Monthly Archives: March 2015

উৎসর্গ : বাবা শ্রীরঞ্জিত রায়চৌধুরীর স্মৃতির প্রতি শ্রদ্ধায়

Leave a comment

Filed under উপন্যাস

এক

লাশগুলোকে নামানো হচ্ছিল হোসপাইপ কেটে থামানো পাটনামুখো দরোজা-জানলাহীন, টয়লেটের পাল্লাহীন গয়া প্যাসেঞ্জারের অন্ধকার লাগেজ ভ্যান থেকে, একের পর এক আদুল-গা তামাটে পুরুষের পেশিদার শরীর, মহিলাদের ঘোমটামোড়া দেহ, ঠাণ্ডা কাঠ, পূণ্যলাভের জন্য পুড়তে যাবে গঙ্গায়, আর এই লেভেল ক্রসিং থেকে একটু দূরত্বে, রাস্তার ধারে ফোলডিং চেয়ার-টেবিল সাজিয়ে, ল্যাম্পপোস্টের তলায় বসে স্বাভাবিক মৃত্যুর প্রমাণপত্র দিয়ে চলেছে পাটনা মিউনিসিপাল কর্পোরেশানের পাকাচুল কদমছাঁট চশমাচোখ ডাক্তার সুনীলরঞ্জন নাহাবিশ্বাস ওরফে বিসওয়াসজি, শ্মশানঘাট কাছেই বলে, প্রতিদিন সন্ধ্যার টিমটিমে বিজলি আর কেরোসিন লন্ঠনের আলোয় ফুলকো মেলার জমজমাট ভিড়, আগেভাগে তৈরি তাদের বাঁশের মাচান, ফুল, শাদা আর গোলাপি থানকাপড়, ঠ্যালা, রিকশা, ট্যাকসি, ধুপ, সিঁদুর, খুচরো টাকা পয়সা, খই-বাতাসা, কাতাদড়ি, নাইলন দড়ি, মাটির কলসি । ফিক্সড প্রাইস । কাউকে দরদস্তুর করতে হয় না । বিহারি সংস্কৃতির মড়া পোড়ার যাকিছু ।

পাটনা-গয়া লাইনে দাঙ্গা বা জাতপাত-মারকাট হলে, যখন লাশের সংখ্যা বেড়ে যায়, লেভেল ক্রসিং পেরোতে ঘণ্টাখানেক লেগে যায় । ট্রেনটার কোনো বরাদ্দ সময় নেই থামার । যতক্ষণ লাশ ততক্ষণ আশ । লেভেল ক্রসিং ছেড়ে প্রচুর সময় লেগে যায় ট্রেনটার, স্টিম এনজিনের ভোপ্পোর ভোঁ কয়লাচুরো উড়িয়ে, কিংবা ডিজেল এনজিনের গরম হলকার ধোঁয়া ভাসিয়ে । বর্ষাকালে জলে ডোবা রাস্তা, গ্রীষ্মে জ্যাম, শীতে শবযাত্রীর শিকারে সস্তার রাঁঢ় ।

মোটর সাইকেলে বসে যখন বিরক্তি উথলে উঠছিল, ট্রেনটার যাবার অপেক্ষায়, পাশেই এক যুবক হাতি, পেছনের বাঁ পা জিরেন দিচ্ছিল শ্রীকৃষ্ণের কায়দায়, নীহারিকার বর্ণালী থেকে তখন সবে হেমন্ত নামছে স্হানীয় পৃথিবীতে, অদৃশ্য কানামাছি-ওড়ানো শুঁড়ের ধাক্কায়, যেন বিদ্যুৎ দিয়ে গড়ে নরম মাংস, ঘুরে যায় মুণ্ডু, চকিতে হাজার সর্ষেফুল ফুটে উঠে মিলিয়ে যায়, তারপর গলায় চোঙবাঁধা অবস্হায় নিজেকে খুঁজে পায় সুশান্ত, হাসপাতালে, সরকারি রাজেন্দ্র ব্লকের শতচ্ছিন্ন গয়ের রক্ত পুঁজ মাখা বিছানায়, মাছির দল তার ঠোঁটে বসে ঘুমজাগানিয়া চালিশা শোনাচ্ছিল । হাসপাতাল, তায় সরকারি, পটল অবধারিত জেনে, একহাতে নলসুদ্দু স্যালাইনের বোতল ঝুলিয়ে বাড়ি কেটে পড়েছিল ও, সুশান্ত, রিকশায় চেপে । বাড়িতে ধুদ্ধুমার । অনেককাল লেগে গিয়েছিল সারতে । থানায় গিয়ে মোটর সাইকেলটা নিয়ে এসেছিলেন সুশান্তর বড়োজ্যাঠা, হাতে-টানা ঠ্যালায় চাপিয়ে ।

বিছানায় শুয়ে, গলায় চোঙবাঁধা, কড়িকাঠের দিকে তাকিয়ে, কাকার কাছ থেকে জানতে পেরেছিল সুশান্ত, ওই পালোয়ান হাতিটায় চেপে ইন্দিরা গান্ধি গিয়েছিলেন আক্রান্ত গ্রামের মানুষদের সান্ত্বনা দিতে । এগারোজন তফশিলি মানুষের সাফায়া করে দিয়েছিল পিছড়াবর্গের কুরমি জাতের মহাবীর আর পরশুরাম মাহাতো, যাদের পরে ফাঁসি হয়েছিল । সীতারাম মাহাতো, সিরি মাহাতো, রামকিশুন মাহাতো, রাজেন্দর মোচি, নেপালি, সিমন, বলদেও আর কেশব মাহাতোর কুড়ি বছরের জেল । কিন্তু কালীচরণ, দাসো পাসোয়ান, রামচন্দর মোচি, মহাবীর মাঝি, শ্রবণ পাসওয়ান, রাজো পাসওয়ানদের  প্রতি একজন মৃত প্রধানমন্ত্রীর বিশ্বাসভঙ্গের আক্রোশ হাতিটা চাপিয়ে দিলে ওর, সুশান্তর, ঘাড়ে !

মুচি মাল্লা শুঁড়িদের হাতে যে-সব দেড়-দু একর জমির কাগজ ধরিয়ে দেয়া হয়েছিল, তার মালিক ওই কুরমিরা জেল থেকে তেল, কাপড়, চিনি, টাকা ফি মাসে পাঠাচ্ছে নিজের নিজের বাড়ি ; জমি কেনাকাটা চলছে, অথচ মুসহর দুসাধ চামার আর তেলিরা সুযোগ পেলেই গ্রাম ছেড়ে পাটনা, জ্ঞাতি খুঁজেপেতে কলকাতা । গ্রামে একটা পুলিশ ফাঁড়ি বসিয়ে কর্তাবাবারা নিশ্চিন্ত ।

বেলছির পর যখন পারসবিঘায় গোলমাল হল, লাগেজ ভ্যান থেকে লাশ নামাতে সময় লেগেছিল বেশ, মনে আছে সুশান্তর । রামাশিষ, হরিভগত, শ্যামনারায়ণ প্রসাদ, রামস্বরূপ, সিয়ারাম, কিসমিসিয়া দেবী, হরমণিকুয়ারি, গুলাবিয়া দেবী, পতিয়া দেবী, আর শ্যামপেয়ারিদের জলজ্যান্ত পুড়িয়ে মেরেছিল নিরঞ্জন শর্মার ছোটো ভাই মদন শর্মা । তারপর থেকে ভূমিহার আর নিচুজাতের খুনোখুনি । খুনোখুনিতে ঝামরে নষ্ট হয়ে গেছে সবুজ গ্রামের পর সবুজ গ্রাম । এই সব গ্রামে রোদ্দুরেরও শীত করে । কনসারা, দরমিয়া, নোনহি-নগওঁয়া, মলবরিয়া, দনওয়র-বিহটা, মিনবরসিমা, বারা– উড়ন্ত ধুলোয় মানুষহীন প্রান্তর, সাপের পালিয়ে যাওয়ার চেয়ে সন্দেহময় শুকনো পাতায় পদক্ষেপ । লেঠেল-ঘেরা পাকা ধানের খেত । পাড়ভাঙা যেমন নদীর মুদ্রাদোষ, তেমন সুশান্তর এই লাশ-নামানো-মেলা দেখা, মাঝে-মধ্যে সান্ধ্যকালীন নেশা ।

সুশান্তর চেহারা অবাঙালি । পাঁচফুটের ফর্সা গালফোলা ঘাড়েগর্দান কোঁকড়াচুল চনমনে । গলায় চোঙ বেঁধে হালকা কাজের বিভাগে কিছুকাল কাটাবার পর পৌঁছেছিল অতনুদের ত্যাঁদড়া-কর্মী বিভাগে । ঘোষ বলে অফিসে জাতপাতের বিভাজনে ও দুধিয়া ঘোষ, মানে গয়লা, যাদব, বিহারি যাদব কর্মীরা নিজেরাই ওকে কৃষ্ণায়ত যাদব বানিয়ে দিয়েছে, কংসায়ত যাদবে ফ্যালেনি । অথচ মুঙ্গেরের পিপারিয়ে গ্রামে, যেখানে ওদের প্রচুর জমিজমা, ঘোষ হবার দরুণ সেখানে যাওয়া, ফসল তোলানো, এতোয়ারি হাটের খাজনা তোলা সব বন্ধ । বাবার ঠাকুর্দা, মানে ঠাকুর্দার বাবা, হাইকোর্টে, তখন কলকাতা হাইকোর্টে মামলা লড়তে যেতে হতো, ভূমিহার রাজনাথ সিংকে ফৌজদারি মামলায় জিতিয়ে দেয়ায়, মুঙ্গেরের রোমহর্ষক দিয়ারায় দুশো একর জমি, আর সাত একর আনাজ-বাগান, আর এতোয়ারি হাট ওর ঠাকুর্দার নামে করে দিয়েছিল । সুশান্ত যায়নি কখনও পিপারিয়ে । ছোটোবেলায় চাল মুসুর অড়র ভুট্টা সর্ষে পটল কচি তরমুজ আম আর হাটের টাকা আসত । তারপর ওখানে  কৈলু যাদব, কজ্জল ধানুকদের অপহরণের দল এমন জ্বালাতন আরম্ভ করলে যে সেসব জমিজমা এখন কাদের হাতে তা শুধু কানাঘুষায়, কোনো যাদব ছিটকে পাটনায় এলে, তার মুখে ভাসাভাসা জানা যায় । বাংগালি-তাংগালি বলে, সুশান্তরা আর সেখানে পাত্তা পায় না । লোকমুখে প্রচারও করে দেয়া হয়েছে যে কোনো বাংগালি ঘোষবাবু এলে তার মাথা ধড় থেকে আলাদা করে দেয়া হবে।

দিয়ারা, দ্বীপের মতন গঙ্গার চর, জেগে ওঠে, থাকে বছরের পর বছর, বেগুসরায় মুঙ্গের থেকে নদীর কিনারে-কিনারে ভাগলপুর কাটিহার ওব্দি । এক জায়গায় ডুবে আরেক জায়গায় কুমিরের পিঠের মতন ভেসে ওঠে অনেক সময়ে, খেলা করা অজস্র মানুষের সুখশান্তি নিয়ে, তাদের দুর্ধর্ষ ক্রুর মমতাহীন আতঙ্কিত করে রাখে আজীবন, ভালা বরছি গঁড়াসা ভোজালি পাইপগান কট্টা তমঞ্চা দিয়ে । ঢেউরা দিনেরাতে হাসি বিলোয় ।

মেদিনি পুলিশফাঁড়ির সুরজগড়হার কাছে হুসেনা গ্রামের পালোয়ান, কোমরে ঘুনসি, গলায় তাবিজ, থলথলে বুক আর উরধ, কদমছাঁট অধিক যাদব, দুধ বিক্রির ফাঁকে, কিষান-কামিলের নূনতম মজুরির মজুরি আন্দোলন পিষে ফেলার লেঠেল হিসেবে জোতদারেরদের স্যাঙাত থাকতে-থাকতে নিজেরাই আরম্ভ করে দিলে জোরজবরদস্তি জমিজমার দখল নেয়া, কানপুর থেকে চটের থলেতে আসত পিস্তল কারতুজ হাতবোমা দোনল্লা একনল্লা, খড়ের গাদায় লুকোনো, পালতোলা নৌকোয় । সামহো-সোনবরসা কুরহা দিয়ারায় গোটাকতক চাষি ট্যাঁফোঁ করলে, তাদের ডান হাত কেটে গঙ্গায় । নিজেদের হুসেনা গ্রামে পুলিশের ওপর কয়েক ঝাঁক গুলি চালিয়ে ভাগাল । তারা আর ওমুখো হয়নি । মেদিনি ফাঁড়ির পুলিশ ইন্সপেক্টর যতীন্দ্রনাথ সিং ছ’জন কন্সটেবলের শং্গে যখন ওদের কাছে আত্মসমর্পণ করলে, অধিক যাদব গঁড়াসা দিয়ে চারজনের ভুঁড়ি ফাঁসায় । লাশ নদীতে আর বন্দুকগুলো নিজেদের কব্জায় । পেট চিরে মারাকে শিল্পের পর্যায়ে তুলেছিল । পেট চিরে পূণ্যসলিলা গঙ্গায় ফেলেছিল আরও অনেককে, টুকরো-টুকরো, যেমন পাঁঠার দোকানের মাংস, বেশিরভাগ সীমান্ত চাষি, যেমন অঙ্গদ যাদব, এতোয়ারি মাহাতো, ডুকো মাহাতো, দেবেন মাহাতো, সুধীর মাহাতো । অধিক যাদব মরলে, ওর রাজ্যপাট যায় কৈলু যাদবের হাতে, সে পিপারিয়ে গ্রামের অমৃত যাদবের ছেলে । সুশান্তদের গরদানিবাগের বাড়িতে অমৃত যাদব একবার এসেছিল, চার বছরের খালি-গা ধুলোমাখা কৈলুকে নিয়ে ।

লখন তাঁতিকে, পুলিশের মুখবির, মানে চর সন্দেহে, কেন তাড়িয়ে-তাড়িয়ে গ্রামবাসীদের চোখের সামনে থেঁতো করে মেরেছিল কৈলু, অফিসের একজন পিওনের কাছে, যে অবসর পাবের পর প্রভিডেন্ট ফাণ্ডের কিছু টাকায় কিনে, কোনও এক কমবয়সী তরুণীকে বিয়ে করেছিল, তার কাছ থেকে জানতে পেরেছিল সুশান্ত । পরে, মুখ্যমন্ত্রীর মধ্যস্হতায়, কৈলু যাদব আর ওর প্রতিবেশী দুলারচন্দ্র যাদবের সন্ধি হলে, অপহরণের ব্যবসা আরমভ করে কৈলু । দিয়ারা থেকে দূরে-দূরে ছড়িয়ে পড়ে ব্যবসার আওতা, পাটনা রাঁচি মজফফরপুর লখনউ কানপুর এমনকি দিল্লির রাস্তা থেকেও তুলে আনতে পেরেছিল রওনক আগরওয়ালকে । কৈলুকে সাফায়া করার জন্যে সরকার ‘অপারেশান কোবরা’ চালু করলে, সেই যে ও গা ঢাকা দিয়েছে, খুঁজে পাওয়া যায়নি আজ পর্যন্ত ।

কৈলুর জায়গা দখল করেছে কজ্জল ধানুক, আর ধানুকদের নরকে যাওয়া উচিত হবে না ভেবে সুশান্তর বাবা কাকা জ্যাঠারা আর নিজেদের জমিজমা খেতখামার চাষবাস হাটের আয় ইত্যাদির কথা ভুলে গিয়ে ও-মুখো হননি । পিপারিয়াতে ওরা বাংগালি যাদব । বারোটা যাদব বাচ্চাকে একদিন দুপুরে বরছি-ভালা দিয়ে ছিন্নভিন্ন করেছে কজ্জল ধানুক, শুনেছেন ওনারা লোকমুখে । ধানুক বিন্দ আর ভূমিহার এখন একদিকে, যাদবরা অন্যদিকে । লছমিপুর-তৌফির দিয়ারায়, বদলা নেবার জন্যে, গঙ্গার ওপর থেকে ভেসে গিয়ে শীতের কুয়াশা যখন ঘিরে ধরেছে কুঁড়েঘরগুলোকে, যাদবরা দল বেঁধে হামলা করে বিন্দ বাচ্চা বউ বুড়োদের আস্ত রাখা অনুচিত ভেবেছিল ; বিন্দ জোয়ানরা বেঁচে গিয়েছিল কেউ কেউ, অন্ধকারে পিটটান দিয়ে ।

 

ঘন সবুজ কচি আমের থুতনিতে হাত দিয়ে আদর করছিল একটা প্রৌঢ় আমপাতা । গাছের প্রায়ান্ধকার গোড়ায়, আধভিজে উইপোকার মেটেরঙা দেউড়ি । মিহিন আবেগপ্রবণ বিকেল-বাতাস বেড়াতে বেরিয়েছে গোধুলী-বাতাসের সঙ্গে হাত ধরাধরি করে । আকাশে দীঘল ফোলাফোলা মেঘ । অনেক দূরে, ওই দিকে, একাধটা ঠুনকো বিদ্যুতের অদৃশ্য আওয়াজ । এখন রূপসী মর্জির বিকেল । অল্পবয়সী খেটে-খাওয়া কয়েকটা কাক চলে গেল দক্ষিণ থেকে উত্তরে । একটু আগে সামনের ছাতিম গাছে যে-চড়াই পাখিগুলো স্হূল রঙ্গরসিকতায় মশগুল রেখেছিল নিজেদের, তারাও এখন ডানা গুটিয়া ঠোঁট গুঁজে চুপচাপ । রাস্তার ওপারে ধনী আর উদার কাঁঠালগাছ । রোদ্দুর বোধহয় গাছের ছায়া মাড়ায় না এ অঞ্চলে । চারিদিকের এমন অতীন্দ্রিয় জগতের আভাস পেয়ে ছোটোখাটো গোলগাল নুড়ির দল উদাসীন শুয়ে আছে কালভার্টের তলাকার ছিপছিপে নালার কিনার বরাবর ।

কালভার্টের ওপর বসে, ধূসরিত কাহিল পা ঝুলিয়ে, আনমনে এইসব দেখছিল অতনু । যে লজঝড়ে বাসটা পাটনা থেকে ভোর পাঁচটায় ছেড়েছিল, তা থেকে এই অজ দিগন্তে নেমে পড়েছে ও । সৌন্দর্য সৃষ্টির আকুতিতে মগ্ন  আসন্ন বিকেল-গোধূলির স্নেহময় আকাশ, বাসের জানালায় থতমত বাতাস, বাধ্য করেছিল ওকে এইখানে নেমে পড়তে । সেই তখনই জড়সড়ভাব এসে গিয়েছিল স্হানীয় রোদ্দুরের । একটু পরেই কেয়ারি-করা অন্ধকার গজিয়ে উঠবে ওর চারপাশে, তখন পথ, চলার পথ, দেখা যাবে না বলে হাঁটতে আরম্ভ করবে ও, অতনু । জঙ্গলের কালচে সবুজ মহাফেজখানা পেরিয়ে, গ্রামটা ওইদিকেই ।

ময়লা বলতে যা বোঝায়, অতনুর গায়ের রঙ তার থেকে এক পোঁচ ফর্সা । দু-চোখ প্রায় সব সময় বরফের বুদবুদ, ভেতরে ভেতরে উসখুসে নদীর মুখচোরা স্রোত । গত অঘ্রাণে তেইশে পড়েছে । নোংরা জামা-কাপড় । টো-টো বেড়ানো চটজলদি পিচপথের ধূসর গন্ধমাখা কোলহাপুরি । হাতঘড়ি পরার অভ্যাস, চুড়ি-চুড়ি মনে হয় বলে, আর সময়ের বাদবিচার না-থাকায়, নেই ওর । এই বয়সেই চুলের কিছুটা চিলতে, ডান ঘেঁষে, পেকে গেছে, দুশ্চিন্তায় নয়, চিন্তাহীনতায় । কখনও যেচে আলাপ করে না, কারোর সঙ্গে অতনু । কম কথা বলে । অনেকক্ষণ টানা কথা বলতে পারে না । খেই হারিয়ে যায় । কথা বলতে-বলতে ওর মনে হয়, এঁর সঙ্গে এসব আলোচনা করার মানে হয় না । তরুণীদের এড়িয়ে চলে । কেউ ওর সঙ্গে কথা বললে, ওর তার সংক্ষিপ্ততম জবাব দ্যায়, হ্যাঁ, না, ও, আচ্ছা, তাই বুঝি, ঠিক আছে, চলি ।

অতনুর হাতে মানসী বর্মণের গচ্ছিত রাখা বাদামি নরম ফোম রেকসিনের ব্যাগ । কয়েক লক্ষ টাকার নোংরা-হাফনোংরা নোট, আর অসীম পোদ্দারের ডায়েরি আছে তাতে । টাকাগুলো তেকচিটে আধমরা অসুখী । ডায়েরিতে স্বীকৃতি আছে যৌন যথেচ্ছাচার থেকে কুড়োনো রোগের । ব্যাগে টাকার ডাঁই আবিষ্কারের সঙ্গে সঙ্গে , রাত্তিরেই, খাটের তলা থেকে টেনে স্তম্ভিত, এই বেরিয়ে পড়ার নির্ণয় নিয়ে ফেলেছিল ।

দূরের ক্ষণজন্মা বিদ্যুৎগুলো এবার ফুরিয়ে গেছে । মেঘের হাত ধরে ছোটো-ছোটো তারারা গুটিগুটি পায়ে আসছে ওই সংসারে । আলুথালু পোশাক সামলে ঘরে ফিরছে বকযুবতী । একটা লরি চলে গেল হেডলাইটের শানবাঁধানো আলো জ্বেলে । গলা শুকিয়ে ধু-ধু করছিল বলে, এবার উঠে দাঁড়াল অতনু । আনমনা হয়ে উঠেছে চারপাশের বর্তমান । বহুক্ষণ বসে থাকার দরুণ ঠ্যাং দুটি ভঙ্গিসর্বস্ব । আড়মোড়া ভেঙে কিছু-ভারি ব্যাগটা তুলে কাঁধে ঝুলিয়ে নিলো । উদ্দেশ্যহীন জীবন হয়তো এবার প্রহেলিকাময় হবে । জীবনের মোড় পালটাবার জন্যে তার সামনে বেশ কয়েকটা বিকল্প থেকে যে-কোনো একটা বেছে নিতে হবে ওকে । ক্ষুধা আর স্বার্থের বাইরে জীবনযাপন আছে কি, যেখানে বেঁচে থাকার জন্যে কোনো চাবিকেন্দ্র চাই না !

যদিও ওরা দেশভাগের উদ্বাস্তু নয়, অতনু কো০নো রাজ্যের ভূমিপুত্র হতে পারেনি, তার জন্য দরকার কোনো জায়গায় ন্যুনতম থাকার প্রমাণপত্র ্র বাবার ছিল না স্হির সাকিন আর ঠাকুর্দার ছিল না স্হাবর ধানপাটের তৌজি-মৌজা । কেউই কোথাও থাকেননি বেশিদিন । শেকড় গজিয়ে ফেলতে ভালো লাগত না ওনাদের । সত্যি, একই বাড়িতে, একই পাড়ায়, একই শহরে, একই লোকজনের মাঝে, মাসের পর মাস, ঋতুর পর ঋতু, বছরের পর বছর, কাটিয়ে দিতে পারে কেউ-কেউ, গর্ব করে অমন মরচেপড়া জীবনযাপন নিয়ে । ভস্মপূঞ্জ জমে যায় না কি তাদের চোখের পাতায় আর ভুরুর চুলে, ভেবেছে অতনু ।

আচমকা খেয়াল করল অতনু,  অন্ধকারে, যুঁই ফুল তার সুগন্ধ দিয়ে ছড়াচ্ছে আন্তরিকতা । এক হাজার বছর পরেও এই সুগন্ধ থেকে যাবে । কোনো রেশ থাকবে না অতনুর । বাবাও তো থিতু হবার আগেই ইঁদুর মারা বিষ খেয়ে আত্মহত্যা করা নিজের ছেলেকে চাকরিটা পাইয়ে দিয়ে গেলেন । জানতেন ছেলেটা নিজে কিছুই করে উঠতে পারবে না । প্রাতিষ্ঠানিক সমবেদনা । গোড্ডা বিহটা লাহেরিয়াসরায় জপলা বা বকসরের কোনো ছাদহীন মাটির দেয়ালের স্যাঁতসেতে স্কুলে, এই চাকরিটা নে পেলে, অর্ধেক মাইনেতে, চরবাহাদের পড়াতে হতো হিন্দির মাধ্যমে ইংরেজি, ওই ভাষায় স্নতকোত্তর হবার মাশুল । মাইনের আর্ধেক দিয়ে দিতে হতো শিক্ষা বিভাগের সরকারি পেয়াদাদের ।

বাবা কেন আত্মহত্যা করেছিলেন ? মাও বলতে পারেননি । অতনু তাই দায়টা নিজের চাকরির ওপর চাপিয়ে নিয়েছে ।

চাকরিটা আসলে কেরানি আর মজুরের দোআঁশলা, শুনতে জমজমাট, ব্যাংকনোট এগজামিনার, টাকাকড়ি পরীক্ষক, অথচ যারা চা কিংবা মদ পরীক্ষা করে, তাদের কতো র‌্যালা । অতনুর কাজ  টাটকা নোট আর পচা নোট আলাদা করা, একশোটা নোটের প্যাকেট তৈরি, দশটা প্যাকেটের বাণ্ডিল, দিনের পর দিন, দিনের পর দিন, দিনের পর দিন, দিনের পর দিন, দিনের পর দিন, দিনের পর দিন, মাসের পর মাস, মাসের পর মাস, মাসের পর মাস, মাসের পর মাস, মাসের পর মাস, মাসের পর মাস, ঋতুর পর ঋতু, ঋতুর পর ঋতু, ঋতুর পর ঋতু, ঋতুর পর ঋতু, ঋতুর পর ঋতু, ঋতুর পর ঋতু, গ্রীষ্মের পর বর্ষা, বর্ষার পর শরৎ, শরতের পর হেমন্ত, হেমন্তের পর শীত, শীতের পর বসন্ত, বছরের পর বছর, বছরের পর বছর, বছরের পর বছর, বছরের পর বছর, বছরের পর বছর, বছরের পর বছর, বাছাই ছাঁটাই, গোনার পর ভালো নোটগুলো চলে যায়  ব্যাংকে আর ট্রেজারিতে । পচা নোটগুলোয় গোল-গোল চাকতির মতন গোটাকতক ছ্যাঁদা, ঝপাং ঝপাং ডাইস দিয়ে করার পর, নোটগুলো মরে গিয়ে অচল হয়ে গেছে ভেবে, যাতে আবার না বেঁচে উঠে ব্যবহৃত হয়, ছ্যাঁদা-ছ্যাঁদা নোটের প্যাকেট আর ঝরে পড়া গোল চাকতি, বস্তাবন্দি সিলমারা চটের থলেতে চলে যায় অন্য বিভাগে পুড়ে ছাই হবার জন্যে ।

প্রথম দিকে অতনু, তেএঁটে ফাঁকিবাজ হবার আগে, এদেশের ভার্জিন কর্মচারীদের যেমন হয়, মন আর সততা খরচ করে, টাটকা আর পচা নোট আলাদা করত, গুনত, পচা নোটগুলোই কেবল নষ্ট করাত গোল-চাকতি ছ্যাঁদা করিয়ে । সহকর্মীরা ধমকাতে আরম্ভ করেছিল ; আর হুমকি দিয়েছিল ভাজপা, জদ, ইনকা, সপা ইউনিয়ানের কত্তারা । কে আর সৎ হয়ে প্যাঁদানি খায় ! ভালো নোট হোক খারাপ নোট ওক, পচা হোক বা আনকোরা, প্যাকেটের সবকটা টাকাকে, প্রতিটি, অতনু পচা ছাপ মেরে নষ্ট করিয়েছে । কমিয়ে ফেলেছিল কাজের চাপ । সৎ হবার ফালতু বোঝা, নোয়ম মেনে চলার লাফড়া, প্যাকেট খোলার আর ঝঞ্ঝাট নেই । দরকার নেই গোনার । এহাতে প্যাকেট নাও, ছ্যাঁদা করাও, নিজের কোড চিহ্ণ দাও শেষ নোটে, এবার তুলে দাও সহকারি খাজাঞ্চির হাতে, যে নিজের টেবিলে বসে জনর রাখে কেউ গ্যাঁড়াবার তাল করছে কিনা, যদিও দরোজায় চেকিং হয় বেরোবার সময় । অতনুর তাড়াতাড়ি কাজ শেষ, ছুটি, বাড়ি যাও, বা বাইরে বেরিয়ে যা ইচ্ছে করে বেড়াও, সহকারি খাজাঞ্চি খুশি, খাজাঞ্চি খুশি, খুশি সব্বাই, স্মুথ সেইলিং । দশটা-পাঁচটার টুঁটি টেপা চাকরি হয়ে গেল এগারোটা-একটা । না-গোনার মধ্যে ঝুঁকির তড়াস । সে ঝুঁকি সবাই নিচ্ছে । অতনু কেন মাঝখান থেকে সৎ হতে যাবে ! চাকরির জন্যে তো আর কারোর প্রতি দায়বদ্ধতা গজায় না । তাই চাকরিকে চাকরি বলে মনে হচ্ছিল না অতনুর । ভেতো জীবন হয়ে উঠেছিল নিরলস কুঁড়েমিতে মুখর । সেকশানের লোহার জাল দেয়া জানলার বাইরে শিমুল গাছটায়, আহ্লাদে ফেটে পড়া লাল ফুলগুলোয় লুকিয়ে বউ কথা কও পাখি নির্দেশ দিয়েছে অতনুকে, নোট গুনে নাও, নোট গুনে নাও, নোট গুনে নাও, নোট গুনে নাও ।

অতনুর সহকর্মীরা বসন্তঋতুকে বলে ফগুয়া । গাঁও চলে যায় অনেকে, বউয়ের কাছে । বসন্তঋতু তো বউদেরও ডাক দেয় । কোথায়-কোথায় সেসব গ্রাম । বাসে-ট্রেনে-নৌকোয়-পায়ে হেঁটে কোশের পর কোশ । রোহতাসের কারমু পাহাড় এলাকায়, ভাগলপুরের কহলগাঁও সুলতানগঞ্জ বহিপুরে, সীতামড়হির মানেচওকে, অওরংগাবাদের মদনপুরায়, দলেলচৌক বধৌরায়, চাতরার প্রতাপপুর হাণ্টারগঞ্জ ইটখোরিতে যেখানে খয়েরের চোলাই হয়, জাহানাবাদের আরওয়ালে, বিষ্ণুগঞ্জে, মখদুমপুরে, পোরমগাঁও আর হিঁডিয়ার নকসল্লি মাওওয়াদি জামাতে, নওয়াদা জেলার হিঁসুয়ায়, মুঙ্গেরের শেখপুরায়, কুঁওর সেনা সানলাইট সেনা ব্রহ্মর্ষিসেনা আজাদ সেনা শ্রীকৃষ্ণ সেনাদের বাভন বনিয়া রাজপুত কোইরি কাহার কুরমি আহির গাঁওয়ে, সোনাপাস রুগড়ি সুপাইসায়, কোতওয়ালসায়, তেলাইডি বড়াউরমা সিংগাড়ি লোসোদিকি পিতকলাঁ মাদেউবটা গ্রামে, যেখানে ধুলোবালি ছাড়া আর কিছুই নিজের মনে ঘোরাঘুরি করে না । কোথাও যায়নি অতনু । সহকর্মীরা বলেছে, আবে চল, তনিক হিলাকে-ডোলাকে মৌজমস্তি কর ফগুয়ামেঁ । সেসব গ্রাম দেখতে ইচ্ছে করেছে কিন্তু যেতে ইচ্ছে করেনি অতনুর । পাটনার কাছে-পিঠের বাইরে যায়নি কোথাও ।

সময় কাটাবার জন্যে একজোড়া কাকাতুয়া কিনেছিল ; আর কিনেছিল শাদাঝুঁটিটার জন্য বাংলা ছড়ার সিডি, আমি হব সকালবেলার পাখি, সবার আগে কুসুমবাগে উঠব আমি ডাকি ।  হলুদঝুঁটির জন্য রবীন্দ্রসঙ্গীতের, আমি হিয়ার মাঝে লুকিয়েছিলে দেখতে আমি পাইনি তোমায় । ছড়ার বা রবীন্দ্রসঙ্গীতের জন্যে কেনেনি, কিনেছিল কাকাতুয়া দুটোর জন্য । এত মিঠে গলা পাখিদুটোর, সত্যি । অডিওগুলো না বাজালে, সকাল থেকে গলিতে গালমন্দের যে তারস্বর আদানপ্রদান হয়, তা শিখে ফেলত পাখি দুটো ।

চাপচাপ অসন্তোষ মাখানো, নোংরা তেলচিটে আধমরা পচা টাকার দু-চোখ জুড়োনো রূপে, চাকরির বছর দেড়েকের মাথায়, নিষ্পৃহ হয়েছিল অতনু । অতিশয়োক্তির মতন কোটি-কোটি কেগজের স্যাঁতসেতে ছাতাপড়া নীলসবজে টাকার টিলা । একশো টাকার, পাঁচশো টাকার, হাজার টাকার, পঞ্চাশ কুড়ি দশ পাঁচ টাকা থেকে সারাবছর শুকনোপচা পাতার বুনো জঙ্গুলে গন্ধ । সেসব আদুলগা টাকার সঙ্গে কথা বলা এদানতি বন্ধ করে দিয়েছিল অতনু । মূল্যহীন অঢেল ।

গলায় চোঙবাঁধা সুশান্ত অতনুর বিভাগে এলে আলাপ । সুশান্তই প্রথম দিন বলেছিল, ‘তোর নাম তো অতনু চক্রবর্তী ? আমি সুশান্ত ঘোষ । দেখেছি তোকে, অমন একা ম্যাদামারা হয়ে পড়ে থাকিস কেন ? চলিস আমাদের বাড়ি, তোর ভাল্লাগবে ।’

একটার পর, শেষশীতের দুপুরে, কাজ শেষ হলেই, অফিস ছুটি, সুশান্তর মোটর সাইকেলে । চালাতে শিখে গেল অতনু, ধুতি পরেই, চটি পায়ে । নাটুকে নষ্টকুমার-কুমারীদের মতন, শীতের বসন্তঋতু মেজাজি পাগলাটে ছায়া-চেহারাগুলোর নিঝুম দাপাদাপি, দৃষ্টিতে রক্তমাখা ছুরি নিয়ে তাপটগবগে হলকার পিচগলা গ্রষ্ম, দিলখোলা বর্ষার প্যাচপেছে হাঁটু-কাদা রাস্তা, ছুটেছে দিশেহারা মোটর সাইকেল । কখনও পেছনে সুশান্ত, কখনওবা পেছনে অতনু । পাটনা সাহেব থেকে দানাপুর-খগোল, এরাস্তা-সেগলি-রাজপথ । কিন্তু ধুতি-পাঞ্জাবি থেকে শার্ট-প্যান্টে যেতে পারেনি অতনু । শীতে আলোয়ান । এদিকে সুশান্ত, বিহারি জোতদার পরিবারের যুবকদের মতন, রাজপুত ভূমিহার কুরমি যারা, কিংবা ব্রাহ্মণ কায়স্হ বিহারি আমলার শহুরে ছেলেদের ধাঁচে, অফিসে প্রতি ঋতুতে হালফ্যাশান এনেছে । জ্যাকেট জিনস টিশার্ট উইন্ডচিটার, ব্রাণ্ডেড । দপতরের গৃহবধু কর্মীদের নজরে সুশান্ত অবিনশ্বর জাদুখোকন, লিচুকুসুম, মাগ-ভাতারের অচলায়তনের ফাটল দিয়ে দেখা মুক্ত দুনিয়ার লালটুশ । গেঁজিয়ে যেতে পারে, চোখে চোখ রেখে, ননস্টপ, যান বাজে বকার মধ্যেই পালটে যাচ্ছে হিজড়েতে, সবায়ের অজান্তে ।

কী হয় অমন কথা-বলাবলিতে, এক্সচেঞ্জ হলে সুশান্তর পাশে চুপচাপ, বাচাল গৃহবধুদের মাঝে ঠায় অপ্রস্তুত, আধ থেকে এক ঘণ্টা দাঁড়িয়ে-দাঁড়িয়ে, ঠোঁট বন্ধ রেখে হাইতোলা চেপেছে অতনু । মহিলাকর্মীদের বিভাগ আলাদা । তিনটে-চারটে বেজে যাবার ভয়ে, যখন কিনা কাজ সেরে একটায় বাড়ি কেটে পড়া নৈতিক । মহিলাকর্মীরা নাকি সৎভাবে কাজ করে, ইউনিয়ানগুলো ওনাদের টলাতে পারেনি । লম্বা টিকোলো আঙুলে টরটরিয়ে দরকচা নোট গোনে, পচা নোট বাতিল করে, সেগুলোতে ছ্যাঁদা করায়, প্যাকেটের পেছনে যে যার নিজের কোডের ছাপ মারে, কেবল হাফকাটা নোট বাছাই করে ফেরত পাঠায় । মহিলাদের সততার চাবিকেন্দ্র, শরীরের তুলতুলে জায়গাগুলোয় লুকোনো থাকে বলে, এও মনে হয়েছে অতনুর, সৎপুরুষ আর সতীনারীর কী অবাঞ্ছনীয় তফাত । ওনাদের সুখপাঠ্য মুখশ্রী, অম্লমধুর স্তন, দুষ্প্রাপ্য নিতম্বের আদেখলাপনায়, শ্রাবণের বিকৃত-মস্তিষ্ক বুড়িগণ্ডক বা পুনপুন নদীগুলোর মতন, নিজেকে মশগুল আর অনিশ্চিত রেখেছে ভারজিন অতনু ।

গায়কের ইশারায় যেভাবে ধ্বনিপরম্পরা টের পায় তবলাবাদক, তেমনই, নৈশভোজে বেরোনো টিকটিকি যুবকের মতন, মহিলা সহকর্মীদের অবান্তর কথাবার্তা, ভোজপুরি হোক হিন্দি-বাংলায়, বলার জন্যেই বলা, একপলক দূরত্বে দাঁড়িয়ে গিলেছে সুশান্ত । কোনো যুবতী মুখে রুমাল চেপে থাকলে অতনুর সন্দেহ হয়েছে যে এবার নির্ঘাৎ ইনফ্লুয়েঞ্জা ধরবে সুশান্তকে, এত কাছে কী করে দাঁড়ায়, শ্বাস-প্রশ্বাসের দূরত্বে !

–অররে সুশান্তজি, একদম টইয়র লগ রহেঁ হ্যাঁয় আজ !

–বাঃ, বেশ মানিয়েছে তো লাল সোয়েটারটা হলদে স্কার্ফের সঙ্গে । শিমলা থেকে বুঝি ?

কৃষিবিজ্ঞানে স্নাতক সুশান্ত, আরও স্বচ্ছলতার আপ্রাণে, ট্রাকে করে শীতে দাক্ষিণাত্য থেকে আম, কোংকন থেকে এঁচোড়-কাঁঠাল, গ্রীষ্মে শিমলা থেকে টোম্যাটো কড়াইশুঁটি ফুলকপি, পুণা হায়দ্রাবাদ থেকে ব্রয়লার, রায়গড় থেকে সফেদা, ভুসাওয়াল থেকে কলা এনে ছেড়েছে পাটনা শহরের বাজারে, ওর কাকার সঙ্গে ব্যবসায় । পিপারিয়ার জমিদারি হাতছাড়া হলেও বর্ধমানের মেমারিতে আছে এখনও বসতবাড়ি আর কিছু তৌজি-মৌজা খামার-খতিয়ান । ওদের পারিবারিক কিংবদন্তি অনুযায়ী, ঠাকুর্দার ঠাকুর্দা ছিলেন নামকরা ঠগি । বাড়ির সবাই এখনও রঙিন রুমাল রাখে । ঠগিদের বংশধর হবার গোপন গর্ব আছে সুশান্তর ।

কৃষিবিজ্ঞান পড়ে নোটপরীক্ষক । এনজিনিয়ার, জীববিজ্ঞানে ডক্টরেট, উচ্চ গণিতে স্নাতকোত্তর, জেনেটিকসে বিশারদ, সংস্কৃতে সান্মানিক স্নাতক, হরেক রকম শিক্ষিতের ছড়াছড়ি এই চাকরিতে, মজুর আর কেরানির এই দোআঁশলা কাজে ; একবার এই এগারোটা-একটার আরামে ঢুকে গেলে বড় একটা বেরিয়ে যায় না কেউ । দশ-বারো বছরের মাথায় কেরানিগিরির সাধারণ বিভাগে পদোন্নতি হলে কাজের ধারা পালটায়, কাজের সময়ও দশটা-পাঁচটায় আটকে পড়ে ।

অতনুকে ছাড়ে না পচা নোটের জীর্ণ গন্ধ, যে গন্ধে ওর চারিপাশে ঘনিয়েছে দুর্বহ স্বচ্ছ অন্ধকার । পোড়াবার সময়, চুল্লি থেকে ভেসে আসে মড়া পোড়াবার হুবহু, অথচ ছাইয়ের রং সোনালি ! চুল্লিতে নোট ফেলার সময় ননীদা হরিবোল দ্যান, রাণা রামদেও সিং আওয়াজ দিয়ে ওঠে রামনাম সৎ হ্যায় । চাকরির দোটানায় বেশির ভাগ স্বপ্নই স্বল্পপরিসর ।

উচ্চাকাঙ্খী মহিলাদের তিনজন, যারা পদোন্নতি পেয়ে ইউডি কাউন্টার আলোকিত করে, যদিও জোচ্চুরির ওই ঘেমো অঞ্চলে পুরুষদের  একচ্ছত্র, কেননা জনগণের বেহুদা কিচাইন, টু-পাইস অফুরন্ত, খুল্লম খুল্লা । একটাকা দুটাকা পাঁচটাকার তরতাজা করকরে নোটের আনকোরা প্যাকেট, দশ-কুড়ি টাকা বেশিতে ঝাড়া যায়, বিয়ের মরশুমে প্রায় দ্বিগুণ, হাতজোড় কন্যাদায়গ্রস্তের কাতার । জোড়াতালি, তাপ্পি, ছেঁড়া, উইচাটা, ঝুরঝুরে, তেলচিটে, ছাতাপড়া, কাহিল, ভ্যাপসা নোট, যেগুলো কেউ নিতে চায় না, ছুঁতে চায় না, কুষ্ঠরোগাক্রান্ত, সেগুলো নিয়ে হাজিরা দ্যায় মুচকিমুখ দালালরা, আবডাল হলেই যারা মনে-মনে আর ফিসফিসিয়ে মাদারচোদ গধে-কা-লণ্ড রণ্ডি-কে-অওলাদ ভোঁসড়ি-কে-জনা কুত্তে-কা-চুত আওড়ায়, অতনুর সুশান্তর মানসী বর্মণের অসীম পোদ্দারের দপতরের উদ্দেশে, কাউন্টারের টেলরদের উদ্দেশে । দালালরা বাঁধা কমিশন হাতপাচার করে । দালালগুলো, কাউন্টারে কিউ দেবার জন্যে অফিসের সিকিউরিটির পালোয়ানদের টাকা খাওয়ায়, কেননা কিউতে প্রতিদিনের বরাদ্দ কেবল চল্লিশজন । ভিজিল্যান্স ধরেছিল সিকিউরিটে অফিসারকে, শর্ট সারভিস কমিশনের সেনাক্যাপ্টেন, সে ব্যাটা এখন ট্রান্সফার হয়ে ত্রিভান্দ্রম না নাগপুরে ।

কতরকমের নোট যোগাড় করে আনে দালাল নোট-বদলকারীরা । এত সূক্ষ্ম জোড়াতালি, শাদা চোখে টের পাওয়া যায় না কিচ্ছু । অফিসাররা পরখ করার জন্যে টেবিলের ওপর এনামেলের গামলায় ছাড়লে, কিছুক্ষণে আলাদা হয়ে ছিতরে যায় তাপ্পি দেয়া জোড়াতালি নোট । হয়তো দুকোণের সংখ্যাগুলো আলাদা, আদ্দেক আসলের সঙ্গে জোড়া আদ্দেক নকল, কিংবা কুড়ি টাকায় দুটাকার তাপ্পি, পাঁচশো টাকায় পাঁচ টাকা, সাতটা একশো টাকার নানা টুকরো জুড়ে একটা আস্ত । চিনে ছাপিয়ে এনে পাকিস্তানিরা নকল নোট ভারতের বাজারে ছাড়ার পর কিচাইন বেড়েছে । দালালগুলো আলট্রাভায়োলেট আলোর যন্ত্র কিনে যাচাই করে নেয় নোটগুলো নকল পাকিস্তানি না আসল ভারতীয় । পাকিস্তানি নোট হলে পুলিশের প্যাঁদানি, জেলহাজত, হুজ্জোতের শেষ নেই ।

আসল নোট যত বেশি পচা, যত বেশি নষ্ট, আবদার তত বেশি, পরিবর্তে অনুমোদিত টাটকা নোট পাবার নিয়ম তত খুঁতখুঁতে, পাশ করার অফিসারের পাদানি তত উঁচু । জুড়ে-জুড়ে কাঠ হয়ে গেছে যেসব নোটের প্যাকেট-বাণ্ডিল, গায়ে গা সেঁটে আলাদা হতে চায় না, উইচাটা থিকথিকে, গ্রামীণ আটচালায় ছিল সোঁদা দেয়ালবন্দি, খামার বাড়ির মাটির অযাচিত গভীরে কলসিবদ্ধ, গাছতলায় পোঁতা গোমোট কাঠের বাক্সে, আত্মহত্যাকারিনীর সঙ্গে জ্বলে আধখাক বা আধসেঁকা ঝুরঝুরে, চেহারা পালটে কাগজ না নোট বোঝার উপায় নেই, এসেছে হয়তো জেলা মুজফফরপুরের মিঠুনপুরা মোহোল্লার রমইরাম বিধায়কের রক্ষিতার বাড়ি থেকে ঘুষের ফাউ, ধানবাদের এ এস পি রেজি ডুংডুঙের ধরা ব্যংক ডাকাতের বস্তা থেকে, সন্ত কানেশ্বরের অমরপুরী আশ্রমের তহখানায় বহুকাল লুকোনো, সে-সব বহুরূপী নোট পাস করেন আরও বড়ো সায়েব । দালালদের বরাদ্দ খাতিরে হাফসায়েব ছোটোসায়েব বড়োসায়েবরা দিনকানা । কোন অফিসের কোন বড়ো সায়েবের দুর্বলতা ঠিক কী আর কতটা নামতে পারেন, দালালরা, ভারত দেশে ছড়ানো অদৃশ্য নাইলনজালের বুনোটে, জানে, না-জানলে চলে না, আর বদলি হলে কাঁড়ির তাড়া বেঁধে ধাওয়া মারে সে-শহরে । দেখতে ভিকিরি সে-সব দাঁত-ফাঁক দালালরা, দাঁতের ফাঁক থেকে টুথপিক দিয়ে মোরগের ডানা বের করতে-করতে, হাওয়াই জাহাজে পাড়ি দ্যায় এক রাজধানি থেকে আরেকে, তোবড়ানো তোরঙ্গে নোটের পচা লাশ নিয়ে । কারোর বা অজানা শহরে বেনামা ব্যাংক খাতায় আড়মোড়া ভাঙে বখশিশ । দেওয়ালি দশেরায় পেস্তা কাজু খোবানি মুনাক্কা আনজির কাগজিবাদামের রঙিন ডিবে । স্টেনলেস স্টিলের, লা ওপালা চিনামাটির ডিনার সেট । শিভাস রিগ্যাল, ব্ল্যাক ডগ, কিং অফ কিংস, আবসোল্যুট ।

গত বছর গরমকালে সুশান্ত, এক শনিবার মহঙ্গুর দোকানে বিকেল ছটায় অপেক্ষা করতে বলেছিল, বগেড়ির মাংস খেয়ে জীবনের অ্যাকশান রিপ্লে দেখাতে নিয়ে যাবে । অতনুর বাসা মহেন্দ্রুতে । সব রকম মাংস পাওয়া যায় মহঙ্গুর দোকানে । ওর নোলানির্ভর রান্না আরম্ভ হয়নি তখনও । কড়াই ডেকচি ঘুমোচ্ছে পোঁদ উল্টে, কোনে ঠেশান দিয়ে জিরোচ্ছে খুন্তি হাতা সানচা । বুকের বসনখোলা তনদুরি চিকেনগুলো গায়েহলুদের মশলা মেখে দোল খাচ্ছে দড়িতে, শিকে গেঁথা খরগোশ, পাঁঠার ঠ্যাঙের ডাঁই অ্যালুমিনিয়াম পাতে ঢাকা টেবিলে, পায়রার গোলাপি মাংস,  বারকোশে পোস্ত আর সাদাতিল মাখা কিমার কাঁচাগোল্লা, ভগ্নস্বাস্হ্য ছাগলের হাড় থেকে চলছে কাবাবের মাংসের চাঁছাই ।

মোটর সাইকেলের পিলিয়নে হেলমেট পরে বসতেই, সুশান্ত বললে, চল, অকুস্হল কাছেই । বুঝলি তো, বিগ বস খান্না সায়েব রিটায়ার করার আগে সিক লিভ খরচের জন্যে একমাসের ছুটিতে । তাঁর কাজ সামলাতে হেড অফিস থেকে এসেছেন ডেলিওয়েজ কড়ারে মুখার্জিসায়েব । চল্লিশোর্ধ টাকমাথা, কড়া লোক হিসেবে কর্মীমহলে পছারিত, দু-বার ঘেরাও আর সাতবার ধর্নার খেতাব আছে ।

ফ্রেজার রোডে, সম্রাট হোটেলের পার্কিং লটে, দোচাকে দাঁড় করাতে, অতনু বললে, ‘, এসব তেলফেল দেয়া আমার দ্বারা হবে না ।’

‘ধারণা করতে পারবি না, এমন ব্যাপার,’ বাঁ চোখের বাঁ কোণ সামান্য কুঁচকে জানিয়েছিল সুশান্ত ।

রিশেপশানে খোঁজ করে সাততলার সাতশো বত্রিশ নম্বর ঘরে কোকিল-ডাক কলিং বেলে টোকা দিতে, দরোজা সামান্য ফাঁক, ভুরু কোঁচকানো চাউনি চারিয়ে এক ঝটকায় মেপে নিলেন দুই কুতূহলী খোট্টাকে । সিঁথে উল্টে চুল বাড়িয়ে টাক-ঢাকা মাঝবয়সী দোহারা । ফরসা । পাজামা ধবধবে । মেরুন সিল্কের ড্রেসিং গাউন । উড়ছে আড়িপাতা বিলিতি পারফিউম আবছা অন্ধকার শীতাতপে । বিছানায় গোলাপি মখমলের চাদর দেখা গেল ফাঁ দিয়ে । মুখার্জি মশায় একটু পেছোতেই, ঘরের ভেতর ফুলদানি রাখা টেবিল-থামের পাশে দাঁড়িয়ে সুশান্ত ভদ্রতার অভিনয় করল, ‘আমার নাম সুশান্ত ঘোষ, আপনার আনডারে কাজ করি, ডি সেকশানে ।’

‘ও, আমি এক্ষুনি বেরোবো, আপনারা যদি রবিবার সকালের দিকে আসেন ।’ ভেসে এলো হুইস্কি-প্লাবিত চেতনা ।

‘ঠিক আছে স্যার, রবিবার সকালেই আসব, এর নাম অতনু চক্রবর্তী, একই সেকশানে ।’

‘ওওওও, বারিন্দির বামুন ।’ হাসলে কপালের শিরা ফোলে । ‘সাতটা শকুন মরলে একটা বদ্যি, আর সাতটা বদ্যি মরলে একটা বারিন্দির ।’ কাঁধের ওপর ঘাড়-বেঁকানো, মুচকি দিয়ে দরোজা ভেজিয়ে দিলেন ।

‘জিরিয়ে নেয়া যাক ।’ জাজিমে ঢাকা সিএফএল প্রায়ান্ধকার করিডরের শেষ প্রান্তে রাখা উনিশ শতকী ঢাউস অ্যান্টিক সোফার কালো ফোমনরম কোলে বসে, কাচের টেবিল থেকে চকচকে বিদেশি পত্রিকা হাতে নিয়ে জানালো সুশান্ত, বলল, ‘তুইও একটা পত্রিকা তুলে মুখ ঢেকে ওই দিকে উঁকি দে ।’ সবুজ কার্পেট পাতা নিঝুম ছমছমে, পেতলের ঝকমকে গামলায় ঘরকুনো  গাছালির ফিকে সবুজ পাতায় ঘন সবুজের ফোঁটা । বাস্তবকে রহস্যখুশি দিয়ে যতটা অবাস্তব করা যায় । কারই বা বাস্তব ভাল্লাগে ।

চিকন রঙিন পত্রিকার বিদেশিনী মাই খোলার এক ফাঁকে, দেয়াল ঘড়িতে সাতটা বাজার কুহু শেষ হয়নি, লিফ্ট থেকে একজন চৌখশ নীল-পাগড়ি আধবুড়ো শিখ দালাকে দেখা গেল খুঁড়িয়ে বের হতে, পেছন-পেছন হলুদ শালোয়ার লাল কামিজ হলুদ ওড়না মাথায়, প্রায় ফর্সা স্বাস্হ্যবতী, যাকে মুখার্জির শীতল ঘরে টোকা দিয়ে ঢুকিয়ে, লোকটা মাথা ঝুঁকিয়ে ফেরত গেল লিফটে । করিডর আবার ফাঁকা নিস্তব্ধ ।

‘দেখলি তো ? তার মানে রোজ সন্ধে সাতটায় ।’

‘রোজই হয় বুঝি ? কে খবর দিলে তোকে ?’

‘এ ব্যাতার রোজ নতুন মডেল চাই । এর বড়ো ছেলে কানপুরে না খড়গপুরে আইআইটিতে পড়ে । শালা বাঙালির নাম ডোবালো ।’

‘লিঙ্গের কোনো জাত ধর্ম ভাষা দেশ হয় না ।’

কথাটা বলে ফেলে অতনু টের পেল, অজান্তে অদ্ভুত সত্যি কথা বেফাঁস উগরে ফেলেছে । লিঙ্গ এক উপহাসাস্পদ আবরদক । বেশিটা জীবন কেটে যায় এর ওপর ভর দিয়ে অথচ জিনিশটা কত অনুর্ভরযোগ্য । কত তাড়াতাড়ি একে জ্বালাতন করা যায়, ধোঁকা দেয়া যায়, হাল ছেড়ে দেয়া যায় এর । কিন্তু এমন ভান করে যেন অজাতশত্রু, মালিককে জাদুক্ষমতা দিয়ে দিতে পারে এমন অস্ত্র যেন, পেশীহীন আঙুল-পোকাটাকে তাই সদম্ভে চেষ্টা করে যেতে হয় সর্বনাশের বিরুদ্ধে লড়তে । কিছুই করার নেই মুখার্জির ।

‘তাই তোকে বলেছিলুম, গেলবার হরিহর ছত্তরের মেলার সময় নাংগা ক্যাবারে দেখে আসি শোনপুরে ; গেলি না । দেখলে তো আর চরিত্র তোর নষ্ট হবে না।’

সুশান্ত নিজে গিয়েছিল যদিও, মোটর সাইকেলে । তখন গঙ্গার ওপর পাটনা সিটির কাছে এপার-ওপার পোলটা হয়নি, এপারে মহেন্দ্রুঘাট থেকে ওপারে পহলেজা ঘাট বাচ্চাবাবুর স্টিমার যেত দিনে চার খেপ, ঢাউস ঢেউ তোলে, নামে স্টিমার হলেও মাপে বিরাট । সে-বছর বৈশালীর বিধায়ক বীর মহোবিয়া মেলা থেকে একটা পাগলা হাতি কিনে নিয়ে গিয়েছিল, একশো লেঠেলের পাহারায় । মহোবিয়ার কাছ থেকে হাতিটা কিনেছিল পালামৌ জেলার বিশ্রামপুর বিধানসভা এলাকার বিধায়ক বিনোদ সিং, সি সেকশানের কয়েননোট এগজামিনার দেবেন্দর পরসাদ সিংএর ফুফেরা কাকা, যে কিনা দিনদুপুরে পুলিশ খুন করে যশশ্বী হয়েছিল, খ্যাতি পেয়েছিল নিজের বিরাদরিতে । মালহানের ফজল মিয়াঁ, কমরুদ্দিন, সহজ গঞ্জুকে পিটিয়ে করেছিল আধমরা, চিত্তবিনোদনের জন্যে । চিত্ত সেরকম হলে শির উচ্চ হয় । পাগলা হাতি কিনে জোতদাররা শির উচ্চ করার উপায় খুঁজে পেয়েছিল । হাতিটাকে মাঝরাতে শেকল খুলে এমন খেপিয়ে দিত বিনোদ সিং যে জেগে থাকতে বাধ্য হতো গ্রামবাসী । ব্যাটাকে অবশ্য খুন করতে বাধ্য হয় সহানুভূতিশীল লোকেরা, যারা রাতে একটু ঘুমিয়ে নিতে চায় । উচ্চ শিরকে মাঝরাতেই নামিয়ে দিয়েছিল কেউ ; নামিয়ে পাগলা হাতির পায়ের তলায় ।

‘বিম্বিসার অশোক জরাসন্ধ অজাতশত্রু এদের থেকে খুব একটা তফাত নেই, না ?’

‘আচ্ছা, কার কাছ থেকে জানলি মুখার্জির ফাইভস্টার অভিসারের কথা ?’

‘মোটা টাকার পচা বাণ্ডিল পাশ করার এই একটাই আবদার লোকটার । মাগি খায় । ভিজিল্যান্স বোধহয় আদিরসের স্টক নিয়ে ঘাঁটায় না কাউকে । আমরা প্রোমোশান পেয়ে ওই পোস্টে উঠতে-উঠতে বুড়িয়ে যাব ।’ সত্যিকার আফশোয সুশান্তর গলায় ।

কুড়ি মিনিট পড় মাথায় হলুদ ওড়না দাঁত চেপে ঢালু কাঁধ ত্রস্ত মেয়েটা লেফটের বদলে পাকানো সিঁড়ি বেয়ে অদৃশ্য হতেই, সুশান্ত সোফা থেকে তড়াক, অতনুর হাত ধরে হালকা পায়ে, তারপর সাতশো বত্রিশে কলিং ঘণ্টি বাজায় আর দরোজা খুলতেই, ‘স্যার, আমার গগলসটা ফেলে গেছি ।’ সায়েবের কোমরে গোলাপি তোয়ালে, সাজানো টাকের চুল উস্কোখুস্কো, ধামসানো বিছানার চাদর চেয়ারে দলা । দরোজার পাশে উঁচু পাতলা স্ট্যাণ্ডে রাখা গ্ল্যাডিওলির গামলার পাশ থেকে চশমাটা তুলে, ‘সরি স্যার, ডিস্টার্ব করলুম ।’

মুখময় কুয়াশামাখা মুখার্জির সামনে, স্তম্ভিত দাঁড়িয়ে থাকা লোকটার, দু-চোখ জুড়ে অগাধ দূরত্ব । লোকটা আবিষ্কার করছিল ওরা দুজন তার দিকে প্রখর চাউনি মেলে তাকিয়ে ।

লিফটের দরোজা বন্ধ হতেই, ‘হাঃ হাঃ হাঃ হাঃ হাঃ হোঃ হোঃ হোঃ হোঃ, পেট ফেটে গেল ।’

সুশান্ত : না, বালিশের পাশে কনডোমের প্যাকেট ছিল ।

সুশান্ত : রেকর্ডারে মোৎসার্টের বাইশ নম্বর কনচের্টো লাগিয়ে রেখেছেন ভদ্দরলোক ; পিয়ানো আর অর্কেস্ট্রা ।

সুশান্ত : টাক থেকে ভুরুর কাজল মোছার সময় হয়নি !

সুশান্ত : ভাবতেই পারেনি, ঢুঁ মারব ।

সুশান্ত : দেখে নিস, নির্ঘাৎ হোটেল পালটাবে কাল ।

সুশান্ত : একেলে ? সেকেলে ? আধুনিক ? উত্তরাধুনিক ? কী বলা হবে লোকটাকে ?

পরের দিন, বুধবার সন্ধেবেলা, বধিরদের মধ্যে কেচ্ছা যেভাবে একান-সেকান হয়, একই শিখ নোট এক্সচেঞ্জার দালালের সঙ্গে ময়লাপানা ডাগরচোখ শাদা টিপ শাদা অরগ্যাণ্ডি শাড়ি, পীনোন্নত ব্লাউজে, গলায় নকল মুক্তোর মালা, ঢ্যাঙা ছিপছিপে । পাটলিপুত্রা হোটেলে, কেননা গোপন রাখতে ঠাঁই পালটেছেন সম্রাট থেকে এই হোটেলে । দরোজায় কান রেখে সুশান্ত বলেছিল, ‘হিউগো মনটেনেগরোর ফিস্টফুল অফ ডলার্স ।’

পঁয়তাল্লিশ দিন জুড়ে হরেকরকম নারীর আনাগোনার মাঝে ওরা শুনল, হোয়াম-এর দ্য এজ অফ হেভেন, মাইকেল জ্যাকসনের ‘আই অ্যাম ব্যাড’, সন্ধ্যা মুখোপাধ্যায়ের ‘গানে মোর কোন ইন্দ্রধনু উউ উউ উউ উউ’, ফিল কলিনসের ‘অনাদার ডে ইন প্যারাডাইস,’ বনি এম-এর ‘ব্রাউন গার্ল ইন দ্য রিং,’ মোৎসার্টের সোনাটা পনেরো, সোনাটা ষোলো, এলভিস প্রেসলির ‘বোসসা নোভা বেবি, বড়ে গুলাম আলি খাঁ-এর ‘কা করুঁ সজনী আয়ে না বালম,’  দ্বিজেন মুখোপাধ্যায়ের ‘আজি এই গন্ধবিধুর সমীরণে,’ বাখ-এর চার নম্বর কনচের্টো, লোপামুদ্রার ‘ছাতা ধরো হে দেওরা এইসান সুন্দর খোঁপা হামার ভিঁজ গেলাই না ।’ শুনলো নজরুল, অতুলপ্রসাদ, আব্বাসউদ্দীন, হেমাঙ্গ বিশ্বাস, পূর্ণদাস বাউল, কিশোর কুমার, মোহম্মদ রফি, কুমার শানু, শ্রেয়া ঘোষাল, লতা মঙ্গেরশকর, আশা ভোঁসলে । জানে না বলে কারা গেয়েছে, কী গান, হদিশ করতে পারল না সুশান্ত, তা কিশোরী আমনকর-এর বসন্তবাহার, পণ্ডিত যশরাজের রাগ ভবানীবাহার, ভীমসেন যোশীর হিন্দোল বাহার, মল্লিকার্জুন মনসুরের বসন্তি কেদার ।

–লোকটা তো হরফনমওলা । এমন বাঁধাধরা সময় করে ফেলেছে । ও তো পাভলভের কুকুর । গড়িতে সাতটার ঢং ঢং হলেই, দুপায়ের মাঝখানে চিতচোর কেলেঙ্কারি । একেবারে ঠাপ্পু ওস্তাদ !

–সেই জন্যে রোজ আলাদা-আলাদা গান বাজায় । বউয়ের সঙ্গে শোবার সময়েও নিশ্চই বাজায় । বাড়িতে প্রচুর গানের স্টক করে ফেলে থাকবে । ঘোড়ার ডাক্তারি, বি ভি এস পড়ে আমাদের পরের ব্যাচে চাকরিতে ঢুকেছে জীবন দে সরকার আর অখিলেশ শ্রীবাস্তব, ওদের জিগ্যেস করেছিলুম ।

–আমার মধ্যে দুটো সুড়সুড়ি চালু হয়েছে । গানবাজনা বুঝতে আরম্ভ করেছি ।

–অন্যটা ? ভুরু কোঁচকায় সুশান্ত । আঁচ করে ফেলেছে । হোসটেলে পুসায় পড়ার সময়ে, অনেক কাল আগে ওর মধ্যেও খেলেছিল । দুটো ব্লক ছিল ছাত্রাবাসের, হোমো ব্লক আর হেটেরো ব্লক । জবাবদিহি চাইবার মতন গলার আওয়াজ টাকরায় ঠেকিয়ে, তাই :’বল ? অন্যটা ?’

–কিছু কিছু ব্যাপার আগে কুকাজ ভাবতুম, এখন আর সেসব তেমন খারাপ মনে হচ্ছে না । কেমন যেন লিবারেটেড ফিল করছি । বোধহয় গানের প্রভাব।

বুদ্ধ মার্গের পাশের রাস্তায়, ধোঁয়া-ডিজেলের ছিন্নাংশে মোড়া ব্যস্ত শহর পাড়ার ভিড়ের মাঝে, লাল মোটর সাইকেলের থ্রটলের গলাখাঁকারি তুলে, জড়োয়া ঝিকমিকে বাজারের সামনে, ছুটন্ত মোটরগাড়িগুলোর শ্যেনদৃষ্টি আলোয়, ফ্যাস করে এক মুহূর্তের জন্যে ফোঁপানির ঝলক তুলে নিজেকে সামলায় সুশান্ত ।

অতনু : আজ ওব্দি তুই বললি না, কার কাছ থেকে জেনেছিলি !

সুশান্ত : রমা বউদির কাছ থেকে ।

অফিসের কেয়ারটেকারের বউ রমা, টেলিফোন অপারেটার । সকলের কথাবার্তা আড়ি পেতে শুনে মশলাদার গল্প চেপে রাখেন আর হাসেন নিজের মনে গিগ গিগ । ওনার বিয়ের আগে কেয়ারটেকার রাঘব সান্যালকে লেখা রমা ব্যানার্জির আট পাতার চিঠি, কাগজের এদিক-ওদিক খুদে-খুদে হাতের লেখায়, পড়েছিল অতনু-সুশান্ত ।  আত্মহত্যার চিরকুটে প্রেমপত্রের মিশেল । রাঘবের জাঁতাকাল অনুনয়, ‘একটা খসড়া লিখে দাও না অতনু । ওর সবকিছু এতো ছোটোছোটো কচিকচি , রুখতে পারলুম না । ‘অতনু উপদেশ দিয়েছিল, চোখমুখ থেকে অভিনয় এক্কেবারে বাদ দিয়ে, ‘বিয়ে করে ফেলুন না, ওসব ফালতু লেখালিখে দিয়ে কী করবেন !’

অফিস বিলডিঙেই সাজানো-গোছানো কোয়ার্টার পেয়েছিল রাঘব । বোতামখোলা একাকীত্বে অকালমৃত স্তনেরা জীবন ফিরে পায় । প্লাসটিকের তৈরি বাঁশপাতার সবুজ খড়খড়ি তুলে ঢুকে পড়ে হাসিমুখ রোদ্দুরের আবালবৃদ্ধবনিতারা । সৈন্য বাহিনীর শর্ট সারভিস কমিশন থেকে ফিরে আসা রাঘব কী একখানা ছিল । অফিস এলাকাকে যুদ্ধক্ষেত্র আর যগ্যিবাড়ির চনমনে চেহারা দিয়েছিল, এ সে-ই । জিপের ট্রেলারে, তাঁবুর তলায়, তুষারের মেঝেতে, গান ক্যারেজে, ট্যাংকের মধ্যে বসে, উটের ছায়ায় মরুভূমির বালিতে, হোমো করার ফিরিস্তি । মেয়েমানুষের অনুপস্হতি দিয়ে ঘেরা দুর্ভেদ্য যৌনতার নড়বড়ে আর নাছোড় স্ট্যাগ কিংবদন্তি । সৈন্য জওয়ানদের জন্যে মুখস্হ হিন্দি হুকুমগুলো চারিয়ে যায় কামিন কামিলা মজুর দারোয়ান ঝি চাকর আরদালি পিওন চাপরাসি খানসামা ঝাড়ুদারদের দুনিয়ায় । আর্মি ক্যানটিনের ঘোড়াছাপ রাম । আফরিকানিবাসীদের মতন ঠাশবুনোট চুল ওর, আঁচড়াতে হয় না, তেল দিতে হয় না । রনা বউদির দেওয়া কোনও খবর গোপন রাখতে পারে না রাঘব ।

রাঘবের দেয়া মুখার্জি মশায়ের বিদেয় পার্টির শেষে, পটলের দোরমা চিংড়ির মালাইকারি গোবিন্দভোগের পায়েস হয়েছিল । অতনু সুশান্ত আনন্দ বোস অরুণ মুখার্জি মণিমোহন মুখার্জি মলয় রায়চৌধুরী প্রদীপ দাশগুপ্ত বাইরে পোর্টিকোয় বেরিয়ে দ্যাখে গেটের কাছে হকিস্টিক সাইকেল চেন লাঠি নিয়ে মারপিট চলছে দু-দল কর্মীর । চন্দ্রকেতু সিং-এর রাজপুত-ভূমিহার গ্যাঙের সঙ্গে তফসিলি গ্যাঙের । ইউনিয়ান নেতা ছিল চন্দ্রকেতু সিং, বছর চারেক, কলকাতা থেকে বদলি নিয়ে আসার পর, কলকেতিয়া স্লোগানবাজি দলাদলি ল্যাং-মারামারি চুকলি শিখে কুরমি কায়স্হ আর গোয়ালারা ওকে ঠেলে ওরই চেলা বেচয়েন লালকে ইউনিয়ান নেতা বানিয়ে ফেলেছিল । মারপিটটা এইজন্যে যে একজন দুসাধ কেরানি নিজেকে রাজপুত হিসেবে পরিচয় দিয়ে চন্দ্রকেতুর গোপন মিটিঙে যোগ দিত, তা ফাঁস হয়ে গেছে । রামচিজ সিং, দুসাধকে, ধোলাই দেয়া আরম্ভ হতে, লাঠিসোঁটা নিয়ে বেরিয়ে এসেছে সবাই, দু-দলের পালোয়ানরা ।

–ওঃ, কী করে এমন একটা অসভ্য দেশে থাকেন । মুখার্জি সায়েব কোঁৎ পাড়েন । চলন্ত মারপিটের মাঝ দিয়েই ওনার গাড়ি বিমানবন্দর যাবে ।

–গেটের বাইরে ওসব, চিন্তার কিছু নেই স্যার ।

–অনেক বাঙালি পরিবার নাকি বিহার ছেড়ে চলে যাচ্ছে ।

–হ্যাঁ, দিল্লি লখনউ মুম্বাই আর তা না হলে পশ্চিমবঙ্গ ।

কথাটা সত্যি, অতনুর মনে হল । গঙ্গাভিলার ছেলেরা চলে গেছে । লঙ্গরটুলির রায়রা । নাগ ডাক্তার । রেডিও টিউটোরিয়ালের বাঁড়ুজ্জে । সমরেণ চক্রবর্তী আর ওর ভাইরা । জীবনময় দত্ত আর ওর বউ, কলকাতায় সাহিত্য করবে বলে । গরদানিবাগ, চাঁইটোলা, লোদিপুর, কংকরবাগ থেকে, পরিবারের পর পরিবার । বাঙালির প্রিয় মাছগুলোই আর আসছেনা পাটনার বাজারে । এখানের জাতপাতের লড়াইতে বাঙালিরা কোন দিকে, নাকি যে যেমন জাতের সেই দিকে যাবে কিনা নির্ণয় নিতে পারছে না বলে পালাচ্ছে । ইসকুলগুলোয় আর বাংলা পড়ানো হয় না । সরকার বাংলা টেকস্টবুক ছাপায় না । বাংলা শিক্ষক নিয়োগ করে না । হিন্দিতেই বাড়িতে কথা বলা আরম্ভ করে দিয়েছে বহু বাঙালি পরিবার । বাংলা অ্যাকাডেমির সভা হলে বাইরে পানের দোকানে দাঁড়িয়ে হিন্দিতে কথা বলেন কোনো-কোনো সদস্য । বিহার ছেড়ে পালাচ্ছে বাঙালিরা । যাদের জো নেই তারা ভাগলপুরের বাঙালিদের মতন স্হানীয় সংস্কৃতিতে মিশে যেতে বাধ্য । সাংস্কৃতিক চাপ থেকে চাগিয়ে ওঠা দুঃখের খতিয়ান রাখে না কোনো ভূভাগের ইতিহাস । মিলিয়ে যায় হরপ্পাবাসী বা মিশরীয়দের মতন।

মারামারির মধ্যে দিয়েই এগোলো অফিসের গাড়ি, মুখার্জি আর রাঘবকে নিয়ে । একাধজনের মাথা ফেটে গেছে, জামায় রক্ত, তেড়ে হিন্দি গালাগাল চলছে । গাড়ির কাঁচ তুলে না দিলে পটল চিংড়ি গোবিন্দভোগ উগরে দিতেন মুখার্জি ।

‘জায়গাটা বড্ড ড্রাই’, সুটকেসে কেবিন ব্যাগেজের টভাগ বাঁধতে-বাঁধতে বিমানবন্দরে বললেন মুখার্জি । বখশি৯শের নিয়মমাফিক লোভে ড্রাইভার রমাকান্ত দাঁড়িয়ে ছিল কিছুক্ষণ, পেল না । মুখার্জি সিকিউরিটি চেকে সেঁদিয়ে গেলে, রাঘব বেরিয়ে আসছে, রমাকান্ত’র উষ্মা, ‘স্যার, লোকটা লুচ্চা, পর-পর তিনটে রবিবার নৌকোয় মেয়েমানুষ নিয়ে ফুর্তি করেছে গঙ্গায় ।’

‘তুই কী করে জানলি ?

‘আমার ট্যাকসি করে ঘাটে গিসলো ।’

গাড়লের মতন কাশতে পারে এমন একটা সাত গ্যারেজের তেল খাওয়া ট্যাকসি কিনেছিল রমাকান্ত । অফিসের নতুন গাড়ি থেকে কলকব্জা মায় টায়ার চালান হয়ে গেছে তাতে । ঘাঁটালে, রমাকান্ত মুরমু ওর ঝাড়খণ্ডি বেরাদর দিয়ে চটিয়ে দেবে মজদুর ইউনিয়ানকে, আর অফিসের মারাঠি ম্যানেজার রাঘবকে বলবে তুমি ট্যাক্ট জানো না । ট্যাকসিটা রমাকান্ত’র ছেলে ছিরিকান্ত চালায়, এটা-সেটায় লাগে । রাঘব সত্যিই অবাক পেল নিজেকে, ওর ছেঁদো খুচরোর লোভ দেখে, বলে ফেলল, ‘কেন, ভদ্দরলোকদের নুনু হয় না বুঝি ? যতো নুনু বাঞ্চোৎ ফুটপাতিয়াদের । জিভের আড় থেকে সৈন্যজওয়ানদের বিটিং দি রিট্রিট হয়নি আজও । সুবেশ মধ্যবিত্ত বাঙালি চোস্ত হিন্দি গালাগাল আরম্ভ করলে থম মেরে যায় বাতাস ।

বিমানবন্দর থেকে ফেরার সময়ে অফিসবাড়ির পেছনের গলিতে ঢোকার মুখে চায়ের দোকানে স্যাঙাতদের সঙ্গে চন্দ্রকেতু সিং, মাথায় ব্যাণ্ডেজ । ‘সব মিটমাট হয়ে গেছে তো ?’ গাড়ির জানলা দিয়ে মুখ বের করে রাঘব জিগ্যেস করায়, চন্দ্রকেতু জবাব দ্যায়, ‘আরে গান্ধিজি বেঁচে থাকলে এসব আম্বেদকরাইটদের রাস্তা মাপিয়ে দিতুম ।’

ভেতর, চটের পর্দার আড়ালে, তিন পাত্তির জুয়া খেলছে কয়েকজন কেরানি নোট-পরীক্ষক আর চতুর্থ শ্রেণির কর্মী ; জুয়া খেলায় শ্রেণি বিভাজনের পাঁচিল হয় না । বোর্ড মানি নেবে বলে, বাঁশের বেঞ্চের ওপরে ঠ্যাঙে ঠ্যাং তুলে বসে আছে চন্দ্রকেতু ; বালিয়া জেলায় ওর বাপের দোশো একর ধানজমি আর পঞ্চাশ একর গ্যয়েরমজরুয়া জমি রেখেছে দখলে । পাটনায় রাজেন্দ্রনগরের একতলা  ফ্ল্যাটের চারপাশে বেড়া তুলে সরকারি জমিতে মোষ পুষেছে । দুধ আর ঘুঁটে বেচে । অফিসে কাজটাজ ছোঁয় না । বললে, ‘হেঃ হেঃ, ইউনিয়ান কা কাম, জানতে হি হ্যাঁয় ।’

ফ্ল্যাটে ফিরে রাঘব জানতে পারল, ঝিয়ের চোদ্দ বছরের মেয়েটা, যাকে ওর বাপ পরশু শশুরবাড়িতে পৌঁছে দিয়ে এসেছিল, আজ সকালে তার লাশ পাওয়া গেছে, কোইলওয়র নদীর বালিতে পোঁতা । পুলিশ তার শশুর আর খুড়শশুরকে গ্রেপ্তার করেছে, বলাৎকার, খুন আর লাশ লোপাটের চেষ্টার দায়ে । মেয়েটার বাপ-মায়ের আছাড়ি-পিছাড়ি কান্নাকাটি চলছে রাঘবের কোয়ার্টারের দোরগোড়ায় ।

রাঘব : ছোটোবেলায় কতবার গেছি কোইলওয়র চড়ায় পিকনিক করতে ।

রমা : কই, আমায় নিয়ে যাওনি তো কখনও !

 

 

Leave a comment

Filed under উপন্যাস

দুই

ঢ্যাঙা ময়লা দোহারা গোলমুখো রাঘব । বেহেড রাম টেনে পেশী গলছে, রক্তে চিনি অবশ্যম্ভাবী, হিসিতে পিঁপড়ে লাগতে শুরু । টুকলি-স্নাতক বলে ওর ছুটির দরখাস্ত, ফিনাইল সাবান ঝ্যাটা ডাসটার সোয়াইপার ন্যাপথালিন, মানে অফিসকে ঝকঝকে রাখার জন্য যাকিছু দরকার, তার আর্জি, যা আগে অতনু লিখে দিত, এখন রমা লেখে । পদাতিক জওয়ানের ওপর যুদ্ধ লড়ার ভার দিয়ে তাঁবুতে আয়েশ করেন ব্রিগেডিয়ার ।

অতনু : টাকা গোনার কেরানিগিরির চেয়ে ঢের ভালো কাজ এই মেথর-ঝাড়ুদার খ্যাদানো ।

ন্যাতানো হিলহিলে সাতবাস্টে পোকালাগা ঝিমিয়ে-পড়া তেলচিটে নোংরা নোটের পাহাড়-ঘেরা উত্যকায় বসে একনাগাড়ে বিচলিত হবার চেয়ে, ও-কাজ অনেক আরামের । নোটের মাঝখানে বসলেই টেনশান । রক্তে গিরগিটি সাঁতরায় । তলপেটে পাঁকাল মাছ কিলবিল করে । প্রথম দিকে তো ঘুমই হতো না ।

রাঘব : শুধু ঝাড়ুদার খ্যাদাই কে বললে আপনাকে ? বেসমেন্টে ফুটবল মাঠের মাপে যে ভল্টটা আছে, দেখেছেন ? চারপাশে আয়না-লাগানো এনটার দ্য ড্র্যাগন করিডরে রাইফেলধারী প্যারামিলিটারি চব্বিশ ঘণ্টা ? আমাকেই খেয়াল রাখতে হয় । সিকিউরিটির অ্যালার্ম বেলের পাগলা ঘণ্টির মহড়ার সময় দেখেছেন ? সবচেয়ে বেশি ছোটাছুটি করতে হয় এই রাঘব বোয়ালকে ।

আগ্রহ নেই বলে দেখেনি অতনু । কী আর এমন আছে দেখার ! কর্মচারীরা ইচ্ছে করলে নিজেদের জরুরি কাগজপত্র দলিল-দস্তাবেজ গয়নাগাটির বাকসো সিল মেরে রাখতে পারে ওখানে, বিনে খরচে । অন্য কোথাও লকার নিতে হবে না । ইনকাম ট্যাক্স সেলস ট্যাক্স সিবিআইরা অতর্কিত হানায়, যা আজকাল আখছার বলে অ্যাকাউন্টস অফিসার বিরক্ত, যে সোনাদানা হিরেমুক্ত পাউণ্ড ডলার ইউরো থাক-থাক নোট পায়, পেল্লাই কালো-কালো তোবড়ানো ট্রাঙ্কে ভরে, ফেলে রেখে যায়, হাভাতে প্যাংলা জনাচারেক দিনমজুরের কাঁধে চাপিয়ে । সহজে ফয়সালা হয় না সেসব কেসের, পড়ে থাকে বছরের পর বছর । কালো প্যাঁটরার ওপর জমতে থাকে কালো প্যাঁটরার পাহাড় । অ্যাকাউন্টস অফিসার চেঁচায়, ‘বাঞ্চোতগুনো সুইস ব্যাঙ্কে রাখলেই পারতো, নিজের বাড়িতে কেন যে লুকিয়ে রাখে ।’

ব্যাপারটা দেখার অনুসন্ধিৎসায় সুশান্ত একটা ফাঁকা চুরুট বাকসো, ওর জ্যাঠার, চটে মুড়ে সিল করে রেখে এসেছে । ননীগোপাল বসু সেদিন ভল্টের বিঘত লম্বা চাবির গোছা ঝুলিয়ে, নাকে রুমাল বেঁধে, পচা টাকার গোটা পঞ্চাশ বস্তা পোড়াতে নিয়ে যাবার জন্যে বের করছিলেন, সুশান্তকে বললেন, ‘বাঃ, এই বয়সেই গুছিয়ে নিয়েছ বেশ ।’

পাটনা শহরে যেবার বন্যার কোমর-উঁচু জল ঢুকেছিল, বেসমেন্টের নতুন-পুরোনো সব নোট গলে হালুয়া হয়ে গিয়েছিল তিন দিনে । চরম ক্ষতি হয় রাম ইকবাল সিং হিন্দি অনুবাদকের । নেপাল থেকে দু’কিলো ভালো জাতের আফগানি চরস এনে রেখেছিল, ঠাকুরের গয়না বলে ।

ননীগোপালবাবুর কাজটা উচ্চপদ্সহ মুদ্দোফরাসের । দিনের পর দিন নাকে রুমাল, টাকে তোয়ালে, অলস দুপুরের টাক-ঝলসানো রোদে,  চুল্লির জানলাফোকর দিয়ে, গুণে-গুণে অগুনতি বিষাক্ত বাণ্ডিল ফেলা, কেরোসিন ছিটিয়ে আগুন ধরানো, দাউ-দাউ ওব্দি শিমুল গাছের ছায়ায়, উনুনবাড়ির চুল্লির খিড়কিতে তালা দেয়া, তালা টেনে দেখা, পরের দিন সকালে এসে ছাই খুঁচিয়ে পরখ কোনো নোট বেঁচে আছে কিনা । সে-সময়ে ময়লা নোটের শ্বাসকষ্টে ঠাস করে ফেটেছে, ননীবাবুকে অবাক করে, শিমুলের উদাসীন বিগতযৌবন তুলোকৌটো ; মুহূর্তখানেকের জন্যে ননীগোপাল-যন্ত্রকে খোকাপুরুষে পালটেছে  বসন্তঋতুর ইয়ার্কি ।

হেডঅফিস থেকে উড়ো খবর এসেছে যে নোট পোড়ানো বন্ধ করে এবার নোটের পাল্প তৈরি হবে আর তা থেকে কাগজ তৈরি হবে । পাল্প তৈরির মেশিন বসবে কয়েকটা সরকারি কেন্দ্রে । সেখানে চালান যাবে বস্তাভরা পচা নোট ।

চুল্লিটার দেয়ালে এক অবিবেচল অশ্বথ্থগাছ, পাত্তা না পেলে এসব গাছগাছালির যেমন হয়, হু-হু বেড়ে চলেছে, কেউ ওপড়াতে চায়নি । এখন কাটতে কারোর সাহসে কুলোয় না, কাটলে বংশরক্ষা হবে না । রাঘব খুঁজে-খুঁজে কাহার কুর্মি দুসাধ মুসহর চামার হাজাম পাশি ডেকে এনেছে । তারপর শিয়া সুন্নি কুরেশি বোহরা আহমেদিয়া শিখ খ্রিস্টান কাঠুরে ছুতোর বা কসাই । ‘হায় বাপ, পিপল,’ বলে পালিয়েছে সবাই ।

‘রাঘববাবু, ইউ ক্যান নট কাট ডাউন দি পিপল,’ বাঁ হাত দিয়ে ডান কান থেকে রুমালের খুঁট তুলে বলেছেন ননীগোপাল, অনেকের মতে কমরেড ননীগোপাল ।

ননীবাবুর এই অনুমান যে যতদিনে জোয়ান গাছটা চুল্লিটাকে খাবে, ততদিনে অবসর প্রাপ্তি ঘটে যাবে ওনার, কপালের ওপর আব বেড়ে আলুর মতন হয়ে গেলেও ক্ষতি নেই । ধারণাটা ঘা খায়, চুল্লিটার ওপর প্রচণ্ড বৃষ্টির রাতে লকলকিয়ে বাজ পড়লে । অশথ্থ গাছটা জাগ্রত প্রমাণ হওয়ায়, কর্মচারী অফিসার ফিরিঅলা দালাল সবাই সেলাম ঠোকে গোড়ায় । বেচয়েন লাল সেখানে পয়সা ফেলার বাকসো রেখেছে কোঅপারেটিভ ক্রেডিট সোসায়টি আর কোঅপারেটিভ স্টোরের সিংকিং ফাণ্ডের জন্য । রাণা রামদেও সিং কোঅপারেটি স্টোরের সচিব থাকাকালে, তালের টিন গুঁড়োদুধের টিন জ্যাম জেলি স্কোয়াশের বোতল ইঁদুর আরশোলা আর মাকড়সায় খেয়ে ফেলেছিল । অডিটাররা বিশ্বস করেছে রানা রামদেও সিং-এর বক্তব্য ।

মুখার্জি এসেই বেচয়েন লালের বাকসো সরাতে চেয়েছিলেন । হেডঅফিসে ফ্লপিতে লিখে নোট পাঠিয়েছিলেন, কুরিয়ারে, তখন ইনটারনেট বসেনি পাটনা অফিসে । যাবার দিন গাছটার গোড়ায় সশ্রদ্ধ প্রণাম জানিয়ে একটা পাঁচশো টাকার নোট ঢুকিয়ে গেছেন বাকসোটায় । উনি যেসব অখদ্দে নোট পাস করেছেন, সেগুলো পুড়ে নষ্ট হবার পরই ধ্বসেছে চুল্লিটা । আসছে মাসের ছাব্বিশ লাল পেনসিল হাতে তারিখে অডিট পার্টি এসে পড়বে ।

রাঘব : ননীদা তো স্বেচ্ছা অবসর নিয়ে নিলেন গো । সোনালি করমর্দন । গ্র্যাচুইটির টাকায় বাংলাদেশি মেয়ে কিনছেন কোন নোট এক্সচেঞ্জারের কাছ থেকে । হিন্দি মতে বিয়ে করবেন ।

রমা : উনি নাকি ভারজিন ?

রাঘব : হ্যাঁ, বিহারে থেকেও ভারজিন রয়ে গেলেন । আমাকে বিয়ের যোগাড়যন্তর করতে হবে আর সম্প্রদান ।

রমা : যাক, একজন সুপারঅ্যানুয়েটেড জামাই বোনাস ।

রাঘব : গোলমাল হবে না তো ? মেয়েটা বগুড়ার মুসলমান । ঝি-গিরি করে থাকা-খাওয়া কুলোচ্ছিল না, তারপর শরীর বেচত । হিন্দু-মুসলিম দাঙ্গাফাঙ্গা না বেধে যায় ।

রমা : তুমি অত ভিতু কেন ? বাংলাদেশ স্বাধীন করতে যুদ্ধ করতে গিসলে, আর এটুকু সামলাতে পারবে না ? তা ননীদার খর্চাখরচ কেমন পড়ল ?

রাঘব : পনেরো হাজার । দেখতে-শুনতে নাকি দারুণ । ইচ্ছে করে নোংরা সেজে থাকে মেয়েটা, যা শহরের অবস্হাগতিক ।

রমা : ননীদার তো কোনও টেলিফোন আসে না ।  নোটের ছাই ঘাঁটতে-ঘাঁটতে  মড়ার সোনার আঙটি !

বিয়ের রাতে, ক্লার্ক অওয়ধ হোটেলের ব্যাংকিয়েট হলে, লোহার হোমকুণ্ড থেকে হিলহিলে ধোঁয়াক্কারে, লিট্টি, বথুয়াশাক, মেথিফোড়ন-দেয়া খোসাসুদ্দু আলুরসুন, বেগুনের ভরতা, লাউয়ের পায়েস, আটার কাচাউড়ি খেতে-খেতে সুশান্ত আর অতনু থ, স্তম্ভিত, হতবাক, এঁটোহাতে কর্তব্যবিমূঢ় ।

সম্রাট হোটেলে মুখার্জির ঘরে যে মেয়েটি ঢুকেছিল প্রথম দিন, আর অতনুর দেহ  ওর জীবনে অর্গলবর্জিত হতে প্রশ্রয় দিয়েছিল, সেই রহস্যময়ীর নাবাল সুগন্ধ, দুজনের কাঁধে ভর দিয়ে, আলপনা আঁকা পিঁড়ের ওপর, সে এক বিপর্যয় । ওরা দুজনেই মনে-মনে চেঁচাচ্ছিল, যা কেবল ওরা দুজনেই, সুশান্ত আর অতনু শুনতে পাচ্ছিল, “ননীদার কাছে যেও না ; আমরা আওরংজেবের অর্ধেক রাজত্ব দিয়ে দেব ।”

‘আর করলার খোসা শুকিয়ে খাবেন না ননীদা, ঠোঁট দুটো মিষ্টি রাখবেন, বহুমূত্র, সরি, অ্যাঁ, ডায়াবেটিস সামলাবার বদ্যি তো পেয়ে গেলেন’, প্রশাসন বিভাগের অরিন্দমের মন্তব্যে নিজেদের সামলে ওঠার সময় আর সুযোগ পেল সুশান্ত আর অতনু ; আর সেই ফাঁকে পকেটে বাঁ হাত ঢুকিয়ে তটস্হ ভাব দূর করতে চাইল সুশান্ত, অতনু ধুতির কোঁচায় । ঘাড়ের কাছটা, লাল ব্লাউজের ওপর যেটুকু খোলা, সুশান্ত মনে-মনে সেখানে ঠোঁট চেপে রইল ।

মালাবদল করতে-করতেই, ননীগোপাল ধমকে উঠলেন অরিন্দমকে, ‘অতনু-সুশান্তদের ক্যাশ সাইড থেকে ক্লারিকাল সাইডে বদলির কেসটা চেপে রেখেছিস কেন ?’

চন্দ্রকেতু সিং জানালো, সবাই বাংলায় কথা বলছে বলে, কিছুই টের পাওয়া যাচ্ছে না । ওর রাজপুত ভূমিহার স্যাঙাতরা ওর সমর্থনে হইহই করে ওঠায়, বেচয়েন লাল বাঙালিদের তরফ নিয়ে নিলে তড়িঘড়ি, কেননা এদান্তি ও কমিউনিস্ট নেতা জগন্নাথ সরকারের সঙ্গে ওঠবোস চালু করেছে, ইউনিয়ানের নির্বাচনে বাঙালিদের ভোট টানতে হবে ।

চশমা, বাইফোকাল, পরে যাতে শুভদৃষ্টি করতে না হয়, তাই নরম কনট্যাক্ট লেন্স, বশ অ্যান্ড ল্যাম্বে ধোয়া, করিয়েছিলেন ননীদা । আর তেমন বুড়িয়ে যাওয়া ঘোলাটে ঘোলাটে দেখাচ্ছিল না ; গোঁফে কলপ, ঠোঁটে হালকা লিপ্সটিক, দামি পারফিউম, শ্যাম্পু-করা বুকে আধপাকা চুল, দুবাই থেকে ঝকঝকে জুতো, নেপাল থেকে চিনা-সিল্কের পাঞ্জাবি, ঢাকা থেকে ধুতি, যতোটা দেখন-জোয়ান করে তোলা যায় ।

মামুদ জোহের ওর পুরো নারী-নারকো গ্যাঙ নিয়ে, অসীম পোদ্দার, দেবেন্দর প্রসাদ, মলয় রায়চৌধুরী, শিবু পালিত, সজল, অশোকতরু, কমলেশ, প্রতুল, নরেশ, রবীন দত্ত, পুলক, সুশীল প্রায় সবাই হাজির । সারারাত সে কি নাচ ! দমাদম মস্ত কলন্দর, কোই মুঝে পগলা কহে, দম মারো দম, ডিজের ফাটা রেকর্ড ঝমাজঝম । সবাই টঙ । টাল্লি । টাইপিস্ট বাহাদুর চউবে, কর্মচারীদের দশ টাকায় দশ পয়সা প্রতিদিন হিসেবে ধার দেয় । একপাশে দাঁড়িয়ে নিজেদের দলে মানসী বর্মণ, শ্যামলী কর্মকার, উমা ভর্মা, নয়নিকা জায়সওয়াল আরও অনেকে । দপতরি গুলাব শর্মা, ছোটো জাতে বিয়ে করে আর ফেরত যেতে পারেনি গ্রামে । ভাজপা, ইনকা, ভাকপা, জপা, জদ গোষ্ঠীর অনেকে । দালালরা নতুন পোশাকে । এলাহি ।

দিনভর জোয়ান হয়ে ওঠার অফুরন্ত নাড়িস্পন্দনের দাবদহে ননীগোপাল নিজের সঙ্গে তর্কে ব্যস্ত, চাউনি দিয়ে ঘেরাও । জানলায়, হলদে নরম কলকে ফুলের দুর্বল ডালে, ভোরবেলায়, দোয়েল পাখির বন্দিশ আশ্রিত গান । পৃথিবীতে এর আগে কলকে ফুল দোয়েল পাখি ছিল না । হুড়মুড় কোথ্থেকে এসে পড়েছে বর্ষাকাল । অন্ধকারের অন্দরমহলে নক্ষত্রদের অবাধ গতিবিধি । বার্ধক্যের কাছাকাছি যখন, বিয়ে করে, শৈশবে হারানো বগুড়া ময়মনসিংহ খুঁজে পেলেন তার অপাপবিদ্ধতার গভীরে, সেখানে, সে অতল-গভীরে, রুই মাছের পিচ্ছিল ঝাঁক পাশাপাশি রুপোলি বাসা বাঁধে ।

ননীগোপালের বিয়ের রাতেই কিছুটা অপ্রকৃতিস্হ দেখাচ্ছিল অরিন্দমকে, মদ তো খায়নি ও । তবু কথায়-কথায় ‘না।’ কেউ কিছু না বলতেই, বাসর জাগার মাঝে, ‘না।’ ‘না।’

–এই অরিন্দম ।

–না ।

–কী হয়েছে ?

–না ।

–আরে, কী হয়েছে ?

–না ।

–যাঃ ।

–না ।

–ইয়ারকি রাখুন তো ।

–না ।

–বোকা নাকি !

–না ।

–নাটক বন্ধ কর দিকিনি ।

–না ।

এক্কেবারে মাথা খারাপ হয়ে গেল শুমুলতলা থেকে ফেরার পরই । ওর মামা চালান করে দিলেন কলকাতার লুম্বিনি পার্ক । ‘কেমন যেন অসংলগ্ন কথাবার্তা বলছিল এদান্তি, তোমরা কিছু জানো ?’ পাশের ফ্ল্যাটের তিরিশোর্ধ গৃহবধুর সঙ্গে অফিস পালিয়ে দুমদাম দুপুর কাটাচ্ছে, জানত ওরা । বলল, সুশান্তই বলল গোবেচারা মুখে দুশ্চিন্তার অভিনয় টাঙিয়ে, ‘না, আমাদের তো কিছু বলেনি ও।’ অরিন্দমের থেকে সাত বছর বড়ি পীনোন্নত মহিলা আসল কাজটা করতে দিচ্ছেন না, অথচ চলছে দুবছর, মুখ আর আঙুল দিয়ে পারস্পরিক যেটুকু হয় । শেষ হাসিখুশি ছিল অরিন্দম শিমুলতলার ক’দিন । তারপর আবিষ্কৃত হয় লুঙ্গি গেঞ্জিতে মোগলসরাই স্টেশানে । নতুন টাকার ষোলোটা প্যাকিং বাকসো বেনারসে স্টেট ব্যাঙ্কে পৌঁছে ফেরার সময় শিবু পালিত ওর কাঁধে হাত রাখতেই, ‘না’। ব্যাপার কী জানতে চাওয়ায় একদলা থুতু বাঁ হাতের তেলোতে নিয়ে কপালে ছপ । সেই কবে বাবা মারা গেছেন অরিন্দমের । বোনের বিয়ে হয়েছে আকাশবাণীর এক গায়কের সঙ্গে । মা আর ছোটো ভাই ।

অরিন্দমের মামার বাড়ির বাইরে বেরিয়ে, গেটের কাছে, ‘পাশের ফ্ল্যাটেই চলছে দু’বছর অথচ ওর মা কেন টের পাননি ?’ প্রশ্নের মধ্যে প্রমেথিয়াসের মতন মুকখু হয়ে উঠতে চাইছিল অতনু ।

শিমুলতলায় ইউনিয়ানের হলিডে হোমে হুড়দংগ । অতনু সুশান্ত মৌলিনাথ অরিন্দম । রাত্তিরে পাথুরে পথে জোনাকি-ওড়ানো অন্ধকার বুনো বাতাসে চারজন উদোম উলঙ্গের লাট্টুপাহাড় জয় । দুপুর পাহাড়ি নদীর জলের তলায় ডুবে জলেতে কেবল উচ্ছৃত শিশ্নটুকু ভাসাতে, মৌলিনাথের ওয়াটার অর্কিড দর্শণ আর চিৎকার । জলে কিছুতেই নামতে চাইছিল না গৌর-গা মৌলিনাথ । অরিন্দম কালো, শৈশব থেকে সর্ষের তেল মালিশ-খাওয়া চিকনত্বক কালো, নার্ভাস হলে নাক খোঁটে ।

‘চেহারা তো কয়লার খাদান, কী করেই বা মেয়েমানুষটা হ্যাণ্ডল করছে আপনাকে,’ অরিন্দমের ভাসমান শিশ্নকে উদ্দেশ্য কে ক্রুদ্ধ মৌলিনাথ, মোটা কাচের চশমায় খুদে-খুদে চোখ । অফিসে বসে দুপুরের লাঞ্চ-খাওয়া হাই তুলতে গিয়ে রেটিনা ফ্র্যাকচার । ভর্তির পরীক্ষায় কেরানিদের তালিকায় শীর্ষে ছিল মৌলিনাথ । রমা ব্যানার্জির জন্যে রাঘবের সঙ্গে অসম প্রতিযোগিতায় নেমেছিল রোগা পাতলা কালো অরিন্দম । অরিন্দম জিততে-জিততে ছেড়ে দিলে । পাশের ফ্ল্যাটে ততদিনে বগলকাটা ব্লাউজের খাঁজ নামতে নামতে করাঘাতের আওতায় ; সন্দেহের অতীত তখন হয়ে চলেছে জীবনের সার্থকতা ।

–ননীদার বউয়ের নাম জানেন নাকি ? মৌলিনাথ প্রসঙ্গ পালটাতেই জলের তলা থেকে শেকড়ের ঝুরিসুদ্ধ উঠে এসেছিল তিনটে তিন রঙের অর্কিড ফুল ।

–সুলতানা, সুলতা বলে ডাকেন ননীদা ।

–তুই কী করে জানলি ?

–রাঘব নেমন্তন্ন করেছিল ওনাদের ।

–ননীদার বউ কি শাড়ি পরে না শালোয়ার ?

–শাড়ি, শাড়ি । তোর প্রেমিকাদিদির মতন ল্যাংটো থাকবে নাকি, ঠিক দুকুরে !

–না, মানে…

–ননীদার কিন্তু উচিত ছিল আমাদের ফিইস্ট দেয়া ।

–তারপর আপনি ঢুকে পড়ুন ওনার হেঁসেলে ।

–ঢুকতে দিলে ঢুকব ।

–ছুঁচ যখন ফাল হয় তখন ছুঁচের কষ্ট কেই বোঝে না ।

–শাল্লাহ ।

চানটান করে ফেরার পর গায়ে, মানে চুলহীন বুকে, আর ভাতখোরের সদ্যনতুন নেয়াপাতিতে পাউডার মেখে, হলিডে হোমের গাড়িবারান্দার সিঁড়িতে বসেছিল, পরিপাটি চুল, কাঁধে পৈতে, স্মৃতির ধোঁয়াটে এলাকায়  ঘুরছিল এক মনে অরিন্দম । মৌলিনাথ বেশ কিছুক্ষণ যাবত অরিন্দমের খোলা পিঠের বাঁ দিকে আলতো ঘুষি সহযোগে, ‘প্রেম করা হচ্ছে ! পরকীয়াবাজি ! অ্যাঁ ?’ বড়বড় করে যাচ্ছিল অবিরাম । আচমকা খেঁকিয়ে অরিন্দমের ককিয়ে ওঠা, ‘কী হচ্ছে কী, লাগে না নাকি !’ শিশুরও লা্বে না এমন আদর-ঘুষি, ওরা তিনজন স্তম্ভিত, বিব্রত । চুপচাপ ।

গলা খাঁকারি দিয়ে অতনু, ‘যাই, দাড়িতা কামিয়ে আসি’, আর সঙ্গে-সঙ্গে সুশান্ত, ‘চল, আমায় একটা শ্যাম্পুর স্যাশে কিনতে হবে।’ রাস্তায় রাস্তায় ফ্যা-ফ্যা শেষে সন্ধে নাগাদ ফিরে এসে ওরা দুজন দেখল, কাঠের বাসন্তী আঁচে সুস্বাদু খরগোশ ঝলসাচ্ছে মৌলিনাথ আর অরিন্দম, লোহার শিকেতে ন্যাকড়ামোড়া দুটো দিক বাঁ-হাত ডান-হাত করছে । মুখময়, দু-জনেরই, উপশমহীনতার আভা । চোখে-মুখে নগর জিয়ন উপভোগের করুণ ও দয়নীয় আনন্দপ্রবাহ । খেতে-খেতে, খাবার পর, শুতে যাবার সময়, কেউ কোনও কথা বলেনি । সকালে মিটকি মেরে পড়ে থেকে চারজনেই দেরিতে একে-একে উঠেও কথাবার্তা না-হওয়ায়, সুশান্ত চেঁচিয়ে উঠেছিল, ‘শিমুলতলা তো দেখা হয়ে গেল । আর কী ? ফেরা যাক তাহলে ।’ ও, সুশান্ত, নিজের ব্যাগ গোছানো আরম্ভ করলে, অরিন্দম মৌলিনাথ অতনুও দেখাদেখি ।

মনের মধ্যে বিতর্কিত মতান্তর চলছিল চারজনের । যে যার নিজের ।

মৌলিনাথ : কোথ্থেকে এই পাতিপুরুষ নোটগুনিয়েদের পাল্লায় পড়লুম । না আসলেই ভালো ছিল । চারদিনের ছুটি নষ্ট । ঘোরাঘুরি আর খাওয়া । বই নেই কাগজ নেই টিভি নেই । পড়াশুনা করে না, গবেটের দল । ছ্যাবলামি আর নোংরামো । ভদ্রতা নেই, আদর্শ নেই, চিন্তা নেই । অফিসে চারদিনে অনেক কাজ জমে যাবে । অ্যাকাউন্টেন্ট মিত্র সায়েব হাসি-ঠাট্টা করবেন । জ্যোতিন্দর প্রসাদকে বলে আসা হয়নি । তাড়াহুড়োয় ছুটির দরখাস্তটা কমরেড এ কে সিনহাকে দিয়ে এসেছিলুম ।

সুশান্ত : জায়গাটায় কোনো ব্যবসার জিনিস কালেক্ট করার সুযোগ নেই । এটা এক্কেবারে ট্যুরিস্টদের স্বাস্হ্য ফেরাবার আড্ডা । প্রেমিক-প্রেমিকা টাইপের ছেলে-মেয়েও রয়েছে, কনডোম তো গেস্টহাউসেই গোটাদশেক পড়ে থাকতে দেখেছি, নানা রঙের । প্রেমের আবার রঙও হয় । দুধের মিষ্টি এখানে প্রচুর হয় বটে, কিন্তু তা পাটনায় নিয়ে গিয়ে বিক্কিরি লোকসান । ফলটল বাইরে থেকে আসে । লর্ড কর্নওয়ালিসের পেয়ারের জমিদারদের স্বাস্হ্য ফেরাবার কিংবা মোসাহেব সঙ্গে নিয়ে মাগিবাজি করবার বাগানবাড়িগুলো ভেঙে পড়ছে, প্রোমোটারদের নজরে এসেছে মনে হচ্ছে । কয়েকটা পালটে গেছে হলিডে হোমে, যদ্দিন টেকে, ধ্বসে না পড়ে । হোমগুলোর জন্যে মদের দোকান চলছে । আরেকটু খোঁজখবর করা যেত । ভেস্তে দিলে অরিন্দম আর মৌলিনাথ । পরে কাকার সঙ্গে আসব একবার । মা-বাবারও ভাল্লাগবে জায়গাটা । আসাম থেকে এক ট্রাক আনারস আনার জল্পনা করছিল কাকা । কদ্দুর এগোলো কে জানে।

অরিন্দম : আমার অবস্হা তো কেউ আর বুঝবে না । মিথ্যে নিয়েও কী গভীর সম্পর্ক গড়ে ওঠে । অসহ্য । এই দুর্গতি থেকে আরোগ্যের উপায় নেই । অথচ জীবনে বিরুদ্ধে আমি কিছুই করিনি । পালাতে হবে । দুঃখের নিজস্ব আনন্দ থেকে পালাতে হবে । কোথায় যাব ? নিঃশ্বাস ধরে রাখার ক্ষমতা আর আজ আমার নেই । পালানো কি নৈতিক বিজয় নয় ! ধাতানি খেয়ে গড়াতে-গড়াতে মানুষ নিজের ঠাঁই টের পায় । জানাজানি হলে আত্মহত্যা ছাড়া উপায় নেই । কী ভাববেন মা ? না । না । ছেড়েছুড়ে চলে যাব অন্য কোথাও । কাশি গঙ্গোত্রী হরিদ্বার দ্বারকা রামেশ্বরম । কলকাতায় বদলির দরখাস্তটা মঞ্জুর হয়ে গেলে বেঁচে যেতুম ।  ওখানেও যদি জেনে যায় সবাই ? ফালতু ছেঁদো লোকেরাও ঘেন্না করার টিটকিরি মারার বিচার করার ক্ষমতা পেয়ে যায় । কেন যে এমন একটা বিপদে আটকে গেলুম ! নেকড়েরা কবর খুঁড়ে লাশ খাবে । পাড়াপড়শি সহকর্মী মৌলিনাথ সবাই জুরি । অবুঝ । ওদের নিয়ম-নীতির বাইরে গেলেই প্রতিশোধ নেবে । ওফ ।

অতনু : জায়গাটা সত্যি, পৃথিবীর বোধহয় সব জায়গাই, কেমন যেন ভালো লেগে যাবার ব্যবস্হা করে রাখে । এরা সব নিজের হ্যান নিজের ত্যান নিজের অমুক নিজের তুসুক নিয়ে কাটিয়ে দিলে । আমিও তো, অন্যের কোনও কাজে এলুম না । নিজেরই বা কী কাজে এলুম ? আমার বেঁচে থাকার মানে কি কেবল আমার ? অরিন্দমের প্রশ্বাসেও রয়েছে স্বীকারোক্তি : প্রেম চাই, নারীর দায়-দায়িত্ব চাই না । অবশ্য, একজন মানুষের গোপনীয়তা তার নিজের । কেন কিছু ব্যাপার গোপনীয় ! এটা আসলে একরকমের চুরি । তালা তো আগে তৈরি হয়, চাবি পরে । জীবনে অনেক ঘটনা এমন যে অপরাধ আর বিচারের তফাত থাকে না । পিঠে লাঠি খেয়ে অনুভবের নতুনত্ব আসে । তা নতুন তো বটে !

 

‘–চল, ইস্টিশানে গিয়ে ট্রেনের টাইম দেখে নেব । কোনও না কোনও ট্রেন তো থাকবে । আমি রেজিস্টারে সই করে চৌকিদারের হিসেব মিটিয়ে দিয়েছি ।’ সুশান্ত জানালো ।

স্টেশানে পৌঁছে প্রচণ্ড ভিড় । শ’দুয়েক লোক প্ল্যাটফর্মে । ট্যুরিস্ট নয় । কালো আটপৌরে সাধারণ মানুষ, নোংরা, গরিব, স্নানহীনতার দুর্গন্ধ । অনেকের হাতে ঝাণ্ডা, কে জানে কোন দলের । দূর থেকে দেখা যাচ্ছিল পাটনাগামী ট্রেন আসছে । চুম্বকে আলপিনের মতো ঝুলছে মানুষ, ট্রেনের ছাদে, এনজিনের সামনে । খাটোধুতি, প্ল্যাটফর্মে বসে-থাকা এক বৃদ্ধের কাছে সুশান্ত, তার হাত থেকে ঝাণ্ডাটা চেয়ে নিয়ে, জানতে পারল, গত আট আগস্ট জামশেদপুরে ঝাড়খণ্ড মুক্তি মোর্চার তরুণ তুর্কি নেতা নির্মল মাহাতো খুন হয়েছেন, তার মানে যেদিন ওরা এখানে এসেছিল, সেই দিনই । এরা সবাই পাটনা যাচ্ছে গুসসা অভিযানে ।

ট্রেনের ঢোকা কেবল দুষ্কর নয় অসম্ভব আঁচ করে, হাতের ঝাণ্ডা উঁচু, ট্রেন এসে পড়েছে প্ল্যাটফর্মে, সুশান্ত ঝাণ্ডা উঁচু করে, যত জোরে পারে চেঁচিয়ে উঠল, ‘নির্মল ঞাহাতো জিন্দাবাদ ।’

: জিন্দাবাদ, জিন্দাবাদ ।

: মাহাতোজি অমর রহে ।

: অমর রহে, অমর রহে ।

: নির্মল মাহাতো ।

: জিন্দাবাদ ।

: জিন্দাবাদ, জিন্দাবাদ ।

: নির্মল মাহাতো জিন্দাবাদ ।

: ঝাড়খণ্ড মুক্তি মোর্চা ।

: জিন্দাবাদ, জিন্দাবাদ ।

তাকে ঘিরে-ওঠা ভিড়কে সঙ্গে নিয়ে একটা কামরায়, শোষক আর শোষিতের আবহমান সম্পর্ককে কাজে লাগিয়ে, ট্রেনের কামরায় ঢুকে গেল সুশান্ত । ওরা তিনজন পারল না উঠতে । ছেড়ে দিল ট্রেন । ট্রেন অদৃশ্য হলে স্টল থেকে একটা খবরের কাগজ কিনলে মৌলিনাথ ।

দক্ষিণ বিহার জুড়ে হরতাল । গমহরিয়ার কংগ্রেসি অমরেন্দ্র সিনহা, ডুমারিয়ার বনরক্ষক প্রয়াস পাসওয়ান, আদিত্যপুরের সতীশ শর্মাকে  কুপিয়ে মেরেছে রাগি জনতা । রাঁচি চাইবাসা জামশেদপুর দুমকায় ভয়ে কেউ বেরোচ্ছে না রাস্তায় ।

টিসকোর চামারিয়া গেস্টহাউসের পোর্টিকোয় পৌড়ায়াটের ঝাড়খণ্ডি বিধায়ক সুরজ মণ্ডল আর নির্মল মাহাতো কথা বলছিলেন স্হানীয় দুই সংবাদদাতা এন কে সিং আর সুনীল ব্যানার্জির সঙ্গে । অওতার সিং তারির মায়ের শ্রাদ্ধ ছিল, তাই রাঁচি থেকে আসার সময়ে মোর্চার কর্মকর্তা বাবুলাল সোয় আর শিবাজি রায়ও মাহাতোজির সঙ্গে ছিলেন । সকাল সাড়ঢ নটা নাগাদ দেখা করতে এসেছিলেন ম্যাজিস্ট্রেট টি এন শর্মা । তারপর কালীপদ মাহাতো যে গাড়িটা কিনেছিল, যেটাকে ঝাড়খণ্ড ক্রান্তিরথে পালটে বিহার বাংলা ওড়িশা ঘোরার পরিকল্পনা, সেটার অনুমোদন শেষে পোর্টিকোয় কিছুক্ষণ অপেক্ষা করছিলেন দুজনে । আচমকা ঘঢ়টানি খেয়ে একটা গাড়ি এসে থামতে, পাখির ডানার মতন গাড়ির চারটে দরোজা একসঙ্গে খুলে, দুমদাম তিনজন বন্দুকধারীর সঙ্গে নামে জামশেদপুরের রংবাজ বাহুবলী বীরেন্দর সিং আর তার দুই ভাই পণ্ডিত-পপপু । চিৎকার করে হুকুম দেয় বীরেন্দর, ‘দুটোকে আজকে এখানেই উড়িয়ে দে ।’ দুজন ঠিকেদার সুনীল সিং আর শংকর সিংও দাঁড়িয়ে ছিল পোর্টিকোয় । ভ্যাবাচাকা কাটিয়ে ওঠার আগেই চলতে থাকে গুলি । নির্মল মাটিতে, রক্তে । সুরজ মণ্ডলের ডান হাত এফোঁড় ।

আগের বছর সোনারিতে, নভেম্বরে, বীরেন্দরের ওপর কয়েকজন লোক চড়াও হয়ে খুন করতে চেয়েছিল ওকে । নির্মলসুদ্দু মোর্চার ছ-সাত জনের নামে পুলিশে এফ আই আর করেছিল ও, বীরেন্দর । এও জানিয়েছিল যে সুবর্ণরেখা পরিকল্পনায় নির্মল বাইরের ঠিকেদারদের আনত, প্রায় নিয়মিত । ঠিকেদারির মালকড়ির বাঁটোয়ারায় নাকি গণ্ডোগোল । এদিকে সুরজ মণ্ডল বলছে যে পুরো ষড়যন্ত্রটা সেচ আর সংসদীয় মন্ত্রী রামাসুর পরসাদ সিং-এর, আট বচ্ছর যাবত বিশ সূত্রীর পুরো টাকা, সিংভূমে খরচ করার বদলে নিজে হড়পে নিয়েছে । বীরেন্দর ওর স্যাঙাত ।

তাত আগের বছর, মানে আগের বছরের আগের বছর, গরমকালে, সাহেবগঞ্জের ঝাঁঝিতে, গলায় ঝোলানো নতুন ডুগডুগি বাজাতে-বাজাতে একজন সাঁওতাল যুবকের পেছন-পেছন তীর-ধনুকধারী সাঁওতাল পুরুষ আর খোঁপায় ফুলগোঁজা নারীদের বিশাল মিছিলের ওপর পুলিশ যাণ পড়পড়িয়ে গুলি চালায়, যেন দোলের পিচকিরি নিয়ে রঙ খেলছে, পনেরোটা লাশ পড়ে গেলেও পালায়নি কেউ, কাননা মন্তর পড়ে নাচতে-নাচতে প্রায়-উদোম জানগুরু  ঝাড়ফুঁক দিয়ে হাপিস করার চেষ্টা করছিল পুলিশ আর গুলিগোলার । ঝাঁঝি থেকে দিকুগুলোকে বিঠলাহা করার জন্য গ্রামে-গ্রামে সবুজ পাতা পাঠিয়ে বার্তা পৌঁছে দেয়া হয়েছিল আগেই । কারি-পাহাড়পুর রকসি সবৈয়া কান্দর বড়াকেঁদুয়া জরদাহা পোখরিয়া এসব দুর্গম গ্রামে পুলিশের সঙ্গে ষড় করে দিকুরা মেরে ফেলেছে অনেক সাঁওতালকে । এই তালে, আইনশৃঙ্খলার গোঁজামিলে, উপজাতি এলাকার পাদরি, ফাদার অ্যান্টনিকে গুলি করে মেরে ফেললে পুলিশের দল, সাঁওতালদের ওসকানোর গুরু ঠাউরে ।

গণ্ডোগোলটা আরম্ভ হয়েছিল, জঙ্গল ইজারার ঠিকেদার, কঠের চোরাচালানি দিকু মোতি ভগত আর বনরক্ষক এরিক হাঁসদার হিসসা ভাগ নিয়ে । পুরো যতটা হিসসা হওয়া উচিত, তা পাচ্ছে না, এই উষ্মায় এরিক হাঁসদা বোরিয়া থানায় মোতি ভগতের বিরুদ্ধে এজাহার ঠুকে দিতে, মোতি ভগত থানার সবাইকে তোড়ে করকরে মিষ্টিমুখ করাবার ফলে, ভগত পেল কংগ্রেসের লোকজন, আর হাঁসদা পেল ঝাড়খণ্ড মুক্তি মোর্চা । একদিকে দিকু আর রাষ্ট্র, অন্যদিকে অরণ্য আর উপজাতি ।

 

মৌলিনাথ চশমার পুরু কাঁচ পুঁছতে-পুঁছতে, ‘কবে সেই বিভূতিভূষণের আরণ্যক পড়ে ছিলুম ; আমরা তাহলে আজ কোথায় দাঁড়িয়ে ?’

‘–ভেবে লাভ নেই, ঘুরেফিরে সব বাঙালি পরিবার ওই কথাই ভাবছে।’ অতনু ফুট কাটল ।

অরিন্দম কোনও কথা বলা দরকার মনে করেনি । শিকারের আগে গোখরো যেমন মাথা তুলে ব্যাঙকে অভিবাদন জানায়, কিংবা পুলিশের কবর খুঁড়ে গুমখুন লাশ তুললে মৃতদেহ যেমন নিজের মনে হাসে, ও-ও, অরিন্দম, ‘সকলেই অস্হিরতা্য় ভুগছে’, ভাবল ।

‘আর তো সন্ধে ওব্দি ফেরার গাড়ি নেই, চলুন না, দেওঘর বৈদ্যনাথধাম যাই ট্যাকসিতে,’ মৌলিনাথ প্রস্তাব দিতেই, আশ্চর্য, অরিন্দম সায় দিলে, ‘হ্যাঁ, হ্যাঁ ।

অতনু জানালো, পুকুরের ঠাণ্ডা জলে নামছে এমন সন্তর্পণে, ‘থ্যুৎ, আমি তো ধর্মের কিচ্ছু বুঝি না । নিউক্লিয়ার ফিজিক্স, টিশ্যু কালচার, পিনাল কোড, জয়েসের ইউলিসিসও যা, ধর্মও তাই ।’

অরিন্দম বিড়বিড় করছে দেখে, ফেলে পালানো সুশান্তর উদ্দেশে চাপা ক্রোধে মৌলিনাথকে জানালো, ‘পৈতে আকটা পরি, বিনা মন্তরের, অফিসের শাদা টোয়াইনের, নইলে মা অশান্তি করেন । রামাশ্রে পাসওয়ানকে বললেই নতুন টোয়াইন দিয়ে তৈরি করে দ্যায়, অফিসের ড্রয়ারে স্টক করা আছে । এখন ওব্বেশে দাঁড়িয়েছে । আমি দিগভ্রান্ত থাকতে চাই।’

খোকাবয়ব মৌলিনাথ দেখল ড্যাবড্যাবে, ফিসফিস করে বলা কথায় যে পুইরোনো তাচ্ছিল্য থাকে, বলল, ‘আরে, চলুন, চলুন ।’ মৌলিনাথ অরিন্দমের মধ্যে তুইতোকারি । অতনুর বেলায় বিশেষ মেশে না বলে, আপনি । নিজে থেকে এই প্রথম বাড়ির বাইরে বেরিয়েছিল অতনু । বাবা মারা যাবার পর । অরিন্দম আর ওর বাড়ির খবরাখবর জানলেও, কিছুই জানে না মৌলিনাথের পরিবারের বিষয়ে । বরানগরে ওর আত্মীয়রা থাকেন, হয়তো, বাবা-মাও, কিন্তু দ্যাখেনি কাউকে কখনও ; আলোচনা করে না বাড়ির ব্যাপারে । পাটনায় এসে মেসবাড়িতে, তারপর একটা ঘরভাড়া, এখন অফিসের কোয়ার্টারে । একা থাকে, একা রাঁধে, একা খায় ।

সামনের সিটে অরিন্দম, পেছনে মৌলিনাথ ঢুলছে অতনুর পাশে । ছুটন্ত পিচপথের দুপাশে যত রকমের সবুজ হয়, সোনাঝুরি আকাশমণি মহুয়া সিরিষ আম দেওদার শিশু অর্জুন তমাল আমলকি বট অশথ্থ তাল খেজুর পিয়াল বকুল মাতামাতি করছে, বাতাসের আদর খেয়ে । প্রতিধ্বনি থেকে নিজেকে মুক্ত করে নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে পাহাড়তলি । অতনু ভাবছিল, অরিন্দমকে বলবে, পশ্চাত্তাপ মানুষকে খাটো করে, কিন্তু বলতে পারল না ।

মৌলিনাথ আর অরিন্দম গেল শিবের পুজো দিতে, বাংলা জানা এক পাণ্ডার হেপাজতে । পাণ্ডার দেয়া ধুতি পরে । ওদের জামা জুতো হাতঘড়ি মানিব্যাগ পাহারা দিতে-দিতে সুশান্তর প্রশংসা করছিল অতনু । সুশান্ত কতো অনায়াস ; বেঁচে থাকার এজেণ্ডা সর্বদা তৈরি, মুহূর্ত অনুযায়ী এজেণ্ডা ।

জলপ্যাচপেচে দালানে খালি-পা, গ্যাঁদাফুলের মালা গলায়, চন্দনের তেলক কপালে, আঁজলায় কচি শালপাতার ঠোঙায় প্রসাদ নিয়ে ফিরলে, অতনু জানতে চাইল, ‘কতো গচ্চা গেল ?’ তাইতে অরিন্দম, ‘ঠাকুরদেবতা নিয়ে ঠাট্টা করবেন না ; পৈতেটা দেবতাকে উৎসর্গ করে দিলুম, আর পরব না ।’

মৌলিনাথ বলল, ‘তাড়াতাড়ি ছাড়ান পাবার জন্যে মানত করেছিস তো ? কাটিয়ে দে, কাটিয়ে দে ।’ অরিন্দম প্রতিক্রিয়া এড়িয়ে গেল ।

জামাকাপড় পরে ওরা অনুকূল ঠাকুরের আশ্রমের দিকে, এক্কাগাড়িতে । মৌলিনাথ গলা ছেড়ে দিয়ে, ‘বেএএদনায় ভোওওরে গিয়েছে পেয়ালাআআআ, নি্য়ো হে নিয়ো, হৃদয় বিদারি হয়ে গেল ঢালা, পিয়ো হে পিয়ো…’ । এক্কাচালক মৌলিনাথকে উদ্দেশ্য করে বলল, ‘আশ্রম মেঁ পিনা মনা হ্যায় ।’

গেটের কাছে নামতেই, এক আশ্রমিক যুবক অরিন্দম কে বলল, ‘স্যার, আপনার কানে-কানে একটা মন্তর ফস করে বলে দেব, জীবন জুড়িয়ে যাবে ।’ একটু দূরে নিয়ে গিয়ে, বকুল গাছের ছায়ায়, ছেলেটি অরিন্দমকে বলল, ‘স্যার দশটা টাকা দেবেন, দরকার আছে ।’ দিয়ে দিলে । দিতে গিয়ে মানিব্যাগে রাখা মহিলাটির ফোটোটা বের করে উড়িয়ে দিল কুটিকুটি ।

আশ্রমে ঘুরতে-ঘুরতে, এক বিশাল বাদামি কুঁজউঁচু সাহিওয়াল ষাঁড় পাঁচিল ঘেরা চৌহদ্দিতে দাঁড়িয়ে ছুঁচলো গোলাপি শিশ্ন বের করে পা পটকাচ্ছে দেখে, অরিন্দম হনহনিয়ে আশ্রমের অফিসঘরে পৌঁছে, সামনের প্যাংলা চেহারা চশমাচোখ মাঝবয়সীকে, ‘দাদা, দিয়ে দিন না একটা গোরু, কতো কষ্ট পাচ্ছে প্রাণীটা, ওই তো অত্তো গোরু রয়েছে ওখানে, ওর মধ্যে থেকে দিয়ে দিন না একটা ।’ ওনারা, বৈরাগী কেরানিরা, অরিন্দমের মুখের দিকে বলদ-চাউনি মেলে, নিজেদের সেরেস্তাদারি বাক্যালাপে ফেরত যায় ।

আবার এক্কাগাড়িতে, গানহীন, স্টেশানের কাছে হোটেলে খেয়ে, ট্রেন ধরল ওরা, তখন রাত অনেক । গাড়ির হ্যাঁচকায়, আচমকা রুকে গেল বলে, বাংক থেকে ঝুঁকে মৌলিনাথ জানতে চাইল, ‘কোন স্টেশান রে অরিন্দম ?’ তারপর সাড়া না পেয়ে আবার, কিন্তু জবাব না পাওয়ায় ঝুঁকে বুঝতে পারল সিটে নেই অরিন্দম । সামনের বাংকটায় অতনু বেঘোর । ঝিমুনির মাঝে সহযাত্রীদের কথাবার্তা থেকে কে একজন কাটা পড়েছে  শুনের বাংক থেকে নিচে লাফিয়ে ডাকল অতনুকে, ‘অরিন্দম সিটে নেই, কে একজন কাটা পড়েছে, গাড়ি থেমে আছে বেশ কিছুক্ষণ ।’

‘কী বলছেন কী,’ অতনু হতচকিত, ও-ও নামে লাফিয়ে, চটিতে পা গলিয়ে কামরা থেকে পাথরের ওপর, দৌড়োয় যেদিকে একদল লোক ভিড় করে দাঁড়িয়ে, আর পৌঁছে জোর দিয়ে ঠেলে  ভিড়ে সেঁদিয়ে যায় । বীভৎস । থেঁতো হয়ে গেছে একেবারে । হাত আর মাথা ধড় থেকে আলাদা ।

–সামনেকি গাঁও কি অওরত হ্যায় কোই । খুদকুশি করলি বেচারি ।

রক্তে জবজবে শাড়ি, কাটা হাতে সবুজ কাঁচের চুড়ি, ভাঙেনি, আতঙ্ক আর উদ্বেগ স্তিমিত হলে, লক্ষ্য করে ওরা দু’জন । কামরায় নিজেদের জায়গায় যখন ফিরল, তখনও আসেনি অরিন্দম । গাড়ি ছেড়ে দিল । ওরা নিজেদের মধ্যে অরিন্দমকে নিয়ে বলাবলি করছিল, কিছুটা চাপা উত্তেজনায়, আঁচ করে সামনের বুড়োটে লোকটা, বোধহয় কৃষক, বেশ চওড়া হাতের তালু, পাকানো রোদে পোড়া গড়ন । জানালো যে আপনাদের সাথী বাড় কিংবা বক্তিয়ারপুরে নেমে গেছে । শুনে, বিরক্তি আর রাগ হল দুজনেরই । ট্রেনটা আস্তে-আস্তে ফতুহা স্টেশান পার হচ্ছিল ।

ফতুহা !

এখানে, এই ফতুহায়, দেশ স্বাধীন হবার পাঁচ মাস আগে, তখন বিহারে কংগ্রেস দলের অন্তরিম সরকার, একটা ছুটন্ত মোটরগাড়িকে হাত দেখিয়ে, থামতে বলেছিল একদল পুলিশ । সবাই হিন্দু । ডাকাত ধরতে বেরিয়েছে । গাড়ির পেছনের সিটে কংগ্রেস দলের অধ্যক্ষ আবদুল বারি । দেশ স্বাধীন হলে উনিই হবেন রাজ্যের প্রথম মুখ্যমন্ত্রী । মোহনদাস করমচন্দ গান্ধি পাটনা আসছেন বলে বারি সাহেবের তাড়া । পুলিশ দল জানালো তারা বারি-ফারি কিছু জানে না, আর টেনে হিঁচড়ে গাড়ি থেকে রাস্তার ওপর ফেলেই একাধিক থ্রি নট থ্রি দিয়ে ঝাঁঝরা, ছলনি । মুখ থুবড়ে পড়লেন আর মারা গেলেন আবদুল বারি, শাহবাদ জেলার কোইলওঅর গ্রাম থেকে সবকিছু ছেড়েছুড়ে নুন বানাতে গিয়েছিলেন গান্ধির সঙ্গে । বলেছিলেন, পাকিস্তান-ফাকিস্তান মানি না । লড়াইটা হিন্দু মুসলমানের গোপন ষড়যন্ত্রের কাজিয়া, না রাজনৈতিক হত্যাকাণ্ড, তা কেউ জানতে পারেনি । অ্যাডিশানাল জজ রায়সাহেব পি কে নাগ নামে এক বাঙালির এজলাসে পুলিশগুলোর বিরুদ্ধে মাসকতক মামলা চলার পর, ব্যাস, ভুলে যায় সবাই, সাংবাদিকরাও । বিহারের মুখ্যমন্ত্রীর তখতে বসলেন বিহার কেশরী নামে খ্যাত শ্রীকৃষ্ণ সিংহ, আর শুরু হয়ে গেল জাতপাতের খেয়োখেয়ি । বারি সাহেবের দুই ছেলে সালাউদ্দিন আর শাহাবুদ্দিনকে বারোকাঠা পুসতইনি জমি থেকে খেদিয়ে দিয়েছিল স্বাধীনতার প্রথম প্রজন্মের গুণ্ডারা । ভারতবর্ষের ভিড়ে হাপিশ হয়ে গেছে ওরা, আর ওদের ছেলেমেয়ে ।

অতনুদের বাড়ির কাছ থেকে পুর্বদিকে মাখানিয়া কুঁয়া চাঁইটোলা নয়াটোলা মছুয়াটুলি লঙ্গরটুলি দরিয়াপুর হাথুয়া মার্কেট বাকরগঞ্জ হবে যে রাস্তাটা গান্ধি ময়দানে গিয়ে পড়েছে, সেটার নাম এখন বারি পথ, মুসলমান ভোটদাতাদের জন্য কনসোলেশান প্রাইজ । গান্ধি ময়দানের দক্ষিণে, অতনুদের অফিসবাড়ির বিশাল অট্টালিকা । বারিপথের দু’পাশে সমস্ত ফাঁকা জায়গায় বাঁশের খুঁটি পুঁতে, চট টাঙিয়ে, অ্যালুমিনিয়াম হাঁড়িকুঁড়ির ষষ্টিপূজক ছট মাইয়ার সংসার, ভাত ডাল রুটি আলুসেদ্ধর দোকান, চুলকাটার, তাড়ির, গাঁজার, জুয়ার, তেলেভাজার, খাজা আর বেসনলাড্ডুর, রিকশ আর ঠ্যালা রাখার, বাঁশ আর শালখুঁটির, টিপ-সিঁদুর-চুড়ির পশরা দোকান, নানা দেবীদেবতার মিনিমন্দির ।

বারি পথের সমান্তরাল, গঙ্গার পাশ দিয়ে, পশ্চিমে পাটনাসাহেব থেকে পুবে খগোল ওব্দি এগিয়ে গেছে, দু’পাশে ঝকমকে দোকানপশরা কলেজ বিশ্ববিদ্যালয় হাসপাতাল টাউনহল গোলঘর সাজিয়ে অশোক রাজপথ । সারা পাটনা শহর দেখা যায় গোলঘরের টং থেকে । দুর্ভিক্ষের শষ্যভাঁড়ার হিসেবে তৈরি হয়েছিল মন্বন্তরে, এখনও তাই, গর্ভগৃহে চ্যাঁচালে তেইশবার প্রতিধ্বনি হয় । পায়ে-পায়ে ক্ষয়ে গর্ত হয়ে গেছে গোলঘরের একশো পঁয়তাল্লিশটা দাঁত বের-করা সিঁড়ি । মেরামতের টাকা, ইংরেজরা চলে যাবার পর,  ফিবছর ভাগাভাগি হয় । রাস্তা সারাবার বরাদ্দও তাই । নালি-নর্দমা পড়ে আছে কন্ঠরুদ্ধ হয়ে পচা পাঁকে ; বর্ষায় রাস্তাগুলো নিজেরাই নিজেদের দুর্বিসহ পায় । গান্ধি ময়দানের পূর্ব-দক্ষিণ দিকটা, ফ্রেজার রোড বেইলি রোড ডাকবাংলো রোড বোরিং রোড নষ্ট আর অসহ্য নয় ততোটা । মন্ত্রী আমলা জজ উকিল ঠিকেদাররা থাকে ওদিকে । টিমটিমে হলেও, সন্ধের পর আলো জ্বলে ওদিকের পথে-গলিতে-মোড়ে । বারিপথ তখন প্রায়ান্ধকার, ছমছমে, ক্রমশ ফাঁকা । মাঝে-মাঝে যাত্রী-ঠাশা মিনিবাস, ধাক্কা খেয়ে আর মেরে দোমড়ানো, অটো থেকে ঝুলন্ত বাড়তি যাত্রী, অবিরাম হর্ন বাজিয়ে আওয়াজ দিয়ে আলোর কাজ চালায় ।

বারিপথে কেবল ছটপুজোয় সারারাত আলো জ্বলে, রাস্তার দুপাশে বেআইনি খুঁটি পুঁতে, হুজিং করে ঝোলানো হাজার চিনা টুনির রিমঝিম আলো । ওই একদিনই ঝাঁট পড়ে রাস্তায় । ভোর রাতে সধবার দল উদোম স্নান করবে । কেউ-কেউ পথের ওপর সাষ্টাঙ্গ প্রণাম করতে-করতে ঘাটে যাবে । ছোকরা মাস্তানরা, বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্ররা, ভেঙে পড়ে ঘাটে-ঘাটে বাইনোকুলার হাতে, পারিবারিক বাইনোকুলার, যা দিয়ে বাপ-জ্যাঠাও একই কাজ করেছিল, অজস্র উলঙ্গ নারীর জোয়ান সুঠাম দেখার লোভে । গঙ্গার পাড় বরাবর তাই ঘাটে-ঘাটে তেরপলের পর্দা টাঙানো থাকে মহিলা পুলিশ পাহারায় । ছটের সময় ঠেকুয়া তৈরি হয় ঘরে-ঘরে । চারপাঁচজন পড়শি দিয়ে যায় অতনুদেরও, শক্ত মুচমুচে নরম ঘি জবজবে নানা রকমের মিষ্টি ঠেকুয়া । অনেকদিন ওব্দি থাকে ।

বেলা হয়ে আসছে, কখন পাটনায় পৌঁছোবে কে জানে, নিজের ব্যাগ থেকে একটা ঠেকুয়া মৌলিনাথকে দিয়ে অতনু বলল, ‘অরিন্দমের ব্যাপারটা সুশান্তকে জানিয়ে দেবেন, বাড়ি না ফিরলে কেলেংকারি, সুশান্ত ওর মা আর ভাইকে ম্যানেজ করে নেবে ।’

 

বাড়ি ফেরেনি অরিন্দম । শিবু পালিত ওকে আবিষ্কার করেছিল মোগলসরাই স্টেশনে, খালি-পা, কদিনের দাড়ি, লাল চোখ, চুল উস্কোখুস্কো , উদভ্রান্ত, কিছু খায়নি দিনকতক । ডানায় ঠোঁট গুঁজে ঘুমন্ত পাতিহাঁসের মতন একা । চেহারা দেখে, মনে হয়েছিল শিবু পালিতের, বেঁচে থাকার ইচ্ছের বাইরে চলে গেছে । শিবু ভুলিয়ে-ভালিয়ে নিয়ে গেল পাটনায় । কলকাতায় নিয়ে গেলেন ওর ডাক্তার মামা ; মানসিক রোগের হাসপাতালে ঠাঁই পেল ।

‘পাগল হবার আগে অরিন্দম তোদের ক্লারিকালে ট্রান্সফারের কেসটা হিল্লে করে গেছে তো ? সারা জীবন নোট গুনবি নাকি ?’ একদিন অফিসে এসে বলে গেলেন ননীগোপাল । আর বললেন, ‘রাঘব তো সিকিউরিটি অফিসার হয়ে চলে যাচ্ছে কলকাতা । হেডাপিস থেকে যে আসছে, তাকেই  মুরগি আর ছানার পায়েস খাওয়াচ্ছে রমা । নতুন সব বিভাগ খোলা হবে, তোরা ঝপাঝপ প্রোমোশান পেয়ে যাবি ।’

অতনু নিজেকে নিঃশব্দে বলল, ‘প্রোমোশান নিয়ে কী করব !’

অফিসের নতুন বাড়িটা ননীগোপালের সামনেই তৈরি । তখন গান্ধি ময়দানের রেলিং ছিল না, গেট ছিল না । শুলভ শৌচালয়ের গ্যাস-আলো জ্বলত না, ময়দানের মধ্যে রেলিঙের কিনারঘেঁষা হাঁটা পথে, যার ওপর এখন জগিং করতে বেরোয় হাফপ্যান্ট যুবকেরা । ময়দানের উত্তরে ডুমো-ডুমো শ্রীকৃষ্ণ হলটা হয়নি । আবদুল বারি মারা যাওয়ায়, শ্রীকৃষ্ণ সিং মুখ্যমন্ত্রী হয়েছিল, ভূমিহার । এখন ভূমিহারদের দিনকাল গেছে । উঁচু জাতের রাজনীতিকদের দিনকাল কোনঠাশা হয়ে গেছে । তফসিলিরাই নিজেদের মধ্যে দলিত-মহাদলিত ভাগাভাগি চালাচ্ছে ।

অফিসে নতুন বাড়িতে তৈরির সময়ে, সিমেন্টে গঙ্গামাটি মেশানো হাতেনাতে ধরেছিল ভিজিল্যান্স । ফলে, এগজিলিউটিভ ইনজিনিয়ারে পদোন্নতি পেয়ে মুম্বাই বদলি হয়ে গেছে মারাঠি ক্লার্ক-অফ-ওয়র্কস । স্হপতি, নামকরা, শতকরা একভাগের আধ ভাগ । বেশি নিয়েছিল সিপিডাবল্যুডির রেটের চেয়ে । ব্ল্যাকলিস্টেড ঠিকেদার, নতুন নামে কোম্পানি খুলে পেয়েছিল ঠিকেটা । পুরোনো দপতরবাড়ি থেকে আসবাবপত্র আসার পথে, নতুন বাড়িটায় আসতে-আসতে, দুটো গোদরেজ আলমারি আর একটা গোদরেজ টেবিল, কুণ্ডলিনী জাগ্রত হয়ে প্রাণ পাবার দরুন, মাঝরাস্তা থেকে লোপাট । ননীদার কাছে অনেক পুরোনো গল্পের ডাঁই । চাকরি ছেড়েও অনেক খবর রাখছেন, যা সবাই জানে না । তার মানে ননীদার ওয়ানরুম ফ্ল্যাটে বেশ মুখরোচক আড্ডা জমছে আজকাল । যাবে একদিন, ভেবেও অতনু কুন্ঠিত ।

 

রাঘব-রমা ট্রান্সফার হয়ে, ছলছলে হাসি বিলিয়ে, কলকাতা যাবার পর, শীতাতপ যন্ত্রের হরিয়ানাবাসী ইলেকট্রিশিয়ান, যার এসি পার্টসের দোকান ফ্রেজার রোডে, আর যে ভ্যায়েনচো ভ্যায়েনচো ভ্যায়েনচো ছাড়া কথা বলে না, পদোন্নতি পেয়ে রাঘবের পোস্টে কেয়ারটেকার হয়ে গেল । অফিসটা কেন্দ্রীয় এসি । ড্রয়ারে শাল-সোয়েটার রাখে কেউ-কেউ । বাচ্চার খেলনার মতন থারমোমিটার ঘুরিয়ে-ঘুরিয়ে হিউমিডিটি মাপার এক ফাঁকে মুচকি হাসি বিলিয়ে যায় টাকমাথা সুপারভাইজার, ‘ঝপ করে এগারো ডিগরিতে নেমে গেল।’ বাইরে তখন রাস্তার পিচ গলাচ্ছে গ্রীষ্ম, আর দুপুর বেলার গোঁয়ার রোদ্দুরকে আস্কারা দিয়ে মাথায় তুলেছে সূর্য । শীতাতপ না হলে অতনু-সুশান্তদের ফ্যানের হাওয়ায় নোট গোনা আর বাছাই অসম্ভব । মৌলিনাথ আর অরিন্দমের সে-সুযোগ নেই, ওরা কেরানি ।

রোজ জতো পুরোনো নোট জমা পড়ে, তার মধ্যে থেকে প্রত্যেক নোট-পরীক্ষক কর্মচারীর মাথাপিছু দিনকার বরাদ্দ অনুযায়ী, পচে নোট আর ভালো নোট বাছাই করার কাজ, যাতে পচা নোটগুলো জ্বালানো আর ভালোনোটগুলো বাজারে ছাড়া যায় আবার । অতনু প্রায় ছেড়ে দিয়েছে বাছাবাছি-গোনাগুনির কাজ । সুশান্ত তো একদমই । নারী-নারকো গ্যাঙের সবাই । মহিলারা কেবল গোনে, বাছাই করে, এক মনে, ধৈর্য ধরে । অতনুর মনের মধ্যে এর জন্য একটা খচখচ থাকলেও, প্রায় সবাই যখব সেই কাজ করছে, তখন সৎ হওয়ার অনেক হ্যাঙ্গাম, বেশ বিপজ্জনক । পাঞ্জাবি এক বড়োসাহেব এসে, ক্লোজ সার্কিট টিভি বসিয়ে নজর রাখতে চাইছিল । বেচয়েন বলেছিল, ‘শালা বিজলি থাকে না বলে এসি চলে না অনেক সময়ে, লিফট চলে না, ঘুরঘুট্টি বেসমেন্ট, উনি চলেছেন টিভি লাগাতে ।’

সত্যি, শীতকালে, অফিস ছুটির সময়ে, আলো চলে গেলে, গায়ে-পড়া পুরুষের ইচ্ছাকৃত ধাক্কা বাঁচাবার জন্য মহিলাতরা অনেকেই, দ্রুত টর্চ বের করে নিজেদের কাঁধব্যাগ হাতব্যাগ থেকে, আত্মরক্ষার জন্য । কেউ-কেউ সিগারেট লাইটার হাতে ফ্লোরেন্স নাইটিংগেল । যেমন মানসী বর্মণ, এককালে ওদের বিরাট বইয়ের দোকান ছিল, ননীগোপাল ওর বাবাকে দেখেছেন, রাশিয়ার নেতাদের মতন বপু-হোৎকা আর মোদো-গোলাপি চেহারা ।

শিমুলতলা দেওঘর থেকে ফেরার পরের দিনই, অতনুর সেকশানে ঝপাং শব্দে ডাইস মেশিনে একাধিক গর্ত করে নোট নষ্ট করছিল রসিক পাসওয়ান, চাপরাসি । ব্যস্ততার মাঝে, কর্মরত অতনুর কপালে এসে ছিতকে লাগল রসিকের তর্জনীর কাটা ডগাটা, লেগে, ওর কপালে রক্তের টিপ পরিয়ে, ওরই টেবিলে পড়ল । বুঝে ওঠা মাত্র ও স্তম্ভিত ।  পেট মোচড় দিয়ে বমি উঠে আসছিল আরেকটু হলে । পকেট থেকে রুমাল বের করে প্রায়-নির্বিকার রসিক জড়িয়ে নিলে কাটা রক্তঝরা আঙুলে, আর আঙুলের টুকরোটা দেখাতে গেল প্রধান খাজাঞ্চিকে । সুশান্তকে বলতে ও জানিয়েছিল, ওদের আঙুল-টাঙুল বীমা করিয়ে রেখেছে অফিস । দুর্ঘটনার বিরুদ্ধে বীমা করানো থাকে । আঙুল কাটার অঢেল ক্ষতিপূরণ দিতে হয় । তর্জনীর জন্যে তো মোটা টাকা পাবে । ওর বোধহয় টাকার খাঁকতি, তাই নিজের আঙুল কেটে ফেলেছে নিজেই ।

গরমকালেও রসিকের সর্ষের তেল, শীতকালে শাদা উর্দির কলার তেলচিটে, বর্ষাকালে রবার জুতোর ক্যাঁকোঁ, পানিবসন্তের শ্রীছাঁদ । রসিকের ঘটনার পর অতনু লক্ষ করেছে, সুখচৈতি রাম, হরবিলাস, ট্যাঙোয়া মাহাতো, রামপুজন সিং, খলিল আহমদ সকলেরই একটা করে বা দুটো আঙুল কাটা ।

বিশ্বসভঙ্গের বিরুদ্ধেও বীমা করানো আছে । মানুষের অভাব-অনটনের দুঃখে গড়া মতিগতি । আগেকার দিনে, ইংরেজদের সময়ে,  প্রধান খাজাঞ্চি আসত সরকারের সঙ্গে চুক্তি করে, নোট গোনানো বাছাই আর পোড়াবার জন্যে । সে ভর্তি করত নিজের চেনাজানা নির্ভরযোগ্য লোকজন । এখন টাকাকড়ি পরীক্ষকরা এলডি থেকে ইউডি, উপখাজাঞ্চি হয় । কেউ যদি নোটফোট গেঁড়িয়ে লোকসান করায়, তাই বিশ্বাসভঙ্গের বিরুদ্ধে বীমা । দিনের পর দিন চারধাতরে এত টাকা, পচা গন্ধমাখা টাকার ঢিবি, থাক-থাক টাকা, যে অতনুর ভয়-ভয় করে । ভয়ের বিরুদ্ধে বীমা নেই । মানুষের সম্পর্ক ভেঙে যায় বিশ্বাসভঙ্গের দরুন, তার জন্য তো বীমা হয় না ! হলে, আর দু’পক্ষ মেনে নিলে, অনেক কষ্টের সুরাহা হতে পারত ।

হাতে-হাতে টাকা এত নোংরা কী ভাবেই বা হয়, ভেবেছে অতনু । তুলতুলে হয়ে ওঠে । মানুষের হাতে তো অমন ময়লা থাকেনা, যতো জমে যায় নোটে ! ময়লা, হাতে থাকলেও, থাকে গরিব মজুর কুলি কামিন চাষির চেটোয় । আর টাকা ঘুরে বেড়ায় ধনীর, সচ্ছল মানুষের, হাত ফেরতা । কতো করকরে থাকে যখন নতুন । অন্ধকারের আগল ঠেলে কী দশা হয় শেষে, পুড়ে মরার আগে । একেবারে মানুষের মতন, সারা জীবন নিজের অস্তিত্বে জড়ো করা ময়লা নিয়ে পুড়তে যায় । এতো গাদাগাদা নতুন-পুরোনো টাকা যে ফুটবল মাঠের মাপের স্ট্রং রুমেও বস্তাবন্দী কুলোবে না । বেশ কয়েক মাস আগে থাকতে ক্লায়েন্ট ব্যাংককে জানিয়ে রাখতে হয় যে তারা কতো বস্তা বা বাকসো পচা নোট জমা দেবে অতনুদের ভাঁড়ারে । কবে যে কাউন্টিং মেশিন আর শ্রেডার আসবে, কেবল গুজবই শোনা যায় । তেলচিটে হিলহিলে নোটগুলো তো কাউন্টিং মেশিনে দিলেই ছিঁড়ে পাকিয়ে দলা হয়ে যাবে ।

আইন পালটে, সরকারি খরচ মেটাবার জন্যে, রাজনীতিকদের পোয়াকে বারো করার জন্যে, যতো ইচ্ছে নোট ছাপা যায়, বাজারে ছাড়া যায় । ননীগোপাল যখন চাকরিতে ঢুকেছিলেন তখন বাজারে পাঁচশো কোটি টাকার নোট ঘুরে বেড়াতো । চাকরিতে ইস্তফাদেবার সময়ে তা এক লক্ষ ষাট হাজার কোটিও । বেড়েই চলেছে প্রতিবছর । সব গেছে হিল্লি-দিল্লির নেতা ঠিকেদার আমলা চোরাকারবারী সঞ্চয়চোরদের গবভে । ডাকাত আর বিধায়ক গোপাল সিং । সতবীর সিং, সুরেন্দ্র সিং রাঠি, মোহম্মদ ইলিয়াস, শাহাবুদ্দিন, শ্রীপাল, ধর্মপাল যাদব, হরিশংকর তেওয়ারি, বীরেন্দ্র শাহি, রঞ্জিত, শারদা প্রসাদ রাওয়ত, বিলায়তি রাম কত্যাল, রাজু ভটনাগর, রাজেশ কুমার সিং, মিত্রসেন যাদব, বিনয় কাটিয়ার, নাজির আলি, লটুরি সিং, রমাকান্ত যাদব, রিজওয়ান জহির, দুধনাথ যাদব, পপ্পু যাদব, ওম প্রকাশ গুপ্তা, শমিউল্লা খাঁ, কৃষ্ণকিংকর সিং, রামপাল শর্মা, বাবুলাল তিওয়ারি, মঙ্গলপতি ত্রিপাঠি, সঞ্জয় সিং, বালেন্দু শুকলা, কুঁয়র অশোক বীরবিক্রম সিং, গণপতরাও ধুরবে, জগমাল সিং, রাজকুমার জয়পাল, বীরভদ্র সিং, আবদুল লতিফ, সি এম ইব্রাহিম, পাপ্পু কালানি, হিতেন্দ্র ঠাকুর, মির্জা হাজি মস্তান, ইউসুফ প্যাটেল, করিম লালা, বরদারাজন মুদালিয়ার, দাউদ ইব্রাহিম, টাইগার মেমমন, সুকুর নারায়ণ বখ।ইয়া, সূর্যদেও সিং, আলমজেব, মহেশ ঢোলকিয়া, রমাকান্ত নায়েক, আমিরজাদা সমদ খান, সতীঋ খোপকর, বিনায়ক ওয়াগলে, বিটঠল চভান, থিম বাহাদুর থাপা, চার্চিল আলেমাও — এদের হাতে-হাতে ফিরেছে মোটা টাকার আর পাতলা টাকার নোট ।

অতনুর মনে হয়, ওর নিজের মাইনের টাকা, আর এই সমস্ত গিজগিজে টাকা  এক জিনিস নয় । মাইনে পেলে ও অঙ্ক গোনে টাকায় । এসব পচা নোটগুলোর অঙ্ক যাই হোক, তাদের সংখ্যা গোনে । পঞ্চাশ টাকার একশোটা নোটও যা পাঁচশো টাকার একশোটা নোটও তাই ।

বরাদ্দ ছুটির শেষে রসিক পাসওয়ান কাজে যোগ দিলে, সুশান্ত জানতে চেয়েছিল, কী গো, আঙুলের ঘা শুকিয়ে গেছে তো ? কাটলে কেন আঙুলটা জেনেশুনে।’

–‘নাতনিটার বিয়ে দিলুম । ছুটিও পেলুম, টাকাও ।’ রসিক পাসওয়ান অমায়িক ।

‘–মাইনে তো যথেষ্ট পাও।’ সুসান্তর খোঁচা ।

‘–ছেলেটাকে তো কোথাও ঢোকাতে পারলুম না । প্রভিডেন্ট ফাণ্ড থেকে টাকা তুলে একটা মুদির দোকান করে দিয়েছিলুম । চালাতে পারলে না ।’

‘–তাই বলে আঙুল কেটে নিলে ?’ সুশান্তর বিস্ময় ।

‘–ওই একটাই নাতনি । ভালো দেখে বিয়ে দিয়ে দিলুম ।’

ভালো শব্দটার কী ভাবে খোলোশা হয়, অপেক্ষা করছিল অতনু । হাল ছেড়ে দিতে বাধ্য হয় সুশান্ত ।

‘–কী করব বলুন । ছেলেটা গধহা বেরোলো । এখন ছ’টা নাতিকে মানুষ করতে হবে । লেখাপড়া শিখছে । মাইনের টাকা তো ওদের জন্যেই খরচে ফেলি পুরোটা । ছেলের বউটা শেষ বাচ্চা বিয়োবার সময় বাঁচেনি ।’

‘–ওদের ঠাকুমা আছে তো ?’

‘–হ্যাঁ, আছে বলেই রক্ষে ।

‘মানুষ করা’ আর ‘গধহা’ শব্দ দুটোয় আরেকবার আটকালো অতনু । রসিকের বাড়ি অওরঙ্গাবাদের দরমিয়া গ্রামে, শুনেছে । অনেকে বলে ও থাকে ওয়ারিসআলি গঞ্জে, নওয়াদা জেলায় । দরমিয়া আর ওয়ারিসআলিগঞ্জ দুটোই নকসল্লি মাওওয়াদিদের গঢ়, ক্রান্তিকারী কিষাণ সমিতি জনআদালত বসায় । গত বছর আশ্বিন মাসে ওর ছেলের নামে হুলিয়া বেরিয়েছিল, আর রসিকের খোঁজখবর করতে শাদাপোশাক পুলিশ এসেছিল অফিসে, সুশান্তর কাছে জেনেছে অতনু ।

 

আশ্বিন মাসের সেই সন্ধেবেলা তিরিশ-চল্লিশজনের জামাত পৌঁছেছিল অম্বিকা সিং-এর বাড়ি, ভালা ভোজালি বরছা গঁড়াসা নিয়ে । বাড়ির দালান থেকে  ইন্দ্রদেব-এর ছোটো ভাই ভীমকে কব্জা করে ওকে দিয়েই দরোজায় টোকা দেওয়াতে, অম্বিকার দাদা জগন্নাথ সিং-এর সদরের দরোজা খুলতে বাধ্য করায় । রামলেশ, প্রমোদ, মুরারী আর বারো বছর বয়সী গয়া সিংএর হাত যারা পিছমোড়া করে বেঁধেছিল, রসিক পাসওয়ান তাদের একজন । ভিড়ে একজন, ‘তোদের বাপগুলো কোথায়,’ বলে উঠতেই, শুনতে পেয়ে, অম্বিকা সিং স্ত্রী গাজরদেবীকে একটু উঁকি মেরে দেখতে বলে কী ব্যাপার । গাজরদেবীর হুঁশিয়ারি শোনামাত্র, চালার গোলটালি সরিয়ে পালায়, লুকোয় গিয়ে অড়হর খেতের মধ্যে । অম্বিকা আর জগন্নাথ সিংকে না পেয়ে রসিকের দল রামলেশ, প্রমোদ, মুরারী, গয়া, গাজরদেবী, অম্বিকার মেয়ে গীতা আর জগন্নাথের মেয়ে পুষ্পার মাথা ওখানে দাঁড়িয়ে আলাদা করে দিয়েছিল ধড় থেকে । তারপর ওরা, ঝিঁঝিডাকা জোনাকি-জ্বলা ওই রাতেই, মরদনবিঘায় গিয়ে, বৈদ্যনাথ সিং, অলখদেও সিং আর ওর ছেলের বউ উষা আর বৈদ্যনাথের মেয়ে শকুন্তলাকে ছিন্নভিন্ন করার পর, আওয়াজ দিয়েছিল, ‘রক্তের বদলে রক্ত চাই লাশের বদলে লাশ ।’ আসলে ঠিক সতেরোদিন আগেই, দরমিয়ার ছ-সাত কিলোমিটার উত্তর-পশ্চিমে, পরসডিহায়, উঁচু জাতের লোকেরা, অম্বিকা-জগন্নাথের লেলিয়ে দেবার দরুণ, বন্দুকের গুলি মেরে ষাট বছরের জগন্নাথ সাহু, নব্বই বছরের চামার সাহু আর তার ছেলে রাজেশ্বর সাহু, রাজারাম সাহু আর দুই নাতি সঞ্জয় আর বিনয়ের লাশ নামিয়ে দিয়েছিল ।

আরেকজন চাপরাশি ঝুনুরাম কিসকুর কাঁধে হাত রেখে মসকরা করতে-করতে রসিক পাসওয়ান সিঁড়ি দিয়ে মেজানাইন ফ্লোরের দিকে এগোলে, অতনু সুশান্তকে বলতে বাধ্য বোধ করল, ‘সবায়ের ব্যক্তিগত ব্যাপারে এত নাক গলাস কেন ?’

সুশান্ত বলল, ‘সকলেরই নকল গল্প আর আসল গল্প দুটোই জানি, সবকটা আঙুল কাটা চাপরাসির । মুঙ্গের থেকে বন্দুক কি৯নবে রসিক । রামখেলাওন ওর রক্ষিতার হার গড়িয়ে দিয়েছিল সবজিবাগের কণকমন্দির জুয়েলার্স থেকে । শেখ আলি পাঁচ হর্স পাওয়ারের ডিজেল পাম্প কিনেছে ।’ তারপর কিছুক্ষণ অন্যমনস্ক থেকে, ‘দিনকতকের জন্যে সিক লিভ নেবো । কাকার সঙ্গে আসাম যাচ্ছি দু ট্রাক আনারস আনতে ।’

অতনু জানতে পারল, শনিবার বিকেলে, অ্যানেকসি বিলডিঙে ক্যানটিন কমিটির নির্বাচনে ভোট দিতে গিয়ে, চন্দ্রকেতু সিং দিলে খবরটা, বাঁ-চোখের পাতা সামান্য কাঁপিয়ে, ননীদা সস্ত্রীক হনিমুনে গেছে সুশান্ত আর ওর কাকার সঙ্গে, কামাক্ষ্যা আর গণ্ডারের অভয়ারণ্যে, বয়সের স্বামী-স্ত্রীর বয়সের পার্থক্য মেটাতে । সুশান্ত তার মানে চেপে যাচ্ছে কিছু-কিছু । চন্দ্রকেতু চশমা পুঁচছিল । চশমা খুলে ফেললে মনে হয় ব্যক্তিত্ব হারিয়ে ফেলেছে ।

সুশান্ত-অতনুর সম্পর্কে যেটুকু লুকোছাপা না হলে নয় । অতনু কুঁড়ে, আরামপ্রিয়, যে-কোনো ছাপা কাগজ পড়তে ভালোবাসে, বসার চেয়ে ওর ভালো লাগে গড়িয়ে পড়তে, মেঝেতে বসলে দেয়ালে ঠেসান দিয়ে, বাসে-ট্রেনে উঠেই হাতল খোঁজে, অতিথি বা বয়স্করা বসার আগেই বসে পড়ে । বিছানায় বসলে এলিয়ে পড়ে বালিশ টেনে । সুশান্ত খবরের কাগজ বই ম্যাগাজিন পড়ে না, শেয়ার দরে ওঠানামার দরটুকু ছাড়া । খেলার খবর, রাজনীতিতে আগ্রহ নেই, অথচ একনাগাড়ে বকবক করতে পারে । সকলের বাড়ি-বাড়ি চষে বেড়ায় মোটরসাইকেলে । ছোঁয়াচে উৎফুল্লতায় ভোগে । অতনু মেয়েমহলে অস্বস্তি পায় । সুশান্ত সহজ । অফিসারদের অ্যাসোশিয়েশান, কর্মচারী ইউনিয়ান, ক্যানটিন, সমবায়, স্পোর্টস ক্লাব কিছুতেই অংশ নেয় না ও, সুশান্ত, কিন্তু খবর রাখে পুরো । গান-বাজনার ও কুইজ মাস্টাত, বিদেশি হোক বলিউডি হোক ইন্ডি পপ হোক । অডিও ডিভাইস কানে লাগিয়ে মোটর সাইকেল চালায় । বললেই টুইস্ট রক অ্যান রোল র‌্যাপ ট্যাংগো হিপহপ রুম্বা ফ্রি ফর অল নেচে দেবে সুশান্ত । অতনু তো নতুন পরিচিতের সামনে বেশিক্ষণ দাঁড়ালে আড়ষ্ট হয়, দ্রুত কেটে পড়ার ছুতো খোঁজে ।

সুশান্তদের একান্নবর্তী পরিবারে প্রতি সপ্তাহে গ্যাস সিলিণ্ডার লাগে । ঢিলেঢালা অগোছালো খোকাখুকুরা চোর-পুলিশ খেলতে-খেলতে পাক খেয়ে যায় বনেদি ড্রইংরুমে । জ্যাঠাকাকাদের অট্টহাসির ছররা ছিটকোয় তিনতলা থেকে একতলা । প্রতিটি ঘরের দেয়াল জুড়ে দোল খেলার রং । এক তলায় সিঁড়ির নিচে ডাঁই করা চটি আর জুতো, যার যেটা ইচ্ছে পায়ে গলিয়ে বেরিয়ে যায় । সুশান্ত আর ওর বড়জ্যাঠামশায় ছাড়া, যিনি এখনও সাইকেল চালিয়ে আন্টাঘাট কিংবা চিড়াইয়াটাঁড়ে বাজার করতে যান, আর কারোর স্নান করার আর খাবার বাঁধাধরা সময় নেই । সুশান্তদের বাড়িতে ঢুকলে অতনুর ইচ্ছে করে পরিবারের সদস্য হয়ে যেতে । ও এত চাপা যে নিজে থেকে কোনো হুল্লোড় আরম্ভ করতে পারে না । অন্যের বানানো হুল্লোড়ে ঢুকতেও ইতস্তত ।

নিজের মাইনের টাকা ওব্দি অন্যের সামনে গুনতে লজ্জা করে অতনুর । চাকরির প্রথম মাইনের একটা পাঁচ টাকার  প্যাকেট, লুকিয়ে গুনতে গিয়ে অফিসের পায়খানায় পড়ে গিয়েছিল । পড়ে যেতেই ফ্লাশ । অফিসকে তাই জানিয়ে দিয়েছে, মাইনেটা ওর ব্যাঙ্ক অ্যাকাউন্টে জমা দিতে ; ব্যাঙ্ক থেকে তো আর থোক অতো টাকা তুলতে হবে না । সুশান্তই পরে অতনুকে খোসা ছাড়িয়ে বের করে আনতে পেরেছে । স্কুল-কলেজে অতনুর নিকটবন্ধু ছিল না । অতনুর কাছ থেকে কলম বা বই নিয়ে কেউ ফেরত না দিলে ওর মন খুঁতখুঁত করে ; নোটসের খাতাও স্নাতকোত্তর পড়ার সময়ে সহপাঠিনীদের কাছ থেকে ফেরত চাইতে পারেনি । সুশান্তর মোটর সাইকেলও যে যখন ইচ্ছে চেয়ে নিয়ে যায় ।

অখিলেশ ঝা আই এ এস দিয়ে সফল হবার পর গ্রামের রাজপুত দারোগা যখন পুলিশ এনকোয়ারি নিয়ে খেলাচ্ছিল তখন সুশান্তর মোটর সাইকেলে অখিলেশকে বসিয়ে তদবিরের জন্যে চন্দ্রকেতু সিং নিয়ে গিয়েছিল ওরই, মানে চন্দ্রকেতুর গ্রাম, উত্তরপ্রদেশের বালিয়া জেলার সোনিয়া-রানিগঞ্জ গ্রামের মাফিয়া সরদার সুরজদেও সিং-এর ভাই রামাধীরের কাছে । দারোগাটা রামাধীরের শালা । রামাধীরের বিরুদ্ধে তখন অবশ্য ফৌজদারি চলছিল ৩০২, ৩০৭, ৩২৪ আর ৪৫২ ধারায় । রামাধীরের একটা টেলিফোনে কাজ হয়ে গিয়েছিল । কিন্তু ফেরার সময় বিহটার কাছে গ্রামের আধন্যাংটো ছেলেরা গোটাকতক মোষের ল্যাজ মুচড়ে, ওদের দিকে হাঁকিয়ে দেওয়ায়, রাস্তা থেকে নেমে মোটর সাইকেলটা কাঁঠাল গাছে ধাক্কা খায় আর সঙ্গে-সঙ্গে দুজনেই অজ্ঞান, গায়ের ওপর খসে-পড়া এঁচোড় । ঘণ্টা দুয়েক ওরা ওখানেই পড়েছিল । গ্রামবাসীরা কলম ঘড়ি আঁটি টাকাকড়ি যা কিছু ওদের পকেটে আর ছিল, মায় কাঁধব্যাগও, হাতিয়ে কেটে পড়েছে সেই সুযোগে । বিডিও দেখতে পেয়ে জিপে তুলে নিয়ে যায় । ওদের আর দোমড়ানো মোটর সাইকেলকে । মামুদ জোহেরের ম্যাটাডর নিয়ে বিহটা থেকে মোটর সাইকেল আর হাতে-মাথায় ব্যাণ্ডেজ বাঁধা দুই সহকর্মীকে ওদের বাড়ি পৌঁছে দিয়েছিল সুশান্ত ।

কোন আগ্রহ গিঁথে রেখেছে সুশান্তদের বিরাট পরিবারটাকে, যখন কিনা পাটনায় কোনো একান্নবর্তী পরিবার আর টিকে নেই, যে পরিবারের মধ্যে চুপচাপ সেঁদিয়ে যেতে চেয়েছে অতনু, তা অনেক ভেবেও বুঝে উঠতে পারেনি অতনু । বর্ধমানের বর্ধিষ্ণু চাষি পরিবারের কৃষিবিজ্ঞানে স্নাতক, অথচ ঢুকেছে আজেবাজে পচা নোট বাছাইয়ের চাকরিতে । গ্লানিবোধ বা দুঃখ, নজরে পড়ে না । মেমারিতে জমিজিরেত চাষবাস তদারক করেন সুশান্তর ন-কাকা নতুনকাকা, তাঁরা আসেন কখনও কখনও পশ্চিমে বেড়াতে আসার নাম করে । নতুনকাকার বড় ছেলে নকশাল হয়েছিল, বাড়ি ফেরেনি আজও । পাটশাক, জামরুল, আঁশফল, নোনা, কামরাঙা, গোলাপজাম ওদের বাড়িতেই প্রথম দেখেছে অতনু, মেমারি থেকে আনা ।

অতনুর বাড়িতে বিধবা মা । তিরিক্ষি দুর্গন্ধের নালির গায়ে সটান শাদা বাড়ি ওদের । একতলা । দোতলা অর্ধেক হয়ে আধখেঁচড়া ইঁট-বেরোনো । মায়ের শাদা থান আর অতনুর শাদা ধুতি-পাঞ্জাবি ছাড়া অন্য কোনো রং নেই পোশাকের । কাকাতুয়া দুটো শাদা । বাড়ি ফিরলেই ওর মন খারাপ, তার কোনো কারণ নেই, উৎস নেই । মায়ের সঙ্গে বড়ো একটা কথাবার্তা হয় না । অতনু মাছমাংস কেনে না । ডাল ভাত আলুভাতে তরকারি । ডাল তরকারি আলুভাতে ভাত । শাদাকালো টিভিটা পালটে রঙিন টিভির প্রস্তাবে রাজি করানো যায়নি মাকে । বহুকাল অন্ধ আর বোবা হয়ে পড়ে আছে ।

সুশান্তর বাড়িতে পুঁটলি তোরঙ্গ বাকসো প্যাঁটরা এলে বাড়িসুদ্দু সবাই হুমড়ি খেয়ে কী আনলে গো, ওটা কী গো, একটু দেখতে দাও না গো, পছন্দের বলিহারি, সুশান্তর ছোটো ভাই অপাংশু সবচেয়ে বেশি উৎসুক । অতনুর কোনো আত্মীয় নেই । আছে কি না তা জানেও না অতনু । কেউ আসে না । কেউ যায় না । কেউ চিঠি লেখে না, বিয়ে পৈতে অন্নপ্রাশন শ্রাদ্ধের কার্ড পাঠায় না ।

অতনুর জন্মের সময়ে ওর মায়ের প্রসবক্রিয়া নষ্ট করতে বাধ্য হয়েছিল ডাক্তার । ভাইবোন নেই । পড়াশোনায় চিরকেলে ছাপোষা, দ্বিত্বীয় শ্রেনিতে, অথচ মুখে বই গুঁজে থাকতে ভালোবাসে সারাক্ষণ । খেলাধুলাহীন । আগ্রহ নেই । কেউ কখনও জানতে চায়নি বড়ো হয়ে ও কী হতে চায় । জিগ্যেস করলে জবাব দেবার মতন ভাবনা ছিল না ওর আকাঙ্খায় । বাবা কেন যে ইংরেজি পড়ালেন ! কখনও ভালো লাগেনি ভাষাটা । রসকসহীন সাহিত্য । যদিও প্রতি ক্লাসে প্রতিবছর ইংরেজি পেপারে সবচেয়ে বেশি মার্কস অতনুই পেয়ে এসেছে । ইংরেজিতে পড়লে ওর মুখস্হ হয়ে যায় ; বাংলা আর হিন্দিতে হয় না । উচ্চাশা না থাকলেও, ভবিষ্যতের ধারণা না থাকলেও, কেউই বোধহয় নোট আর পয়সাকড়ির পরীক্ষক হতে চায় না । ভালো নোট, খারাপ নোট, আসল নোট, নকল নোট,সচল নোট, অচল নোট, আস্ত নোট, কাটা নোট, বাছাই নোট, ছাঁটা নোট, তাজা নোট, পচা নোট, কারোর উচ্চাকাঙ্খায় জাগে কি ! বালকের কিশোরের তরুণের যুবকের ? তার বাবার ঢুকেছিলেন এই চাকরিতে । বছর দু’তিন চাপরাশি থাকার পর নোটপরীক্ষক হয়েছিলেন । নাগপুরে । তারপর মুম্বাই, হায়দ্রাবাদ, মাদ্রাজ, বাঙ্গালুরু, পাটনা । পাটনায় মারা গেলেন বলে বাবার দৌলতে অতনু পেল চাকরিটা । মাইনে যথেষ্ট, দুপুরেই ছুটি, এরকম আয়েশের চাকরি তো আর পাওয়া যাবে না । সেঁটে গেল অতনু ।

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

Leave a comment

Filed under উপন্যাস

তিন

সুস্হ অরিন্দম ফিরে এসে কাজে যোগ দিলে, সবাই ওকে ঘিরে ধরেছে যখন—

: পাশের খাটালটায় গয়লাগুলো দুধে জল মেশাতো রোজ । আমরা পাগলরা একদিন হইচই করে সেটা বন্ধ করালুম ।

: মানে ? পাগল হোসনি তুই ?

: বাহ ! পাগল আবার হতে যাব কেন ?

: আর এই যে এত কাণ্ড-কারখানা করলেন ?

: কী করব ! ছাড়াতেই পারছিলুম না নিজেকে । ভালোলাগাটাই খারাপ লাগতে আরম্ভ করেছিল ।

: আর মানিব্যাগে ফোটি নিয়ে ঘুরলি ! সবাইকে দেখিয়ে-দেখিয়ে বেড়ালি যে ?

: জানি । প্রেম সম্পর্কে ধারণাটা লটকে গেছে । ওটার দরকার ছিল ।: সকলেরই জীবনে ভুল ভাঙার সুযোগ আসে ।

: মজা তো যথেষ্ট লুটলেন !

: অমন জাঁতিকলে পড়লে বুঝতেন । জীবনটা নষ্ট করে ফেললুম ।

: বিয়ে করে ফ্যাল এবার, বিয়ে করে ফ্যাল ।

: পাগলামির বদনামটা আগে কাটিয়ে নিই ।

: আরে কন্যাপক্ষ শুধু চাকরি আর নুনুর রঙ দেখবে । আর তাছাড়া কাট মারলেই পারতেন । পাগল সাজার দরকার তো ছিল না ।

: ও আপনারা বুঝবেন না । যাকগে, যখন পাগল ছিলুম, তখন দশ টাকার রুপোর কয়েন বেরিয়েছিল । আমার জন্যে রেখেছে কি না ?

: পঞ্চানন সিনহার কাছে খোঁজ নিন । রেখেছে নিশ্চই । আপনাকে বাদ দিতে সাহস পাবে না ।  পাগল হয়েছেন খবর পেয়েও ম্যানেজমেন্ট কাউকে পোস্ট করেনি আপনার জায়গায় । তবে মেড়ো পার্টিদের একেকটা কয়েন পনেরো-কুড়ি টাকায় বেচেছিল পঞ্চানন । কাউন্টারে ও-ই তো ছিল তখন । বাজারে এখন পঁচিশ টাকা রেট যাচ্ছে । কালীপুজো-দেওয়ালিতে পঞ্চাশে উঠবে ।

পঞ্চানন সিনহা ভাগলপুরের । বলে, আরে ভাই, ম্যায় বঙ্গালি হুঁ । কায়স্হ । ঘোষ বোস মিত্রা সে শাদি হোতা হ্যায় হম লোগোঁ কা । বংলা কা চর্চা নহিঁ হ্যায়, ভুল গয়ে । নদিয়া পুরেইলিয়া জলপাইগুররি মেঁ কাফি সগে-সমবন্ধি রহতে হ্যাঁয় ।

কী ভয়াবহ । এভাবে নিশ্চিহ্ণ হওয়া । অতনুর মনে হয়েছে । সুশান্ত বলেছে, তাতে কি ! ভাষা আবার কোনও ব্যাপার নাকি ? কিছু একটা বলতে আর বলে বোঝাতে পারলেই হল ।

অরিন্দম সত্যই পাগল হয়ে গিয়েছিল কি না, কথার মারপ্যাঁচে সে ব্যাপারে সহকর্মীদের মাঝে অবুঝ সন্দেহ চাউর করে দিতে পেরেছে বেশ সহজে । অরিন্দম যখন চিকিৎসার স্মৃতিহীন ঘেরাটোপে, অফিসের কোয়ার্টার রাজেন্দ্রনগরে রেলফাটকের কাছে, বিলির জন্যে তৈরি হয়ে যাওয়ায়, ওর নামে, অনুপস্হিতিতে বরাদ্দ হয়ে গিয়েছিল একটা ফ্ল্যাট । মা আর ছোটো ভাই নতুন কোয়ার্টারে । পুরোনো  ভাড়া বাড়ির পাশের ফ্ল্যাটের প্রতিবেশিনীর মুখোমুখি হবার সম্ভাবনা আর নেই, কিংবা তার থলথলে খলবলে স্বামীর, যে বাড়তি রোজগারের ধান্দায় অহরহ ট্যুরে ।

পাগল হয়ে অরিন্দম মোটা হয়ে গিয়ে খানিক । ভুঁড়ি এখন বপু । ঘিরে থাকা মুখমণ্ডলের ওপর দৃষ্টিকে আনাগোনা করিয়ে, পিয়ানোর রিডের ওপর যেমন আঙুল, ডো রে মি ফা, ভাঙা গলায় বলে উঠল অরিন্দম, ‘আচ্ছা, অতনু-সুশান্ত জুটিকে দেখছি না, ওরা আমার জয়েন করার খবর পায়নি বুঝি ?’

শিবু পালিত, মানে আশিয়ানা বিলডিঙের শৈবাল, যে নাটক করে, মানে গ্রুপ থিয়েটার, বিপ্লবী উৎপল দত্তের সঙ্গে রঙ্গিলা উত্তমকুমারের মিশেল দিয়ে জানালো, ‘সুশান্ত গেছে দু-ট্রাক কড়াইশুঁটি আনতে, আর অতনু গেছে রেমিটান্স নিয়ে ।

‘অতনু আর রেমিট্যান্স ?’

রেমিট্যান্স মানে বন্দুকধারী  প্যারা মিলিটারি পুলিশ পাহারায় অনেকগুলো কাঠের বাক্সে থাক-থাক টাটকা নোট  ট্রেনের ওয়াগনে করে পাততাড়ি । সেগুলো তুলে দেয়া নির্ধারিত কর্তৃপক্ষের জিম্মায় ; যে নিয়ে যাচ্ছে যে বুঝে নেবে প্যাকেট আর বাণ্ডিল । যারা নেবে তারা গুণে যাচাই করে নেবে । গোনাগুনি করতে তাদের যতদিন সময় লাগে ততদিন সেখানে ঘাঁটি গেড়ে বসে থাকতে হবে । নিয়ে যাবার হরেক হ্যাঙ্গাম । ওয়াগন ব্রেকারের ভয় । লক্ষ লক্ষ কোটি কোটি টাকার সঙ্গে সফরের ভয় । ট্রেন থামলেই গাড়ি থেকে নেমে দেখে নাও সব ঠিকঠাক । তালা টেনে যাচাই করে নাও । ঘুমের দফারফা । বারবার হিসি পাবে । গোনাগুনতিতে দিনের পর দিন কাটাতে হয় অচেনা জায়গায় । থাকার হোটেল নেই অনেক শহরে । মুখে দেয়া যায় না এমন খাবার । মশা । রোগের বালাই । নোংরা জল । লোডশেডিং । ধুলো । লু । বৃষ্টি । একা ।

পুরোনো হিলহিলে নোটের স্যাঁতসেঁতে গুঁড়ো০গুঁড়ো ধুলোয় অতনুর অ্যালার্জি হয়েছিল । চাকরিতে ঢুকেই । চোখের জলে নাকের জলে রুমাল ভিজে, ধুতির খুঁট ভিজে, সহ্যশক্তি না গজানো ওব্দি অ্যালাজেসিক আর অ্যালার্জির বড়ি খেয়ে অর্ধনিমিলিত, ক্যানটিনের বেঞ্চে বা ডিসপেনসারির স্ট্রেচারগাড়িতে চিৎ । বড়ো খাজাঞ্চি, যাঁর টেবিলের বিশাল কাঁচের তলায় ভারতের প্রতিটি তীর্থের দেবী-দেবতার রঙিন-শাদাকালো ছবি,  বলেছিলেন, ‘এ চাকরির অনেক হ্যাপা আছে, কিন্তু সয়ে যাবে, এরপর যদি আঁস্তাকুড়ে শোও তাহলেও অসুখে পড়বে না ।’

নামকরা কেরানি বলে দশটা-পাঁচটায় নির্ভুল আটক অরিন্দম । পাগলোত্তর জীবনে একদিন চারটে নাগাদ, যখন ও মনে-মনে একটা খসড়া বাংলা থেকে ইংরেজিতে তর্জমা করছে, ধাড়ি নোট-পরীক্ষক গৃহবধুদের মুখরা দল নানা সুগন্ধের বেড়ায় ঘিরে ধরল ওকে । উমা ভর্মা, মানসী বর্মণ, শ্যামলী কর্মকার, হেমা শ্রীবাস্তব, সরিতা যাদব, আরও কয়েকজন । একজন বলল, ‘আমরা নালিশ জানাতে এসেছি, সাকসেনা সাহেব সবাইকে দেখিয়ে-দেখিয়ে আমাদের কনফিডেনশিয়াল অ্যাপ্রেজাল রিপোর্ট লিখেছেন আর হাসিঠাট্টা করেছেন ।’

‘জানি,’ অরিন্দম মুখ না তুলেই বলল, ‘মানসী বর্মণের পোটেনশিয়ালিটির কলামে লিখেছিলেন “আনপ্রুভড”, কারেক্ট করিয়ে নেয়া হয়েছে ।’

মানসী বর্মণ কাছে ঘেঁসে দাঁড়িয়ে বলল, ‘বৃন্দাবন পার্কে ছিলেন শুনলুম ।’ মানসী দৃষ্টিকটুভাবে সুশ্রী, আকর্ষণিয়ভাবে উন্নাসিক, ফুলোফুলো ত্বরান্বিত আঙুলে নোট গোনার অকল্পনীয় ব্যুৎপত্তি ।

‘না, লুম্বিনী পার্কে,’ গা বাঁচায় অরিন্দম, মুখ না তুলেই ।

উমা ভর্মা হিন্দিতে বলল, ‘ওঃ, ভাগ্যিস মথুরায় নয় ।’

অরিন্দম চোখাচোখি এড়াতে চাইছিল । কে জানে মৌলিনাথ উসকেছে কি না এদের । এরা ওকে দলবেঁধে হেনস্হা করতে এসেছে । প্রতিবেশিনীর কানাঘুষো দূতী । তার পাগলামির খবরের সঙ্গে মুখরোচক আরও গুজব রটে থাকবে, সত্যিকে ফেনানো অতিকথা । গ্লানিকে পাগলামি দিয়ে সারাবার প্রক্রিয়াকে তাহলে রুদ্ধ করতে চাইছে এরা । একজন মানুষের ভাবনাচিন্তাকে আঘাত করার ঠিক কতটা অধিকার, সামাজিক প্রাণী হিসেবে, আরেকজনের থাকতে পারে ? মানসীর তো বরের সঙ্গে ছাড়াছাড়ির গুজব । লক্ষ কি সত্যিই অরিন্দম !

‘মথুরার রাজায় গিজগিজ করছে অফিসটা ।’ শ্যামলী কর্মকার, ময়লা, কোঁকড়া চুল, দেখতে দশ-পনেরো দিনের পোয়াতি, মন্তব্য করল । গায়ের রঙ ময়লা নয়, তবু বাবা-মা শ্যামলী নাম রেখেছে বলে হয়তো কৃষ্ণ আর তার লীলার ওপর ওর রাগটা আমার ওপর ঝাড়ল, নিজেকে নিঃশব্দে বলল অরিন্দম।

চলে গেলেন গৃবধুরা, মোজেকজমিনে ময়ূরপঙ্খী নৌকো বেয়ে । শিশির ফোঁটারা বেরিয়েছেন নৈশভ্রমণে । শ্যামলী কর্মকারের দু’কাঁধে আর পিঠে মাংসের আদরনীয় তিরিশোর্ধ পরত জমতে শুরু করেছে, না তাকিয়েও দেখতে পাচ্ছিল অরিন্দম, ফর্সা পিঠে শিরদাঁড়ার দুপাশে জড়ুল আঁকা ডানাছড়ানো নরম মাংসের প্রজাপতি ।

অরিন্দম জানে ও পাগল হয়ে গিয়েছিল । কেন তাও মনে আছে ওর । অ্যাটেনডেন্স রেজিস্টার থেকে জানতে পেরেছে কবে থেকে ছুটিতে ছিল ও । কিন্তু কোন মুহূর্তে পাগল হয়ে গিয়েছিল, মনে নেই, কবে কখন, কোথায় । উন্মাদ হয়ে ওঠার মুহূর্তটা জানতে চায় অরিন্দম, নিজেকে নিজের বাইরে থেকে জানতে চায়, দেখতে চায়, আহ্লাদের অনিকেত মুহূর্তটা, সেই উজ্বল বিস্ফোরণ, বিগ ব্যাং, নীহারিকাপূঞ্জ, অন্য জগতে স্হানান্তরন । হাসপাতালের কাগজে ইলেকট্রোকনভালসিভ থেরাপির অঙ্কময় লেখাজোখা । বোবাদের বিনির্মাণ করলে কতরকম গোলমেলে অরিন্দম বেরিয়ে আসবে,  যে অরিন্দমদের ও চেনে না । বুড়ো কাউনসেলার সেরে যাবার পর বলেছিলেন, আপনার আত্মবিশ্বাস আপনাকে সারিয়ে তুলেছে । সেটা কোন অরিন্দমের আত্মবিশ্বাস ?

নিকট বন্ধুদের কাছ থেকে লুকিয়ে রাখেনি । জানা ছিল, এই সম্পর্কের উত্তরণ নেই । কিন্তু নরম মাংসের নেশায় একরোখা অন্ধত্ব জাপটে ধরল ওকে । নিজের সঙ্গে বিশ্বাসভঙ্গ দিয়ে শুরু ।

অফিসের কাচের বাইরে তাকাল অরিন্দম ; এক গূড়দর্শী শঙ্খচিল সাঁতরাচ্ছে আকাশের রোদ্দুর-মাখানো ঢেউয়ে ।

ওদের সংস্হায় প্রত্যেক বছর একজন পাগল হয় । গেল-বার দুবেজি হয়েছিল, তার আগের বছর এম কে ঝা পাগল হয়ে আর ফেরেনি । আসছে বছর কার পালা কে জানে । এর চেয়ে, অসীম পোদ্দার মামুদ জোহের মিলে যে সান্ধ্যদল গড়ে তুলেছে, যাকে সবাই নারী-নারকো গ্যাঙ বা না-না লেচার বলে, তাতে ঢুকলে পাগল হওয়া থেকে রেহাই পেত হয়তো ।

বি সেকশানের নোট পরীক্ষকদের কেউ বড় একটা ঘাঁটায় না । সংস্হা যাদের ঘ্যাঁচড়া বজ্জাত আড়বুঝো বদরাগি ঝগড়ুটে কর্মচারী মনে করে, তাদের পাঠায় ওই সেকশানে । মামুদ জোহরের কাছে জানলায় সানফিল্ম লাগানো ফিকে নীল রঙের ম্যাটাডর ভ্যান, সানফিল্ম লাগানো বেআইনি হওয়া সত্বেও লাগিয়েছে, ড্রাইভারের পেছনে সানমাইকার দেয়াল । পেছনে কি চলছে দেখা যায় না । ড্রাইভার পেছনের ট্র্যাফিক দ্যাখে রিয়ারভিউ আয়নায়, তাই ভাড়া করা ড্রাইভার রাখে না, গ্যাঙের সদস্যরা নিজেরাই চালায় । সানমাইকার দেয়ালের পেছনে, দুদিকের সিট টানলে সোফা-কাম-বেড, মখমালের চাদর দেয়া বিছানা গড়ে ওঠে । মাইক্রোবায়োলজিতে গবেষণা মাঝপথে ছেড়ে দিয়ে মামুদ জোহের ঢুকেছিল চাকরিতে । নিজের শহর, নিজের প্রাসাদোপম বাড়ি, এখানেই চাকরি, ব্যাস ।

অসীম পোদ্দারের জানলায় পর্দা ঢাকা শাদা ডিজেল অ্যামব্যাসাডর । অ্যামবাসাডর উঠে যাচ্ছে বলে মনখারাপ থাকে । জেনেটিকসে পিএইচডি অসীম পোদ্দার । কেন্দ্র সরকারের বায়োটেকনোলজি বিভাগে অধস্তন বৈজ্ঞানিকের চাকরি পেয়েছিল, কিন্তু নোটপরীক্ষকের চেয়ে মাইনে কম বলে যায়নি ; অফিসে, এমনকি চায়েরদোকানে, পেছনের গলিতে তাড়ির আর জুয়ার ঠেক-এ ওর নাম ডকটর ।

অফিসের কাজ শেষ হলে, একটা-দুটোর মধ্যেই হয়ে যায়, পেছনের গলিতে, যেখানে পোড়া নোটের ছাই দিয়ে একটা পোর্টেবল গন্ধমাদন ঢিপি, ওরা গিয়ে দল বেঁধে তাড়ি খায় চায়ের কাপে, সিপ মেরে, তাড়ির ঋতুতে । ভাঙের ঋতু হয়, দিশি মদের, আফিমের, গাঁজার, চরসের, স্ম্যাকের । গাঁজাগুঁড়ো তামাক-চরসে মিশিয়ে আইভরি পাইপে । মেডিকাল কলেজের নাইজেরিয় ছাত্ররা হেরয়িন এল এস ডির ব্যবস্হা করে । ম্যাটাডরে ফার্স্ট এইড বাক্সে অ্যালুমিনিয়াম পাত, চামচ, ডিস্টিলড জল, সুঁই নেবার পিচকিরি, কাঁচি, লাইটার, ছিলিম, টয়লেট পেপার, তুলো । আর আছে বিদেশি-স্বদেশি নিরোধ বা কনডোম, রঙবেরঙ, নানা সুগন্ধের । আছে অকুস্হলকে তুলতুলে করে তোলার মলম । শনিবার-শনিবার হল্লাবোল । সেদিন যে একটারও আগে ছুটি । সেদিন ওদের দলে বেশ কয়েকজন অফিসারও শহরের অন্য কোনো নির্দিষ্ট মোড়ে গিয়ে ঢুকে পড়ে ওদের দলে । দাশগুপ্ত, বোস, আগরওয়াল, রায়চৌধুরী, মুদলিয়ার, খান্না, মুখার্জি ওরা সব । লটারি অনুযায়ী ফি-হপ্তায় দুজন, ট্রেজারার আর ম্যানেজার হয়, যারা গাড়ি চালায়, ছোঁয় না কিছু । সন্ধে নাগাদ কোনও হাফগেরস্হ যুবতীকে এই কড়ারে তোলা হয়, দশ বারোজন তার সঙ্গে রতিভ্রমণ করবে ম্যাটাডরের সোহাগ বিছানায়, আর তারপর তার আসতানায় ছেড়ে দেয়া হবে কাজ শেষে । দুদিন বা তিনদিন একসঙ্গে ছুটি থাকলে ওরা অমন যুবতীকে নিয়ে বাইরে কোথাও চিটফান্ডের লটারি খেলতে যায় । মেয়েটির সঙ্গে লুকোচুরির খেলা । যে জেতে সে মেয়েটিকে আর চিটফাণ্ডের নির্দিষ্ট অংশ পায় ।

এই দলটার সঙ্গে মেশার অসুবিধে, তাদের অনৈতিকতা আর উচ্চশিক্ষার গর্ববোধ ছাড়া, নিজেদের মধ্যে কনভেন্টে পড়া ইংরেজিতে কথা বলে । মৌতাত ছাড়া, কারোর কোনো উচ্চাকাঙ্খা নেই, বা নেই কেরিয়ার সম্পর্কে চিন্তা । যতটুকু আয় তাকে মনে করে যথেষ্ট । ওদের কথা বলার ঝাঁঝ থেকে জানিয়ে দেয় যে কেউ কিছু হয়ে ওঠে না, বুদ্ধিজীবির কাজ আদর্শবাদকে এড়ানো, বেঁচে থাকাটা জ্বরভারে আনন্দ, স্মৃতি জিনিসটা বানানো, বাস্তব বলে আদপে কিছু হয় না বলে কোনো দুশ্চিন্তায় ভোগার দরকার নেই । অসম ধ্যানধারণার কারণে, অনেকে হেঁ-হেঁ হাসতে-হাসতে দ্রুত পাশ কাটায় । বংশরোপণ সিং যাদব ওই ভাবে পাশ কাটাতে গিয়ে থলে ভর্তি অফিস থেকে চুরি করা গোটা দশেক রঙিন পেপারওয়েট নিয়ে ওদের হাতে ধরা পড়েছিল । চাপরাশি থেকে উঠতে-উঠতে অবসরপ্রাপ্তির বছরে অফিসার হয়ে হেনস্হা ।

মামুদ জোহের সব সময় গম্ভীর, চিন্তিত । অন্য মুসলমান কর্মচারী বা অফিরাররাও ওর ধারে কাছে যায় না । কিছুটা কুঁজো আর গাঁট্টাগোঁট্টা, বেশ ফর্সা, কুঁজো হলেও ঢ্যাঙা, নিজের নাক দেখিয়ে বলে এটাই আরবদেশের, বাদবাকি ইনডিয়ান । অসীম পোদ্দারের বাঁ হাতে, এমনকি নাচগান-হুল্লোড় আর যৌন-অভিসারের সময়েও, একটা ডায়েরি, টুকটাক লিখে নিচ্ছে কিছু । দলে আছে বাইশ থেকে চল্লিশ বয়সি । রেগুলার দেবেন্দর, অভিজিৎ, শৈবাল, হরিশ, রবীন, অশোক, নরেন, প্রতুল, অনিমেষ, সুশীল, সুধীর, কমলেশ — বাঙালি বিহারি পাঞ্জাবি ওড়িশি ।

সুশান্ত, সব ব্যাপারে নাক গলানোর সুবাদে, অসীম পোদ্দারকে একবার অনুরোধ করেছিল, গরদানিবাগ হাই স্কুলে পড়া স্হানীয় ইংরেজি এড়িয়ে বাংলাতেই, অ্যামব্যাসাডরটা চালিয়ে দেখবে । চালু কিরতে গিয়ে বোঝে গাড়িটায় ক্লাচ নেই । কমলেশ, অটোমোবিল এনজেনিয়ারিং পড়ে যে ছোকরাটা নোট-পরীক্ষকের চাকরিতে ঢুকেছিল, ক্লচ বাদ দিয়ে দিয়েছে । কত গাড়ি বারিপথ বুদ্ধমার্গ অশোক রাজপথ থেকে দিনদুপুরে হাপিস হয়ে যায় রোজ, ওদেরটা হয়নি । চাকা ব্যাটারি ওয়াইপার ওব্দি চুরি যায়নি । অথচ চুরি হতে পারে না এমন অস্হাবর এমন কিছু পাটনা শহরে নেই, জীবজন্তু এমনকি মানুষও, মাঝপথ থেকে আচমকা উধাও ।

নিসপিসে বাঁ পা দুচারবার নাড়ানাড়ি করে বিস্ময়ে গাড়ি থেকে বেরিয়ে এসেছে সুশান্ত, ‘হিন্দমোটরে পাঠিয়ে দিন না প্রোজেক্টটা ।’

‘না, অনেকের চাকরি চলে যাবে ; তাছাড়া এর ড্রিং তো অনেককাল আগে এসে গেছে ইনডিয়ায়, অটোমোবিল ইনডাসট্রিতে সম্পূর্ণ রদবদল ঘটে যাবে কয়েকবছরে । তখন আমাদের ইনডিয়ান গাড়ি কমপিট করতে পারবে না , ‘ বলেছিল অসীম পোদ্দার । অসীম এখনও বাংলায় কথা বলে, অথচ ওর জাঠতুতো ভাই তরুণ পোদ্দার, যার বাবা ক্ষেত্রমোহন পোদ্দার ব্রাহ্মস্কুল রামমোহন রায় সেমিনারির প্রধান শিক্ষক ছিলেন, আর পায়জামার ওপর ধুতি পরতেন, ও, তরুণ পোদ্দার বাংলা জানলেও বলে না, বাঙালিদের সঙ্গেও হিন্দিতে কথা বলে । তরুণের বড়দা, কল্যাণ পোদ্দার এখন প্রধান শিক্ষক, নিজেকে বাঙালি পরিচয় দিতে কুন্ঠিত হয় । ব্রাহ্ম শিক্ষক পাওয়া যায় না বলে উনিই প্রধান শিক্ষক, বংশপরম্পরায় চলবে স্কুল । বাংলা পড়ানো হয় না, কেননা সরকার আর বাংলা টেক্সটবুক ছাপে না ; স্কুলও বাঙালি শিক্ষক পায় না ।

সুশান্তকে কিন্তু মামুদ জোহের সমীহ করে, ট্রাকে করে ভিন্ন রাজ্য থেকে অসময়ের ফল-আনাজ আমদানির খাটুনি-প্রতিভার জন্যে । কেননা প্রায় সবাই মনে করে খাটুনির প্রতিভা একেবারে নেই বাঙালি যুবকদের, ঝুঁকি নেবার, অথচ অনেকেই মাওওয়াদি হবার ঝুঁকি নিয়ে বনপার্টিতে চলে যায় । মামুদ জোহেরের গ্যাঙের অনেকে যেতে চেয়েছে সুশান্ত’র পেছন-পেছন, কিন্তু ওর কাকা বলেছেন ব্যবসাপাতির ঘাঁতঘোঁত সবাইকে জানানো উচিত নয় ।

ননীদার বিয়েতে পৌঁছেছিল মামুদ জোহের অসীম পোদ্দাররা, রাত একটা নাগাদ আকাশের তারা মাথায় করে, টং, ঝিমন্ত বাসরের টনক নড়িয়ে, বেদম বাজনা ম্যাটাডরের মিউজিক সিসটেমে, পরিত্রাহি আশা ভোঁসলে আর ডি বর্মণের সুরে । ওদের গুরুমাতাল শৈবাল পালিত  শুধু লিট্টি খেয়ে বলেছিল, ‘চিংড়ি কাটলেট চিকেন টিক্কা চিজ পকোড়া করতে পারতেন, নইলে আর প্রভিডেন্ট ফাণ্ড কেন ?’ কিন্তু ওদের সঙ্গে নকল কোঁকড়াচুল টকটকেঠোঁট চোখেকাজল গালেরুজ  হাতেমেহেন্দি তরুণীটি বথুয়া শাক দিয়ে গোগ্রাসে গিলেছিল পুরি, মানে বড়ো মাপের মোটা-মোটা লুচি, নিজের সঙ্গে একটা হোমসার্ভিস প্যাকেটও তৈরি করিয়ে নিয়েছিল ।

ননীদা বললেন, ‘যাক, বিয়েতে এই পূণ্যিটা অন্তত করে নিলুম, কী বল হে মামুদ, জীবনে যে কখনও এমন নেমন্তন্ন খায়নি, তার আশীর্বাদ পেলুম।’ রাজেন্দ্রনগরের কমিউনিটি সেন্টারের সামনের বাড়িটায়, রাস্তার ওপারে, সারা রাতের ভগবতী জাগরণের জগঝম্প চলছিল পুরোদমে । নরক, ব্যাস, রাত দেড়টা-দুটোয় লোডশেডিং গুলজার ।

মামুদের দলের অফিসাররা, জানাজানি এড়াতে যাদের নির্ধারিত জায়গা থেকে তুলে নেয়া হয়, ননীদার বিয়েতে আলাদা এসেছিল একে-একে । ওদের লাম্পট্যের উল্লেখ করে প্রচুর উড়ো অভিযোগ এসেছে বেনামে । অফিস নির্ণয় নিয়েছে, সেরকমই কেস তৈরি করেছিল অরিন্দম, অফিসের বাইরে যে যা করে তা তার নিজস্ব ব্যাপার, সংস্হার কোনও দায়দায়িত্ব নেই । ‘ভাগ্যিস আপনি অবৈধ সম্পর্ক পাতিয়েছিলেন,  বাঁচাবার পথ কেটে বের করতে পারলেন,’ ওর কানের কাছে মুখ নামিয়ে বলেছিল মুদালিয়ার ।

রমাবৌদি সবচেয়ে আগে ধরে ফেলেছিলেন এই নানা গ্যাঙের কাজকারবার, উপস্হিতি । ‘কাউকে শিগগির পাঠিয়ে দ্যাখো তো ও-ফুটে গেটের সামনে লাল শাড়ি-পরা একটা মেয়ে দাঁড়িয়ে আছে কি না’, টেলিফোনে বলেছিলেন রাঘবকে । রাঘব তখন দুপুরের ভোজন সেরে টুথপিক দিয়ে দাঁতের ফাঁক থেকে ছাগল বের করছিল, দৌড় দিলে দোতলার ওর কোয়ার্টার সংলগ্ন  বারান্দায় । ‘হ্যাঁ, রয়েছে একজন কারোর অপেক্ষায়, চোখে কালো চশমা । কাঁচ তোলা সাদা অ্যামবাসাডর তুলে নিয়েছিল সুবেশা তন্বীকে, পেছনে ফলো করছে একটা ম্যাটাডর ভ্যান ।’

‘দাশগুপ্ত সায়েবের কাছে কলগার্লের ডায়রেকটরি আছে গো,’ জানিয়েছিল রমা । শুনে রাঘবের  মদে চিকনগাল বিখ্যাত ঘিঘিক-ঘিঘিক হাসি, হেঁচকিকে হাসিতে রূপান্তরিত করে ফেলেছে অভ্যাসবশত ।

দাশগুপ্ত যখন লাঞ্চ করতে লাউঞ্জে, ব্রিফকেসে পাওয়া গেল সুদৃশ্য ছোট্ট ডাইরেকটরি, সিঙ্গাপুরে গ্লসি কাগজে ছাপানো । টালিফোন নাম্বার, চেহারা, উচ্চতা, বয়স, কতোগুলো ভাষা জানে, সাংকেতিক না, কয়েকজনের খোলাবুক ফোটো । প্রত্যেকের দরদাম ডলার আর দিনার-দিরহামে । এদেশের সেরা খরিদনারীদের তালিকা । কিছু টেলিফোন নম্বর নিজেই লিখে রেখেছে  দাশগুপ্ত । টিক দেয়া কয়েকটায় । প্রথম পৃষ্ঠায়, ‘উইথ গ্রেট অ্যাডমিরেশান ফ্রম এস পি মুখার্জি,’ মুক্তোর মতন ।

অরিন্দমের সেসময়ের মণিব দাশগুপ্ত, প্রশাসনের অধিকর্তা । ব্রিফকেসে নিখিল ভারত কলগার্ল ডাইরেকটরি আবিষ্কার শান্তি দিয়েছিল অরিন্দমকে, বিপথগমনের সাহস যুগিয়েছিল, কেননা ও তখন বিবাহিতা অভিজ্ঞ প্রতিবেশিনীর দুই থলথলে শ্যামল উরুর খিলে আটক । অন্যের অনুপস্হতিকে পুষিয়ে দিচ্ছে নিজের নির্ভেজাল কৌমার্য দিয়ে ।

তার দিনকতক পরেই নিজের ঘোরানো চেয়ারে পাক খেয়ে হৃদরোগে কার্পেটে ঠিকরে পড়ে যখন দাশগুপ্ত মৃত্যুমুখী, অরিন্দমের দুহাতের চেটোয় হিম জমে উঠছিল ফোঁটায়-ফোঁটায়, ঘামের সন্দিহান বিন্দু বিনবিনিয়ে উঠেছে কপালে । মামুদ জোহের কাঁদতে-কাঁদতে না-না গ্যাঙের সহমর্মীদের নিয়ে অকালবৃদ্ধের লাশ গাড়িতে তুলে ছুটেছিল কুরজি মিশনারি হাসপাতালে ।

শ্যামলী কর্মকার যাখন শ্মশান অভিমুখী ফুলে ঢাকা দাশগুপ্তর শবের কপালে হাত বুলিয়ে বলেছিল, ‘যৌনতা বাদ দিলে লম্পটদের চরিত্র আদারওয়াইজ ভালো হয়,’ তখন অরিন্দম আচমকা, ‘কী বলছেন কী আপনি ? দাশগুপ্ত সায়েব আর লম্পট ! দাম না দিয়ে কোনও সেবা কারোর থেকে নিতেন না ।’

অফিসের গৃহবধু কর্মীরা থ, যেন অরিন্দমেরও যোনি ছিল কখনও, কোনও বয়সে ।

দাশগুপ্তের মৃত্যুর পর, অফিস যখন অফিসের মতন নির্লিপ্ত নৈর্বক্তিকে ফিরেছে, উকিল ভৈরোঁনারায়ণ শুক্লা স্টাফ সেকশানে ঢুকে জানিয়ে গেল, দাশগুপ্ত নিজের সম্পত্তি দিয়ে গেছে সান্ধ্যদলের পাঁচজনকে, স্হাবর সম্পত্তিও বেচে তাদের মধ্যে টাকা ভাগ করে দেয়া হবে ।

তেরো দিনের মাথায় রাজেন্দ্রনগরের কমিউনিটি হলে শ্রাদ্ধ-উৎসব । উৎসবের কাণ্ডারী না-না গ্যাঙের সদস্যরা । অরিন্দম শ্রাদ্ধে গিয়ে দ্যাখে ও-ই  একলা শুধু ধুতি পাঞ্জাবি পরে বাঙালি সেজে পৌঁছেছে । এতদিন কাছাকাছি থেকেও নিজের নিকট ওপরঅলাকে বুঝতে পারেনি, মিশতে পারেনি দাশগুপ্তর কমবয়সী সঙ্গীদের সাথে । চরিত্র জুড়ে তক্কে-তক্কে থাকার সতর্কতা অরিন্দমকে সব ব্যাপারেই উটকো করে ফেলেছিল ।

সবাইকে অবাক করে কিন্তু ভিড়ে গেল, এতদিনকার চর্চিত দূরত্ব মুছে, অতনু ।

ঘরকুনো মনমরা নিঃসঙ্গবিলাসী গররাজি অতনু বাধ্য হয়েছিল টাকা ঠাসা কাঠের বাক্সগুলো নিয়ে অনেকদূরে যেতে, কারণ এবার আর তার বদলে কেউ রাজি হয়নি । এর আগে এড়িয়ে যেতে পেরেছে প্রত্যেকবার । ট্যুরের টিএ-ডিএর লোভে চলে গেছে ওর বদলে আরেকজন । প্রথমে ভেবেছিল লম্বা ছুটি মেরে ডুব দেবে দায়িত্ব থেকে । অবাক হয়ে গেল নিজের মধ্যেই ইচ্ছেটা আবিষ্কার করে ।  অনিচ্ছার মধ্যে বোধহয় পরাজয়বোধের ঘুণপোকা পাক খাচ্ছিল এতকাল । তাছাড়া শরীরের কষ্টবোধকে মনে হতো সবচেয়ে বড়ো শত্রু । রোপনি আর কাটাই ঋতুতে বেশির ভাগ বিহারি কর্মচারী গ্রামে যায় ; তাই অতনুর বদলে এবার যাবে না কেউ ।

যাদের জমিজমা নেই, ব্রাহ্মণ কায়স্হ দলিত-মুসলমান বা অবিহারি, তারা বললে, এবার নিজের পায়ে দাঁড়াও ; তোমার হয়ে আমরা আর কতো সেইব ! গুলিগোলা খেতে আমরা যাচ্ছি না ।

: ওখানের লোকেরা কুকুর-বেরালের মাংস খায় ।

: সবরকম পাখি খায়, কাকও, তারিয়ে ।

: সাপখোপ খায় ।

: প্রকৃতি কিন্তু অপূর্ব ।

: মেয়েরা অপূর্ব সুন্দরী । টকটকে রঙ । দেখে মনে হবে আনটাচড ।

: পুরুষগুলো কিন্তু অফিসেও মাল টেনে ভোম হবে থাকে ।

: নোট গুণে দেখে-শুনে নাবার জন্যে রোজ হাতজোড় করতে হবে তোকে । বিরক্ত হয়ে যাবি । এক ঘণ্টায় যা গোনা যায় তা গুনতে দিন কাবার হয়ে যাবে।

: ঘোরাঘুরিরও তেমন স্কোপ নেই ।

: কদ্দিন যে গিয়ে পড়ে থাকতে হবে কে জানে !

: একদম টাইমপাস হয় না ; তার ওপর সন্ধে হয় তাড়াতাড়ি, দুটো বাজতেই বিকেল ।

: মালটানা পাতাফোঁকার ওব্বেস থাকলে তেমন অসুবিধে হতো না ।

: সাবধানে মেলামেশা করবেন । ওদিকে খুব এডস-ফেডস হয়, সেদিন দেখাচ্ছিল দূরদর্শনে । ধুতিটা পালটে এবার ফেডেড জিনস ধরুন । কাপড়-ফাপড় কাচাকাচির অনেক ঝুঠঝামেলা ।

: গরম কাপড় নিয়ো সঙ্গে । শুধু আলোয়ানে কুলোবে না ।

: থাকার জায়গাও পাওয়া যায় না সহজে । যাও বা দুচারটে হোটেল আছে বা গেস্ট হাউস, সরকারি অফিসারদের কব্জায় ।

: আরে অফিসারগুলো নিজেদের ইচ্ছেমতন শহরে ফেরত যায়, দু-তিনটে বছর কোনও রকমে কাটিয়ে । বাড়তি মাইনে, বাড়তি এল টি সি, তবু কি নাকে কান্না ।

: খোঁজাখুঁজি করলে দু’তিনঘর বাঙালি পেয়ে যাবেন । বাঙালি কোথায় নেই !

বেচারা । অতনুর সবই জানা । অফিসের সকলেই জানে এসব । উৎসাহ দেবার বদলে ভয় পাইয়ে দিচ্ছে । কারণ হ্যাঙ্গাম পোয়াতে পারে না বলে, কাছাকাছি শহরেও ক্যাশ রেমিট্যান্স নিয়ে যাবার কাজ এড়িয়ে গেছে এর আগে । সবাই তা জানে । এখন তিরিশ-চল্লিশ বাকসো  পাঁচশ একশ পঞ্চাশ কুড়ি আর দশ টাকার নোট পুলিশ পাহারায় ট্রেনে, তারপর ভ্যানে, ইনার লাইন পারমিটের ভ্যানতারা, স্হানীয় পুলিশকে জানানো, ওফ কি ঝকমারির চাকরি । কিছু অঘটন হলে, যদি বেঁচে থাকে, অতনুকে নিয়ে টানাটানি । গুলি খেয়ে পটল তুললে তো কথাই নেই । অফিস বীমা করিয়েই খালাস ।

মা-কে একলাই চালাতে হবে । সুশান্তকে বলে যাবে বাজার-টাজার করে দিতে । ও বাইরে গেলে মুশকিল ।

সকালেই ভাগলপুর থেকে ফিরেছে সুশান্ত । ওর বড়দা, বড়জ্যাঠামশায়ের ছেলে, যা ডাক্তারের ক্লিনিকে কাজ করে, অনেককাল কমপাউণ্ডার, সেই সত্যেন বোসরায়ের সতেরো বছরের মেয়ে পাপড়িকে বাড়ি থেকে জোর করে তুলে নিয়ে গেছে গুণ্ডারা ।

হিন্দিতে লেখা স্টেটমেন্ট, এফ আই আর-এর জেরক্স অতনুকে দিয়েছিল সুশান্ত ।

“আমি ডক্টর সত্যেন্দ্রমোহন বোসরায়ের স্ত্রী অর্চনা বোসরায় সাকিন বড় পোস্টাপিসের কাছে, কপতোয়ালি থানা, জেলা ভাগলপুর । আজ সতেরো ডিসেম্বর দুপুর একটায় ভাগলপু মেডিকাল কলেজ হাসপাতালস্হিত পুলিশ শিবিরের জমাদারের উপস্হিতিতে মেডিকাল কলেজের এমার্জেন্সি ওয়ার্ডে বয়ান দিচ্ছি যে দুপুর বারোটা নাগাদ যখন আমি পুজোর ঘরে ছিলুম, হঠাৎ আমার মেয়ে পাপড়ির মা-মা চিৎকার শুনতে পাই । চিৎকার শুনে বাইরে বেরিয়ে এসে দেখি চার-পাঁচজন জোয়ান ছেলে আমার মেয়েকে টেনে বাইরে নিয়ে যেতে চাইছে । তাদের মধ্যে জিন্দো এলাকার সাবোর থানা-নিবাসী রামদাস মণ্ডলের ছেলে প্রবীণ সিংহকে চিনতে পারি । অন্য আরেকটা ছেলেকেও চিনি যে ডাক্তার আর এন ঝার স্ত্রীর সঙ্গে দিনকুড়ি আগে এসে প্রবীণের সঙ্গে পাপড়ির বিয়ের প্রস্তাব দিয়েছিল । ওই প্রস্তাব আমি সঙ্গে-সঙ্গে প্রত্যাখ্যান করেছিলুম । আমার মেয়েকে ধরে টানাটানি রুখতে যেই আমি ওদের মধ্যে গিয়ে পড়ি, তক্ষুনি নীল রঙের জ্যাকেট পারা বেঁটে মতন এক ছোকরা আমার দিকে পিস্তল তাক করে । ভয়ে আমি যেই পুজোর ঘরে ঢুকেছি, মেয়ের বাঁচাও-বাঁচাও চিৎকার শুনে তক্ষুনি বাইরে এসে দেখি, প্রবীণ এক হাতে আমার মেয়ের চুলের মুঠে আর অন্য হাতে পিস্তল নিয়ে বেরিয়ে যাচ্ছে । আমাকে দেখে পাপড়ি আমার দিকে এগিয়ে আসতেই, প্রবীণ চে!চিয়ে উঠল, ‘প্রদীপ ঝা, এর মুখ বন্ধন করে দাও ।’ রোগা ফর্সা ছেলেটা আমার মুখে লিউকোপ্লাস্ট এঁতে দিল । তারপর প্রবীণ বলল, ‘এই সুরেশ বুধিয়া, দেখছিস কি, তাড়াতাড়ি উঠিয়ে নিয়ে চল ।’ যে ছেলেটা পিস্তল নিয়ে দাঁড়িয়েছিল, সে এই ফাঁকে পিস্তলটা দিয়ে বেশ জোরে আমার মাথায় মারে, আর হিঁচড়ে নিয়ে যায় আমার মেয়েকে । আমি আবার বাধা দেবার চেষ্টা করলে প্রবীণ গুলি চালায় । রাস্তার সিঁড়িতেও আটকাতে গেলুম তো সেখানে দুটো লোক দাঁড়িয়ে ছিল, দেখলে চিনতে পারব, কোনও ভারি জিনিস দিয়ে আমার মাথা ফাটিয়ে দিলে । এর মধ্যে আমার দেওর আর ওর স্ত্রী এসে পড়ে ওদের আটকাতে গেলে প্রবীণ আবার গুলি চালায় । আমরা চেঁচাতে-চেঁচাতে ওদের পেছন-পেছন গেট পর্যন্ত পৌঁছলে, ওরা একটা শাদা মারুতি গাড়িতে আমার মেয়েকে তুলে নিয়ে পালিয়ে যায় । গাড়ির নম্বর ডি আই ডি ২৮৯৬, আর গাড়িটার কাছে ২২২৩ নম্বরের আরেকটা গাড়ি ছিল । ভেতরে তিন-চারজন, সেটাও মারুতির সঙ্গে পালায় । গাড়ি দুটো বিহার হোটেলের দিকে চলে গেল । আমি আমার ছ’বছরের মেয়ে অর্পিতার সঙ্গে রিকশয় চেপে প্যাটেলবাবু রোডে আমার স্বামীর ক্লিনিকে যাই, আর ঘটনা জানাই । তারপর আমার স্বামী কমপাউণ্ডার শচীন ঘোষকে নিয়ে ভাগলপুর মেডিকাল কলেজ হাসপাতালে চিকিৎসার জন্যে আসি । আমি নিশ্চিত যে প্রবীণ সিংহ, প্রদীপ ঝা, সুরেশ বুধিয়া আর অন্য ছ;সাতজন ষড় করে আর পিস্তল চালিয়ে আমার মেয়ে পাপড়িকে অপহরণ করেছে ।”

পড়ার পর, অতনু জোরে বলে ফেলেছিল, ‘এবার কী হবে তাহলে ?’ সুশান্তর জ্যাঠামশায় নামছিলেন দোতলা থেকে, বললেন, ‘হবে আবার কী ! মারুতি গাড়িটা মুখ্যমন্ত্রীর শালা বাচ্চা ঝা’র । তারপর একটু থেমে, ‘এদেশ থেকে পাততাড়ি গোটাতে হবে ।’

সুশান্তকে এই প্রথম, এত বছরের পরিচয়ের পর, গম্ভীর আর চিন্তিত দেখে, অতনু বিমর্ষ হয়ে পড়েছিল ।

সুশান্তর বাড়ি থেকে একটা ব্লোপ্লাস্ট সুটকেস, কানে ঠুলি দেবার অডিও ডিভাইস, ওর নিজে ট্যুরে যাবার পাতলা বিছানা, ফোলানো বালিশ নিয়েছে, আর সুশান্তর মেজদার একটা ফুলপ্যান্ট জ্যাকেট, যদি দরকারে পড়ে, তাই । যেখানে যাচ্ছে সেখানে জিনসের জামা-কাপড় কর্ডুরয় জুতো বিদেশি অনেক জিনিস পাওয়া যায়, সুশান্ত জানিয়েছে । সস্তায় । সুশান্তর মাধ্যমে, মানসী বর্মণ দিয়েছে ফ্রানসের ইউ ডি কোলোন আর মাস্ক পারফিউম আনতে । আলু ছেঁচকি রুটি আর স্কুলের সময়ের রঙিন ওয়াটার বটল দিয়েছেন মা । উনি ততো চিন্তিত নন কেননা বাবা প্রায়ই যেতেন অমন বাইরে ট্যুরে, অফিসের কাজে । মায়ের সঙ্গে কেমন যেন দূরত্ব গড়ে উঠেছে ক্রমশ, খুব কম কথা হয় । অতনু নিজে ছাড়া কেউই ওর প্রথম ট্যুর নিয়র চিন্তিত নয় । চিন্তায় পাকিয়ে উঠেছে ওর দুশ্চিন্তা ।

কিসের দুশ্চিন্তা, নিজেই ঠাহর করে উঠতে পারছিল না । পেটের মধ্যে পাক খাচ্ছে পিচ্ছিল পাঁকালের দল ।

অতনুর ঊর্ধতন অফিসার, যার এসব কাজের দায়, এসেছিলেন স্টেশানে, লোডিং ঠিকমতো হল কিনা যাচাই করতে, ওয়াগন বন্ধ হবার পর তালাগুলো নাড়িয়ে দেখলেন অনেকবার, সিল করে দিলেন সবকটা তালা অফিসের সিলমোহর মেরে । সুশান্তও এসেছিল, বলল, ‘পাপড়িকে জোর করে বিয়ে করেছে প্রবীণ, কেস দায়ের হয়েছে, কিন্তু পাপড়িকে ওর বাবা-মা ফেরত নিতে চাননি, বেশ গণ্ডোগোল আরম্ভ হয়েছে ।’ আরও থমথমে হয়ে উঠল অতনু, বিমর্ষ, আক্রান্ত, নিঃসঙ্গ ।

ট্রেন ছাড়তে, হাত নাড়িয়ে বিদায় সম্ভাষণ জানাবার মাঝে, অতনুর মনে পড়ে গেল, আচমকা, চিরুনি টুথব্রাশ পেস্ট সাবান দাড়ি কামাবার সরঞ্জাম নিতে ভুলে গেছে ও ।

ট্রেন থামলেই, প্ল্যাটফর্মে নেমে, ওয়াগানটার দিকে খেয়াল রাখছিল অতনু । বারবার ওর ওই প্রকাশ্য উদ্বেগে বিরক্ত প্যারা মিলিটারির সঙ্গী হেড কন্সটেবল জানালো, অত চিন্তার কিছু নেই, অমন ঢের ক্যাশ বাকসো সঙ্গে নিয়ে গেছে ওরা, ডাকাতরা এ-মাল ছুঁতে ভয় পায়, আর এই রুটে মাওওয়াদি পড়ে না ; মাওওয়াদিরাও এই ওঘান ভাঙতে চায় না, নতুন নোটের নম্বরের ট্রেল অনুসরণ করে প্রশাসন ওদের ধরে ফেলতে পারে ।

ঠিক আছে, যা হবার হবে, দেখা যাবে, ভেবে, রুটি আলু ছেঁচকি খেয়ে, বিছানা পেতে শুয়ে পড়ল অতনু । স্বপ্ন দেখল, বাবা পায়ে হেঁটে ট্রেকিং করে, মিউলের পিঠে দু’পাশে টাকার বাকসো ঝুলিয়ে, সঙ্গে লাল মুরেঠা-মাথা বন্দুকধারী পুলিশ, ছ’টা বাদামি কালো মিউলের পাশে-পাশে মালবাহকদের পিঠে সুটকেস বেডিং, যাচ্ছেন হিমালয়ের কোনো ব্যস্ত গঞ্জের কারেন্সি চেষ্টে । হনুমান টুপি, মাফলার, দস্তানা, বালাপোষের কালো কোট । দূরের অস্বচ্ছ হিমবাহের উড়ন্ত শ্বাস খেলে বেড়াচ্ছে সিঁড়ি-ভাঙা সবুজ ধানখেতের ওপর । পায়ের কাছে হলুদ প্রজাপতির চনমনে দল, এই শীতেও, বসন্ত ঋতুকে ডানায় করে নিয়ে চলেছে বাবার জন্য । চড়াই থেকে নেমে ভাঙছেন উৎরাই । সাদা-বেগুনি ঘাসফুলের ছিটে । গলায় ঘণ্টি-বাঁধা উদাসীন গাইগোরু মুখ তুলে আগন্তুকদের এক পলক দেখে, জাবর কাটায় মন দ্যায় ।

ঘুম ভাঙল সেপাই নুরুদ্দিন মণ্ডলের দাড়ি-ঝোলানো ডাকাডাকিতে । ঘুম ভাঙতেই আশঙ্কিত, ভাবল বুঝি গোলমাল, ছিটকে উঠে বসল । না, সকাল । টুথব্রাশ পেস্ট আনেনি শুনে নিমদাঁতন দিয়ে গেল আর দাঁতন হয়ে গেলে গরম চপ আর চা । সুশান্তর উপদেশ অনুযায়ী সেপাইগুলোকে গুড হিউমারে রাখার জন্য এসব ভদ্রতা অতনুরই করার কথা । কিনউ অপ্রস্তুত ভাব কাটিয়ে উঠতে পারছিল না । চা-চপ খেয়ে নিল গোবেচারা নৈঃশব্দে, আলগা চটি বুড়ো আঙুলে ঝুলিয়ে । গন্তব্যে না-পৌঁছানো ওব্দি, ওখানে সরঞ্জাম কেনার পরই দাড়ি কামাবে ।

নুরুদ্দিন আবার খোঁজ করতে এলে, ‘আমি ঠিক আছে, অত ভাবছেন কেন—,’ অতনু বলল ।

‘না, মানে সাহাব বলেছেন আপনি কখনও যাননি রেমিট্যান্স নিয়ে, তাই ।’

‘আরে ঠিক আছে, কেন কষ্ট করছেন মিছিমিছি’— কে এদের এসব বলেছে কে জানে ! অযথা অপদস্হ করা । সবাইকে সব কথা কি না বললেই নয় । স্টেশানে এসেছিলেন শ্রীনিবাসন, ওঁরই কীর্তি, নির্ঘাৎ । ছি ছি ।

পরের স্টাশানে নুরুদ্দিন হিন্দি খবরের কাগজ দিয়ে গেল ।

‘আপনি কি পুলিশে ? একজন মোটামতন বয়স্ক সহযাত্রী, উসখুস বাদ দিয়ে জানতে চায় সরাসরি ।

‘না’ । নোট পরীক্ষক বললে বুঝতে পারবে না আঁচ করে উত্তর দিল অতনু ।

‘ও । সি আই ডি ? সি বি আই ?’

চুপ মেরে থাকাটা বরং ভালো । আর জবাব দিল না অতনু । আবার জেরা আরম্ভ হতে পারে আঁচ করে ওপরে নিজের বার্থে উঠে গেল । সহযাত্রীদের মধ্যে ইন্দিরের খুন, অপারেশান ব্লু স্টার, বোফোর্স, নাগমণির স্ত্রী হত্যা, নির্মল মাহাতো হত্যা, বৈশালীতে মহোবিয়া খুন, জগন্নাথ মিশ্রর বলুয়া গ্রামের কাছে কমরেড রাজকিশোর ঝার হত্যা, বেগুসরায়ে ভাজপা, মাকপা, ইনকা নেতাদের বেরহম পিটুনি, জয়প্রকাশের চ্যালা লালু যাদব নীতিশকুমারদের জাতপাত রাজনীতি, বিধান পরিষদের উপসভাপতি রাজেশ্বরী দাশের দত্তকপুত্রী শ্বতনিশা  ওরফে ববিকে নিয়ে মন্ত্রী বিধায়ক আর তাদের জোয়ান ছেলেদের বেলেল্লাপনা, দলেলচৌক বধৌরায় মুখ্যমন্ত্রী বিন্দেশ্বরী  দুবের হাত, জয়প্রকাশ নারায়ণের সচিব আব্রহাম কী ভাবে শোভা চক্রবর্তীকে ঠকিয়েছে, ধানবাদের মাফিয়া মকদ্দমায় সূর্যদেব সিং সত্যদেব সিং শংকরদয়াল সিং সকলদেও সিং রঘুনাথ সিং কেমন হেসেখেলে ছাড়া পেয়ে গেছে, আর সমস্ত অপদার্থতার কারণ পুলিশ সি বি আই সি আইডির অফিসাররা, এসব গল্প চলে অতনুকে উদ্দেশ্য করে ।

অতনু খবরের কাগজ দিয়ে মুখ ঢেকে নিল নিজের বার্থে শুয়ে । কাগজে লিখেছে, প্রবীণ সিংকে ১০৭, ১৪৮, ১৪৯, ৪৫২, ৩৬৭, ৩৪১, ৩৪২ দণ্ড সংহিতার ধারায় আর অস্ত্র আইনের ২৭ ধারায় গ্রেপ্তার করা হয়েছে । প্রশাসন প্রবীণের আস্তানার খবর পেলেও পুলিশ সে রাতে তাকে বারাহাটে গ্রেপ্তার করতে যায়নি। বারাহাটে ওরা বাহুবলী নেতা ওংকার রামের বাড়িতে উঠেছিল । সেখানেই প্রথমে ধর্ষণ, তারপর বিয়ে ।

অতনুর আবার মনে হল, ‘এবার কী হবে ?’ প্রত্যেকে, সবাই, গোটা রাজ্য উচ্ছন্নে যাবার আর কোনও নজির নেই বোধহয় ।

 

হাতিদহের পোলটা দেখা হল না । খাগাড়িয়া কাটিহার নিউ জলপাইগুড়ি পেরিয়ে গেছে । বিহার থেকে পশ্চিমবাংলায় ঢোকার নিসর্গ পরিবর্তনের মধ্যে শিহরণ বোধ করছিল অতনু ; পরিচিত স্বপ্নের চলচ্ছবির মধ্যে ছুটছিল ট্রেন, বাতাসের গন্ধেও পরিবর্তন ঘটে গেছে যেন ।

গৌহাটিতে ওয়াগন থেকে প্যারা মিলিটারি পাহারায় মাল গুনে-গুনে নামিয়ে তোলা হল অন্য ওয়াগনে । সারারাত স্টেশানে, মশা, কাঁধ ব্যথা, ঘুম নেই, । সকাল দশটায় ইনার লাইন পারমিট সংগ্রহ । শিলচর । বন্ধ কালো ভ্যান । সামনে জিপ পেছনে জিপ । উবড়ো খাবড়া চড়াই । অপ্রতিদ্বন্দ্বী নিসর্গের নয়নাভিরাম নষ্ট হয়ে যায় শরীরের সহ্যশক্তির অসহায় পরাজয়ে । দুর্গম প্রকৃতি আর অনভিপ্রেত ভয়ে বিরক্ত হয় অতনু, ঘুমিয়ে পড়ে ।

 

 

 

Leave a comment

Filed under উপন্যাস