্যে চলে যাবার আধঘণ্টা পর যাবে বাকি সবাই…যে সবচেয়ে আগে শেফালিকে পাবে সে জিতবে…খুঁজে পেলে ওকে ধরে রাখতে হবে…এনে গাড়িতে অপেক্ষা করবে সবাই না ফেরা ওব্দি…ইচ্ছে করলে শেফালি যতবার ইচ্ছে হাত ছাড়িয়ে পালাতে পারে…যে একবার বাইরে বেরিয়ে আসবে সে ডিসকোয়ালিফায়েড…গুড লাক।’

কেউ কাউ কছ থেকে সত্যিই খুঁটিয়ে দেখল শেফালিকে । টু-ও ঠোঁটের কোণে হাসি । যৌনতার চিটফাণ্ড তাকে গৌরবোজ্জ্বল করেছে । এক বৃদ্ধ ট্যুরিস্ট, গবেষকও হতে পারেন, দাঁড়িয়ে রবীন দত্তর বক্তৃতা শুনছিলেন, গজগজ করতে করতে চলে গেলেন সস্ত্রীক ।

কাঁধে ব্যাগ ঝুলিয়ে শেফালিও চলে গেল বৌদ্ধ মহাবিহারের ধ্বংসাবশেষে , প্রাচীন বিশ্ববিদ্যালয়ে ।

ভেতরে গিয়ে খিদে তেষ্টা পায় যদি, অনেকে কেনাকাটা করে নিচ্ছে । অতনু কিনল না কিছু । এতগুলো ছোকরা, কতক্ষণই বা লাগবে, ভিড়ও নেই বিশেষ । তার মানে শুধু একজনই পাচ্ছে মেয়েটাকে, বাদবাকি সকলের লোকসান । জিতলে অবশ্য যে জিতবে, তার অনেক । শেফালি বলেছিল হারজিত ছাড়া ভাবতে পারো না কিছু । হারজিত রয়েছে বলেই তো ভালো, মনে হল অতনুর, নয়তো এতগুলো ছেলে যদি একজন মেয়ের সঙ্গে সেক্স করে তাহলে তো মেয়েটা মারা পড়বে ।

ঘড়ি দেখে আধঘণ্টা পরা অতনুও ঢুকল সবায়ের সঙ্গে । ঢুকেই নরেন একদিকে আর প্রতুল আরেকদিকে দৌড়োলো বোঁ বোঁ, হয়তো ষড় করে ষাঁড়াশি অভিযান, টাকাটা ভাগ করে নেবে, বা একজন টাকা, একজন শেফালি । মামুদ জোহের শিবু পালিত দেবেন্দর প্রসাদ উঁচু জায়গাটায় বসল ঘাসের ওপর । বোধহয় ওদিক থেকে তাড়া খেয়ে এলে ধরবে এদিকে । কিংবা শেফালির সঙ্গে ট্রেম করা হয়ে গেছে বলে তেমন আগ্রহ নেই । বাকি সবাই গটগট, গুটিঘুটি, লম্বা পা ফেলে, এক-পা টগবগিয়ে, দুমদাম, হন্তদন্ত, হেলতে দুলতে, যে যেমন আঁক কষেছে গায়েব হয়ে গেল ।

অতনু দোটানায়, এর আগে দেখা হয়নি নালান্দার ধ্বংসাবশেষ, মগজের ভেতরে বৌদ্ধ ভিক্ষুরা চোরপুলিশ খেলছে শেফালির সঙ্গে । খেলতে খেলতে দেখতে হবে, দেখতে দেখতে খুঁজতে হবে । পাথরের বালিশে ঠেশ দিয়ে দাঁড়ানো একটা কিশোরী-গাছের ছায়ায় অতনু দেখছিল প্রাচীন ইঁটের গাঁথুনি, ছাত্রদের যাতায়াতের পধ, ইসকুলের পরিসর, ভিক্ষুদের ঘর, ধাপে ধাপে উঠে যাওয়া সিঁড়ি — সবই কেমন যেন উদ্দেশ্যহীন । ধ্বংসাবশেষের ঠিক কী উদ্দেশ্য হয় ? তারা কি জীবন পেয়ে যায় পর্যটকদের চাউনির মাধ্যমে, তাদের ছোঁয়ায় ! এখানকার বাতাসে, কই, তখনকার মহাজ্ঞানী শিক্ষকদের উপস্হিতি টের পাওয়া যাচ্ছে না তো ! নালান্দা সম্পর্কে একটা ট্যুরিস্ট বুকলেট কিনে নিলে কাজের কাজ হতো । গাড়িতে বসে শেফালি বুকে মুখ আর মাথা ঘষে ভাবনা গণ্ডোগোল করে দিয়েছে ।

কাছেপিঠে, দূরে, কোথাও কচি সবুজ শাড়িতে, দেখতে পাওয়া যাচ্ছে না কাউকে, না শেফালি, না বকুল রজনীগন্ধা বেলি চামেলি টগর যুঁই । পর্যটক দলের তরুণীদের মুখের দিকে এভাবে তাকানো বেশ বিপজ্জনক ।

শিক্ষিকার সঙ্গে কিশোর-কিশোরীদের দল চলে গেল, বিদেশিনীদের বোঝাতে ব্যস্ত গাইড, জাপানি চেহারার ভিক্ষু গোষ্ঠী । ঘণ্টাখানেক কেটেছে । ওই তো, এ সেকশানের অনিমেষ । খোঁজা এখনও চলছে তার মানে । ওপরে উঠে বিহঙ্গম দৃশ্য নেয়া যাক ভেবে অতনু সিঁড়ি ভেঙে উঠে দেখল সুবীর জিরোচ্ছে । ‘আমার হাঁটু ব্যথা হয়ে গেছে, জল তেষ্টা পাচ্ছে, সারেনডার করে বসে আছি’, ভুরুর ওপরে বাঁ হাতের ছায়া ফেলে জানাল সুবীর ।

এক পাক ঘোরা হয়ে গেছে অতনুর । অনেকের সঙ্গে দু-বার তিন বার সাক্ষাৎ, যেন কেউ চেনেই না কাউকে । গাছের ছায়ায় দাঁড়িয়ে সজল, চোখে বায়নাকুলার । কেয়ারি করা বেড়ার পাশে ঘাসে শুয়ে পুলক আর সুবীর । পাশ কাটিয়ে চলে গেল দিগ্বিদিক জ্ঞানশূন্য কমলেশ । কেবল টু নামের কালো মেয়েটির দেখা নেই । দেখাই পাওয়া যাচ্ছে না, ধরার, ধরে রাখার, ধরে সঙ্গে নিয়ে যাবার কথা তো পরে । এই রোখটাই তাহলে নেশা, একজন যুবতীকে অন্য পুরুষের কাছে হারাবার ভয় । বাঘ সিংহ হরিণ জেব্রা জিরাফ বনমহিষ হলে পুরুষরা নিজেদের মধ্যে দ্বন্দ্বযুদ্ধ করত, লড়ে মরে যেত, তবু জিততে হবে, জিততে হবে, জিততে হবে । ঘুমন্ত মাছের চোখে তীর মারার খেলা ।

এই নিয়ে অতনুর তিনবার পাক । রোদ্দুর তেজ দেখাচ্ছে । ক’টা বেজেছে কে জানে । বেশ খিদে । অবসন্ন অতনু খোঁজা ছেড়ে দিয়ে বাইরে বেরিয়া যায় । অনেকে বেরিয়ে এসেছে ওর মতন, ঢুলছে গাড়িতে বা ভ্যানে বসে, কানে গানের ঠুলি । চারটে ডানা মেলে দেয়া অ্যামবাসাডর থেকে বেরিয়ে এলো রবীন দত্ত, ‘পেলে না তো ? ব্যাড লাক, বেটার নেক্সট টাইম । ও একেবারে খরগোশ, মাটি খুঁড়ে লুকিয়ে পড়ে, তাই ওকে আমাদের এত পছন্দ । ডিকিতে লাঞ্চ প্যাকেট আর বিয়ার আছে।’ বেশ অপ্রস্তুত লাগছিল অতনুর । খেয়ে, ঘাসের ওপর চিৎ শুয়ে ঢুলতে মনোযোগ দ্যায় ।

সাড়ে চারটে নাগাদ শেফালির হাত শক্ত করে ধরে বেরিয়ে আসে অভিজিৎ, চেঁচাচ্ছে, ‘পেয়ে গেছি আমার হেলেন অফ টার, পেয়ে গেছি আমার হেলেন অফ টার, কোথায় একিলিস ইউলিসিস আগামেমনন !’ হতচকিত সবাই ।

অতনু দেখল, শেফালির পরণে কমলা-হলুদ সিল্ক, খোঁপা বাঁধা মাথায় ঘোমটা, মোটা কালো ফ্রেমের বাইফোকাল, পাউডারে ফর্সা মুখ, হাতে প্লাসটিকের ব্যাগ । ওঃ, একে তো অতনু দেখেছিল, খটকা লাগেনি শাড়ি চশমা ব্যাগে ভোল পালটাবে । নিশ্চিত ছিল । পেল না । শেফালি কি টার শব্দটার মানে জানে !

‘আরে, আমি ধরেছিলুম একবার ওকে, কিন্তু বোকা বানিয়ে ছাড়িয়ে পালিয়ে গেল । আমার কাছে জলের বোতল চেয়ে জল খাচ্ছিল, আমি ভাবলুম, আহা, তেষ্টা পেয়েছে মেয়েটার, ব্যাস পালালো’, বলতে বলতে গলা বুজে যাচ্ছিল কমলেশের ।

শেফালির চোখে রাশছাড়া অবিমৃষ্যকারিণীর আনমনা কৌতুক ।’

–কী করে পেলি তুই ?

–মেয়েদের পেচ্ছাপখানায় নজর রেখেছিলুম । তা সত্ত্বেও ফেল করেছিলুম একবার । লাল শাড়িতে ছিল । লাল গিয়ে যখন কমলা-হলুদ শাড়ির বুড়ি বেরোল, অমনি পেছু নিয়েছি । কিছুটা ফলো করে বুঝলুম সঙ্গে ন্যাওটা নেই । ও তো দৌড় দিলে । ধরে ফেললুম । এক ব্যাটা শিখ সরদার আরেকটু হলেই প্যাঁদাত । টু বাঁচাল ।

বেশ জোরে জোরে সংক্রামক অন্তরঙ্গ হাসি খেলাচ্ছিল নিজের আগাপাশতলা জুড়ে সতেজ মেয়েটা ; সকলেই ক্লান্ত, অথচ শেফালি ক্লান্ত নয় । ওর এই প্রাণপ্রাচুর্যের বখরা পাবার জন্যেই ওর ডাক পড়ে, তাহলে । অতনুর কাছে এসে, ‘কেমন হাঁদা গো তুমি, দু-বার তোমার সামনে দিয়ে এলুম গেলুম,’ বলতে-বলতে মুখমণ্ডলকে ম্লান করে ফ্যালে ও, অতনুর নতুনত্ব তাহলে কাম্য ছিল । হাতছাড়া হয়ে গেল অকপট স্ফূর্তির জীবন্ত গ্র্যানিট-প্রতিমা ।

ফেরার পর, রাত্তিরে, জমজমাট হল বুফে ভোজ । পোলাও নান সসেজ মেটে চিংড়ি দইবড়া হুইস্কি রাম জিন । রইরই । তেড়ে বিলিতি বাজনার ছটফটে হুল্লোড় । যেমন ইচ্ছে নাচের বেহিসেবি আপ্রাণ । দেবেন্দরের গ্রাম থেকে আনা সাত-আটজন বরগার খাটছে । কমিঅওটি প্রথায় এরা বংশপরম্পরায় বঁধুয়া মজুর । নইলে এতজন যুবকের সাধ-আহ্লাদের খেয়াল কেই বা রাখবে ! দাড়িঅলা ছেঁড়া-লুঙ্গি লোকটাকে দেখে বোঝা যাচ্ছিল কমিঅওটির হিন্দু-মুসলমান হয় না ।

অভিজিতের বগলদাবায় মেয়েটা । ঝাড়লন্ঠনে আন্তরিক নেশার ঝিকমিক । প্রত্যেকের খেয়াল নিজের হুঁশ নষ্ট করার দিকে, যেন কারোর আর কাউকে দরকার নেই । নাচবে কিনা সিদ্ধান্ত নিতে না পারায় হাতে গেলাস নিয়ে আরেকটা চেয়ারে ঠ্যাং তুলে অতনু । টেবিলে ফেলে-রাখা কারোর একটা ডায়েরি, অন্যমনস্ক কয়েকপাতা উল্টে চুপসে গেল । অসীম পোদ্দারের । সাংকেতিক রোজনামচার ফাঁকে-ফাঁকে, প্রতি পৃষ্ঠায় লাল কালিএ ঠাসা ‘ওঁ হ্রীং রামকৃষ্ণায় নমঃ,’ অগণন নিভৃত মুহূর্তের জমাট অন্তরাল ।

অভিজিৎ-শেফালি এসে বসল অতনুর পাশে ।

অতনু : একদিন লুট করে নিয়ে যাব তোমায়, তোমার বাবা যেমন করেছিল ।

শেফালি : না বাবা, আমি অমন দারিদ্দির হতে চাই না । যদি অঢেল টাকা আনো তাহলে যাব ।

অভিজিৎ : আরে, আমার বদলে তুমিই নিয়ে যাওনা হে । আমি টাকাটা পেয়েই খুশ ।

শেফালি : এই অভিজিৎ লোকটা একদম ভেড়া । ওর কিসের ভয় জানো ? ও কোনও মেয়েমানুষের সঙ্গে এখনও ওইটা করেনি ।

অতনু : টু, খেয়েদেয়ে একটু মোটা হও । তবে তো আমার সংসার চালাতে পারবে ।

শেফালি : খাবার পয়সা কোথায় ! আনিসাবাদে এক কাঠা জমি কিনেছি । দুটো ঘর তুলতে হবে ।

অভিজিৎ : বাড়ি-ফাড়ি অতনু বানিয়ে দেবে তোমায় । ওর বাবার পুরো টাকাটা তো রয়েছে ।

শেফালি : সত্যি ?

অতনু : তিন সত্যি ।

মদের ভাসমান ঘোরে, হাতে গেলাস, কখন খালি হয়ে গেছে তার হুঁশ নেই, বিহ্বল সংবেদনে চুর অতনু, প্রচণ্ড ডি. জে. বাজনার উদ্দামের মাঝে ঝিম মেরে বসে থাকে, আনন্দ নিচ্ছিল টুকরো-টাকরা আদানপ্রদানের ।

শেফালি : তোমার বাড়িটা কোন পাড়ায় গো ?

অভিজিৎ : চালাকি নাকি । বলে দিই, তারপর তুমি এসে বাপ-মার হাটে হাঁড়ি ভেঙে ব্ল্যাকমেল করো । সেটি হচ্ছে না ।

দেবেন্দর : একে তো শালা ধানে উপজ ভালো হয়নি, তার ওপর মাওওয়াদি নকসল্লিগুলো দিককরা আরম্ভ করেছে । নিচু জাতের লোকেদের ভুনে মাটিয়ামেট না করলে পুরো দেশ ডুবে যাবে । কাংরেস কিচ্ছু করবে না ।

কমলেশ : আমি তো জানতুম শুধু অওরঙ্গাবাদ জেহানাবাদ নওয়াদা গয়াতেই দঙ্গাফসাদ । পলামুতেও পূঁছে গেছে ?

অশোক : চন্দ্রকেতু সিং দশ হাজার টাকা খরচ করে আমেরিকান মাগিদের ঠুকে আসছে রজনীশ আশ্রমে ফি বছর একবার । বলছিল যে পেন্টাগন সিআইএ এমএনসিদের ঠুকছে মনে করে চাপে ফর্সা মাগিগুলোর ওপর । চলুন না, আসছে শীতে এক ট্রিপ মারি ।

সুশীল : তার চেয়ে ব্যাংকক চলুন না এল টি সি নিয়ে । থাইল্যাণ্ডের মতন ল্যাংটো কচি-কচি নধর মেয়েছেলের বাজার আর কোথাও নেই ।

নরেশ : তোর জন্যেই মিস করলুম । স্ট্র্যাটেজিটা ভুল ছকে ফেললি ।

প্রতুল : বা রে, আমি কী করব ! এমন বহুরূপী সাজবে তুই জানতিস ?

সুবীর : জনি ওয়াকারের সঙ্গে চিড়াইয়াটারের ধেনো মিশিয়ে ককটেল করেছে দেবেন্দর । মজা কিরকিরা হয়ে গেল ।

শিবু : মজফফরপুর থেকে লিচুর মদ আনিয়েছি । গন্ধেতেই আমেজ এসে যায় । আসুন না একদিন বিকেলে, আমার ফ্ল্যাট আশিয়ানায়, চেনেন তো ?

নাচ-গান-হুল্লোড় তুমুল । বাঁ দিকের কোনের পেল্লাই দরোজার কাছে, পাঁচ-সাতজনের তক্কাতক্কি, প্রায় হাতাহাতি, হাত ঝাঁকানো, মুণ্ডু ঘাড় থেকে এগিয়ে জিরাফি বক্তব্য, মাথা ঝাঁকানো । জটলায় কোমর দুলিয়ে ফুট কাটতে কাটতে অটোমোবিল ইনজিনিয়ার আর জিওলজি স্নাতকের রাগি চাপান-উতোর । হঠাৎ তার মাঝ থেকে মামুদ জোহের দ্রুত এসে ফাঁকা চেয়ারে বাঁ পা রেখে ডাইনিং টেবিলে উঠে পড়ে, চেঁচামেচির বেড়া ডিঙিয়ে আচমকা, প্যান্টের চেনবোতাম বাঁ হাতে দিয়ে টেনে খুলেই ঝপ করে জাঙিয়ে হীন চিৎকার, এই বে, কারা কারা জানতে চাইছিস মৌলবাদ কাকে বলে ।’

নেশার গহীন মৌতাতে অতনু টের পায় বাজনা থেমে গেছে । নাচানাচি । স্তব্ধ । কথা কাটাকাটি কাহিল । পিনপতন স্তব্ধতায়, আরেকবার চেঁচিয়ে ওঠে কবেকার কোন পাঠানের বিহারি বংশধর, গয়া অওরঙ্গাবাদের মাঝামাঝি চালহো পাহাড়ার উপত্যকার ক্রুদ্ধ নগমাগড়ের মামুদ জোহের ।

–উড়িশসাঁটা, এ তো জৌনপুরের লালমূলা । শেফালির আন্তরিক উদ্গীরণে কেটে যায় অস্বস্তিকর স্তব্ধতা, ফিরে আসে বাজনার স্বাভাবিকতা, কথা বলাবলি, পানীয়ে চুমুক ।

মামুদ নামে টেবিল থেকে । একজন দু’জন করে নাচ আরম্ভ হয় আবার । যোগ দেয় অভিজিৎ শেফালি অতনু । চুর অতনি অবাক হয়, মেয়েটা বিদেশি নাচ জানে, নেচে দেখায় অতনু অভিজিৎকে । ডান হাত ধরে ঘুরে এসে ঝাপটে পড়ে অভিজিতের বুকে, আবার পাক খুলে ঘুরে দাঁড়ায় । অভিজিৎ ক্রমে স্বাভাবিক হয়ে উঠছে শেফালির সঙ্গে ।

আবোল-তাবোল নাচতে নাচতে একা-একাই, অতনুর দৈহিক আড়ষ্টতা খসে পড়তে থাকে, শেফালির উদ্দেশে ওথেলোর সংলাপ আরম্ভ করে, “ও, বিওয়্যার, মধ লর্ড, ওফ জিলাসি ; ইট ইজ দি গ্রিন আইড মনস্টার, হুইচ ডথ মক দি মিট ইট ফিডস ওন…” আর অভিভূত শেফালি অতনুকে জড়িয়ে ঠোঁটে ঠোঁট চেপে ধরলে, রবীন দত্ত্ এসে ছাড়ায় ওদের দুজনকে, ‘স্টপ ওথেলোইং উইথ দিস গার্ল।’

ভিরু অভিজিতের কাঁধে ভর দিয়ে বিড় বিড় করতে করতে খাবার ঘর থেকে শেফালি বেরিয়ে গেলে, রবীন দত্ত আলতো স্বরে বলে অতনুকে, ‘তোমার কি মেয়েমানুষ চাই ? দেবেন্দর ব্যবস্হা করেছে ।

‘মেয়েমানুষ ?’ কতবার কতজনের মুখে শোনা শব্দটা এই প্রথম সম্পূর্ণ অপরিচিত মনে হল অতনুর ।

‘হ্যাঁ, দশ-বারোজন কমিঅওটি মেয়েছেলে এনে রেখেছে ওর গ্রাম থেকে, আমাদের জন্যে ।’

রবীন দত্তর পেছন-পেছন গিয়ে অনুসন্ধিৎসু অতনু দেখল, একটা ঘরের মেঝেতে বসে চারজন গ্রাম্য বিহারি যুবতী এঁটো থালাগুলো থেকে উচ্ছিষ্ট নিয়ে কাগজে রেখে বেশ তৃপ্তি করে খাচ্ছে । ঘরের এক কোনে ঢাকা দেয়া কপমিউটার, প্রিন্টার, স্ক্যানার । প্রিন্টআউট-নেয়া বাতিল কাগজে খাচ্ছে ওরা । এমন উদ্ভট জায়গায় কমপিউটার !

–ওই মেয়েটাকে নিতে পারো, গা-গতর আর মুখচোখ ভালোই ।

জীবনে হয়তো কয়েকবার চান করেছে, নোংরা জামাকাপড়, চুল আঁচযায়নি কোনোদিন, কটারঙের উস্কোখুস্কো চুল । এর হাতে এখনও হয়তো ধানকাটার বিচুলির গন্ধ । পায়ের গোছে ধান মাড়াইয়ের কুঁড়ো লেপ্টে আছে এখনও, চুলের ফাঁকে শালপাতার টুকরো । একে ধর্ষণ করে থাকবে দেবেন্দরের পরিবারের সবকটা পুরুষ । এর মাকে কি দেবেন্দরের বাবা ধর্ষণ করেছিল ? কে জানে , হয়ত এই যুবতীই দেবেন্দরের বাবার ঔরসপ্রসূত ।

মেয়েটি অতনুর মুখের দিকে ম্লান চাহিদা নিয়ে তাকায় । পেট ভরে সুস্বাদু খাবার খেয়ে নিয়ে যাবার অনুনয় । যেতে অনিচ্ছুক নয়, হয়তো নরম গদির বিছানায় শুতে পাবে রাতভর ।

–এরকম নোংরা মেয়েমানুষ চলবে না । অতনু সত্যি কথা বলে । টলতে-টলতে নিজের বরাদ্দ ঘরে । মেয়েমানুষের সামনে তাহলে পুরুষের উদারতন্ত্র এভাবেই খসে পড়ে । মাতালেরও থাকে শ্রেণিচেতনা, অ্যাঁ ? এসব পালটাবে না কখনও । পালামৌয়ের লাতেহারে নকসল্লি মাও্ওয়াদিরা  বনপার্টি বানিয়ে চেষ্টা করে যাচ্ছে । কিন্তু এসব বোধহয় চলতে থাকবে, তাপ্পি-মারা আবহমান, সোভিয়েত দেশের মতন । নিজের সঙ্গে জোচ্চুরিও চলতে থাকবে প্রত্যেকের।

 

পরের বারের খেলাটা হয়েছিল শোনপুর মেলার কার্তিক পূর্ণিমার দিন । পুরস্কার এক লাখ । যুবতীর প্রাপ্য পঞ্চাশ হাজার । রাজপুত বাড়ির বিবাহিতা তরুণী, ফর্সা, ভরাট বুক, ভারি পাছা– যৌনতা উদ্রেকের জন্যে নানা আঙ্গিকের রঙিন ফোটোর অ্যালবাম হাতে হাতে গোপনে ঘুরছিল অফিসের এ-বিভাগ সে-বিভাগ । রাজপুত বাড়ির বউ শুনে ভেঙে পড়েছিল তফসিলি যুবকের ভিড় এইবারের খেলায় । কে একজন গ্রিক সেনাপতি মগধ রাজ্যকে এক হাজার গ্রিক যুবতী উপহার দিয়েছিল, নসল বদলের জন্য । খেলার যুবতীর গায়ে হয়তো সেই গ্রিক যুবতীদের কারোর রক্ত বইছে । জিতলে গ্রিসের প্রতিটি মহাকাব্যের নায়িকাদের পাওয়া যাবে ।

মেলার হাজার হাজার মানুষের মধ্যে অফিসের বেশ কিছু উচ্চ-পদাধিকারীর সঙ্গে হঠাৎ দেখা হয়ে গেছে অতনুর । হাফ-কেরানি, কেরানি, ছোটো সায়েব, মেজো সায়েবের দল দাঁও লাগিয়েছিল, অথচ সকলেই সকলকে, হঠাৎ দেখা হয়ে গেলে, বলেছে মেলা দেখতে এসেছিল, হাতি উট ঘোড়া মোষ বিক্রি, চটের পর্দা টাঙানো ল্যাঙটো ক্যাবারে, লোহার গোল অতিকায় নাগরদোলা, ছোটো কাঠের নাগরদোলা, সঙ, ম্যাজিক, নকল বিনুনি, চুড়ি, হিজড়ে, লউণ্ডা, ভুতঘর ।

অতনু জিততে পারেনি । শেফালি হলে চেষ্টা করত ।

জিতেছিল ডক্টর অসীম পোদ্দার ।

ওদের ফুলশয্যার ব্যবস্হা ছিল খড়বোঝাই পালতোলা নৌকোয় । রাজপুত যুবতীর পাশ থেকে উঠে কখন যে জলেতে শব্দহীন নেমে গিয়েছিল মাঝরাতের গঙ্গার শীতল অতলে, মাঝিরাও টের পায়নি । সাঁতার না-জানার আমোদ ওর পেট ফোলা লাশের ঠোঁটে আবিষ্কার করে পুলিশ । নৌকোয়, মেয়েটির শিয়রে যে ডঅয়রিটা রেখে গিয়েছিল অসীম পোদ্দার, পৃষ্ঠার পর পৃষ্ঠা লিখে রেখেছে, নামসই আর তারিখসুদ্দু, ‘আমার মৃত্যুর জন্য কেউ দায়ি নয়।’

চন্দ্রকেতু সিং-এর দ্বিতীয় পক্ষের বউ ওই যুবতী পুরো দেড় লক্ষ টাকা নিয়ে গিয়ে দিয়েছিল হাসিমুখ চন্দ্রকেতুকে । দিয়ে ফিরে গেছে বালিয়ায় নিজের ধুলোসুনিবিড় গ্রামে ।

 

 

 

 

 

Leave a comment

Filed under উপন্যাস

ছয়

নালান্দা থেকে ফিরে জানা গিয়েছিল হরতাল তুলে নিয়েছে ইউনিয়ান, কেননা সমস্যাটা সার্বজনীন নয় । আর, বাঙালি একটা ডিভোর্সির জন্যে ধর্মঘটে প্রতিদিন এভাবে মাইনে কাটানোর মানে হয় না । রাজপুত কায়স্হ ব্রাহ্মণ কুরমি কোয়রি কাহার  পাসি হাজাম দুসাধ ভূঁইয়া চামার সকলে একমত ।

প্রধানমন্ত্রির লাথি খেয়ে মুখ্যমন্ত্রীও পালটে গেছে । ধানবাদের কয়লা মাফিয়ার সঙ্গে বনিবনা হচ্ছিল না মুখ্যমন্ত্রীর । নতুন মুখ্যমন্ত্রী রাজপুত । আগেরটা ছিল ব্রাহ্মণ । কয়লা মাফিয়ারা রাজপুত । দিল্লিতে ওদের ঘুঁটি এককালের যুবাতুর্কি ভিকিরি এখনকার কোটিপতি সাংসদ চন্দ্রশেখর । নতুন মুখ্যমন্ত্রী জানিয়েছে এদের মাফিয়া বলা অনুচিত ।

কত মুখ্যমন্ত্রী এলো-গেলো, সবকিছুই যেমনকার তেমন । পাকাচুল হাফটেকো সুনীলরঞ্জন নাহাবিশ্বাস, কর্পোরেশানের ডাক্তার । ছাদের ওপর মাটি ফেলে বাগান করেছে । রঙিন ছাতার তলায় বেতের ধবধবে চেয়ার । শ্মশানগামী লাশের সংখ্যা, গয়া অওরঙগাবাদ জাহানাবাদ নওয়াদায় এমসিসি আর লিবারেশানের মাওবাদি বনপার্টির  জলপাইরঙা বিপ্লবে, বেড়ে চলেছে প্রতিদিন । এই মাটির জীবনে খাপ খেয়ে গেছে নাহাবিশ্বাস, বাঙালি অট্টহাসির বদলে বিহারি ঠহাকা দিতে পারে, দ্যায়ও আহ্লাদে টইটুম্বুর হলে, লাশের সংখ্যা বাড়ছে দেখে ।

 

বাড়ির সব কাজ মায়ের থেকে নিজের হাতে নিয়ে নিতে পেরেছিল অতনু । মেছুয়াটুলির মাছের বাজার আর মুসল্লাপুর সবজিহাট থেকে, কুটনো কোটা, রান্না, বাসন মাজা, ঘর ঝাঁট, কাপড় কাচা । মা বলেছিলেন, মাছ-মাংস এনে রাঁধতে পারিস, আমারটা না হয় অন্য বাসনে রেঁধে দিবি । অতনু তা করেনি । বাবার সময়ের পেতলের ধালাবাটি বেচে কিনেছে স্টেনলেস স্টিলের আর কাচের । গোদরেজ বুককেস আর আলমারি । রঙিন টিভি । সিডি-ডিভিডি প্লেয়ার কিনে দিয়েছে মাকে, বাংলা ফিল্মের ডিভিডি আর রবীন্দ্রসঙ্গীত-আধুনিক গানের সিডি । নিজের জন্য মোটর সাইকেল কিনেছে, বাজাজ পালসার ।

কিন্তু মানসী বর্মণের বাচ্চাটা, অল্পবিস্তর গণউৎসাহ সত্বেও বাঁচেনি । ঠিকই জন্মেছিল, যেমন বাচ্চারা পৃথিবীর দিকে মাথা করে বেরিয়ে আসে । পাটনা মেডিকাল কলেজের ডাক্তার লক্ষ্মী চ্যাটার্জি বাচ্চাটাকে উলটো টাঙিয়ে, ছাত্রছাত্রীদের বোঝাবার সময়, কাঁদাতে গেলে, হাত পিছলে মেটিতে । মানসী বর্মণের জ্ঞান ছিল না ।

কাছের লোকের সহানুভূতি দুঃখকে গভীর করে ।

অতনুর মা মারা গেলেন । রক্তচাপের ওষুধ খাওয়া গোপনে বন্ধ করে দিয়েছিলেন । নিঃসঙ্গতার আহ্বান করা হার্ট অ্যাটাক । বছর খানেকের বেশি হরেক রঙের ওষুধ পাওয়া গেল ওনার তোরঙ্গে । বোধহয় বাবার আত্নহত্যার প্রতিশোধ । বা, অতনুর স্বনির্ভর হওয়ায় নিজের প্রয়োজনীয়তা ফুরিয়েছিল । কিংবা বার্ধক্যের উদ্দেশ্যহীন ক্লান্তি । কেউ মাকে এসে খবর দিয়েছিল কি, তার আজকালকার চালচলন !

বিহারে সব্বাই যেভাবে বাঁচতে চাইছে, তাইতে মিশতে চেয়েছে অতনু । বাঙালিরা যাকিছু খারাপ মনে করে, অথচ বিহারিরা করে না, তা কেন খারাপ মনে হবে অতনুর, বিহারে থেকে ? এখানেই তো মরা আর বাঁচা । পশ্চিমবাংলায় ওর কেউ নেই, কিছুই নেই, তাই নিজেকে প্রবাসী বাঙালি বলে চালাবার মানে হয় না । ঢাকা আর কলকাতা থেকে বহির্বাংলার দূরত্ব সমান ।

রোজ সাড়ে দশটায় অফিসে আসার কিছুক্ষণের মধ্যে ভেকাভেজা হতদরিদ্র নিকষ বিষণ্ণ নোটের আমন্ত্রণ অতনুকে ছেয়ে ফ্যালে, ধূসর বিষাদমুখো নোটের ঢিবি আড়াল তোলে জানলার মুখরিত আলোয়, স্খলিত-বিগতযৌবনা নোটের ভেষজ অন্ধকূপে ও চাকরি করে চলে ভারাক্রান্ত, দিনের পর দিন, ম-ম করে ন্যাতানো শ্বাসরুদ্ধকর ছাতাপড়া সোঁদা-সোঁদা নোট । যেন ওৎ পেতে থাকে হাড়হাভাতে নোটেরা ।

অনেকদিন, অনেক অনেকদিন, আকাশে যখন ত্যাবড়ানো অ্যালুমিনিয়াম থালার চাঁদ, অতনু চেয়েছে এই নিরাভরণ কদাকার বিবর্ণ নোটের জাপট থেকে মুক্তি পেতে ।

আজকাল, বলতে গেলে, নিজের নতুন মোটরবাইকেই জীবনযাপন করে অতনু । বাড়ি ফিরে একা-একা রান্না, একা-একা খাওয়া, একা-একা টিভি, সিডিতে, পেনড্রাইভে হিন্দি আর ইংরেজি ফিল্ম, বাসন মাজা, ঘর ঝাঁট, মশারিটাঙানো, বিদেশি গান কানের মিনিঠুলিতে । একা-একা খেতে বসাটা ভয়াবহ । সকালে অন্তত কাকাতুয়া দুটো সঙ্গে দেয় । ওরাও ছড়া আর গান গুলিয়ে ফ্যালে । অ্যানিমাল প্ল্যানেটে কিংবা ন্যাশানাল জিওগ্রাফিকে বাঘ সিংহ কুমির চিতা হায়েনার মাংস ছিঁড়ে-ছিঁড়ে খাওয়াটা ভাত-ডাল-তরকারি খাবার সময়ে ভাল্লাগে না ।

ঘুমের মধ্যেই কখন, অজান্তে, মারা গিয়েছিলেন মা । চা বানিয়ে দিতে গিয়ে টের পেয়েছিল অতনু । কাকে বলবে, কাকে খবর দেবে, কী করবে এখন, চাপা গলায় অজস্র অনুত্তর ছেয়ে ফেলেছিল কিছিক্ষণ । মানসীকে খবর পাঠাবে ? শেফালির মতন চটপটে কেউ থাকত যদি । সুশান্ত থাকলে কথাই ছিল না । রসিক পাসওয়ানকে খবর দেবে ? শেষে মামুদ জোহেরকে টেলিফোনে জানালে ও অনেককে নিয়ে পৌঁছে গিয়েছিল ঘণ্টাখানেকে, দলের প্রকল্প অভিভাবক যেন, কে আনবে কাঁচা বাঁশের মাচান, পুরুত ডেকে আনবে, শ্রাদ্ধের ফর্দ নিয়ে কেনাকাটা, একজন আগেই চলে যাক গুলফিঘাট শ্মশানে । শ্মশানে যাবার মালপত্তর তুলে নিয়েছিল মামুদ, কিন্তু মুসলমান বলে যদি পরে কথা হয়, রেখে দিয়েছিল মাটিতে ।

বাঙালি পুরুত পাওয়া গেল না । সতীশ ঘোষাল বললেন, বুড়ো হয়ে গেছি, আর পারি না । শ্মশানের যেতে চায়নি অন্য বাঙালি পুরুতরা, যারা শ্মশানের কাজটা করে দিতে পারত ; বড্ডো হ্যাঙ্গাম, তেমন আয় দ্যাখে না পুজোআচ্চার মতন । তায় বিধবা, গায়ে তো গয়নাগাটিও থাকবে না । পাওয়া গিয়েছিল মৈথিলি পুরুত । অরিন্দম অবাক, বাঙালিদের তো এসব আচার নেই, মন্তরগুলোও অচেনা ।

বয়সের গাছপাথর নেই এমন পুরোনো শ্মশান । আলমগঞ্জ থেকে মাখানিয়া কুঁয়া অব্দি বিস্তৃত এলাকার কতো বাঙালি পরিবার ছাই হয়েছে এখানে, সেই কোম্পানির আমল থেকে, যারা সায়েবদের পেছন-পেছন এসেছিল, ম্যাকলে সায়েরবের শেখানো ইংরেজি লিখতে শিখে । মরে গেলে মানুষ এত ঠাণ্ডা হয়ে যায়, এমন বিসদৃশভাবে শক্ত, বাবা মারা গেলে ময়না তদন্তে সেলাই-করা ওনার শরীর ছুঁয়ে টের পায়নি অতনু । মায়ের মারা যাওয়াটা কেন যেন ব্যক্তিগত ক্ষতির মতন হাঁ-করা অভাব গড়ে দিয়েছে । শূন্যতা নয়, ভরাট বেদনা । একেই বোধ হয় শোক বলে । গভীরভাবে উদগ্রীব টিমটিমে গোপন পীড়া ।

 

সুশান্তর বাড়িতে খবর নেবার জন্য গিয়েছিল অতনু । রেলফাটকে, সঙ্গে মোটরবাইক থাকায়, একঘণ্টা কাবার । প্যাসেঞ্জারের লাগেজভ্যান থেকে চলছে লাশ নামানো, কাঁচা বাঁশের মাচানে কাতাদড়ি দিয়ে বাঁধাবাঁধি । লাশেরদের মুখ আগে থেকেই ব্যথায় কাতর । কাতাদড়িতে বাঁধার কষ্ট তবুও ফুটে উঠছে । কান্নাকাটি নেই শববাহকদের ; যা কাঁদবার কেঁদে নিয়ে থাকবে যে-যার নিজের গ্রামে । পুলিশের বিরক্তমুখ লোভী-হাত কেঠো-ব্যাটন তদারকি চলছে । সাসারামে দাঙ্গা হয়েছিল ।

সাসারামের নুরনগঞ্জ পাড়ার কাদা-প্যাচপেচে রাস্তায় স্কুটার স্কিড করে সাইকেল আরোহীকে ধাক্কা মারলে, দাঙ্গার আরম্ভ মদরসলামি পির মজারের দেখাশোনা করত বুড়ো ইউনুস শাহ আর জোয়ান জুমরাতি শাহ, তক্ষুনি খুন হয়েছিল । মাজারের বাইরে ফুল বেচত সলমা, সেও । মুহম্মদ হাফিজ, আবদুল সত্তার আর মুহম্মদ নাজিরের লাশ লোপাট । শহরের সবচেয়ে বড়ো দোকান মুহম্মদ ফিজুদ্দিনের লিবাসঘর পুড়ে ছাই । বদলা হিসেবে এই ট্রেনযাত্রী লাশ ।

সুশান্তর জ্যাঙামশায় বললেন, ‘আমাদের কিছু না বলে উনি গিসলেন জমির দখল নিতে, লেঠেল লাগাতে । নওগাছিয়ার কাজিকোইরা গ্রাম থেকে এক ব্যাটা মণ্ডল এসে জানিয়েছিল, সুসান্তকে ওরা কিডন্যাপ করেছে, আর দশ লাখ টাকা ফিরৌতি দিলে ছাড়া হবে ।’

ফিরৌতি ? মানে, র‌্যানসাম ?

হ্যাঁ, হ্যাঁ । অতো টাকা কোথায় পাবো আমরা ? জেলা ম্যাজিস্ট্রেট, মুখ্যমন্ত্রী, স্বরাষ্ট্র সচিবের সঙ্গে দেখা করেছিলুম । শুধু আশ্বাস । কেউ কিচ্ছু করলে না ।

সুশান্ত ভালো আছে তো ?

ভালো আছে মানে ? তারিণী মণ্ডল নাকি নিজের চোদ্দ বছরের মেয়ের সঙ্গে ওর বিয়ে দিয়ে দিয়েছে । এই ক্রিমিনাল মণ্ডলগুলো আদিতে বাঙালি ছিল ; লেঠেল হয়ে এসেছিল কোম্পানির আমলে । সুশান্ত বাঙালি জানতে পেরে বন্দুক পাহারায় জোর করে বিয়ে দিয়ে জামাই করে নিয়েছে, বিহারে যেমন হয় আকছার, জামাই দখল ।

চোদ্দ বছরের মেয়ে ?

ওদের বন্দুকধারি লোক জিপগাড়িতে এসে জানিয়ে গেছে, গোপালপুর, ফলকিয়া, পরবত্তা, ডিমহা, কেলওয়ারি, তিনহেংগা, আর কহলগাঁও-এর অনাদিপুর, আভাপুর, আর অঠগম্মা দিয়ারায় এখন সুশান্তর রাজত্ব ।

রাজত্ব ! মানে ?

মানে আবার কী ! ভিড়ে গেছে ক্রিমিনালগুলোর দলে । আর কি ফিরতে পারবে কখনও ? দিয়ারার বাইরে বেরোলে পুলিশ ওর পোঁদের চামড়া তুলে নেবে ।

অতনু টের পাচ্ছিল, হাসিখুশি একান্নবর্তী পরিবারটা পালটে ফেলেছে বাড়ির আবহাওয়া, কেননা তাদের বাড়ির ছেলে তোয়াক্কা করেনি পারিবারিক যৌথ সাধআহ্লাদ, দাবি-দাওয়া, স্বপ্ন-কল্পনা । একান্নবর্তী পরিবারের সদস্যরা সবাই মিলে কি দশ লাখ টাকা জোগাড় করতে পারত না ! চেষ্টা করতে কী ছিল ; সুশান্তর অফিস থেকে চাঁদা তুলে কিছু জোগাড় হতো । বাকিটা ওনারা দিতেন ।

তারিণী মণ্ডলরা এককালে বাঙালি ছিল ! সুশান্ত যদি ওভাবে মিসে যেতে পারে তাহলে ওর ঝুঁকি নিশ্চই শ্রদ্ধেয় । চোদ্দ বছরের গ্রাম্য অশিক্ষিত, বাংলা জানে না এমন একটি মেয়ের সঙ্গে ও কী করে কে জানে ! তরুণী হয়ে উঠতেও তো বছর দুয়েক । খালি গায়ে গলায় তাবিজ খাটো ধুতি ধরেছে কি ? ফ্যান নেই, লাইট নেই, টিভি নেই, ওর প্রিয় বিদেশি গান শোনার সুযোগ নেই । কীভাবে থাকে, সময় কাটায়, কী খায় ? জলের ওয়াটার ফিলটার নেই । কিসের জন্যে সবকিছু ছেড়েছুড়ে ঢুকে গেল অমন অচেনা সমাজে ? বাড়িতে বলেনি, অথচ মৌলিনাথকে বলেছিল ।

অফিসে, সিঁড়ি দিয়ে নামতে-নামতে , দেখা হলে, মৌলিনাথ বলে উঠল, ‘কী অতনু, রেণ্ডিবাজি করে ইনটেলেকচুয়াল হবার তালে আছেন নাকি ?’

‘আপনি তো দাস ক্যাপিতালের মলাট লাগিয়ে ফ্যানি হিল পড়তেন অফিসে বসে, উরুর ওপর উরু রেখে ।’ অতনুর আকস্মিক ঠারে চুপসে যায় মৌলিনাথ ।

মানসী বর্মণ ডেকে পাঠিয়েছিল আপনাকে । যাবেন বলে আর দেখা করতে যাননি । বাচ্চাটা মরে গেল । সহানুভূতির জন্যে অন্তত যাওয়া উচিত ছিল । নেশাফেশা বেশি করবেন না অতনু, রোগে ধরলে কে দেখবে ।

ঠিকাছে, যাব । অনেকক্ষণ ধরে হিসি চেপে আছি ।

কে দেখবে, জানতে চাইল মৌলিনাথ ! দেখাদেখির দরকার হয় কি ? একা মরে পড়ে থাকলেও দুর্গন্ধের দায়ে পড়াপড়শিরা ছুটে আসবে গতি করার জন্য ; পুলিশে নিয়ে গিয়ে পোড়াবে । কাউকেই কেউ দেখে না, সবই আপনা থেকে ঘটে যায় । মায়ের মারা যাবার সময় যেমন মামুদ জোহের ঘটে গেল ।

অফিসের চতুর্থ-তৃতীয় শ্রেণির কর্মিদের টয়লেটের বালব-টিউব মেরে দিয়েছে ঝাড়ুদাররা । পেতলের কল, সিংকের ধাতব পাইপ চুরি হবার পর এখন লেগেছে পিভিসি প্লাসটিক । জল বেয়ে মেঝেতে শ্যাওলা। দরোজার হাতল বার-বার চুরি হয় বলে পাটের দড়ি দিয়ে বাঁধা । ডোর-ক্লোজার কাজ করে না বহুকাল । দেয়ালজুড়ে পরস্পরবিরোধী ইউনিয়নের হরেকরঙা পোস্টার । টয়লেটে যৌনসংকেত লিখনের দিন বোধহয় শেষ ; সমাজ উন্নত হয়ে চলেছে, তার লক্ষণ । কোনে-কোনে খাপচা-খাপচা পানের আর তামাকের পিক গয়ের থুতু শিকনি । রাঘব বদলি হয়ে যাবার পর দুস্হ হয়ে গেছে এই বিশাল অট্টালিকা । জানলার নোংরা কাচের বাইরে, চোদ্দ বছরের ছাগলচরানি বালিকার মতন রোঁয়া ওড়াচ্ছিল শিমুল ।

সন্ধ্যাবেলা মানসী বর্মণের ফ্ল্যাটের কলিংবেল বাজিয়ে মিনিট পাঁচেক দাঁড়িয়ে অপেক্ষার পর ফিরে যাবে কিনা ভাবছে যখন অতনু, দরোজা খুলতেই ধুপকাঠির গন্ধ আর মানসী, রোগাটে, চুলে ববকাট, ফ্রিল দেয়া হলুদ ব্লাউজ, তাঁতের ফিকে হলুদ শাড়ি । কই, দুঃখ কষ্টের ছাপ, মৌলিনাথ বলেছিল, পেলো না অতনু, মানসীর চেহারায় আচরণে, ঘরের আসবাবে ।

আরে, অতনু !

ফিকে হাসল অতনু । আমি ভাবলুম এখনও ওপরতলার আগরওয়ালের নেকনজর এড়াতে খুলতে চাইছেন না ।

ও ব্যাটা বিদেয় হয়েছে এই বিল্ডিং থেকে । পুজো করছিলুম, তাই দেরি হল ।

পুজো ? আপনি পুজো করেন বুঝি ? জানতুম না ।

কেন ? ঠাকুর-দেবতা মানো না । বোসো না, দাঁড়িয়ে রইলে কেন !

ভাগ্য ভালো যে আপনি ঈশ্বরে বিশ্বাস করি কিনা জানতে চাননি । মা মারা যাবার পর ঠাকুর-দেবতাদের তোরঙ্গে বন্দি করে রেখেছি । একদিন গিয়ে গঙ্গা ব্রিজ থেকে বিসর্জন দেবো ।

ছিঃ, অমন বলে না । কতো বিপজ্জনক চাকরি, কখন কী হয় তার ঠিক আছে ? ভগবানে বিশ্বাস রাখতে হয় ।

এসব কী এখানে ?

সেন্টার টেবিলে রাখা ছিল তুলো, সাইকেল রিকশার ভেঁপুর মতন কাঁচে লাগানো রবারের হর্ন, স্টেনলেস স্টিলের বাটিতে কয়েক চামচ দুধ, মসৃণ প্লাস্টিকের গোলাপি হাতলে ডিম্বাকার আয়না । মানসী বর্মণের দপ করে রং পালটানো মুখশ্রী দেখে অতনু টের পায় যে প্রশ্নটা করা উচিত হয়নি । শাড়ির আঁচল সরায় মানসী । ব্লাউজে ছড়িয়ে-পড়ে দুই বৃন্তকে ঘিরে দুধের ভিজে ছোপ দেখে অতনু নির্বাক ।

কী করি ? ডাক্তার বলেছে পাম্প করে বের করে দিতে, নইলে ক্যানসার হতে পারে, বলল মানসী ।

স্তনবৃন্ত দেখে উতরোল অতনু জিগ্যেস করল, রোজ পাম্প করতে হয় ?

দু’বেলা । দাঁড়াও, চা বসাই । আগের বার নে খায়েই চলে গিসলে । টোস্ট খাবে ? চানাচুর ?

মানসী রান্নাঘরে ঢুকতেই, ঘোর-লাগা অতনু টুক করে খেয়ে ফ্যালে বাটির দুধ । সোঁদা আচ্ছন্ন করা গন্ধ, সারা শরীর জুড়ে শিহরণ খেলে যায়, শিশুর আহ্লাদ বয়ে যায় দেহের আগাপাশতলা ।

অনভিপ্রেত আকস্মিকতায় থ, ও, মানসী, ‘পাগল না মাথাখারাপ, ওঃ, সত্যি, ওফ, কোন জগতের জীব তুমি ?’ অন্য ঘরে চলে যায় আর ফেরে বেশ কিছুক্ষণ অতনুকে বসিয়ে রেখে, লালপেড়ে গরদ, কপালে বিশাল লাল টিপ, হাতে রেকসিনের ঢাউস ব্যাগ, রাখে, অতনুর পায়ের কাছে, ‘তালশাঁসের গন্ধ পাচ্ছ না’, জানতে চায় ।

না, চারিদিকে কেমন মিষ্টি দুধ-দুধ গন্ধ । বাচ্চাটা নষ্ট হল আপনার মন খারাপ হয়নি ?

এখন আমি জানি আমার পেটে বাচ্চা হতে পারে, বলার সময়ে ময়ূরের গলার মতন হয়ে উঠল মানসীর গর্ব, অদৃশ্য পেখম লাল গরদের শাড়িতে । বলল, তোমার কথা বল । অনেক কানাঘুষা শুনি ।

যা শোনেন সবই সত্যি । নিজের লাম্পট্যের সংবাদকে অতিরঞ্জন দেবার চেষ্টা করল অতনু ।

সত্যি ?

অতনু বুঝতে পারল সত্যি কথা আশা করেনি মানসী, তাই অন্য  প্রসঙ্গে চলে যায় সুশ্রী যুবতী, ‘আমার এই ব্যাগটা তোমার কাছে রেখে দিও, অ্যাঁ, কিছু দরকারি কাগজপত্র আছে, আমি কিছু দিনের জন্যে ওরসলিগঞ্জ যাচ্ছি ।

ওয়ারিস আলি গঞ্জ ? ও তো মারাত্মক জায়গা, মুসহররা থাকে, সতযুগ মানঝি, ঝাড়ুদার, রাঘবের পেছন-পেছন চাবির থলেগুলো নিয়ে ঝনঝনিয়ে ঘুরতো, ও তো ওখানকার । ইঁদুর পুড়িয়ে খায় ।

ইঁদুর রোস্ট করে বা রেঁধে তো অনেক দেশেই খায় । ওতে আবার খারাপ কিসের, আরশুলা, উচ্চিংড়ে, কুকুর, বেরাল, সাপ, ফড়িং, গুটিপোকা সবই খায় মানুষ । আমরা খাই না, তাতে কি ! আসলে ওরা একঘরে হয়ে থেকে গেছে উঁচু জাতের লোকগুলোর চাপে । কুচ্ছিত অবস্হা । কবে যে অবস্হা বদলাবে, কে জানে !

ওরা তো বিয়ে করে আর ছাড়ে । করেই না অনেক সময় । সতযুগ মানঝির কতগুলো ছেলেমেয়ে ও নিজেই জানে না । কিন্তু আপনি অমন একটা জায়গায় যাচ্ছেনই বা কেন ? প্রশ্ন করে অতনুর মনে হল ওইটুকু দুধ খাবার দরুণই এরকম একটা ব্যক্তিগত কথা জিগ্যেস করার অধিকার পেয়ে গেছে ও । দুধের সম্পর্ক গড়ে ফেলেছে ।

আমার এক নিকটাত্মীয় ওখানকার গান্ধী আশ্রমে মুসহরদের উন্নতির জন্য কাজ করেন ।

তাই বুঝি ? দুধের মাধ্যমে গড়ে ওঠা সুতোয় টান পড়ল অতনুর ।

হ্যাঁ । দ্বারভাঙ্গা কালীবাড়ি যাচ্ছি, তুমি যাবে ?

চলুন । ব্যাগটা উঠিয়ে নিল অতনু । ভাগ্যিস মোটরসাইকেল আনেনি ।

রিকশয়, ঠেসাঠেসি, দুধের মোহক গন্ধ পায় অতনু । রাস্তায় এতো গর্ত যে শক্ত করে হ্যাণ্ডল ধরে না থাকলে, ছিটকে পড়তে হবে মুখ থুবড়ে । রাজেন্দ্রনগর, মেছুয়াটুলি, মাখানিয়া কুঁয়া, হয়ে অশোক রাজপথে পড়ে । তারপর বাঁ দিকে বিশ্ববিদ্যালয়ের দ্বারভাঙ্গা বিলডিঙের গলি । চত্বরের ভেতরে গঙ্গার তীরে মন্দির । বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ার সময়ে মন্দিরের সিড়ির লাগোয়া ছিল গঙ্গা, এখন সরে গেছে অনেকটা । দ্বারভাঙ্গা বিলডিঙে ঢোকার মুখে গলিপথের দুপাশে মেডিকাল কলেজের যৌনরোগ চর্মরোগের বিভাগ । খুঁটিতে বাঁধা গোরু, হয়তো কোনো ডাক্তারের ।

ছাত্র ইউনিয়ানের নির্বাচনের সময়ে যে পাম গাছটায় বেঁধে অরবিন্দ অবস্হির মাথায় লোমনাশক লাগানো হয়েছিল, গাছটা এখনও তেমনি ঠায় । ইউনিয়ানের নির্বাচনে এখন আর অমন নিরীহ আক্রমণ হয় না, ছুরি-ছোরা তমঞ্চা-কাট্টা নিয়ে হয় ।

অন্ধকারে প্রাচীন মন্দির, কালচে ধরেছে দেয়ালে, পায়রা চামচিকে অবাধ, ফুল-পচা বেলপাতা শুকনো, রেড়ির তেলের গুমো গন্ধ । শাদা ধবধবে চুনকাম করা পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন মন্দির হলে বোধহয় শ্রদ্ধাভক্তি কমে যায় । মন্দিরে ঢোকার মুখে অতিগরিব ভিকিরি আর গরিব জুতোরক্ষক । জল-স্যাঁতসেতে পাথরের ঠাণ্ডা মেঝে । সিঁদুরমাখা হাড়িকাঠ, কখনও ছাগবলি হতো । পাকাদাড়ি প্রায়ান্ধকার বুড়োদের আদুলগা জটলা । ঝাঁপতোলা ঘোমটায় বিহারি বউ।

‘খুব জাগ্রত দেবতা, এই মন্দিরের ঘণ্টা আপনা থেকে বাজে, রাত আটটায়’, জানায় মানসী ।

অতনু উত্তর দ্যায় না ; বহুদিন ও আর সহপাঠীরা রাত নটা-দশটা পর্যন্ত গঙ্গার ঘাটে বসে আড্ডা মেরেছে । মন্দিরের দরোজা বন্ধ হবার পর কে যে ঘণ্টা বাজায়, জানে ও । চেয়ে-চেয়ে ও দেখছিল নিরন্তন পরিপূর্ণতায় উপচে-পড়া নর্দমা, কুলুঙ্গির মধ্যে শ্যাওলাপোশাক ঈশ্বরদের দুর্বল ভঙ্গি, নিরীহমুখ দেবতা, দালানে শুয়ে নিজের কুঁই-কুঁই উপলব্ধিকে প্রকাশে মশগুল কুকুর । একশো বছর আগে শেয়ালরা আসত, তাদের কাজ চালাচ্ছে শহুরে কুকুরেরা ।

‘খুব জাগ্রত, মাথায় জবাফুল রাখার পর যদি পড়ে না-যায়, তাহলে মনস্কামনা পূর্ণ হয়,’ মানসী বোঝাল ।

আপনার ফুল পড়ে ,না থাকে ? মেঝেয় রেক্সিনের ব্যাগটা রাখতে-রাখতে জানতে চাইল অতনু ।

পড়ে যাবে কেন ? থাকে । একবারও পড়েনি আজ ওব্দি ।

বাচ্চাটার স্বাস্হ্যের জন্যে কি মানত করেছিল মানসী বর্মণ ? কে জানে, জিগ্যেস করা উচিত হবে না, তার প্রাপ্যের দুতিন ঝিনুক দুধ তো ও নিজেই খেয়ে নিয়েছে ।

অন্ধকারে রেড়ির তেলের প্রদীপ জ্বালিয়ে কয়েকশো বছর ধরে দাঁড়িয়ে আছেন এককালের দ্বারভাঙ্গা মহারাজের পারিবারিক কালীপ্রতিমা । বোধ হয় দুধে-চিনিতে চান করানো হয় তাই মাথার ওপর ফুল রাখলে তা আটকে যায় । দর্শনার্থীরা একের পর এক ফুল চাপিয়ে, পুরুতকে টাকা দিয়ে, মনস্কামনা পুরো করার আগাম মিটিয়ে চলে যাচ্ছে । মানসী  ব্লাউজ থেকে ভাঁজ করা টাকা বের করে পুরুতকে দিল, হাত জোড় করে দেখে নিল প্রতিমার মাথার ওপর ফুল । অতনু দেখল নোটটা বুকের দুধে ভেজা ।

তুমি চাও না কিছু । দ্যাখো না । হয়তো ঝট করে অফিসার হয়ে যাবে ।

একটা করকরে নতুন নোট দিল অতনু, প্যাকেট থেকে তাসের মতন টেনে বের করে । পুরুত অভ্যস্ত হাসিমুখে ফুল চাপাল প্রতিমার মাথার ওপর । তক্ষুনি পড়ে গেল ফুলটা । মানসী গম্ভীর । গম্ভীর কাঁচুমাচু পুরুত । অতনু আবার প্যাকেট থেকে টেনে নতুন নোট দিল । পুরুত খোঁজাখুঁজি শেষে বাছে এমন ফুল যাতে পড়ে না যায়, বেশ কিছুক্ষণ প্রতিমার মাথায় ঠিক মতন গুছিয়ে রেখা হাত সরিয়ে নিল । পড়ে গেল ফুলটা । দর্শকদের গুঞ্জন আরম্ভ হয়ে গেছে অতনুকে ঘিরে । তিনবার ফুল চড়ানো যায় জানালো এক প্রৌঢ় গৃহস্হ । অতনু আবার দিল করকরে নতুন টাকা । পুরুতের থাত থরথর । ফুল পড়ে যায় । ভিড় জমতে থাকে অতনুকে ঘিরে । মানসীর ঠাণ্ডা অথচ ঘেমো হাত ধরে বাইরে আসে অতনু, হাঁটে গলিপথ ধরে দুজনে, চুপচাপ ।

এই কাঁপুনির সঙ্গে পরিচয় আছে অতনুর । জুলি-জুডির সঙ্গে বসবাস করে জেনে ফেলেছে যুবতী দেহে অরগ্যাজমের ঢেউয়ের কথা । মানসী বর্মণের অরগ্যাজম ঘটে গেল তিনবার ফুল পড়ে যাবার ঘটনায় । নারীর মানসিক দেহের রহস্য এখনও অতনুর কাছে অধরা, নিজেকে নিঃশব্দে বলল অতনু ।

প্রাঞ্জল রাজপথে পৌঁছে, যে-যার বাড়ি যাওয়াই, কোনো কথা না বলে, উচিত মনে করে । নভেলটি বুক ডিপোর বহুতল বাড়িটার কাছ থেকে রিকশয় তুলে দিল মানসীকে । রিকশয় চাপার আগে ওব্দি, ওর পাশে দাঁড়িয়ে কাঁপছিল মানসী, নিয়ন্ত্রণহীন । এমনকি হ্যালোজেন আলোয়, আবছা বেজে উঠছিল পায়ের মল । ওর কাঁপুনিতে কেমন যেন লুকিয়ে রেখেছে গোপন তথ্য, যেন অতনুর দুধ খেয়ে নেওয়া আর ফুল পড়ে যাবার মধ্যে দিয়ে সেই গর্হিত গোপনে পৌঁছে দিয়েছে কালীপ্রতিমার বোবা বার্তা ।

অতনু বোধ করছিল এক গোপন আনন্দ । বিজয়প্রাপ্তির গরিমা ছেয়ে ফেলছিল ওকে । অতনুকে দেখে ছুটন্ত ট্রাকগুলোর চক্ষুস্হির । খাজাঞ্চি রোডের মোড় থেকে পাটনা-সাহেবগামী অশোক রাজপথের অবস্হা ভালো নয় । পাটনা কলেজের সামনে রাজপথের মাঝখানে বিশাল গাছ, অশথ্থ গাছ কোথাও গজিয়ে গেলে কাটে না কেউ, কেন তা জানে না অতনু । রাজপথ খোঁদলে ছয়লাপ, প্রতি বৃষ্টিতে খোঁদলের ভাইবোনের সংখ্যা বেড়ে যায় । ওরা মিউনিসিপাল কর্পোরেশানের অবৈধ সন্তান । এগলি-ওগলি কোনো আগাম না জানিয়ে ঢুকে পড়েছে রাজপথে, এমন সদালাপী অন্ধকার । উষ্মাপ্রকাশে সদাব্যস্ত ডিজেল ধোঁয়া ।

অমনভাবে না কাঁপলে, কী এক অচেনা নির্বাক থরথরে আটক রহস্য, বাড়ি ওব্দি পৌঁছে দেবার প্রস্তাব দিত অতনু, দুধের গন্ধে মেশানো মানসীর পারফিউমের সুগন্ধের আয়ত্বাধীন রিকশয় পাশাপাশি বসে যেতে মানসীর ফ্ল্যাটে । আধুনিকতা নামের বিহারি কালখণ্দে সেঁদিয়ে, মানসী বর্মণের ঠিক কোথায় চিড় ধরেছে, আর কেনই বা, ঠাহর করতে পারছিল না অতনু ।

মায়ের ওষুধবড়ি আর ক্যাপসুলগুলো দিয়েছিল সামনের বাড়ির পদমদেও সিনহার ছোটো ছেলেটাকে, চেয়েছিল স্কুলের প্রোজেক্ট বানাতে চায় জানিয়ে, ও সেগুলো দিয়ে গণেশঠাকুরের মূর্তি তৈরি করেছিল কালো কাগজে ফেভিকল দিয়ে সেঁটে-সেঁটে । সেইন্ট জেভিয়ার স্কুল তার জন্য ওকে বেস্ট প্রজেক্টের পুরস্কার দিয়েছে, দেখিয়েছিল এনে । পুরস্কারের তুলনায় প্রজেক্টটাই মনে ধরেছিল অতনুর ।

নানা অগোছালো ভাবনা মগজে জেঁকে আসে, ঝরে পড়তে থাকে ছবির মতন । টি কে ঘোষ স্কুলের মোড় থেকে বাড়ির দিকে হাঁটতে থাকে, কীই বা করবে বাড়ি গিয়ে, হাঁটাই যাক । মহেন্দ্রু মোহোল্লা, ওর বাড়ি, বেশি দূরে নয় । বিশ্ববিদ্যালয় লাইব্রেরি, বিজ্ঞান কলেজ পেরিয়ে এগোয় । ব্যাগটায় কী আছে কে জানে ! দলিল-টলিল বোধহয় । মেঘলা রাতের গোলাপি আকাশ । সোঁদা গন্ধ উড়ছে বাতাসে । গান্ধি ময়দানে আরম্ভ হয়ে গিয়ে থাকবে বৃষ্টির অঝোর, শান্তি ফিরে আসছে বাতাসের আলোয় ।

কড়কড়াৎ শব্দ, চিড় ধরে গেল আকাশে । একাধ ফোঁটা টুপটাপের পরেই, অতর্কিত ঝমঝমাঝম । ভেজা যাক খানিক । কাঁধ কুঁচকে, প্যান্টের দু’পকেটে হাত ঢুকিয়ে, কনুইতে ঝুলছে রেক্সিনের ব্যাগটা, যদিও ওজন বোধহয় তিন কিলোটাক হবে, বাড়ি পৌঁছে, তালা খুলতেই, কাকাতুয়া দুটোর স্বাগতম শোনা যায় । বৃষ্টির তুমুলতায় বিদ্যুৎ সম্পর্কে একটা চাপা অহংকার ভাব । ব্যাগটা বেডরুমের খাটের তলায় ঠেলে দিয়ে, জানলা খুলে, জামা কাপড় ছাড়তে-ছাড়তে অতনু দেখল, পদমদেওবাবুর বাড়িতে ঢোল বাজিয়ে কীর্তন চলছে । শৈশব থেকে এই সমস্ত ধার্মিক জগঝম্প সয়ে গেছে ওর । জানলা দিয়ে দেখা যাচ্ছে, দেয়ালে টাঙানো ওষুধবড়ির ফ্রেমে বাঁধানো গণেশঠাকুরের পায়ের কাছে ধুপ গোঁজা । রাজা রবি বর্মার আঁকা হলে হয়তো গণেশঠাকুরের হাঁচি পেতো ধোঁয়ায়, এ তো ওষুধবড়ির দেবতা, হাঁচি-কাশির ওষুধবড়িও আছে হয়তো ওগুলোর মধ্যে ।

রান্না চাপাতে ইচ্ছে করছিল না । একটা ছোটো চরসের নরম সিগারেট তামাক মিশিয়ে টানতে-টানতে এসে যায় ঘুমনেশার আচ্ছন্নতা । তন্দ্রার শিথিল আহ্লাদে, মন কেমন করে ওঠে সুশান্তর জন্য । ভিনভাষী পঞ্চদশীর বুককে আদরযোগ্য করে তুলছে হয়তো বৃষ্টির নিরপেক্ষ হৃদয়হীনতায়, উপভোগ আর দুর্ভোগে ভাগাভাগি-করা দিয়ারা তীরের গ্রামীণ অন্ধকারে ।

আচ্ছন্নতায় ভেসে ওঠে মানসী বর্মণের বৃষ্টি ভেজা চুলের ঝাপট । জানলার কপাট বন্ধ করে বৃষ্টির ঝাপট সামলায় অতনু ।

 

অফিস যাবার সময়ে পদমদেওবাবুর ছেলেকে কাকাতুয়া দুটো নিয়ে গিয়ে দিল অতনু, কাকাতুয়া দুটো ছেলেটার সঙ্গে পরিচিত । কাল রাতে ওরা রামশীলা পুজনের কীর্তন গাইছিল । রামশিলা মানে একটা নতুন থানইঁট, লাল রঙের গামছার ওপরে রাখা । পদমদেওবাবুর বও মাথায় করে নিয়ে যাবে ইস্টিশান ওব্দি, তারপর সেখান থেকে রামভগতরা নিয়ে যাবে অযোধ্যা ।

কাকাতুয়াদুটো পেয়ে যাওয়ায় ওদের রামশিলা প্রোগ্রামে  ভাটা পড়ল বোধহয়, কেননা ওদের দেখাশোনার জন্য বাড়িতে কাউকে থাকতে হবে সব সময় ।

ধান ইঁট পুজো নিয়ে সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা হয়ে গেছে অনেক শহরে, কসবায় । নাথনগরের তনৌনি, সিমরিয়া, বিন্দু, বেলদরটোল গ্রামে চারশোজনকে মেরে ফেলা হয়েছে । চান্দেরির কুয়ো আর পুকুরগুলো ভেপসে উঠচে ফ্যাকাশে চোখখোলা লাশে, জলে এলোচুল ভাসিয়েছে মৃত যুবতী আর প্রৌঢ়ারা । কহলগাঁও গ্রামের ধনৌরা গ্রামে বিশাল উচ্ছৃঙ্খল ভিড়কে ছত্রভঙ্গ করতে গুলি চালিয়েছে সি আর পি । অন্ধকারে গচ্ছিত-রাখা বোমা-বারুদ নেমে পড়েছে চৌখণ্ডি, মণ্ডই, ভারতীগঞ্জ, কিল, বভনটোলার পথে-পথে । পাটনাতে থমথমে ভাবটা টের পাওয়া যাচ্ছিল না ।

অসীম পোদ্দার মারা যাবার পর দলের মধ্যে, সবাই এককাট্টা হলেই, টিমটিমে শোক ছেয়ে ধরে । অফিস বিলডিঙের পেছনের গলিতে তাড়ির দোকানটায় বসে ভাঁড় হাতে কেঁদে ফ্যালে কেউ-কেউ । অতনুর মনে হয় তাকে বাদ দিয়ে সমস্তকিছুই অস্বাভাবিক । অস্বাভাবিকতা বাদ দিয়ে চলতে পারেনা বিহার, অজাতশত্রু-অশোকের এই রাজ্য, বিহার, পাটলিপুত্রের হিংসা-দ্বেষ রয়ে গেছে উড়ন্ত হৈমন্তী বাতাসে । কংগ্রেসের রাজত্ব শেষ । যাদব-কুর্মি-দলিত-মহাদলিতের জটপাকানো রাজত্ব আরম্ভ হয়ে গেছে । অফিসের ইউনিয়ান আগেই চলে গেছে যাদব কব্জায়, চলছে ছিনাঝপটি । যাদব, মুসলমান, তফসিলী কর্মীরা একদিকে । ছেঁড়া-পচা নোটবদলের যে কাউন্টারটায় দালালদের কাছ থেকে উপরি সবচেয়ে মোটা, তাতে ম্যানেজমেন্ট পালা করে বসায় যাদব মুসলমান তপসিলি । ট্যুরে যায় যে ডিপার্টমেন্টের অফিসাররা, সেই বিভাগের পোস্টিং-এর জাতনির্ভর কোটা মেনে নিয়েছে অফিস-প্রসাসন । প্রায়ই অফিস গেটের বাইরে, সুলভ শৌচালয়-নিঃসৃত গ্যাসবাতিতে রক্তারক্তি ঘটছে ।

অফিসের মধ্যেই কারোর-কারোর পিঠে পিস্তল ঠেকানো হয়, দিশি তামাঞ্চা বা কাট্টা । বাইরে বেরোলে একচোট দেখে নেবার প্রস্তাব ।

বাঁকহীন চলে যাচ্ছে অতনুর জীবনপ্রবাহ । ব্রিটেনে আমেরিকায় একটা নোটের আয়ু সাত মাস ; নোটের ত্বক শ্বেতাঙ্গ থেকে কৃষ্ণাঙ্গ হলেই তার জীবন ফুরিয়ে যায় । এখানে তা তিন-চার বছর ; ফর্সা থেকে ধূসর থেকে কালো থেকে কুচকুচে হওয়া পযর্ন্ত ধুঁকিয়ে-ধুঁকিয়ে বেঁচে থাকে । অতনু সেই আয়ুকে কমাতে সাহায্য করে । নতুন চুল্লি বলে নোট পোড়াবার ধুম লেগেছে । শোনা যাচ্ছে চুল্লিব্যবস্হা বিদেয় করে শ্রেডার আনা হবে, কাগজের মণ্ড তৈরি করে তা থেকে আবার কাগজ তৈরি হবে ।

মোটর সাইকেলের পিলিয়নে বসে অরিন্দম একদিন অতনুর ফাঁকা বাড়িতে অফিসফেরতা এসেছিল, দু-ফুঁক চরস খাবার গোপন সদিচ্ছা নিয়ে । পাকানো সিগারেটে তামাক মিশেল দিয়ে বেশ কয়েকফুঁক টেনে ঘণ্টা দুয়েক এমন নিয়ন্ত্রণহীন হেসেছিল অরিন্দম যে, মনে হচ্ছিল আবার বুঝি ঘটল মগজের বেগড়বাঁই ।

‘জানেন তো মানসী বর্মণ রিজাইন করে চলে গেছেন ওরসলিগঞ্জের গান্ধি আশ্রমে কাজ করার জন্যে,’ নেশাচ্ছন্ন অরিন্দম, বিছানায়, পাশবালিশ টেনে, বলেছিল ।

–চলে গেছে ? কবে ? জানি না তো !

–আপনি এমন বলছেন যেন আপনার অনুমতি নিয়ে যাওয়া উচিত ছিল ।

–হ্যাঁ।  খবরটা শুনে ভেতরে-ভেতরে খারাপ লাগল । কবে গেছে ?

–গত মাসের পনেরো তারিখে । উনি বলেছিলেন জানাজানি না করতে ।

–ওয়ারিস আলি গঞ্জ তো নওয়াদার মারাত্মক জায়গা । মুসহররা থাকে । বিনোদ মিশ্রর নকশালদের মাওওয়াদি বনপার্টির গঢ় । একজন সুন্দরী আধুনিকা থাকবে কী করে সেখানে গিয়ে ! ওরকম জায়গায় গান্ধি আশ্রম করেটাই বা কী ?

–আশ্রম পরিচালক ওনার স্বামী ।

–স্বামী ? মানসী তো ডিভোর্সি !

–সব বানানো গল্প । লোক দেখানো । ওনার স্বামী এমবিবিএস ডাক্তার, বোধহয় বিলেত থেকে পাশ করা সার্জেন । ডাক্তারি করেন আর দলিত-মহাদলিতদের লোকেদের মধ্যে বিপ্লবের প্রচার । ওষুধ কেনার জন্য ভদ্রলোক পাটনায় আসতেন মাঝেমধ্যে, হয়তো ওনাদের গোপন মিটিঙের জন্যেও । বাচ্চাটা ওনারই । ননীদারাও গেছেন মানসী বর্মণের সঙ্গে, ওখানেই থাকবেন, বুড়ো বয়সে মুসলমান মেয়ে বিয়ে করে পাটনায় থাকলে গণ্ডগোল পোয়াতে হতে পারে, তাই ননীদা চলে গেলেন । ওখানে কেউ অত খোঁজখবর করবে না পারিবারিক ব্যাপার নিয়ে । আর, গান্ধি আশ্রম বলে কিছুই নেই ওখানে । আছে ডাক্তারখানা । মাওওয়াদি কমিউনিস্ট সেন্টারের ক্রান্তিকারী কিষাণ সমিতির অফিস ওটা । গান্ধি আশ্রমের একটা সাইনবোর্ড অবশ্য আছে বলে শুনেছি ।

–আপনি কী করে এত সব জানলেন ?

–উনি চলে যাবার পর জানতে পারলুম রসিক পাসওয়ানের কাছ থেকে ।

অতনুর মনখারাপ হয়ে যায় । পৃথিবীর কাজকারবার থেকে তাকে সত্যিই বাদ দিয়ে দেয়া হয়েছে । এরপর অরিন্দম যা বলে তাতে ওর মনে হয় ক্রমশ একলা হয়ে যাওয়াই ভবিতব্য ।

–আমি তো মিউচু৮য়াল করে কলকাতা চলে যাচ্ছি ।

অতনু তখন ভাবতে আরম্ভ করেছে, বছর সাতেক আগে পাটনার রাস্তায় এক শোকযাত্রা, বিপ্লবী ফরোয়ার্ড ব্লক নেতা বালমুকুন্দ রাহি আর চন্দ্রদেও যাদবের গলাকাটা মৃতদেহ নিয়ে মিছিল । ক্রান্তিকারী কিষাণ সমিতি তখন জমিদারি উচ্ছেদ শুরু করেছে,  অপরাধী জোতদারদের মৃত্যুদণ্ড দিচ্ছে জনআদালত, ভূমিহীনদের পাইয়ে দিচ্ছে জমিজমা । তখন, কানাই চ্যাটার্জি, অমূল্য সেনের মৃত্যুর পর, বিহারিত্বে পালটে গেছে বিপ্লব । ভাষার ক্ষমতাও যে এভাবে হস্তান্তরিত হতে পারে তা তখন আর এখনও ভাবেনি বাঙালিরা, যারা হয়তো বেশিদিন আর থাকতে চাইবে না বিহারের মাটি কামড়ে ।

–বুঝলেন অতনু, কলকাতায় চলে যাচ্ছি ।

–কিন্তু কেন ?

–এখানে থাকা যায় না । ওখানে গিয়ে ফ্ল্যাট-ট্যাট কিনব, দরকার হলে বিয়ে-ফিয়ে করব । এখানে থাকতে হলে হতে হবে সুশান্তর মতন ট্যাঁশ রাজা বাহদুর, নয়তো মানসী বর্মণের মতন বিপ্লবী, নয়তো আপনার মতন ইয়ে…

–রেণ্ডিবাজ ? ছাপোষা জীবন বেশ কঠিন এখানে তাই না ?

–কলকাতার লাইফই আলাদা ; টাটকাতাজা ফিলিং পাওয়া যায় ।

 

অরিন্দম চলে গেল বদলি হয়ে । রাঘব-রমা তো আগে থাকতেই রয়েছে কলকাতায় । যারা কলকাতায় চলে যায় তাদের সম্পর্কে আর কোনো খবর পাওয়া যায় না ; পাওয়া যায় যখন তারা খাপ খাওয়াতে না পেরে পাটকায় ফিরে পশ্চিমবঙ্গের শাসকদের গালমন্দ করে । অথচ বিহারের অনধিগম্য গ্রাম থেকেও নানা খবর আসে লোকমুখে । সুশান্ত নাকি নতুন বীজ আর খেতি আর্মভ করে উপজ বাড়িয়ে ফেলেছে, দিয়ারার জমি আর পড়ে থাকে না ; সরকারকে লেখালিখি করে পাকা রাস্তা, খাবার জল আর বিজলি আনিয়েছে নিজের এলাকা পর্যন্ত । আংরেজিতে লেখালিখি করলে সরকার নড়েচড়ে বসে ।

দলিত-মহাদলিত ছেলেমেয়েদের অক্ষরজ্ঞান দিতে দেখা গেছে মানসী বর্মণকে, গয়া জাহানাবাদ অওরঙ্গাবাদ নওয়াদার গ্রামে, বনপার্টির বন্দুকধারী যুবক-যুবতী থাকে ওনার পাহারায় । ননীদা সাইকেলে এ-গ্রাম সে-গ্রাম করে টাকমাথায় ভিজে গামছা বেঁধে ।

 

মাসকতক পরে অফিসে একদিন কি হ্যাঙ্গাম, বিপদসংকেতের পাগলা ঘণ্টি । বিপদ আপদ সন্ত্রাস ডাকাতি সামলাবার জন্যে অফিসে নানা জায়গায়  অ্যালার্ম ঘণ্টির বোতাম লুকোনো আছে । কাঁচের ঢাকনি ভেঙে বোতাম টিপলে সারা অট্টালিকা জুড়ে অবিরাম বাজতে থাকে মাথা-ধরানো পাগলা ঘনহতি । ন-মাসে ছ-মাসে একবার করে মহড়া হয় । বহুক্ষণ বাজছিল বলে আশঙ্কা করা গেল যে আজকেরটা রিহার্সাল নয়, আসল । বাইরে বেরোবার আর ঢোকবার শাটার গেট দরোজা বন্ধ হয়ে গেল দ্রুত, তাক করে বসে গেল বন্ধুকধারী সরকারি সেপাইরা, স্যুট-টাই পরা কর্তাদের হন-হন গট-গট, চেয়ার থেকে মুণ্ডু বের করে হাফ-কেরানি আর কেরানিদের কচাল । ঘণ্টাখানেক পর অলক্লিয়ার ঘণ্টি বাজলে জানা যায় ব্যাপারটা । একজন অফিসার, যিনি জোড়াতালি দেয়া নোট একটা-একটা করে পাস করেন, তিনি বাজিয়েছিলেন ।

ছেঁড়া-জোড়াতালি নোটবদলের কেরানির খাঁচার পেছনে ওই অফিসারের টেবিল । পাবলিক-দালালরা নোটের লট দ্যায় কেরানিকে । কেরানি নিজের খাতায় নথি করে দ্যায় অফিসারকে । তক্ষুণি বদলযোগ্য হলে অফিসার নোটের ওপর সই-তারিখ দিয়ে পাঠান হাফ-কেরানির কাউণ্টারে । সেখানে টোকেন দেখিবে নতুন নোট পেয়ে যায় পাবলিক । এই দুটো কাউণ্টারে বসার জন্য তুমুল হয় কর্মীমহলে ।

অফিসার আপন মনে জোড়াতালি নোট পাস করছিলেন প্রতিদিনের ঘানির বলদের ঢঙে । আচমকা একটা নোট হাতে নিয়ে তিনি স্তম্ভিত । নোটটা তিনি নিজেই বছরখানেক আগে ছাপ সই-তারিখ দিয়ে পাস করেছিলেন । এটা তো পুড়ে নষ্ট হয়ে যাবার কথা । বাজারে গেল কী ভাবে ! তার মানে পোড়াবার চুল্লিতে পৌঁছোবার আগেই মাঝপথে মেরে দিয়েছে কেউ । কোনও কর্মী নিশ্চয়ই করেছে কাজটা । একটা যখন সরিয়েছে তখন আরও অনেক সরিয়েছে নির্ঘাৎ । তার মানে অন্তত এক বছর যাবত চলছে চুরিচামারি । তার মানে একজন মাত্র নয়, অনেকে জড়িয়ে আছে, কেননা নোটটা তো নানা ধাপ হয়ে পুড়তে যায়, সেই ধাপগুলোয় যারা আছে তাদেরও হাত আছে । মগজের ভেতরে দ্রুত ছবি গড়ে উঠছিল ওনার ; তাঁর পাস করা নোট বলে আরও বেশি আতঙ্কিত বোধ করছিলেন অফিসার । যে লোকটা নোটটা দিয়েছিল, ধরতে হবে তাকেই, তাকে ধরলে পুরো সুতোর গোলাটা বের হয়ে আসবে । ভয়া গলা শুকিয়ে যায় ওনার । কপালে বিনবিনে ঘাম । পেপারওয়েট দিয়ে কাঁচের ঢাকা ভেঙে বাজিয়ে দিলেন পাগলা ঘণ্টি । খদ্দেরটা ছিল ঘোড়েল । নজর রেখেছিল । পাগলা ঘণ্টির প্রথম রেশটা উঠতেই হাওয়া ।

পুলিশে খবর দেয়া হল ।

ওই নোটটা যেদিন পুড়ে যাবার কথা, সেদিন কাদের ডিউটি ছিল চুল্লিতে, তাদের নাম রেজিস্টার থেকে বের করে, প্রথমে একজন চতুর্থ শ্রেণির কর্মীর বাড়ি হানা দিয়ে পুলিশ আরও কিছু অমন নোট পেল । তাকে উত্তম-মধ্যম আদরের পর পুলিশ জানতে পারল চুল্লির জানালা দিয়ে মুণ্ডু ঢুকিয়ে, চুল্লির আগুনে ফেলবার বদলে, নিজের গেঞ্জির ভেতরে ঢুকিয়ে নিত প্যাকেট । ছ্যাঁদা-করা নোটের প্যাকেট হলে বদলে নিত নোট পরীক্ষক অসীম পোদ্দারের কাছ থেকে । নিজের সেকশানে আস্ত প্যাকেটের সঙ্গে ছ্যাঁদা-করা নোটের প্যাকেট পালটে নিত অসীম । কারোর সন্দেহ হতো না, কারণ আস্ত নোট ছ্যাঁদা করানোর কাজটা অসীমেরই ছিল ।

অসীমের বন্ধুবান্ধবদের একে-একে জেরা করা আরম্ভ হল । মৃত অসীম সম্পর্কে ক্ষুব্ধ হয়ে উঠেছিল ওর দলের সবাই । দাশগুপ্ত মারা গিয়ে যা দিয়ে গেছেন, সেটাই তো যথেষ্ট ছিল, তবে ? অতনুরও জেরা হল ।

–আপনার নাম অতনু চক্রবর্তী ?

–হ্যাঁ ।

–মহেন্দ্রু মোহোল্লায় থাকেন ?

–হ্যাঁ ।

–নিজেদের বাড়ি ?

–হ্যাঁ ।

–বাবা-মা কেউ নেই ?

–হ্যাঁ ।

–বাবা মারা যাওয়ায় চাকরি পান ?

–হ্যাঁ ।

–বাবার প্রভিডেন্ট ফাণ্ড গ্র্যাচুইটির টাকা স্টেট ব্যাংকে ফিক্সড ডিপোজিটে জমা আছে ?

–হ্যাঁ ।

–একটু-আধটু নেশা করেন ?

–হ্যাঁ ।

–অসীম পোদ্দারের সঙ্গে নালান্দা আর শোনপুর মেলায় গিয়েছিলেন ?

–হ্যাঁ ।

–একটু-আধটু মাগিবাজি করেন ?

–হ্যাঁ ।

–জুয়া খেলেননি তো কখনও ? তাস, ঘোড়দৌড় ?

–হ্যাঁ ।

–বিয়ে করেননি কেন ?

–প্রস্তাব আসেনি ।

–রান্নাবান্না নিজেই করেন ?

–হ্যাঁ ।

–নোট না গুণেই পোড়াতে পাঠান ?

–হ্যাঁ ।

–ঠিক আছে, যেতে পারেন ।

 

বাড়ি পৌঁছে, খাটের তলা থেকে মানসী বর্মণের দেয়া রেকসিনের ব্যাগটা টেনে ধুলো ঝেড়ে, জিপ খুলতেই অতনু স্তম্ভিত । ঠাইক যা অনুমান করেছিল । অগোছালো নোটে ঠাসা । আস্ত নোটের ভেতরে গোঁজা অসীম পোদ্দারের ডায়েরি । পাতার পর পাতা মানসী বর্মণকে লেখা প্রেমপত্র । যৌনরোগ বা যৌনস্বেচ্ছাচার থেকে পাওয়া রোগ আর সারবে না, তাই শেষ প্রেমপত্র লিখেছে, জানিয়েছে শেষ চিঠিটায় ।

অতনুর অজান্তে তাকে বিসদৃশ ষড়যন্ত্রে জড়িয়ে দিয়েছে সবাই, খেলা করেছে ওর ইনোসেন্স নিয়ে । ওর কাঁধের ওপর একটা ব্যথা উঠে কোমর বেয়ে পায়ের গোছে নেমে যায় । বুকের তীব্র ঢিপঢিপে অসুবিধে হয় শ্বাস নিতে ।

কীভাবে গতি করবে এই রহস্যেঘেরা দায়িত্বের ? কীই বা উদ্দেশ্য ? মায়ের ছোটো-ছোটো ঠাকুরদেবতা এর মধ্যে পুরে গঙ্গা ব্রিজ থেকে ফেলে দেয়া যায় নদীতে । সুশান্তর কাছে চলে যাওয়া যায় ফিরৌতির টাকা দিতে । আনিসাবাদে বাড়ি উঠে যেতে পারে শেফালির । প্রয়োজনীয় অস্ত্র যোগাড় হয়ে যাবে রসিক পাসওয়ানের । ছোটোখাটো গ্রামীণ হাসপাতাল হতে পারে ওয়ারিস আলি গঞ্জে । আজীবন সুখে থাকা যায় জুলি-জুডির সঙ্গে । এতগুলো বিকল্প থেকে যে-কোনো একটা বেছে নেয়া শক্ত ।

দুশ্চিন্তা, তাও অহেতুক, অন্যের চাপানো, কাহিল করে রাখে অতনুকে রাতভর ।

ভোরবেলা, প্রথম বাস ধরার জন্যে, ধুতি-পাঞ্জাবি-চটিতে রূপান্তরিত অতনু, ব্যাগ সঙ্গে নিয়ে, রিকশ চাপে, বাঁকিপুরে দূরপাল্লাগামী বাস ডিপোর উদ্দেশে ।

কোনও একটা, যে-কোনও একটা, বিকল্পগুলোর মধ্যে থেকে বেছে নিতে হবে ।

———————————————————————————————————————————————

( পরের পর্ব আছে ‘জলাঞ্জলি’ উপন্যাসে )

 

 

 

 

Leave a comment

Filed under উপন্যাস