ছয়

নালান্দা থেকে ফিরে জানা গিয়েছিল হরতাল তুলে নিয়েছে ইউনিয়ান, কেননা সমস্যাটা সার্বজনীন নয় । আর, বাঙালি একটা ডিভোর্সির জন্যে ধর্মঘটে প্রতিদিন এভাবে মাইনে কাটানোর মানে হয় না । রাজপুত কায়স্হ ব্রাহ্মণ কুরমি কোয়রি কাহার  পাসি হাজাম দুসাধ ভূঁইয়া চামার সকলে একমত ।

প্রধানমন্ত্রির লাথি খেয়ে মুখ্যমন্ত্রীও পালটে গেছে । ধানবাদের কয়লা মাফিয়ার সঙ্গে বনিবনা হচ্ছিল না মুখ্যমন্ত্রীর । নতুন মুখ্যমন্ত্রী রাজপুত । আগেরটা ছিল ব্রাহ্মণ । কয়লা মাফিয়ারা রাজপুত । দিল্লিতে ওদের ঘুঁটি এককালের যুবাতুর্কি ভিকিরি এখনকার কোটিপতি সাংসদ চন্দ্রশেখর । নতুন মুখ্যমন্ত্রী জানিয়েছে এদের মাফিয়া বলা অনুচিত ।

কত মুখ্যমন্ত্রী এলো-গেলো, সবকিছুই যেমনকার তেমন । পাকাচুল হাফটেকো সুনীলরঞ্জন নাহাবিশ্বাস, কর্পোরেশানের ডাক্তার । ছাদের ওপর মাটি ফেলে বাগান করেছে । রঙিন ছাতার তলায় বেতের ধবধবে চেয়ার । শ্মশানগামী লাশের সংখ্যা, গয়া অওরঙগাবাদ জাহানাবাদ নওয়াদায় এমসিসি আর লিবারেশানের মাওবাদি বনপার্টির  জলপাইরঙা বিপ্লবে, বেড়ে চলেছে প্রতিদিন । এই মাটির জীবনে খাপ খেয়ে গেছে নাহাবিশ্বাস, বাঙালি অট্টহাসির বদলে বিহারি ঠহাকা দিতে পারে, দ্যায়ও আহ্লাদে টইটুম্বুর হলে, লাশের সংখ্যা বাড়ছে দেখে ।

 

বাড়ির সব কাজ মায়ের থেকে নিজের হাতে নিয়ে নিতে পেরেছিল অতনু । মেছুয়াটুলির মাছের বাজার আর মুসল্লাপুর সবজিহাট থেকে, কুটনো কোটা, রান্না, বাসন মাজা, ঘর ঝাঁট, কাপড় কাচা । মা বলেছিলেন, মাছ-মাংস এনে রাঁধতে পারিস, আমারটা না হয় অন্য বাসনে রেঁধে দিবি । অতনু তা করেনি । বাবার সময়ের পেতলের ধালাবাটি বেচে কিনেছে স্টেনলেস স্টিলের আর কাচের । গোদরেজ বুককেস আর আলমারি । রঙিন টিভি । সিডি-ডিভিডি প্লেয়ার কিনে দিয়েছে মাকে, বাংলা ফিল্মের ডিভিডি আর রবীন্দ্রসঙ্গীত-আধুনিক গানের সিডি । নিজের জন্য মোটর সাইকেল কিনেছে, বাজাজ পালসার ।

কিন্তু মানসী বর্মণের বাচ্চাটা, অল্পবিস্তর গণউৎসাহ সত্বেও বাঁচেনি । ঠিকই জন্মেছিল, যেমন বাচ্চারা পৃথিবীর দিকে মাথা করে বেরিয়ে আসে । পাটনা মেডিকাল কলেজের ডাক্তার লক্ষ্মী চ্যাটার্জি বাচ্চাটাকে উলটো টাঙিয়ে, ছাত্রছাত্রীদের বোঝাবার সময়, কাঁদাতে গেলে, হাত পিছলে মেটিতে । মানসী বর্মণের জ্ঞান ছিল না ।

কাছের লোকের সহানুভূতি দুঃখকে গভীর করে ।

অতনুর মা মারা গেলেন । রক্তচাপের ওষুধ খাওয়া গোপনে বন্ধ করে দিয়েছিলেন । নিঃসঙ্গতার আহ্বান করা হার্ট অ্যাটাক । বছর খানেকের বেশি হরেক রঙের ওষুধ পাওয়া গেল ওনার তোরঙ্গে । বোধহয় বাবার আত্নহত্যার প্রতিশোধ । বা, অতনুর স্বনির্ভর হওয়ায় নিজের প্রয়োজনীয়তা ফুরিয়েছিল । কিংবা বার্ধক্যের উদ্দেশ্যহীন ক্লান্তি । কেউ মাকে এসে খবর দিয়েছিল কি, তার আজকালকার চালচলন !

বিহারে সব্বাই যেভাবে বাঁচতে চাইছে, তাইতে মিশতে চেয়েছে অতনু । বাঙালিরা যাকিছু খারাপ মনে করে, অথচ বিহারিরা করে না, তা কেন খারাপ মনে হবে অতনুর, বিহারে থেকে ? এখানেই তো মরা আর বাঁচা । পশ্চিমবাংলায় ওর কেউ নেই, কিছুই নেই, তাই নিজেকে প্রবাসী বাঙালি বলে চালাবার মানে হয় না । ঢাকা আর কলকাতা থেকে বহির্বাংলার দূরত্ব সমান ।

রোজ সাড়ে দশটায় অফিসে আসার কিছুক্ষণের মধ্যে ভেকাভেজা হতদরিদ্র নিকষ বিষণ্ণ নোটের আমন্ত্রণ অতনুকে ছেয়ে ফ্যালে, ধূসর বিষাদমুখো নোটের ঢিবি আড়াল তোলে জানলার মুখরিত আলোয়, স্খলিত-বিগতযৌবনা নোটের ভেষজ অন্ধকূপে ও চাকরি করে চলে ভারাক্রান্ত, দিনের পর দিন, ম-ম করে ন্যাতানো শ্বাসরুদ্ধকর ছাতাপড়া সোঁদা-সোঁদা নোট । যেন ওৎ পেতে থাকে হাড়হাভাতে নোটেরা ।

অনেকদিন, অনেক অনেকদিন, আকাশে যখন ত্যাবড়ানো অ্যালুমিনিয়াম থালার চাঁদ, অতনু চেয়েছে এই নিরাভরণ কদাকার বিবর্ণ নোটের জাপট থেকে মুক্তি পেতে ।

আজকাল, বলতে গেলে, নিজের নতুন মোটরবাইকেই জীবনযাপন করে অতনু । বাড়ি ফিরে একা-একা রান্না, একা-একা খাওয়া, একা-একা টিভি, সিডিতে, পেনড্রাইভে হিন্দি আর ইংরেজি ফিল্ম, বাসন মাজা, ঘর ঝাঁট, মশারিটাঙানো, বিদেশি গান কানের মিনিঠুলিতে । একা-একা খেতে বসাটা ভয়াবহ । সকালে অন্তত কাকাতুয়া দুটো সঙ্গে দেয় । ওরাও ছড়া আর গান গুলিয়ে ফ্যালে । অ্যানিমাল প্ল্যানেটে কিংবা ন্যাশানাল জিওগ্রাফিকে বাঘ সিংহ কুমির চিতা হায়েনার মাংস ছিঁড়ে-ছিঁড়ে খাওয়াটা ভাত-ডাল-তরকারি খাবার সময়ে ভাল্লাগে না ।

ঘুমের মধ্যেই কখন, অজান্তে, মারা গিয়েছিলেন মা । চা বানিয়ে দিতে গিয়ে টের পেয়েছিল অতনু । কাকে বলবে, কাকে খবর দেবে, কী করবে এখন, চাপা গলায় অজস্র অনুত্তর ছেয়ে ফেলেছিল কিছিক্ষণ । মানসীকে খবর পাঠাবে ? শেফালির মতন চটপটে কেউ থাকত যদি । সুশান্ত থাকলে কথাই ছিল না । রসিক পাসওয়ানকে খবর দেবে ? শেষে মামুদ জোহেরকে টেলিফোনে জানালে ও অনেককে নিয়ে পৌঁছে গিয়েছিল ঘণ্টাখানেকে, দলের প্রকল্প অভিভাবক যেন, কে আনবে কাঁচা বাঁশের মাচান, পুরুত ডেকে আনবে, শ্রাদ্ধের ফর্দ নিয়ে কেনাকাটা, একজন আগেই চলে যাক গুলফিঘাট শ্মশানে । শ্মশানে যাবার মালপত্তর তুলে নিয়েছিল মামুদ, কিন্তু মুসলমান বলে যদি পরে কথা হয়, রেখে দিয়েছিল মাটিতে ।

বাঙালি পুরুত পাওয়া গেল না । সতীশ ঘোষাল বললেন, বুড়ো হয়ে গেছি, আর পারি না । শ্মশানের যেতে চায়নি অন্য বাঙালি পুরুতরা, যারা শ্মশানের কাজটা করে দিতে পারত ; বড্ডো হ্যাঙ্গাম, তেমন আয় দ্যাখে না পুজোআচ্চার মতন । তায় বিধবা, গায়ে তো গয়নাগাটিও থাকবে না । পাওয়া গিয়েছিল মৈথিলি পুরুত । অরিন্দম অবাক, বাঙালিদের তো এসব আচার নেই, মন্তরগুলোও অচেনা ।

বয়সের গাছপাথর নেই এমন পুরোনো শ্মশান । আলমগঞ্জ থেকে মাখানিয়া কুঁয়া অব্দি বিস্তৃত এলাকার কতো বাঙালি পরিবার ছাই হয়েছে এখানে, সেই কোম্পানির আমল থেকে, যারা সায়েবদের পেছন-পেছন এসেছিল, ম্যাকলে সায়েরবের শেখানো ইংরেজি লিখতে শিখে । মরে গেলে মানুষ এত ঠাণ্ডা হয়ে যায়, এমন বিসদৃশভাবে শক্ত, বাবা মারা গেলে ময়না তদন্তে সেলাই-করা ওনার শরীর ছুঁয়ে টের পায়নি অতনু । মায়ের মারা যাওয়াটা কেন যেন ব্যক্তিগত ক্ষতির মতন হাঁ-করা অভাব গড়ে দিয়েছে । শূন্যতা নয়, ভরাট বেদনা । একেই বোধ হয় শোক বলে । গভীরভাবে উদগ্রীব টিমটিমে গোপন পীড়া ।

 

সুশান্তর বাড়িতে খবর নেবার জন্য গিয়েছিল অতনু । রেলফাটকে, সঙ্গে মোটরবাইক থাকায়, একঘণ্টা কাবার । প্যাসেঞ্জারের লাগেজভ্যান থেকে চলছে লাশ নামানো, কাঁচা বাঁশের মাচানে কাতাদড়ি দিয়ে বাঁধাবাঁধি । লাশেরদের মুখ আগে থেকেই ব্যথায় কাতর । কাতাদড়িতে বাঁধার কষ্ট তবুও ফুটে উঠছে । কান্নাকাটি নেই শববাহকদের ; যা কাঁদবার কেঁদে নিয়ে থাকবে যে-যার নিজের গ্রামে । পুলিশের বিরক্তমুখ লোভী-হাত কেঠো-ব্যাটন তদারকি চলছে । সাসারামে দাঙ্গা হয়েছিল ।

সাসারামের নুরনগঞ্জ পাড়ার কাদা-প্যাচপেচে রাস্তায় স্কুটার স্কিড করে সাইকেল আরোহীকে ধাক্কা মারলে, দাঙ্গার আরম্ভ মদরসলামি পির মজারের দেখাশোনা করত বুড়ো ইউনুস শাহ আর জোয়ান জুমরাতি শাহ, তক্ষুনি খুন হয়েছিল । মাজারের বাইরে ফুল বেচত সলমা, সেও । মুহম্মদ হাফিজ, আবদুল সত্তার আর মুহম্মদ নাজিরের লাশ লোপাট । শহরের সবচেয়ে বড়ো দোকান মুহম্মদ ফিজুদ্দিনের লিবাসঘর পুড়ে ছাই । বদলা হিসেবে এই ট্রেনযাত্রী লাশ ।

সুশান্তর জ্যাঙামশায় বললেন, ‘আমাদের কিছু না বলে উনি গিসলেন জমির দখল নিতে, লেঠেল লাগাতে । নওগাছিয়ার কাজিকোইরা গ্রাম থেকে এক ব্যাটা মণ্ডল এসে জানিয়েছিল, সুসান্তকে ওরা কিডন্যাপ করেছে, আর দশ লাখ টাকা ফিরৌতি দিলে ছাড়া হবে ।’

ফিরৌতি ? মানে, র‌্যানসাম ?

হ্যাঁ, হ্যাঁ । অতো টাকা কোথায় পাবো আমরা ? জেলা ম্যাজিস্ট্রেট, মুখ্যমন্ত্রী, স্বরাষ্ট্র সচিবের সঙ্গে দেখা করেছিলুম । শুধু আশ্বাস । কেউ কিচ্ছু করলে না ।

সুশান্ত ভালো আছে তো ?

ভালো আছে মানে ? তারিণী মণ্ডল নাকি নিজের চোদ্দ বছরের মেয়ের সঙ্গে ওর বিয়ে দিয়ে দিয়েছে । এই ক্রিমিনাল মণ্ডলগুলো আদিতে বাঙালি ছিল ; লেঠেল হয়ে এসেছিল কোম্পানির আমলে । সুশান্ত বাঙালি জানতে পেরে বন্দুক পাহারায় জোর করে বিয়ে দিয়ে জামাই করে নিয়েছে, বিহারে যেমন হয় আকছার, জামাই দখল ।

চোদ্দ বছরের মেয়ে ?

ওদের বন্দুকধারি লোক জিপগাড়িতে এসে জানিয়ে গেছে, গোপালপুর, ফলকিয়া, পরবত্তা, ডিমহা, কেলওয়ারি, তিনহেংগা, আর কহলগাঁও-এর অনাদিপুর, আভাপুর, আর অঠগম্মা দিয়ারায় এখন সুশান্তর রাজত্ব ।

রাজত্ব ! মানে ?

মানে আবার কী ! ভিড়ে গেছে ক্রিমিনালগুলোর দলে । আর কি ফিরতে পারবে কখনও ? দিয়ারার বাইরে বেরোলে পুলিশ ওর পোঁদের চামড়া তুলে নেবে ।

অতনু টের পাচ্ছিল, হাসিখুশি একান্নবর্তী পরিবারটা পালটে ফেলেছে বাড়ির আবহাওয়া, কেননা তাদের বাড়ির ছেলে তোয়াক্কা করেনি পারিবারিক যৌথ সাধআহ্লাদ, দাবি-দাওয়া, স্বপ্ন-কল্পনা । একান্নবর্তী পরিবারের সদস্যরা সবাই মিলে কি দশ লাখ টাকা জোগাড় করতে পারত না ! চেষ্টা করতে কী ছিল ; সুশান্তর অফিস থেকে চাঁদা তুলে কিছু জোগাড় হতো । বাকিটা ওনারা দিতেন ।

তারিণী মণ্ডলরা এককালে বাঙালি ছিল ! সুশান্ত যদি ওভাবে মিসে যেতে পারে তাহলে ওর ঝুঁকি নিশ্চই শ্রদ্ধেয় । চোদ্দ বছরের গ্রাম্য অশিক্ষিত, বাংলা জানে না এমন একটি মেয়ের সঙ্গে ও কী করে কে জানে ! তরুণী হয়ে উঠতেও তো বছর দুয়েক । খালি গায়ে গলায় তাবিজ খাটো ধুতি ধরেছে কি ? ফ্যান নেই, লাইট নেই, টিভি নেই, ওর প্রিয় বিদেশি গান শোনার সুযোগ নেই । কীভাবে থাকে, সময় কাটায়, কী খায় ? জলের ওয়াটার ফিলটার নেই । কিসের জন্যে সবকিছু ছেড়েছুড়ে ঢুকে গেল অমন অচেনা সমাজে ? বাড়িতে বলেনি, অথচ মৌলিনাথকে বলেছিল ।

অফিসে, সিঁড়ি দিয়ে নামতে-নামতে , দেখা হলে, মৌলিনাথ বলে উঠল, ‘কী অতনু, রেণ্ডিবাজি করে ইনটেলেকচুয়াল হবার তালে আছেন নাকি ?’

‘আপনি তো দাস ক্যাপিতালের মলাট লাগিয়ে ফ্যানি হিল পড়তেন অফিসে বসে, উরুর ওপর উরু রেখে ।’ অতনুর আকস্মিক ঠারে চুপসে যায় মৌলিনাথ ।

মানসী বর্মণ ডেকে পাঠিয়েছিল আপনাকে । যাবেন বলে আর দেখা করতে যাননি । বাচ্চাটা মরে গেল । সহানুভূতির জন্যে অন্তত যাওয়া উচিত ছিল । নেশাফেশা বেশি করবেন না অতনু, রোগে ধরলে কে দেখবে ।

ঠিকাছে, যাব । অনেকক্ষণ ধরে হিসি চেপে আছি ।

কে দেখবে, জানতে চাইল মৌলিনাথ ! দেখাদেখির দরকার হয় কি ? একা মরে পড়ে থাকলেও দুর্গন্ধের দায়ে পড়াপড়শিরা ছুটে আসবে গতি করার জন্য ; পুলিশে নিয়ে গিয়ে পোড়াবে । কাউকেই কেউ দেখে না, সবই আপনা থেকে ঘটে যায় । মায়ের মারা যাবার সময় যেমন মামুদ জোহের ঘটে গেল ।

অফিসের চতুর্থ-তৃতীয় শ্রেণির কর্মিদের টয়লেটের বালব-টিউব মেরে দিয়েছে ঝাড়ুদাররা । পেতলের কল, সিংকের ধাতব পাইপ চুরি হবার পর এখন লেগেছে পিভিসি প্লাসটিক । জল বেয়ে মেঝেতে শ্যাওলা। দরোজার হাতল বার-বার চুরি হয় বলে পাটের দড়ি দিয়ে বাঁধা । ডোর-ক্লোজার কাজ করে না বহুকাল । দেয়ালজুড়ে পরস্পরবিরোধী ইউনিয়নের হরেকরঙা পোস্টার । টয়লেটে যৌনসংকেত লিখনের দিন বোধহয় শেষ ; সমাজ উন্নত হয়ে চলেছে, তার লক্ষণ । কোনে-কোনে খাপচা-খাপচা পানের আর তামাকের পিক গয়ের থুতু শিকনি । রাঘব বদলি হয়ে যাবার পর দুস্হ হয়ে গেছে এই বিশাল অট্টালিকা । জানলার নোংরা কাচের বাইরে, চোদ্দ বছরের ছাগলচরানি বালিকার মতন রোঁয়া ওড়াচ্ছিল শিমুল ।

সন্ধ্যাবেলা মানসী বর্মণের ফ্ল্যাটের কলিংবেল বাজিয়ে মিনিট পাঁচেক দাঁড়িয়ে অপেক্ষার পর ফিরে যাবে কিনা ভাবছে যখন অতনু, দরোজা খুলতেই ধুপকাঠির গন্ধ আর মানসী, রোগাটে, চুলে ববকাট, ফ্রিল দেয়া হলুদ ব্লাউজ, তাঁতের ফিকে হলুদ শাড়ি । কই, দুঃখ কষ্টের ছাপ, মৌলিনাথ বলেছিল, পেলো না অতনু, মানসীর চেহারায় আচরণে, ঘরের আসবাবে ।

আরে, অতনু !

ফিকে হাসল অতনু । আমি ভাবলুম এখনও ওপরতলার আগরওয়ালের নেকনজর এড়াতে খুলতে চাইছেন না ।

ও ব্যাটা বিদেয় হয়েছে এই বিল্ডিং থেকে । পুজো করছিলুম, তাই দেরি হল ।

পুজো ? আপনি পুজো করেন বুঝি ? জানতুম না ।

কেন ? ঠাকুর-দেবতা মানো না । বোসো না, দাঁড়িয়ে রইলে কেন !

ভাগ্য ভালো যে আপনি ঈশ্বরে বিশ্বাস করি কিনা জানতে চাননি । মা মারা যাবার পর ঠাকুর-দেবতাদের তোরঙ্গে বন্দি করে রেখেছি । একদিন গিয়ে গঙ্গা ব্রিজ থেকে বিসর্জন দেবো ।

ছিঃ, অমন বলে না । কতো বিপজ্জনক চাকরি, কখন কী হয় তার ঠিক আছে ? ভগবানে বিশ্বাস রাখতে হয় ।

এসব কী এখানে ?

সেন্টার টেবিলে রাখা ছিল তুলো, সাইকেল রিকশার ভেঁপুর মতন কাঁচে লাগানো রবারের হর্ন, স্টেনলেস স্টিলের বাটিতে কয়েক চামচ দুধ, মসৃণ প্লাস্টিকের গোলাপি হাতলে ডিম্বাকার আয়না । মানসী বর্মণের দপ করে রং পালটানো মুখশ্রী দেখে অতনু টের পায় যে প্রশ্নটা করা উচিত হয়নি । শাড়ির আঁচল সরায় মানসী । ব্লাউজে ছড়িয়ে-পড়ে দুই বৃন্তকে ঘিরে দুধের ভিজে ছোপ দেখে অতনু নির্বাক ।

কী করি ? ডাক্তার বলেছে পাম্প করে বের করে দিতে, নইলে ক্যানসার হতে পারে, বলল মানসী ।

স্তনবৃন্ত দেখে উতরোল অতনু জিগ্যেস করল, রোজ পাম্প করতে হয় ?

দু’বেলা । দাঁড়াও, চা বসাই । আগের বার নে খায়েই চলে গিসলে । টোস্ট খাবে ? চানাচুর ?

মানসী রান্নাঘরে ঢুকতেই, ঘোর-লাগা অতনু টুক করে খেয়ে ফ্যালে বাটির দুধ । সোঁদা আচ্ছন্ন করা গন্ধ, সারা শরীর জুড়ে শিহরণ খেলে যায়, শিশুর আহ্লাদ বয়ে যায় দেহের আগাপাশতলা ।

অনভিপ্রেত আকস্মিকতায় থ, ও, মানসী, ‘পাগল না মাথাখারাপ, ওঃ, সত্যি, ওফ, কোন জগতের জীব তুমি ?’ অন্য ঘরে চলে যায় আর ফেরে বেশ কিছুক্ষণ অতনুকে বসিয়ে রেখে, লালপেড়ে গরদ, কপালে বিশাল লাল টিপ, হাতে রেকসিনের ঢাউস ব্যাগ, রাখে, অতনুর পায়ের কাছে, ‘তালশাঁসের গন্ধ পাচ্ছ না’, জানতে চায় ।

না, চারিদিকে কেমন মিষ্টি দুধ-দুধ গন্ধ । বাচ্চাটা নষ্ট হল আপনার মন খারাপ হয়নি ?

এখন আমি জানি আমার পেটে বাচ্চা হতে পারে, বলার সময়ে ময়ূরের গলার মতন হয়ে উঠল মানসীর গর্ব, অদৃশ্য পেখম লাল গরদের শাড়িতে । বলল, তোমার কথা বল । অনেক কানাঘুষা শুনি ।

যা শোনেন সবই সত্যি । নিজের লাম্পট্যের সংবাদকে অতিরঞ্জন দেবার চেষ্টা করল অতনু ।

সত্যি ?

অতনু বুঝতে পারল সত্যি কথা আশা করেনি মানসী, তাই অন্য  প্রসঙ্গে চলে যায় সুশ্রী যুবতী, ‘আমার এই ব্যাগটা তোমার কাছে রেখে দিও, অ্যাঁ, কিছু দরকারি কাগজপত্র আছে, আমি কিছু দিনের জন্যে ওরসলিগঞ্জ যাচ্ছি ।

ওয়ারিস আলি গঞ্জ ? ও তো মারাত্মক জায়গা, মুসহররা থাকে, সতযুগ মানঝি, ঝাড়ুদার, রাঘবের পেছন-পেছন চাবির থলেগুলো নিয়ে ঝনঝনিয়ে ঘুরতো, ও তো ওখানকার । ইঁদুর পুড়িয়ে খায় ।

ইঁদুর রোস্ট করে বা রেঁধে তো অনেক দেশেই খায় । ওতে আবার খারাপ কিসের, আরশুলা, উচ্চিংড়ে, কুকুর, বেরাল, সাপ, ফড়িং, গুটিপোকা সবই খায় মানুষ । আমরা খাই না, তাতে কি ! আসলে ওরা একঘরে হয়ে থেকে গেছে উঁচু জাতের লোকগুলোর চাপে । কুচ্ছিত অবস্হা । কবে যে অবস্হা বদলাবে, কে জানে !

ওরা তো বিয়ে করে আর ছাড়ে । করেই না অনেক সময় । সতযুগ মানঝির কতগুলো ছেলেমেয়ে ও নিজেই জানে না । কিন্তু আপনি অমন একটা জায়গায় যাচ্ছেনই বা কেন ? প্রশ্ন করে অতনুর মনে হল ওইটুকু দুধ খাবার দরুণই এরকম একটা ব্যক্তিগত কথা জিগ্যেস করার অধিকার পেয়ে গেছে ও । দুধের সম্পর্ক গড়ে ফেলেছে ।

আমার এক নিকটাত্মীয় ওখানকার গান্ধী আশ্রমে মুসহরদের উন্নতির জন্য কাজ করেন ।

তাই বুঝি ? দুধের মাধ্যমে গড়ে ওঠা সুতোয় টান পড়ল অতনুর ।

হ্যাঁ । দ্বারভাঙ্গা কালীবাড়ি যাচ্ছি, তুমি যাবে ?

চলুন । ব্যাগটা উঠিয়ে নিল অতনু । ভাগ্যিস মোটরসাইকেল আনেনি ।

রিকশয়, ঠেসাঠেসি, দুধের মোহক গন্ধ পায় অতনু । রাস্তায় এতো গর্ত যে শক্ত করে হ্যাণ্ডল ধরে না থাকলে, ছিটকে পড়তে হবে মুখ থুবড়ে । রাজেন্দ্রনগর, মেছুয়াটুলি, মাখানিয়া কুঁয়া, হয়ে অশোক রাজপথে পড়ে । তারপর বাঁ দিকে বিশ্ববিদ্যালয়ের দ্বারভাঙ্গা বিলডিঙের গলি । চত্বরের ভেতরে গঙ্গার তীরে মন্দির । বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ার সময়ে মন্দিরের সিড়ির লাগোয়া ছিল গঙ্গা, এখন সরে গেছে অনেকটা । দ্বারভাঙ্গা বিলডিঙে ঢোকার মুখে গলিপথের দুপাশে মেডিকাল কলেজের যৌনরোগ চর্মরোগের বিভাগ । খুঁটিতে বাঁধা গোরু, হয়তো কোনো ডাক্তারের ।

ছাত্র ইউনিয়ানের নির্বাচনের সময়ে যে পাম গাছটায় বেঁধে অরবিন্দ অবস্হির মাথায় লোমনাশক লাগানো হয়েছিল, গাছটা এখনও তেমনি ঠায় । ইউনিয়ানের নির্বাচনে এখন আর অমন নিরীহ আক্রমণ হয় না, ছুরি-ছোরা তমঞ্চা-কাট্টা নিয়ে হয় ।

অন্ধকারে প্রাচীন মন্দির, কালচে ধরেছে দেয়ালে, পায়রা চামচিকে অবাধ, ফুল-পচা বেলপাতা শুকনো, রেড়ির তেলের গুমো গন্ধ । শাদা ধবধবে চুনকাম করা পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন মন্দির হলে বোধহয় শ্রদ্ধাভক্তি কমে যায় । মন্দিরে ঢোকার মুখে অতিগরিব ভিকিরি আর গরিব জুতোরক্ষক । জল-স্যাঁতসেতে পাথরের ঠাণ্ডা মেঝে । সিঁদুরমাখা হাড়িকাঠ, কখনও ছাগবলি হতো । পাকাদাড়ি প্রায়ান্ধকার বুড়োদের আদুলগা জটলা । ঝাঁপতোলা ঘোমটায় বিহারি বউ।

‘খুব জাগ্রত দেবতা, এই মন্দিরের ঘণ্টা আপনা থেকে বাজে, রাত আটটায়’, জানায় মানসী ।

অতনু উত্তর দ্যায় না ; বহুদিন ও আর সহপাঠীরা রাত নটা-দশটা পর্যন্ত গঙ্গার ঘাটে বসে আড্ডা মেরেছে । মন্দিরের দরোজা বন্ধ হবার পর কে যে ঘণ্টা বাজায়, জানে ও । চেয়ে-চেয়ে ও দেখছিল নিরন্তন পরিপূর্ণতায় উপচে-পড়া নর্দমা, কুলুঙ্গির মধ্যে শ্যাওলাপোশাক ঈশ্বরদের দুর্বল ভঙ্গি, নিরীহমুখ দেবতা, দালানে শুয়ে নিজের কুঁই-কুঁই উপলব্ধিকে প্রকাশে মশগুল কুকুর । একশো বছর আগে শেয়ালরা আসত, তাদের কাজ চালাচ্ছে শহুরে কুকুরেরা ।

‘খুব জাগ্রত, মাথায় জবাফুল রাখার পর যদি পড়ে না-যায়, তাহলে মনস্কামনা পূর্ণ হয়,’ মানসী বোঝাল ।

আপনার ফুল পড়ে ,না থাকে ? মেঝেয় রেক্সিনের ব্যাগটা রাখতে-রাখতে জানতে চাইল অতনু ।

পড়ে যাবে কেন ? থাকে । একবারও পড়েনি আজ ওব্দি ।

বাচ্চাটার স্বাস্হ্যের জন্যে কি মানত করেছিল মানসী বর্মণ ? কে জানে, জিগ্যেস করা উচিত হবে না, তার প্রাপ্যের দুতিন ঝিনুক দুধ তো ও নিজেই খেয়ে নিয়েছে ।

অন্ধকারে রেড়ির তেলের প্রদীপ জ্বালিয়ে কয়েকশো বছর ধরে দাঁড়িয়ে আছেন এককালের দ্বারভাঙ্গা মহারাজের পারিবারিক কালীপ্রতিমা । বোধ হয় দুধে-চিনিতে চান করানো হয় তাই মাথার ওপর ফুল রাখলে তা আটকে যায় । দর্শনার্থীরা একের পর এক ফুল চাপিয়ে, পুরুতকে টাকা দিয়ে, মনস্কামনা পুরো করার আগাম মিটিয়ে চলে যাচ্ছে । মানসী  ব্লাউজ থেকে ভাঁজ করা টাকা বের করে পুরুতকে দিল, হাত জোড় করে দেখে নিল প্রতিমার মাথার ওপর ফুল । অতনু দেখল নোটটা বুকের দুধে ভেজা ।

তুমি চাও না কিছু । দ্যাখো না । হয়তো ঝট করে অফিসার হয়ে যাবে ।

একটা করকরে নতুন নোট দিল অতনু, প্যাকেট থেকে তাসের মতন টেনে বের করে । পুরুত অভ্যস্ত হাসিমুখে ফুল চাপাল প্রতিমার মাথার ওপর । তক্ষুনি পড়ে গেল ফুলটা । মানসী গম্ভীর । গম্ভীর কাঁচুমাচু পুরুত । অতনু আবার প্যাকেট থেকে টেনে নতুন নোট দিল । পুরুত খোঁজাখুঁজি শেষে বাছে এমন ফুল যাতে পড়ে না যায়, বেশ কিছুক্ষণ প্রতিমার মাথায় ঠিক মতন গুছিয়ে রেখা হাত সরিয়ে নিল । পড়ে গেল ফুলটা । দর্শকদের গুঞ্জন আরম্ভ হয়ে গেছে অতনুকে ঘিরে । তিনবার ফুল চড়ানো যায় জানালো এক প্রৌঢ় গৃহস্হ । অতনু আবার দিল করকরে নতুন টাকা । পুরুতের থাত থরথর । ফুল পড়ে যায় । ভিড় জমতে থাকে অতনুকে ঘিরে । মানসীর ঠাণ্ডা অথচ ঘেমো হাত ধরে বাইরে আসে অতনু, হাঁটে গলিপথ ধরে দুজনে, চুপচাপ ।

এই কাঁপুনির সঙ্গে পরিচয় আছে অতনুর । জুলি-জুডির সঙ্গে বসবাস করে জেনে ফেলেছে যুবতী দেহে অরগ্যাজমের ঢেউয়ের কথা । মানসী বর্মণের অরগ্যাজম ঘটে গেল তিনবার ফুল পড়ে যাবার ঘটনায় । নারীর মানসিক দেহের রহস্য এখনও অতনুর কাছে অধরা, নিজেকে নিঃশব্দে বলল অতনু ।

প্রাঞ্জল রাজপথে পৌঁছে, যে-যার বাড়ি যাওয়াই, কোনো কথা না বলে, উচিত মনে করে । নভেলটি বুক ডিপোর বহুতল বাড়িটার কাছ থেকে রিকশয় তুলে দিল মানসীকে । রিকশয় চাপার আগে ওব্দি, ওর পাশে দাঁড়িয়ে কাঁপছিল মানসী, নিয়ন্ত্রণহীন । এমনকি হ্যালোজেন আলোয়, আবছা বেজে উঠছিল পায়ের মল । ওর কাঁপুনিতে কেমন যেন লুকিয়ে রেখেছে গোপন তথ্য, যেন অতনুর দুধ খেয়ে নেওয়া আর ফুল পড়ে যাবার মধ্যে দিয়ে সেই গর্হিত গোপনে পৌঁছে দিয়েছে কালীপ্রতিমার বোবা বার্তা ।

অতনু বোধ করছিল এক গোপন আনন্দ । বিজয়প্রাপ্তির গরিমা ছেয়ে ফেলছিল ওকে । অতনুকে দেখে ছুটন্ত ট্রাকগুলোর চক্ষুস্হির । খাজাঞ্চি রোডের মোড় থেকে পাটনা-সাহেবগামী অশোক রাজপথের অবস্হা ভালো নয় । পাটনা কলেজের সামনে রাজপথের মাঝখানে বিশাল গাছ, অশথ্থ গাছ কোথাও গজিয়ে গেলে কাটে না কেউ, কেন তা জানে না অতনু । রাজপথ খোঁদলে ছয়লাপ, প্রতি বৃষ্টিতে খোঁদলের ভাইবোনের সংখ্যা বেড়ে যায় । ওরা মিউনিসিপাল কর্পোরেশানের অবৈধ সন্তান । এগলি-ওগলি কোনো আগাম না জানিয়ে ঢুকে পড়েছে রাজপথে, এমন সদালাপী অন্ধকার । উষ্মাপ্রকাশে সদাব্যস্ত ডিজেল ধোঁয়া ।

অমনভাবে না কাঁপলে, কী এক অচেনা নির্বাক থরথরে আটক রহস্য, বাড়ি ওব্দি পৌঁছে দেবার প্রস্তাব দিত অতনু, দুধের গন্ধে মেশানো মানসীর পারফিউমের সুগন্ধের আয়ত্বাধীন রিকশয় পাশাপাশি বসে যেতে মানসীর ফ্ল্যাটে । আধুনিকতা নামের বিহারি কালখণ্দে সেঁদিয়ে, মানসী বর্মণের ঠিক কোথায় চিড় ধরেছে, আর কেনই বা, ঠাহর করতে পারছিল না অতনু ।

মায়ের ওষুধবড়ি আর ক্যাপসুলগুলো দিয়েছিল সামনের বাড়ির পদমদেও সিনহার ছোটো ছেলেটাকে, চেয়েছিল স্কুলের প্রোজেক্ট বানাতে চায় জানিয়ে, ও সেগুলো দিয়ে গণেশঠাকুরের মূর্তি তৈরি করেছিল কালো কাগজে ফেভিকল দিয়ে সেঁটে-সেঁটে । সেইন্ট জেভিয়ার স্কুল তার জন্য ওকে বেস্ট প্রজেক্টের পুরস্কার দিয়েছে, দেখিয়েছিল এনে । পুরস্কারের তুলনায় প্রজেক্টটাই মনে ধরেছিল অতনুর ।

নানা অগোছালো ভাবনা মগজে জেঁকে আসে, ঝরে পড়তে থাকে ছবির মতন । টি কে ঘোষ স্কুলের মোড় থেকে বাড়ির দিকে হাঁটতে থাকে, কীই বা করবে বাড়ি গিয়ে, হাঁটাই যাক । মহেন্দ্রু মোহোল্লা, ওর বাড়ি, বেশি দূরে নয় । বিশ্ববিদ্যালয় লাইব্রেরি, বিজ্ঞান কলেজ পেরিয়ে এগোয় । ব্যাগটায় কী আছে কে জানে ! দলিল-টলিল বোধহয় । মেঘলা রাতের গোলাপি আকাশ । সোঁদা গন্ধ উড়ছে বাতাসে । গান্ধি ময়দানে আরম্ভ হয়ে গিয়ে থাকবে বৃষ্টির অঝোর, শান্তি ফিরে আসছে বাতাসের আলোয় ।

কড়কড়াৎ শব্দ, চিড় ধরে গেল আকাশে । একাধ ফোঁটা টুপটাপের পরেই, অতর্কিত ঝমঝমাঝম । ভেজা যাক খানিক । কাঁধ কুঁচকে, প্যান্টের দু’পকেটে হাত ঢুকিয়ে, কনুইতে ঝুলছে রেক্সিনের ব্যাগটা, যদিও ওজন বোধহয় তিন কিলোটাক হবে, বাড়ি পৌঁছে, তালা খুলতেই, কাকাতুয়া দুটোর স্বাগতম শোনা যায় । বৃষ্টির তুমুলতায় বিদ্যুৎ সম্পর্কে একটা চাপা অহংকার ভাব । ব্যাগটা বেডরুমের খাটের তলায় ঠেলে দিয়ে, জানলা খুলে, জামা কাপড় ছাড়তে-ছাড়তে অতনু দেখল, পদমদেওবাবুর বাড়িতে ঢোল বাজিয়ে কীর্তন চলছে । শৈশব থেকে এই সমস্ত ধার্মিক জগঝম্প সয়ে গেছে ওর । জানলা দিয়ে দেখা যাচ্ছে, দেয়ালে টাঙানো ওষুধবড়ির ফ্রেমে বাঁধানো গণেশঠাকুরের পায়ের কাছে ধুপ গোঁজা । রাজা রবি বর্মার আঁকা হলে হয়তো গণেশঠাকুরের হাঁচি পেতো ধোঁয়ায়, এ তো ওষুধবড়ির দেবতা, হাঁচি-কাশির ওষুধবড়িও আছে হয়তো ওগুলোর মধ্যে ।

রান্না চাপাতে ইচ্ছে করছিল না । একটা ছোটো চরসের নরম সিগারেট তামাক মিশিয়ে টানতে-টানতে এসে যায় ঘুমনেশার আচ্ছন্নতা । তন্দ্রার শিথিল আহ্লাদে, মন কেমন করে ওঠে সুশান্তর জন্য । ভিনভাষী পঞ্চদশীর বুককে আদরযোগ্য করে তুলছে হয়তো বৃষ্টির নিরপেক্ষ হৃদয়হীনতায়, উপভোগ আর দুর্ভোগে ভাগাভাগি-করা দিয়ারা তীরের গ্রামীণ অন্ধকারে ।

আচ্ছন্নতায় ভেসে ওঠে মানসী বর্মণের বৃষ্টি ভেজা চুলের ঝাপট । জানলার কপাট বন্ধ করে বৃষ্টির ঝাপট সামলায় অতনু ।

 

অফিস যাবার সময়ে পদমদেওবাবুর ছেলেকে কাকাতুয়া দুটো নিয়ে গিয়ে দিল অতনু, কাকাতুয়া দুটো ছেলেটার সঙ্গে পরিচিত । কাল রাতে ওরা রামশীলা পুজনের কীর্তন গাইছিল । রামশিলা মানে একটা নতুন থানইঁট, লাল রঙের গামছার ওপরে রাখা । পদমদেওবাবুর বও মাথায় করে নিয়ে যাবে ইস্টিশান ওব্দি, তারপর সেখান থেকে রামভগতরা নিয়ে যাবে অযোধ্যা ।

কাকাতুয়াদুটো পেয়ে যাওয়ায় ওদের রামশিলা প্রোগ্রামে  ভাটা পড়ল বোধহয়, কেননা ওদের দেখাশোনার জন্য বাড়িতে কাউকে থাকতে হবে সব সময় ।

ধান ইঁট পুজো নিয়ে সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা হয়ে গেছে অনেক শহরে, কসবায় । নাথনগরের তনৌনি, সিমরিয়া, বিন্দু, বেলদরটোল গ্রামে চারশোজনকে মেরে ফেলা হয়েছে । চান্দেরির কুয়ো আর পুকুরগুলো ভেপসে উঠচে ফ্যাকাশে চোখখোলা লাশে, জলে এলোচুল ভাসিয়েছে মৃত যুবতী আর প্রৌঢ়ারা । কহলগাঁও গ্রামের ধনৌরা গ্রামে বিশাল উচ্ছৃঙ্খল ভিড়কে ছত্রভঙ্গ করতে গুলি চালিয়েছে সি আর পি । অন্ধকারে গচ্ছিত-রাখা বোমা-বারুদ নেমে পড়েছে চৌখণ্ডি, মণ্ডই, ভারতীগঞ্জ, কিল, বভনটোলার পথে-পথে । পাটনাতে থমথমে ভাবটা টের পাওয়া যাচ্ছিল না ।

অসীম পোদ্দার মারা যাবার পর দলের মধ্যে, সবাই এককাট্টা হলেই, টিমটিমে শোক ছেয়ে ধরে । অফিস বিলডিঙের পেছনের গলিতে তাড়ির দোকানটায় বসে ভাঁড় হাতে কেঁদে ফ্যালে কেউ-কেউ । অতনুর মনে হয় তাকে বাদ দিয়ে সমস্তকিছুই অস্বাভাবিক । অস্বাভাবিকতা বাদ দিয়ে চলতে পারেনা বিহার, অজাতশত্রু-অশোকের এই রাজ্য, বিহার, পাটলিপুত্রের হিংসা-দ্বেষ রয়ে গেছে উড়ন্ত হৈমন্তী বাতাসে । কংগ্রেসের রাজত্ব শেষ । যাদব-কুর্মি-দলিত-মহাদলিতের জটপাকানো রাজত্ব আরম্ভ হয়ে গেছে । অফিসের ইউনিয়ান আগেই চলে গেছে যাদব কব্জায়, চলছে ছিনাঝপটি । যাদব, মুসলমান, তফসিলী কর্মীরা একদিকে । ছেঁড়া-পচা নোটবদলের যে কাউন্টারটায় দালালদের কাছ থেকে উপরি সবচেয়ে মোটা, তাতে ম্যানেজমেন্ট পালা করে বসায় যাদব মুসলমান তপসিলি । ট্যুরে যায় যে ডিপার্টমেন্টের অফিসাররা, সেই বিভাগের পোস্টিং-এর জাতনির্ভর কোটা মেনে নিয়েছে অফিস-প্রসাসন । প্রায়ই অফিস গেটের বাইরে, সুলভ শৌচালয়-নিঃসৃত গ্যাসবাতিতে রক্তারক্তি ঘটছে ।

অফিসের মধ্যেই কারোর-কারোর পিঠে পিস্তল ঠেকানো হয়, দিশি তামাঞ্চা বা কাট্টা । বাইরে বেরোলে একচোট দেখে নেবার প্রস্তাব ।

বাঁকহীন চলে যাচ্ছে অতনুর জীবনপ্রবাহ । ব্রিটেনে আমেরিকায় একটা নোটের আয়ু সাত মাস ; নোটের ত্বক শ্বেতাঙ্গ থেকে কৃষ্ণাঙ্গ হলেই তার জীবন ফুরিয়ে যায় । এখানে তা তিন-চার বছর ; ফর্সা থেকে ধূসর থেকে কালো থেকে কুচকুচে হওয়া পযর্ন্ত ধুঁকিয়ে-ধুঁকিয়ে বেঁচে থাকে । অতনু সেই আয়ুকে কমাতে সাহায্য করে । নতুন চুল্লি বলে নোট পোড়াবার ধুম লেগেছে । শোনা যাচ্ছে চুল্লিব্যবস্হা বিদেয় করে শ্রেডার আনা হবে, কাগজের মণ্ড তৈরি করে তা থেকে আবার কাগজ তৈরি হবে ।

মোটর সাইকেলের পিলিয়নে বসে অরিন্দম একদিন অতনুর ফাঁকা বাড়িতে অফিসফেরতা এসেছিল, দু-ফুঁক চরস খাবার গোপন সদিচ্ছা নিয়ে । পাকানো সিগারেটে তামাক মিশেল দিয়ে বেশ কয়েকফুঁক টেনে ঘণ্টা দুয়েক এমন নিয়ন্ত্রণহীন হেসেছিল অরিন্দম যে, মনে হচ্ছিল আবার বুঝি ঘটল মগজের বেগড়বাঁই ।

‘জানেন তো মানসী বর্মণ রিজাইন করে চলে গেছেন ওরসলিগঞ্জের গান্ধি আশ্রমে কাজ করার জন্যে,’ নেশাচ্ছন্ন অরিন্দম, বিছানায়, পাশবালিশ টেনে, বলেছিল ।

–চলে গেছে ? কবে ? জানি না তো !

–আপনি এমন বলছেন যেন আপনার অনুমতি নিয়ে যাওয়া উচিত ছিল ।

–হ্যাঁ।  খবরটা শুনে ভেতরে-ভেতরে খারাপ লাগল । কবে গেছে ?

–গত মাসের পনেরো তারিখে । উনি বলেছিলেন জানাজানি না করতে ।

–ওয়ারিস আলি গঞ্জ তো নওয়াদার মারাত্মক জায়গা । মুসহররা থাকে । বিনোদ মিশ্রর নকশালদের মাওওয়াদি বনপার্টির গঢ় । একজন সুন্দরী আধুনিকা থাকবে কী করে সেখানে গিয়ে ! ওরকম জায়গায় গান্ধি আশ্রম করেটাই বা কী ?

–আশ্রম পরিচালক ওনার স্বামী ।

–স্বামী ? মানসী তো ডিভোর্সি !

–সব বানানো গল্প । লোক দেখানো । ওনার স্বামী এমবিবিএস ডাক্তার, বোধহয় বিলেত থেকে পাশ করা সার্জেন । ডাক্তারি করেন আর দলিত-মহাদলিতদের লোকেদের মধ্যে বিপ্লবের প্রচার । ওষুধ কেনার জন্য ভদ্রলোক পাটনায় আসতেন মাঝেমধ্যে, হয়তো ওনাদের গোপন মিটিঙের জন্যেও । বাচ্চাটা ওনারই । ননীদারাও গেছেন মানসী বর্মণের সঙ্গে, ওখানেই থাকবেন, বুড়ো বয়সে মুসলমান মেয়ে বিয়ে করে পাটনায় থাকলে গণ্ডগোল পোয়াতে হতে পারে, তাই ননীদা চলে গেলেন । ওখানে কেউ অত খোঁজখবর করবে না পারিবারিক ব্যাপার নিয়ে । আর, গান্ধি আশ্রম বলে কিছুই নেই ওখানে । আছে ডাক্তারখানা । মাওওয়াদি কমিউনিস্ট সেন্টারের ক্রান্তিকারী কিষাণ সমিতির অফিস ওটা । গান্ধি আশ্রমের একটা সাইনবোর্ড অবশ্য আছে বলে শুনেছি ।

–আপনি কী করে এত সব জানলেন ?

–উনি চলে যাবার পর জানতে পারলুম রসিক পাসওয়ানের কাছ থেকে ।

অতনুর মনখারাপ হয়ে যায় । পৃথিবীর কাজকারবার থেকে তাকে সত্যিই বাদ দিয়ে দেয়া হয়েছে । এরপর অরিন্দম যা বলে তাতে ওর মনে হয় ক্রমশ একলা হয়ে যাওয়াই ভবিতব্য ।

–আমি তো মিউচু৮য়াল করে কলকাতা চলে যাচ্ছি ।

অতনু তখন ভাবতে আরম্ভ করেছে, বছর সাতেক আগে পাটনার রাস্তায় এক শোকযাত্রা, বিপ্লবী ফরোয়ার্ড ব্লক নেতা বালমুকুন্দ রাহি আর চন্দ্রদেও যাদবের গলাকাটা মৃতদেহ নিয়ে মিছিল । ক্রান্তিকারী কিষাণ সমিতি তখন জমিদারি উচ্ছেদ শুরু করেছে,  অপরাধী জোতদারদের মৃত্যুদণ্ড দিচ্ছে জনআদালত, ভূমিহীনদের পাইয়ে দিচ্ছে জমিজমা । তখন, কানাই চ্যাটার্জি, অমূল্য সেনের মৃত্যুর পর, বিহারিত্বে পালটে গেছে বিপ্লব । ভাষার ক্ষমতাও যে এভাবে হস্তান্তরিত হতে পারে তা তখন আর এখনও ভাবেনি বাঙালিরা, যারা হয়তো বেশিদিন আর থাকতে চাইবে না বিহারের মাটি কামড়ে ।

–বুঝলেন অতনু, কলকাতায় চলে যাচ্ছি ।

–কিন্তু কেন ?

–এখানে থাকা যায় না । ওখানে গিয়ে ফ্ল্যাট-ট্যাট কিনব, দরকার হলে বিয়ে-ফিয়ে করব । এখানে থাকতে হলে হতে হবে সুশান্তর মতন ট্যাঁশ রাজা বাহদুর, নয়তো মানসী বর্মণের মতন বিপ্লবী, নয়তো আপনার মতন ইয়ে…

–রেণ্ডিবাজ ? ছাপোষা জীবন বেশ কঠিন এখানে তাই না ?

–কলকাতার লাইফই আলাদা ; টাটকাতাজা ফিলিং পাওয়া যায় ।

 

অরিন্দম চলে গেল বদলি হয়ে । রাঘব-রমা তো আগে থাকতেই রয়েছে কলকাতায় । যারা কলকাতায় চলে যায় তাদের সম্পর্কে আর কোনো খবর পাওয়া যায় না ; পাওয়া যায় যখন তারা খাপ খাওয়াতে না পেরে পাটকায় ফিরে পশ্চিমবঙ্গের শাসকদের গালমন্দ করে । অথচ বিহারের অনধিগম্য গ্রাম থেকেও নানা খবর আসে লোকমুখে । সুশান্ত নাকি নতুন বীজ আর খেতি আর্মভ করে উপজ বাড়িয়ে ফেলেছে, দিয়ারার জমি আর পড়ে থাকে না ; সরকারকে লেখালিখি করে পাকা রাস্তা, খাবার জল আর বিজলি আনিয়েছে নিজের এলাকা পর্যন্ত । আংরেজিতে লেখালিখি করলে সরকার নড়েচড়ে বসে ।

দলিত-মহাদলিত ছেলেমেয়েদের অক্ষরজ্ঞান দিতে দেখা গেছে মানসী বর্মণকে, গয়া জাহানাবাদ অওরঙ্গাবাদ নওয়াদার গ্রামে, বনপার্টির বন্দুকধারী যুবক-যুবতী থাকে ওনার পাহারায় । ননীদা সাইকেলে এ-গ্রাম সে-গ্রাম করে টাকমাথায় ভিজে গামছা বেঁধে ।

 

মাসকতক পরে অফিসে একদিন কি হ্যাঙ্গাম, বিপদসংকেতের পাগলা ঘণ্টি । বিপদ আপদ সন্ত্রাস ডাকাতি সামলাবার জন্যে অফিসে নানা জায়গায়  অ্যালার্ম ঘণ্টির বোতাম লুকোনো আছে । কাঁচের ঢাকনি ভেঙে বোতাম টিপলে সারা অট্টালিকা জুড়ে অবিরাম বাজতে থাকে মাথা-ধরানো পাগলা ঘনহতি । ন-মাসে ছ-মাসে একবার করে মহড়া হয় । বহুক্ষণ বাজছিল বলে আশঙ্কা করা গেল যে আজকেরটা রিহার্সাল নয়, আসল । বাইরে বেরোবার আর ঢোকবার শাটার গেট দরোজা বন্ধ হয়ে গেল দ্রুত, তাক করে বসে গেল বন্ধুকধারী সরকারি সেপাইরা, স্যুট-টাই পরা কর্তাদের হন-হন গট-গট, চেয়ার থেকে মুণ্ডু বের করে হাফ-কেরানি আর কেরানিদের কচাল । ঘণ্টাখানেক পর অলক্লিয়ার ঘণ্টি বাজলে জানা যায় ব্যাপারটা । একজন অফিসার, যিনি জোড়াতালি দেয়া নোট একটা-একটা করে পাস করেন, তিনি বাজিয়েছিলেন ।

ছেঁড়া-জোড়াতালি নোটবদলের কেরানির খাঁচার পেছনে ওই অফিসারের টেবিল । পাবলিক-দালালরা নোটের লট দ্যায় কেরানিকে । কেরানি নিজের খাতায় নথি করে দ্যায় অফিসারকে । তক্ষুণি বদলযোগ্য হলে অফিসার নোটের ওপর সই-তারিখ দিয়ে পাঠান হাফ-কেরানির কাউণ্টারে । সেখানে টোকেন দেখিবে নতুন নোট পেয়ে যায় পাবলিক । এই দুটো কাউণ্টারে বসার জন্য তুমুল হয় কর্মীমহলে ।

অফিসার আপন মনে জোড়াতালি নোট পাস করছিলেন প্রতিদিনের ঘানির বলদের ঢঙে । আচমকা একটা নোট হাতে নিয়ে তিনি স্তম্ভিত । নোটটা তিনি নিজেই বছরখানেক আগে ছাপ সই-তারিখ দিয়ে পাস করেছিলেন । এটা তো পুড়ে নষ্ট হয়ে যাবার কথা । বাজারে গেল কী ভাবে ! তার মানে পোড়াবার চুল্লিতে পৌঁছোবার আগেই মাঝপথে মেরে দিয়েছে কেউ । কোনও কর্মী নিশ্চয়ই করেছে কাজটা । একটা যখন সরিয়েছে তখন আরও অনেক সরিয়েছে নির্ঘাৎ । তার মানে অন্তত এক বছর যাবত চলছে চুরিচামারি । তার মানে একজন মাত্র নয়, অনেকে জড়িয়ে আছে, কেননা নোটটা তো নানা ধাপ হয়ে পুড়তে যায়, সেই ধাপগুলোয় যারা আছে তাদেরও হাত আছে । মগজের ভেতরে দ্রুত ছবি গড়ে উঠছিল ওনার ; তাঁর পাস করা নোট বলে আরও বেশি আতঙ্কিত বোধ করছিলেন অফিসার । যে লোকটা নোটটা দিয়েছিল, ধরতে হবে তাকেই, তাকে ধরলে পুরো সুতোর গোলাটা বের হয়ে আসবে । ভয়া গলা শুকিয়ে যায় ওনার । কপালে বিনবিনে ঘাম । পেপারওয়েট দিয়ে কাঁচের ঢাকা ভেঙে বাজিয়ে দিলেন পাগলা ঘণ্টি । খদ্দেরটা ছিল ঘোড়েল । নজর রেখেছিল । পাগলা ঘণ্টির প্রথম রেশটা উঠতেই হাওয়া ।

পুলিশে খবর দেয়া হল ।

ওই নোটটা যেদিন পুড়ে যাবার কথা, সেদিন কাদের ডিউটি ছিল চুল্লিতে, তাদের নাম রেজিস্টার থেকে বের করে, প্রথমে একজন চতুর্থ শ্রেণির কর্মীর বাড়ি হানা দিয়ে পুলিশ আরও কিছু অমন নোট পেল । তাকে উত্তম-মধ্যম আদরের পর পুলিশ জানতে পারল চুল্লির জানালা দিয়ে মুণ্ডু ঢুকিয়ে, চুল্লির আগুনে ফেলবার বদলে, নিজের গেঞ্জির ভেতরে ঢুকিয়ে নিত প্যাকেট । ছ্যাঁদা-করা নোটের প্যাকেট হলে বদলে নিত নোট পরীক্ষক অসীম পোদ্দারের কাছ থেকে । নিজের সেকশানে আস্ত প্যাকেটের সঙ্গে ছ্যাঁদা-করা নোটের প্যাকেট পালটে নিত অসীম । কারোর সন্দেহ হতো না, কারণ আস্ত নোট ছ্যাঁদা করানোর কাজটা অসীমেরই ছিল ।

অসীমের বন্ধুবান্ধবদের একে-একে জেরা করা আরম্ভ হল । মৃত অসীম সম্পর্কে ক্ষুব্ধ হয়ে উঠেছিল ওর দলের সবাই । দাশগুপ্ত মারা গিয়ে যা দিয়ে গেছেন, সেটাই তো যথেষ্ট ছিল, তবে ? অতনুরও জেরা হল ।

–আপনার নাম অতনু চক্রবর্তী ?

–হ্যাঁ ।

–মহেন্দ্রু মোহোল্লায় থাকেন ?

–হ্যাঁ ।

–নিজেদের বাড়ি ?

–হ্যাঁ ।

–বাবা-মা কেউ নেই ?

–হ্যাঁ ।

–বাবা মারা যাওয়ায় চাকরি পান ?

–হ্যাঁ ।

–বাবার প্রভিডেন্ট ফাণ্ড গ্র্যাচুইটির টাকা স্টেট ব্যাংকে ফিক্সড ডিপোজিটে জমা আছে ?

–হ্যাঁ ।

–একটু-আধটু নেশা করেন ?

–হ্যাঁ ।

–অসীম পোদ্দারের সঙ্গে নালান্দা আর শোনপুর মেলায় গিয়েছিলেন ?

–হ্যাঁ ।

–একটু-আধটু মাগিবাজি করেন ?

–হ্যাঁ ।

–জুয়া খেলেননি তো কখনও ? তাস, ঘোড়দৌড় ?

–হ্যাঁ ।

–বিয়ে করেননি কেন ?

–প্রস্তাব আসেনি ।

–রান্নাবান্না নিজেই করেন ?

–হ্যাঁ ।

–নোট না গুণেই পোড়াতে পাঠান ?

–হ্যাঁ ।

–ঠিক আছে, যেতে পারেন ।

 

বাড়ি পৌঁছে, খাটের তলা থেকে মানসী বর্মণের দেয়া রেকসিনের ব্যাগটা টেনে ধুলো ঝেড়ে, জিপ খুলতেই অতনু স্তম্ভিত । ঠাইক যা অনুমান করেছিল । অগোছালো নোটে ঠাসা । আস্ত নোটের ভেতরে গোঁজা অসীম পোদ্দারের ডায়েরি । পাতার পর পাতা মানসী বর্মণকে লেখা প্রেমপত্র । যৌনরোগ বা যৌনস্বেচ্ছাচার থেকে পাওয়া রোগ আর সারবে না, তাই শেষ প্রেমপত্র লিখেছে, জানিয়েছে শেষ চিঠিটায় ।

অতনুর অজান্তে তাকে বিসদৃশ ষড়যন্ত্রে জড়িয়ে দিয়েছে সবাই, খেলা করেছে ওর ইনোসেন্স নিয়ে । ওর কাঁধের ওপর একটা ব্যথা উঠে কোমর বেয়ে পায়ের গোছে নেমে যায় । বুকের তীব্র ঢিপঢিপে অসুবিধে হয় শ্বাস নিতে ।

কীভাবে গতি করবে এই রহস্যেঘেরা দায়িত্বের ? কীই বা উদ্দেশ্য ? মায়ের ছোটো-ছোটো ঠাকুরদেবতা এর মধ্যে পুরে গঙ্গা ব্রিজ থেকে ফেলে দেয়া যায় নদীতে । সুশান্তর কাছে চলে যাওয়া যায় ফিরৌতির টাকা দিতে । আনিসাবাদে বাড়ি উঠে যেতে পারে শেফালির । প্রয়োজনীয় অস্ত্র যোগাড় হয়ে যাবে রসিক পাসওয়ানের । ছোটোখাটো গ্রামীণ হাসপাতাল হতে পারে ওয়ারিস আলি গঞ্জে । আজীবন সুখে থাকা যায় জুলি-জুডির সঙ্গে । এতগুলো বিকল্প থেকে যে-কোনো একটা বেছে নেয়া শক্ত ।

দুশ্চিন্তা, তাও অহেতুক, অন্যের চাপানো, কাহিল করে রাখে অতনুকে রাতভর ।

ভোরবেলা, প্রথম বাস ধরার জন্যে, ধুতি-পাঞ্জাবি-চটিতে রূপান্তরিত অতনু, ব্যাগ সঙ্গে নিয়ে, রিকশ চাপে, বাঁকিপুরে দূরপাল্লাগামী বাস ডিপোর উদ্দেশে ।

কোনও একটা, যে-কোনও একটা, বিকল্পগুলোর মধ্যে থেকে বেছে নিতে হবে ।

———————————————————————————————————————————————

( পরের পর্ব আছে ‘জলাঞ্জলি’ উপন্যাসে )

 

 

 

 

Leave a comment

Filed under উপন্যাস

Leave a comment